আমার আকাশে তারা নেই পর্ব -১০ ও শেষ

#আমার_আকাশে_তারা_নেই
#লাবিবা_আল_তাসফি
পর্ব: ১০ / অন্তিম

দুপুরের দিকে বেশ প্রখর রোদ উঠেছে। জমিদার বাড়িতে সবাই দুপুরের ভোজন এর জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাদের সকলের মাঝে টান টান উত্তেজনা কাজ করছে। বাড়ির জামাই রান্না করেছে বলে কথা! ইহানকে জব্দ করতে পেরে মোশাররফ মোড়ল বেশ খুশি। কেবল তো একটা চমক শেষ হলো। যখন সবাই ইহানের রান্না খেয়ে মুখ কুঁচকাবে তখন আরো মজা হবে ভেবেই বাঁকা হাসল মোশারফ মোড়ল। সে আজ তার জামাইকে খুব ভালোভাবে জব্দ করতে পেরেছে। চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছেন তিনি।

ইহান নিজের হাতে সবাইকে সার্ভ করে দিয়েছে। রান্নার চেহারা দেখে সেটাকে খুবই সুস্বাদু লাগছে। মোশাররফ মোড়লের প্লেটে বেশি করে মাংস দিতে গেলে মোশারফ বলে উঠলেন,

–‘না না জামাই এত দিওনা। এই এক টুকরোই যথেষ্ট। আমি আবার গোশত বেশি একটা পছন্দ করি না।’

শ্বশুরের কথায় ইহান বাঁকা হাসলো।

–‘শ্বশুর মশাই আপনার কথায় তবে থাকলো! পরবর্তীতে চাইলেও কিন্তু আমি আপনাকে আর দিব না।’

ইহানের কথায় মোশারফ মোড়ল মনে মনে হাসলেন। মনে মনে বলতে থাকলেন, “কি যে রান্না করেছো আল্লাহ মাবুদ জানেন। এই এক টুকরো আমি শেষ করতে পারবো কিনা সেটাই সন্দেহ তারপর তো আবার চেয়ে নেওয়া!”

তবে ইচ্ছে খুব খুশি মনি বেশ কয়েক টুকরো মাংস নিজের প্লেটে তুলে নিল। তার বরের হাতের রান্না সে না খেলে হবে! ভালো হোক কিংবা খারাপ সে আজ এই গোশত দিয়েই ভাত খাবে। প্রথম লোকমা গালে দিতেই সবাই চোখ বড় বড় করে ইহানের দিকে চাইল। তা দেখে ইহান পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। সে শুধু মোশাররফ মোড়লের এক্সপ্রেশন দেখতে চাচ্ছে। সবার এমন চোখ বড় বড় করে তাকানো দেখে মোশারফ মোড়লও খাবার গালে তুলে নিলেন। তার চোখ ছানাবড়া। ইহানের দিকে চাইতে ইহান তাকে চোখ টিপ দিল। যার অর্থ, “আমিও কম নই!”

আসলে ইহান রান্না পারেনা এটা পুরো একটি ভুল কথা। ইহান খুব সুন্দর রান্না পারে। সে যখন লন্ডনে থেকে পড়াশোনা করেছিল তখন সে একা রান্না করে খেত। তবে দেশে ফেরার পর থেকে রান্নার প্রতি টান উঠে গিয়েছিল। যে কারণে সে রান্না পারে এটা আজ অব্দি কেউ জানতে পারেনি। মোশাররফ মোড়ল তাকে রান্নার কথা বললে সে মনে মনে খুশি হয় তবে বাহিরে তা প্রকাশ করে না। সে এমন একটা ভাব নেয় যেন সে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে।

খাওয়া-দাওয়া শেষে ইহান যায় মোশাররফ মোড়লের কাছে।

–‘ডিয়ার শ্বশুরমশাই। চ্যালেঞ্জ তো জিতে নিলাম। এবার আপনার কথা রাখার পালা। আমি কালই ফিরে যেতে চাই। অবশ্যই ইচ্ছেকে সাথে নিয়ে। এখন ইচ্ছেকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আপনার। এমনটাই কিন্তু ছিল শর্তে।’

