আমার মনকাননে ভ্রমর তুমি পর্ব -০৩

#আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি
#পর্বঃ০৩
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

বাসে জানালার পাশে বসেছিলো হেমসিনী, দৃষ্টি তার বাইরে। আচমকা একটা জায়গায় তার দৃষ্টি আটকে গেলো। সাদা শার্ট পরিহিত মাহাতিব রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে দলের ছেলেদের সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছে। ছেলেদের হাতে ভিন্ন ব্যানার, পোস্টার দেখতে পেলো হেমসিনী। খুবই বাজেভাবে ঘেমে গিয়েছে মাহাতিব, তাকে দেখে হেমসিনী বুঝতে পারলো সামনে ভোটের প্রচারে সে প্রচুর খাটাখাটুনি করছে। মাহাতিবের অবস্থা দেখে খানিকের জন্য হেমসিনীর তার প্রতি মায়া হলো তবে সে বেশিক্ষণ তার দিকে তাকালোনা৷ খানিকবাদেই তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে সে চোখ ফিরিয়ে নিলো৷ কিছুক্ষণ এর মধ্যেই যাত্রী উঠানো হলে বাসও ছেড়ে দেওয়া হলো। হেমসিনী একদম বাইরে তাকাতে চাইলোনা তবে বেহায়া চোখ তার অবাধ্য হলো।

দেখতে দেখতে মাহাতিব হেমসিনীর চোখের আড়ালে চলে গেলো, একটা হতাশাভরা নিশ্বাস নিলো সে। এরই মাঝে টুং করে ফোনে শব্দ হলো। দ্রুত ফোন চেক করলো হেমসিনী।

” আমাকে লুকিয়ে না দেখে সামনে থেকেও দেখতে পারেন হেমসিনী। আমি মোটেও বাঁধা দেবোনা বরং সমস্ত কিছু একপাশে রেখে আপনার চোখের সামনে বসে থাকবো, যতক্ষণ না আপনার চোখের তৃষ্ণা নিবারণ হয়। সেই সময়টাতে আমি না হয় আপনাকে দেখে আমার চোখের তৃষ্ণা নিবারণ করবো। এভাবে লুকিয়ে দেখবেন না হেমসিনী, নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে।”

মাহাতিবের মেসেজ দেখে হেমসিনীর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। সে টেরও পাইনি কবে মাহাতিব তাকে লক্ষ্য করেছে। হেমসিনী জলদি ব্যাগ থেকে পানি বের করে খেলো।

” মাহাতিব আপনি বড় অদ্ভুত মানুষ। আপনাকে বোঝার সাধ্য আমার নেই। তবে আপনি বৃথা চেষ্টা করছেন মাহাতিব, আপনি যা ভাবছেন তা কখনোই হবে না।”
.
.

” মা, চাচী কোথাই?”

” দেখো গিয়ে আবারো কারো শো’কে মুছরে আছে। বুঝি না বাপু এই মেয়ে এরকম কেন? মাঝে মাঝে মন চাই দু’টো চ’ড় মে’রে যদি ঠিক করতে পারতাম। সম্পর্কে আমার বড় বলে বেশি কিছু করতে পারিনা। যত জ্বালা হয়েছে সব আমার।” বেশ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন হেমসিনীর মা প্রীতি আহমেদ।

” মা আস্তে বলো, চাচী শুনতে পেলে ক’ষ্ট পাবেন।”

” পাক ক’ষ্ট, ওর ক’ষ্ট পাওয়ারই দরকার। এতোদিন হয়ে গেলো তাও ওনার ঢং এখনো কমেনি।”

হেমসিনী আর কিছু বললো না চুপচাপ ঘরে চলে গেলো। প্রীতি আহমেদের বড় জা সৃষ্টি ঘরের ভেতর থেকে স্পষ্ট ওনার সব কথা শুনতে পেয়েছেন। ওনার এদের কথা শুনে সৃষ্টি আহমেদ ঢুকরে কেঁদে উঠলেন।

” হে খোদা তুমি আমার কপালে কি একটুও সুখ লিখে রাখোনি? এতোটাই দুঃখিনী করে আমাকে পৃথিবীতে পাঠালে তুমি।”
.
.

পার্টি অফিসে বসে ভোট সম্পর্কে আলোচনা করছিলো মাহাতিব। সে সময় মুকিত এসে তাতে বাঁধা দিলো।

” ভাই প্রণয় শিকদার আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে?”

