#আমার_মেয়ে
#Khadija_Akter
#পর্ব_০২
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেও আমি যখন শ্বশুরবাড়িতে যেতে চাচ্ছিলাম না।তখন একদিন না জানিয়ে শাশুড়ী নিজেই আমার বাবার বাড়িতে এসে উপস্থিত হোন।
ঠিক সেদিনই ঘটলো আসল বিপত্তিটা।
সেদিন উনি একনজর আমাকে দেখেই বুঝে নিয়েছিলেন যে আমি প্রেগন্যান্ট।
শাশুড়ীর এমন আচমকা আগমন আর উনার চোখের কড়া দৃষ্টির সামনে আমি একদম মিহিয়ে গেছিলাম ভয়ে।
সেদিন একটা কথা না বলেও আমাদের বাড়ির উঠান থেকে হনহন করে আবার ফিরতি পথ ধরেছিলেন আমার শাশুড়ী । আমি পিছন থেকে অনেক ডাকলাম,একটাবার ঘরে এসে বসার জন্য।আমার কথা শোনার জন্য।কিন্তু উনি ফিরেও তাকালেন না একবারও।
আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম তুলকালাম কান্ড একটা ঘটতে চলেছে এবার।
আমার মাও সেই থেকে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন।না জানি তার মেয়ের কপালে কি অপেক্ষা করছে।
——————
বিকালেই হন্তদন্ত হয়ে রাশেল আসলো আমাকে নিতে। বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকেই হাঁকডাক দিল,
“রাকা,রেডী হও।তোমাকে নিতে এসেছি।তোমার তো পরীক্ষা শেষ। মা বলেছে আর এই বাড়িতে থাকা যাবে না।”
আমি কোনো দ্বিরুক্তি না করে ব্যাগটা হাতে বেরিয়ে এসেছিলাম ঘর থেকে।হয়তো আমি রাশেলের আসার অপেক্ষাই করছিলাম!
রাশেলের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পেরেছিলাম,আমার গোবেচার স্বামী এখনো কিছুই জানে না।
শ্বশুর বাড়িতে উপস্থিত হওয়া মাত্রই হয়তো সবার সম্মুখেই শাশুড়ী তার রোষানলে পুড়াবে আমায়।
আসার সময় আমার মায়ের মুখে ফুটে উঠা চিন্তার রেখা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি।
মা আমাকে ডেকে একপাশে নিয়ে গিয়ে চুপিচুপি বলে দিলেন,”শাশুড়ী যেইভাবে কয় হুনিস মা,হুদাই সংসারে হাঙ্গামা বাঁধাইস না।যেমনেই হোক স্বামীর সংসার কামড়ে ধইরা পইরা থাকবি।”
আমি কিছুই বলিনি শুধু অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলাম মায়ের দিকে।
শ্বশুর বাড়িতে যাওয়া পথে ভ্যানে বসে নীরবে দুইদিকের ধানি জমিগুলোর দিকে চেয়ে থেকে আমি শুধু চিন্তা করছিলাম একটু পর ঠিক কি হতে যাচ্ছে আমার সাথে।
নীরবতা ভেঙে দিয়ে রাশেল বেশ শঙ্কিত গলাত জিজ্ঞেস করেছিল,
–কোনো ক্যাঁচাল লাগাওনি তো আবার মা’র সাথে?
–কেন কিছু বলেছে তোমাকে?
–না।কোথায় যেনো গিয়েছিল মা, এসে শুধু বললো আজকের মধ্যেই তোমাকে গিয়ে নিয়ে আসতে।
–ওহ্
–হঠাৎ করে তোমাকে এভাবে আনতে পাঠালো কেনো বুঝলাম না।সকালেও তো বলে রাখেনি কিছু ।
–ওহ্
–বললে না তো?মায়ের সাথে কিছু হয়নি তো ফোনে?
–উনি এসেছিলেন দুপুরে আমাদের বাড়িতে।
–কি বলো!এই কথা তো আমাকে আগে বলো নাই।
তারপর?
