#আমার_আকাশে_তারা_নেই
#লাবিবা_আল_তাসফি
পর্ব: 4
ইহান ইচ্ছের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা হুটহাট এমন আবদার করে বসে যা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। ইহান ইচ্ছের চোখের দিকে তাকায়। ঐ চোখে রয়েছে একরাশ আকুতি। বেশি সময় ঐ চোখে তাকিয়ে থাকতে পারলো না ইহান। চোখ ফিরিয়ে নিল। দরজার দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
–‘আমি বের হচ্ছি, তুমিও এসো।’
বলতে বলতেই দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ইহান। ইচ্ছে নিজের চোখ বন্ধ করে নিল। চোখ বন্ধ করতেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো তার সুন্দর মুখশ্রীতে।
পুরোটা দিন তারা সমুদ্র পাড়ে ঘুরে কাটিয়েছে। দুপুরের দিকে পাশের এক রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নিয়েছিল। দিন গড়িয়ে রাত নেমেছে। রাতে যেন সবুজের সৌন্দর্যতা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তারা আরো কিছুক্ষণ সমুদ্রপাড়ে কাটিয়ে নিজেদের রুমে ফিরে আসল। ইচ্ছেকে অনেক ক্লান্ত লাগছে। কোনরকম ফ্রেশ হয়ে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। নরম গদিওয়ালা বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে তার চোখে ধরা দিল। ইহান একবার ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে সেও একপাশ করে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মাঝে সেও ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
ইচ্ছের যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন মাঝরাত। জানালা গলিয়ে চাঁদের আলো পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়েছে। এই চাঁদের আলোয় ইহানের সুন্দর মুখটা ইচ্ছের নজর কাড়ল। একটি অবাধ্য ইচ্ছা তাকে গ্রাস করে নিল। মনের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে সে অতি সাবধানে ইহানের কপালে তার নরম অধর ছোঁয়াল। ঘুমের মাঝেই ইহান চোখ কুঁচকে ফেলল। তা দেখে ইচ্ছের কেন জানি খুব মন খারাপ হলো।
–‘লোকটা জেগে থাকতেও আমায় পছন্দ করে না। আমার স্পর্শ তো মোটেইনা। ঘুমিয়ে থেকেও আমার স্পর্শে বিরক্ত হয়! এতটাই কি অপছন্দের আমি?’
নিজ মনেই প্রশ্ন করল ইচ্ছে। তার মনে হলো তার প্রশ্নের উত্তরে আশপাশ থেকে কেউ চিৎকার করে বলছে,
–‘হ্যাঁ! তুমি তার খুবই অপছন্দের একজন। তুমি তার বিরক্তির একমাত্র কারণ।’
দুহাত দিয়ে নিজের দুকান চেপে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ মনে হল সবকিছু শান্ত হয়ে গেছে। কান থেকে হাত নামিয়ে ফেলল ইচ্ছে। জলে ভরা চোখ নিয়ে একবার ইহানকে দেখে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বিষন্ন মন নিয়ে আকাশ পানে তাকাল। আকাশে অগনিত তারার মেলা বসেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তার হিংসা হল। এই অন্ধকার আকাশের বুকে কত তারা। কিভাবে তারা অন্ধকার আকাশকে আলোতে ভরিয়ে দিয়েছে! তার আকাশকে কেন কেউ আলোকিত করে না!? ইচ্ছে তার দুঠোঁট নাড়িয়ে নেভা কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
–‘আমার আকাশে তারা নেই!’
_______________
অন্ধকার কাটিয়ে দিনের আলো ফুতে শুরু করেছে। শীত শীত পড়েছে। এখন কার্তিক মাস। শীতের আগমনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ার বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে ইচ্ছে। মেঝেতে বসে সোফায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। ইহান ইচ্ছেকে এ অবস্থায় দেখে কপাল কুঁচকাল। বিরবির করে বলল,
–‘কেয়ারলেস!’
একটি পাতলা কম্বল ইচ্ছের গায়ে জড়িয়ে দিল। ইচ্ছের এরূপ কাজে প্রচন্ড বিরক্ত সে। মেয়েটা ঠিকঠাক নিজের খেয়াল নিতে পারে না অথচ সারাটা সময় উল্টোপাল্টা আবদারের ঝুলি খুলে বসে। ইহান বারান্দা থেকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল কিন্তু পরক্ষনে কিছু একটা ভেবে আবার ইচ্ছে পাশে এক হাঁটু গেড়ে বসে। ইচ্ছের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলত হাতে গাল ছুঁয়ে দেয়। গাল ছুঁয়ে দিতেই ইচ্ছের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা দেখা যায়। ইহানের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে গাল থেকে হাত তুলে ইচ্ছের মুখের সামনে নাড়ায় কিন্তু ইচ্ছে চোখ মেলে না। ইহান এবার শিউর হয় ইচ্ছে ঘুমিয়ে আছে। ভাবতেই বুকে হাত দিয়ে জোরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে ভেবেছিল হয়তো ধরা পড়ে গেছে। বিড়বিড় করে বলে উঠে,
–‘বজ্জাত মেয়ে!’