–‘হু।’

কিছুক্ষণ দুজন চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। হঠাৎ করে মোশাররফ মোড়ল ইহানকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। কেঁদে দিলেন তিনি।

–‘আমার মেয়েটাকে আর কখনো কষ্ট পেতে দিও না বাবা। আমি আর কয়দিনই বা আছি! সারাটা জীবন পাশে থেকো। ভালোবেসে যত্ন করে আগলে রেখো। বড্ড ছেলেমানুষ মেয়েটা আমার।’

ইহানের চোখে পানি চলে এলো। সেই ছেলের সাথে সাথে নিজের বাবা-মা, বাবা মায়ের সমতুল্য শ্বশুর-শাশুড়িকে পর্যন্ত কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।

–‘কথা দিচ্ছি বাবা। আর কখনো কষ্ট পেতে দিবো না ইচ্ছেকে। অতি যত্নে আগলে রাখব। এই শেষবারের মত বিশ্বাস করতে পারেন আমায়। আপনার এই বিশ্বাস আমি ভাঙবো না ইনশাআল্লাহ।’

__________________

–‘ইচ্ছে? রুমে আছিস মা?’

বাবার কন্ঠ শুনে বারান্দা থেকে রুমে ফিরে এলো ইচ্ছে।

–‘হ্যাঁ বাবা ভেতরে এসো।’

মোশারফ মোড়ল ভিতরে আসেন। বিছানায় বসে মেয়েকে পাশে ডাকেন। ইচ্ছে বাবার পাশে এসে বসে। মোশারফ মোড়ল পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

–‘একটা দরকারি কথা বলতে এসেছিলাম।’

–‘বল বাবা। আমি ফ্রি আছি সমস্যা নেই।’

মোশারফ মোড়ল হাসলেন। মেয়েটাকে সে খুব ভালোবাসেন। তার কলিজার একটি অংশ তার মেয়ে।

–‘ইহানের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?’

বাবার কথায় ইচ্ছের মুখ মলিন হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না উত্তরটা ঠিক কি দিবে। তার মন চাইছে ইহানকে ক্ষমা করে দিতে।

–‘আমার মনে হয় তোমার ইহানকে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত। সে যেহেতু তার ভুল শুধরে নিতে চাইছে সেহেতু তাকে তার ভুল শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ অবশ্যই দেওয়া উচিত।’

ইচ্ছে এবার ও নিরব রইল।

–‘দেখো মা আমি তোমায় জোর করছি না। তুমি যেটা চাইবে অবশ্যই সেটা হবে। আমি শুধু তোমায় বোঝালাম। এবার সিদ্ধান্ত তোমার হাতে।’

–‘আমি তার সাথে যেতে চাই বাবা।’

মেয়ের কথায় হাসি ফুটে উঠল মোশাররফ মোড়লের। মেয়েটা তার অল্পতেই বুঝতে পারে।

–‘আচ্ছা তবে তৈরি হয়ে থেকো। ইহান হয়তো রাতেই রওনা হবে।’

আবারো মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। ইচ্ছের মুখেও প্রশান্তির হাসি।

____________________

আজ নদীর পাড়টা কেমন নির্জিব হয়ে পড়ে আছে। এক ব্যার্থ প্রেমিকের চোখের পানি হয়তো তাকেও আহত করেছে।

হাসান চোখ বন্ধ করে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে। এক সময় সে আর ইচ্ছে এখানে বসে এভাবেই পা ভিজিয়ে নানান গল্প করত। সেই মধুর সময়গুলো বড্ড মনে পড়ছে তার।আজই হয়তো এ গ্রামে তার শেষ দিন। আর কবে ফিরবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে ইচ্ছের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছের ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে সে হয়তো তার মোনের অবাধ্য অনুভূতি ধরে রাখতে পারবে না। হাসানের চোখের সামনে আজ সকালের দৃশ্যপট ভেসে উঠলো।