–অপেক্ষা করো নিজেই সব জানতে পারবে।
রাশেল সাথে সাথেই চুপ হয়ে গেল আর কিছু বললো না।কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর আবার কিছুটা চিন্তিত সুরে বললো,
–তোমার শরীর ঠিক আছে রাকা?কেমন কেমন দেখাচ্ছে তোমায়?
আমি দূরের ধানক্ষেতগুলোর দিকে প্রসারিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থেকেই অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলাম,
–আমি ঠিক আছি।
–সত্যি বলছো?
-হু
এরপর দুজনের মাঝেই নেমে এসেছিল পুরোপুরি নীরবতা।পুরো রাস্তায় আর কেউ কারোর সাথে কথা হয়নি।
রাশেলকে কিছু না বললেও তার মুখ দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম আসন্ন কোনো ক্যাচালের আশঙ্কায় ওর মুখ শুকিয়ে গেছে একদম।
————————–
পাশাপাশি গ্রামে শ্বশুর বাড়ি ও বাপের বাড়ি হওয়ায় খুব বেশি সময় লাগে না যাতায়াতে।সন্ধ্যার একটু পৌঁছে যাই শ্বশুর বাড়ি।
বাড়িতে পা রেখে বারান্দায় কেবল ব্যাগটা রেখে দাঁড়িয়েছি। তখনই আমার শাশুড়ী মা তার ঘরের দরজা খুলে উঠানে এসে দাঁড়ালেন।আবছা অন্ধকার আমার ছায়ামূর্তির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেশ রুঢ় কন্ঠে দাঁড়িয়ে হুকুম দিলেন,
–ছোড বউমা,এইখানে আসো।
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।আমার পা যেনো চলছিল না।রাশেল আমার দিকে কিছুটা সরে এসে একটু চাপা কণ্ঠে বললো,”কি হলো,দাঁড়িয়ে রইলে যে।মা ডাকছেন তো।”
তবুও আমি চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলাম।
–কি হইলো আমার কথা কি কানে যায় না?এইখানে ঠিক আমার সামনে আইসা দাঁড়াইতে কইছি।
ভরসন্ধ্যায় শাশুড়ী মায়ের এমন বাজখাঁই গলার কথা শুনে আমার জা’য়েরাও যার যার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।তাদের পিছু পিছু আমার ভাসুরগন ও তাদের ছেলেপিলেরাও সব উঠানে এসে জড়ো হলো।সবার মুখেই একটা অজানা কৌতুহল।
সবার মধ্যমনি হয়ে আমি ও আমার শাশুড়ী উঠানে দাঁড়িয়ে আছি।বাকী সবাই আমাদের ঘিরে রেখেছে চারদিক থকে।
রাশেলের দিকে চেয়ে দেখলাম,ও হতভম্ব হয়ে ঢোক গিলছে আর একবার শাশুড়ীর দিকে তো আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছে।
সকলের চাপা গুঞ্জন এড়িয়ে শাশুড়ীর বজ্র কন্ঠ আবার শোনা গেল,
–কয়মাস চলে?
–জ্বী আম্মা ৮ মাস।
–সন্তানটা কি?
আমি কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলাম।
–কি হইলো কও না ক্যান!সন্তানটা কি?ছেলে নাকি অলক্ষ্মী মাইয়?
–আমি জানি না আম্মা। আল্ট্রা করাইনি।
–তুমি না জাইনলেও কিন্তু আমি খুব ভালা কইরাই জানি।
কি ভাবছিলা গো তুমি,ছোড বউমা?দুই দিনের মাইয়া মনে করছো শাশুড়ীর চোখ ফাঁকি দিয়া একটা অলক্ষ্মী জন্ম দিয়া ফালাইবা?এত্তো সহজ না হোসনে আরার চোখকে ফাঁকি দেওয়া বুজলা?২ পাতা কিতাব পইড়াই ময় মুরব্বীগো ফাঁকি দিয়া ফরফর ফরফর কইরা উইড়া বেড়াইতে চাও তাই না?