বেলা বাড়তেই সূর্য তার সোনালী রশ্মি ছড়িয়ে দেয়। সূর্যের মিষ্টি আলোতে ঘুম ভাঙ্গে ইচ্ছের। আড়মোর ভেঙে পিটপিট করে চোখ মেলে। ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করছে। এভাবে ঘাড় বাকা করে ঘুমানোর ফল। ঘাড় চেপে ধরে উঠতে যেয়েই সে অনুভব করল তার গায়ে কিছু জড়িয়ে আছে। এতক্ষণে নিজের শরীরের দিকে নজর পরে ইচ্ছের। গায়ে কম্বল জড়ানো দেখে তার কপাল মাঝে ভাঁজ দৃঢ় হয়। পরক্ষণেই তা মিলিয়ে যায় এবং ঠোঁটে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি। ইসস্ আজকের সকালটা এত সুন্দর কেন!
সকালের খাবার খেতে একটি হোটেলে এসেছে তারা। ইহান লক্ষ্য করেছে সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই ইচ্ছে তার দিকে কামনার চোখে তাকাচ্ছে আর মিটি মিটি হাসছে। ইহান এখন পর্যন্ত এর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। তবে সে থেমে নেই সে বারবার মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছে যে কি এমন কারণে ইচ্ছে এমন করতে পারে! ভোরের ঐ বিষয়টিতো হতেই পারে না কারণ ইহান বেশ কয়েকবার চেক করে দেখেছিল। সে কোনভাবেই সমীকরণ মিলাতে পারছেনা। এরই মাঝে তাদের খাবার চলে আসে। এখানের রেস্টুরেন্ট গুলোতে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের খুবই সুস্বাদু আইটেম পাওয়া যায়। খাবার আসতেই খাবারের সুন্দর স্মেল খুদা যেন আরো বাড়িয়ে তুলছে। ইচ্ছের নজর গেল তাদের পাশের টেবিলে বসা এক কাপলের দিকে। নিউ ম্যারিড কাপল হয়ত। ছেলেটি খুব যত্নকরে মেয়েটির গালে খাবার তুলে দিচ্ছে। মূহুর্তেই ইচ্ছের ও মনে হলো ইহান যদি তাকে একবার খাইয়ে দেয় তাহলে ব্যাপারটা দারুন হবে। তবে বলতে সাহস ও পাচ্ছেনা। যদি বকে! লোকটার তো আবার নাকের ডগায় রাগ থাকে।
–‘এই যে! শুনুন?’
ইহান তাকালো। ভ্রু নাড়িয়ে জানতে চাইল কি হয়েছে? ইচ্ছে কিছুটা আমতা আমতা করে অবশেষে চোখ বন্ধ করে বলেই ফেলল,
–‘আমায় একটু আপনার হাতে খাইয়ে দিবেন?’
কথাটা শেষ করে ইচ্ছে এক চোখ মেললো ইহানের মুখভাব পর্যবেক্ষণ করার জন্য। এদিকে ইচ্ছের হঠাৎ এমন আবদারে ইহানে গলায় খাবার আটকে গেল। সে কাশতে শুরু করল। ইচ্ছে দ্রুত পানি বাড়িয়ে দিল ইহানের দিকে। কাশি থামতেই ইহান গরম চোখে ইচ্ছের দিকে তাকালো। ইচ্ছে তখন ভয়ে কাচুমাচু হয়ে রয়েছে।
–‘ফিরে চল তারপর তোমায় দেখে নিচ্ছি।’
ইহানের এমন হুমকি শুনে ইচ্ছের আর খাওয়া হলো না। সে যে কেন তখন ওটা বলতে গেল! আফসোস হচ্ছে তার বড্ড। ভয়ে সে এখন খেতেও পাড়ছেনা।
হোটেল থেকে বেরিয়ে তারা এখানের মার্কেটে এসেছে। আজ তাদের এখানে শেষ দিন। কাল তারা আবার ফিরে যাবে ঢাকা। তারা একটি দোকানে গেল যেখানে ঝিনুক এর তৈরি বিভিন্ন অর্নামেন্টস রয়েছে। ইচ্ছে বেশ কিছু জিনিস কিনল। তার নজর গেল কাঁচের কিছু চুড়ির উপর। তা দেখামাত্রই ইচ্ছের কিনতে মন চাইলো। চুড়ির প্রতি তার বরাবরই দুর্বলতা রয়েছে।
–‘শুনুন? আমায় কিছু চুড়ি কিনে দিবেন? চুড়ি আমার খুব পছন্দ!’
–‘তোমায়তো আমি টাকা দিয়েছি কেনাকাটা করার জন্য। এগুলো কিনলে যখন ওটাও কিনে নাও!’
মূহুর্তেই ইচ্ছের মন খারাপ হয়ে গেল। সে চেয়েছিল ইহান নিজ হাতে তাকে চুড়ি কিনে দিক। সে আর চুড়ি কিনল না। ইহান ব্যাপারটা লক্ষ্য করেও পাত্তা দিলনা। কেনাকাটা ঘোরাঘুরি শেষ করে তারা একবারে সন্ধ্যার পর হোটেলে ফেরে। হোটেলে ফিরে তাদের মধ্যে আর কোন কথা হয়না। এমনকি সকালের ব্যাপারটা নিয়েও ইহান ইচ্ছেকে কিছু বলেনা। তবে ইচ্ছে চাইছিল ইহান তার সাথে কথা বলুক। সকালের ব্যাপারটা নিয়ে বকাঝকা করুক তবুও সে তার সাথে একটু কথা বলুক। ইহানকি বুঝে না সে তার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করে? কেন বুঝে না ইহান যে ইচ্ছে নামের মেয়েটি তাকে পাগলের মত ভালবাসে! নিজের থেকে ও বেশি ভালোবাসে!
চলবে…………