মোশাররফ মোড়লের থেকে হাসান ইহানের ব্যাপারে সবটাই জেনেছে। ইচ্ছে আর ইহানের মিল হয়ে গেছে ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় ফিরে যাওয়ার। সকালে সে ইচ্ছেদের বাড়িতে গিয়েছিল ইচ্ছের থেকে বিদায় নিতে। কিন্তু বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়াতেই তার চোখ যায় ছাদে বসে থাকো কপোত কপোতীর দিকে। ইচ্ছে ইরানের কাঁধে মাথা রেখে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে হেসে হেসে কিছু বলছে যা শুনে ইহানও মিষ্টি করে হাসছে আবার কখনও কখনও হাত দিয়ে ইচ্ছের মুখের সামনে ছড়িয়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছিল দীর্ঘ এক বিরহের পর তারা মিলিত হয়ে খুবই আনন্দে সময় পার করছে। হাসান কিছু সময়ের জন্য থমকায় ইচ্ছের ওই হাসি মাখা মুখ দেখে। কিন্তু পরক্ষনেই চোখ সরিয়ে নেয় কারণ অন্যের অর্ধাঙ্গিনী রূপে মুগ্ধ হওয়ার অধিকার তার নেই। সে আর যায়নি ইচ্ছের থেকে বিদায় নিতে। ফিরে এসেছিল তখনই। তাদের ভালোবাসার সুন্দর মুহূর্ত গুলোতে প্রবেশ করে তাদের বিরক্ত করতে চায় না সে।

আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। হাসান উঠে দাঁড়ায়, দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে সে বাড়ির পথে রওনা দেয়। তার ফেলে যাওয়া এই নিঃশ্বাসে ছিল ভালোবাসা হারানোর এক তীব্র বেদনা, ছিল এক বুক ব্যর্থতার গল্প, ছিল এক ব্যর্থ প্রেমিকের কাহিনী যার সাক্ষী কেবল এই নদী।

____________________

–‘ইচ্ছে! আমার ওয়ালেট টা কোথায়?’

–‘বেডের উপর রাখা আছে সব।’

রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে জানালো ইচ্ছে। ইহানের এবার মেজাজ খারাপ হলো। এই মেয়েটা একটুও বুঝেনা সে এখন ইচ্ছেকে একান্ত ভাবে চাইছে।

–‘ইচ্ছে আমি পাচ্ছিনা।’

ইচ্ছে বুঝল সে না যাওয়া অবদি কিচ্ছু খুঁজে পাবেনা। হাতের কাজটা ইরাকে দেখতে বলে সে রুমের দিকে এগিয়ে গেল।

রুমে ঢুকতেই ইহান ইচ্ছের হাত টেনে ধরল।

–‘এত ব্যাস্ততা কেন? এবার আমি কাকে বিচার দিব শুনি?’

ইহানের অভিযোগে ঠোঁট চেপে হাসলো ইচ্ছে।

–‘একটু আধটু রিভেঞ্জ নিচ্ছি এই আরকি।’

ইচ্ছের কথায় ইহান হেসে ফেললো। কপালে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেল।

________________

চিন্তিত হয়ে বসে আছে ইহান। এই নিয়ে দুবার বমি করেছে মেয়েটা। বাড়িতে কেউ নেই। সবাই গ্রামের বাড়ি ঘুরতে গেছে। ফিরতে আরো সপ্তাহ খানেক লাগবে। এরই মাঝে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসে ইচ্ছে। পরপর দুবার বমি করায় একেবারে ভেঙ্গে গেছে মেয়েটা। চোখ মুখে ক্লান্তির ছাপ। ইহান দ্রুত পায়ে ইচ্ছের পাশে যেয়ে হাত ধরে এনে বেডে বসাল।

–‘হঠাৎ কি হলো তোমার?এমন কেন হচ্ছে?’