ডানা আমি কাইট্টা রাখতে জানি কইলাম।
–আম্মা,আপনি এগুলো কি বলছেন?আমি কি এমন করেছি?
–ওমাগো রাশেল দেখছোসনি তোর বউয়ে আস্পর্ধা! আমার মুখের উপর জানতে চায় আমি এইগুলা কি কইতাছি!
যাও যাও তুমি এহন যাও।মাইয়াছেলে পেটে লইয়া বড় করতাছো আমাগো না জানাইয়া।ভুল তো করছোই আবার বড় গলায় কথাও কও।নির্লজ্জ মাইয়া কাহাকার।
তয় ভুল তুমি কইরা ফালাইছো তো এইটা শুধরানোর ব্যবস্থা আমি নিজেই করতাছি।
আমি কোনো কথা না বলে সবাইকে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে দিলাম।আসার সময় শুনতে পেলাম,শাশুড়ী সবাইকে যার যার ঘরে যাওয়ার আদেশ দিচ্ছে আর রাশেলকে তার ঘরে গিয়ে কথা শুনে আসতে বললো।
তারপর থেকেই রাশেল আমাকে বারবার চাপ দিচ্ছে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার জন্য।আর আজ টিকতে না পেরে অবশেষে ক্লিনিক থেকে পালিয়ে আবার চলে আসলাম বাবার বাড়িতে।
কিন্তু আমার পোড়া কপাল!
এখানে আসা অব্দি থেকে মা’র গঞ্জনা লাঞ্চনা শুনেই যেতে হচ্ছে, “কত কইরা কইলাম কোনরকম ঝামেলা বাঁধাইস না, শাশুড়ী যা কয় মাইনা যাইস।কিন্তু কে শোনবে কার কথা!এতোদিন তো তোর জামাই খরচ চালাইছে তাই বইল্লাই তো ভালা-মন্দ খাইয়া পইরা চলতে পারছোস এই বাড়িত্তে।।এখন যে পলাইয়া আইছস,দিব জামাই এহন একটা পইসাও?তোর বাপের কি মুরোদ আছে বাড়তি একজনরে খাওয়ান পিন্দনের!চিন্তাভাবনা না কইরা কি কামডাই না করলিরে তুই মা।দিছস তো শাশুড়ীরে অখুশি কইরা।কি হইবো এহন সামনে তোর আমি তো কিছুই বুঝবার পারতাছি না……….।”
—————–
রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়লাম।মনে মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলাম,যে যাই বলুক না কেনো এই সন্তানকে আমি জন্ম দিবই।তিলতিল করে বড় করে তুলে এখন আমি কিছুতেই ওকে হারাতে পারবো না।
ভাগ্যের কথা চিন্তা করে দু’চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে আমার।সারারাত এক ফোটাও ঘুম হলো না।এপাশ-ওপাশ করেই কাটিয়ে দিলাম।
ভোররাতের দিকে সাইলেন্ট করে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি রাশেলের ২৩টা মিসডকল! লাস্ট মিসডকল ৪মিনিট আগের,আমি ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে আবার জায়গা মতো রেখে বাহিরে এসে দাঁড়ালাম।
রাতের আঁধার কেটে গিয়ে সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে কেবলমাত্র।
আমি আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে জীবনের হিশাব-নিকাশ মিলাতে শুরু করে দিলাম।
এই তিন বছরের সংসারে কি পেলাম আমি?সবার জন্য এতো করেও আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি একা,একদম একা।আমার পেটের নিষ্পাপ শিশুটার কারণেই আমি এখন সবার শত্রু হয়ে গেছি!