” পরে আসতে বলো।”

মুকিতের কথা শুনে সবার চোখ কপালে উঠে গেলো। সবাইকে এভাবে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে তাকতে দেখে মাহাতিব বেশ বিরক্ত হলো।

” কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেন সবাই?”

” ভাই প্রণয় সিকদার, আমাদের বিপক্ষ দলের লোক। আপনার বিরুদ্ধে তো এবার প্রণয় শিকদারই দাঁড়াবেন। গত দু’বার তো আপনার বাবার বিপক্ষে ওনার বাবাই দাঁড়িয়েছিলেন কিন্তু আগের বার… ”

” মুকিত এতো কিছু বলার দরকার নেই। আর সে আমার বিপক্ষ দলের লোক, তাকে আপ্যায়ন করে আনার কোন প্রয়োজন আমি দেখছিনা। সে নিজে আমার কাছে এসেছে, নিশ্চয়ই নিজের প্রয়োজনে এসেছে। আমি এখন ব্যস্ত আছি। তাকে অপেক্ষা করতে বলো না হয় চলে যেতে বলো।”

” আমি কি তাহলে চলে যেতে বলবো?”

” আমি যা বলেছি প্রতিটি কথা ওখান থেকে কপি করে নিয়ে ওনার সামনে পেস্ট করে তাও। বাকিটা তিনিই বুঝে নেবেন।”

মুকিতও কথা না বাড়িয়ে মাহাতিবের কথামতো কাজ করলো।

মিটিং শেষ হতে হতে প্রায় তিনটে বেজে গিয়েছে। সবাই চলে যাওয়ার পর মাহাতিব চেয়ারে হেলাম দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। মনটা তার খুবই আনচান করছে আর তার এক এবং অন্যতম কারণ হচ্ছে হেমসিনী নামের মানবী। আজকে একবারের জন্যও হেমসিনীর সাথে তার কথা কিংবা দেখা হয়নি। সকালে তাড়াতাড়ি সে অফিসে চলে এসেছে, তারপর থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ টেবিল থেকে ফোনটা তুলে হেমসিনীর নম্বর ডায়েল করলো তবে কল করার আগেই মুকিত এসে উপস্থিত হলো।

” ভাই প্রণয় শিকদার এখনো আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”

” এতোটা সময় ধরে?” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো মাহাতিব।

” ওনাকে কি বলবো এখন?”

” পাঠিয়ে দাও।” হতাশার নিঃশ্বাস নিয়ে ফোনটা পুনরায় টেবিলে রেখে দিলো মাহাতিব।

” কেমন আছো মাহাতিব?” পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসলো প্রণয় শিকদার। প্রণয় শিকদার মাহাতিব থেকে বয়সে কিছুটা বড়। মাহাতিবের আগে থেকেই সে এই পথে কাজ করছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে চোখের ইশারায় জিনিসগুলো টেবিলে রাখতে বললো।

মাহাতিব চুপচাপ প্রণয়ের কাজ দেখছে।

” এসব কেন এনেছেন আপনি?”

” তোমার অফিসে এলাম কিছু না আনলে কি ভালো দেখাই? তুমি কি ভ’য় পাচ্ছো মাহাতিব? আরে ভ’য় পেও না, আমি বি’ষ-টি’ষ মিশিয়ে আনিনি। নিশ্চিন্তে এগুলো খেতে পারো।”

” আপনি এখানে কেন এনেছেন?”

” আমি? দেখতে এলাম, আমার বিপক্ষ দলের অপরিস্থিতি কি রকম। কোন সাহায্য লাগবে কিনা। ব্যাস। আসলে আমি একটু বেশিই দয়ালু মানুষ। তুমি তো এখনো এই পথে বাচ্চা মানুষ, অনেক কিছু সম্পর্কে অবগত নয়। চিন্তা করোনা, কোন সমস্যা হলে আমার কাছে চলে আসবে। প্রণয় শিকদার আছে তোমাকে সাহায্য করার জন্য। আসি তাহলে।”

প্রণয়ের কথা শুনে মাহাতিবের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। সে খুব ভালো করেই জানো প্রণয় শিকদার এমনিতেই আসেনি।