ইচ্ছে ইহানের চিন্তিত মুখের পানে চেয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করল।

–‘আমি ঠিক আছি ইহান। আপনি ব্যাস্ত হবেননা।’

–‘একটুও ঠিক নেই তুমি। আমি নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি।’

ইহানের কথাকে পাত্তা না দিয়ে ইচ্ছে ইহানের দিকে নিজের গাল এগিয়ে দিল।

–‘টুপ করে একটা চুমু খান তো।’

এমন একটি মুহূর্তে ইচ্ছের এমন ছেলেমানুষি দেখে ইহান অবাক হলো। মেয়েটা একটুও বদলায়নি। ইহান আলতো করে ইচ্ছের গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তা দেখে এখান থেকে চেপে হাসলো। নিজেই আবদার করবে আবার নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে যাবে। ইহানের অবশ্য এই ব্যাপার গুলো খুবই ভালো লাগে।

_________________

ইহানের জরুরি তলবে গ্রাম থেকে সবাই ফিরে এসেছে। ইচ্ছের বাবা-মাও এসেছে। এই মুহূর্তে সবাই ড্রইংরুমে ইহানের জরুরি তলব কারণ জানার জন্য উৎসুক জনতার ন্যায় বসে আছে। তবে ইহানের কোন খোঁজ নেই। সে পাঁচ মিনিটের কথা বলে বের হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত ফেরেনি। শারমিন বেগম বেশ কয়েকবার ইচ্ছের কাছে জানতে চেয়েছিল কি কাহিনী কিন্তু ইচ্ছে প্রতিবারই কোন না কোন ছুতো দিয়ে তা এড়িয়ে গিয়েছে।

অবশেষে সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ইহানের আবির্ভাব ঘটে। হাতে তার দশ কেজি মিষ্টি। এত মিষ্টি দেখে সকলের মাঝে এক ধরনের চঞ্চলতা শুরু হয়ে যায়। শারমিন বেগম আর জিয়া খাতুন একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলে তারা দুজন উঠে ইচ্ছের কাছে চলে যায়। ইচ্ছে তখন রুমে বসে ফল খাচ্ছিল। তাদের দুজনকে দেখতেই সে তাড়াতাড়ি খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তারা দুজন ইচ্ছেকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ইচ্ছের উপর চিৎকার করে ওঠে,

–‘বজ্জাত মেয়ে। আমাদের ঘরের ছোট সদস্য আসছে সেটা আমাদের না জানিয়ে তুই কিনা সেটা লুকিয়ে বেড়াচ্ছিস।’

শারমিন বেগম তো খুশিতে কেঁদেই দিয়েছেন। তিনি ভেবে পাচ্ছেনা। কিছুদিন বাদে ছোট্ট একটি প্রাণ এ বাড়ির ভেতরে ছুটোছুটি করবে। আদো আদো কন্ঠে তাকিয়ে দাদু বলে ডাকবে। বাড়িতে একরকম উৎসব পড়ে যায়। সকলে খুবই আনন্দিত। ইরাতো পিপি হওয়ার খুশিতে তার সকল ফ্রেন্ডকে ট্রিট দিবে বলে জানিয়েছে।

আজও আকাশে তারারা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে রয়েছে। ইহানের কাঁধে মাথা রেখে ইচ্ছে ঐ দূর আকাশে চেয়ে রয়েছে। আজ তার মনে হচ্ছে তার মনের আকাশে ও তারা আছে। সে তারা গুলো তার মন আকাশে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

–‘ইহান?’

–‘হুম।’

–‘একবার বলবেন ভালোবাসি?’

ইহান ইচ্ছের কপালে অঝর ছুয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলল,

–‘ভালোবাসি আমার ইচ্ছেকে। আমার বাবুর আম্মুকে আমি অনেক ভালবাসি। নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি।’

ইচ্ছে পরম শান্তিতে এখানের বুকে মাথা রাখল। তার মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে আছে। নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে তার। আল্লাহতাআলা কাছে সে অশেষ কৃপা জানায় এমন একজন জীবনসঙ্গী পাওয়ার জন্য।

সমাপ্ত

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here