” তবে হ্যাঁ আমার কাজে বেশি বাঁধা দিতে এসোনা। প্রথমবার ভুল করেছো ভেবে ক্ষমা যদিও করে দি, পরের বার ছেড়ে দেবোনা৷ তাই যা করবে ভেবেচিন্তে করবে।”

প্রণয় শিকদারের কথা শুনে হালকা হাসলো মাহাতিব।

” তাহলে আসল কথা বলেই ফেললেন। তাই তো ভাবি প্রণয় শিকদার এতোটা সময় সামান্য কথা বলার জন্য কেন অপেক্ষা করবেন। আমি আসবোনা আপনার পথে, একদম নিশ্চিতে থাকতে পারেন। তবে আপনাকে যদি আমি আমার পথে দেখতে পাই উপরে ফেলে দিতে দ্বিধা করবোনা।”

” বাহ্ খুব আত্মবিশ্বাস দেখছি তোমার, সেইসাথে সাহসও আছে। আমাকে উপরে ফেলার কথা আমার সামনে জোড় গলায় বলছো। ভেরি ইন্টারেস্টিং। নিজের প্রতি তোমার এতো বিশ্বাস মাহাতিব?”

” জ্বি বিশ্বাস আছে। কোন অন্যায় করলে মনে ভয় বাসা বাঁধে, আমি যদি কোন অন্যায় না করি তাহলে নিজের প্রতি বিশ্বাসও আমার শতভাগ থাকবে।”

“মনে হচ্ছে খেলা জমবে। তাহলে প্রস্তুত থেকো, খুব শীঘ্রই মাঠে দেখা হচ্ছে।”
.
.

বিভোরে গুমিয়ে ছিলো হেমসিনী। তীব্র শব্দে বেজে উঠা ফোনের শব্দে তার ঘুম হালকা হয়ে এলো। হাতড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করলো সে।

” হ্যালো।” ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো হেমসিনী। অপর পাশ থেকে কোন সারাশব্দ না পেয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় কপাল কুচকালো সে।

” হ্যালো? কে বলছেন?”

” আমাকে অকালে মা’রা’র পরিকল্পনা আছে বুঝি আপনার?”

অপরপ্রান্ত থেকে মাহাতিবের কন্ঠ শুনে মহা বিরক্ত হলো হেমসিনী। ফোনটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে সময় দেখে নিলো। রাত প্রায় তিনটে বাজে, সময় দেখে হেমসিনী চোখ-মুচ কুচকে ফেললো।

” এই মধ্যরাতে বিরক্ত করার জন্য কেন ফোন দিয়েছেন মাহাতিব? আপনি কি সময় দেখননি?”

” একটিবার বারান্দায় আসবেন? আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু আপনাকে একপলক না দেখলে যে আমার চোখে শান্তির ঘুম এসে ধরা দেবে না।”

এতো রাতে মাহাতিব নিচে দাঁড়িয়ে আছে, মস্তিষ্কে কথাটি পৌঁছাতেই হেমসিনী দ্রুত বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। অনেক উঁকিঝুঁকি দেওয়ার পর অবশেষে অাবছা আলোয় মাহাতিবের দেখা পেলো সে।

” আপনি এতো রাতে বাইরে কি করছেন? জানেন না বর্তমানে এভাবে বাইরে চলাফেরা করা আপনার জন্য কতটা বিপ’দজন’ক!”

” ধন্যবাদ আমার কথা রাখার জন্য। আজ সারাদিন আপনাকে একবারো দেখিনি বলে বড্ড অস্থির লাগছিলো। এবার আমার অশান্ত মন শান্ত হয়েছে, এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো।”

” বাড়িতে ফিরে যান মাহাতিব, সবসময় এসব ভালো লাগেনা। বিপদ কখনো বলে আসেনা, সবসময় এধরণের ছেলেমানুষী বড্ড বা’জে লাগে।”

” আমার কাছে একেবারের জন্য চলে আসুন। তাহলে ছেলেমানুষী করা ছেড়ে দেবো।”

” আপনি যাবেন নাকি আমি অন্য ব্যবস্থা নেবো?”

” আচ্ছা বাবা যাচ্ছি, শুভ রাত্রি।”

ফোন কেটে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো মাহাতিব। হেমসিনী বারান্দায় আলো নিভিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। যতক্ষণ গাড়ি দেখা গিয়ে ততক্ষণ সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।

চলবে……

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here