এমনকি রাশেলকেও পেলাম না জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তটাতে পাশে!যখন কিনা ওকেই আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
রাশেল আমার ভালোবাসার মানুষ।ভার্সিটিতে পড়াকালীন রাশেলের সাথে আমার পরিচয় হয়।আমি তখন অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্রী আর সে ছিল সেই ভার্সিটির একজন অস্থায়ী সহকারী কেরানী।
প্রথমে চেনাজানা তারপর বন্ধুত্ব আর একসময় সেই বন্ধুত্বই রুপ নিয়েছিল প্রেমের সম্পর্কে।
রাশেলের সাথে ২ বছর সম্পর্কের পর আমরা নিজেরাই বিয়ে করে ফেলি।পারিবারিকভাবে জানিয়ে বিয়ে করতে গেলে রাশেলের মা কখনোই মানতেন না আমাদের বিয়েটা।কারণ আমার বাবা-মা গরীব,তাদের মেয়েকে সাজিয়ে শ্বশুর বাড়ি তুলে দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই তাদের একদমই।
এদিকে যৌতুকের প্রতি মায়ের আকাঙ্খাটা রাশেলও বুঝতো খুব ভালো করেই।সে অত্যন্ত যৌতুকের জন্য রাকাকে হারাতে চায়নি।
তাই একদিন হুট করেই আমাকে কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়েটা করে ফেলে।তারপর আমাকে নিয়ে সোজা ওর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।
বিয়ে করে বাড়িতে আনার আগে আমাকে রাশেল শুধু একটা কথাই বলেছিল,”আমার মা হয়তো আমাদের এই ব্যাপারটাতে কষ্ট পেয়ে এখন অনেক কিছুই বলবে।তুমি কিন্তু কোনো কিছুই মনে নিও না।
আর কখনো আমার মায়ের অবাধ্য হয়ো না।আমি আমার মাকে খুবই ভালোবাসি।তাই আমার মা’র সাথে কখনো কেউ বেয়াদবি করলে সেটা কিন্তু আমি মেনে নিব না।বুঝলে?
প্রতুত্তরে আমি শুধু ঘাড় কাত করে রাশেলের কথায় সম্মতি দিয়েছিলাম।
আমাদের দেখে তো আমার শাশুড়ীর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়া বাকী ছিল।
একে তো রাশেলের বউ বাপের বাড়ি থেকে কিছু নিয়া আসে নাই উপরন্তু সে শিক্ষিতা।তার পড়াশোনার আরও বাকী,পড়াশোনার খরচও কিনা তার ছেলেকেই চালাতে হবে এখন!
সেই থেকে অনেক ঝড়ঝাপটার আর চরাই উৎরাই পেরিয়ে পরে স্থায়ী হতে পেরেছিলাম ঐ সংসারে।রাশেলের হাতে পায়ে ধরে পড়াশোনাটাও চালিয়ে নিচ্ছিলাম।
রাশেলের অন্যান্য ভাইদের মতো রাশেল একদম গন্ডমূর্খ ছিল না,সে অত্যন্ত বুঝতো পড়াশোনার মর্মটা।
তাই অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাকে রাজী করিয়ে তবেই সে বউয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতো।
অবশেষে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যখন শ্বশুর বাড়ির লোকেদের একটা অপছন্দের জিনিস থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম।আর ঠিক তখনই আমার সন্তান নিয়ে আরেকট বড় ঝঞ্জাট শুরু হয়ে গেল আমার সংসারে।
—————
চারদিকে বেশ আলো ফুটে গেছে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখনকার মতো স্মৃতির ডায়েরীর পাতা উল্টিয়ে রেখে পুকুরপারে চলে গেলাম মুখহাত ধুতে।
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি রান্নাঘরের পাশে মোড়া পেতে রাশেল বসে আছে।
পাশেই আমার মা আমার বোরকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়।
মা হয়তো আমাকে এক্ষুনি রাশেলের সাথে পাঠিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারলে বাঁচেন।
সকাল সকাল রাশেলকে দেখে আমার মেজাজটা চড়ে গেল।মায়ের “না,না” বোধক চোখের ভাষাকে উপেক্ষা করে আমি অগ্নিশর্মা হয়ে সামনে গিয়ে বললাম,
–কেন এসেছো এখন?কি চাও?আমি আমার বাচ্চাকে হত্যা করতে দিব না তোমাদের, এটাই শেষ কথা।শুনছো তুমি?
রাশেল মায়ের সামনে আমার এহেন ব্যবহারে একটু অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ালো।নিরীহ কন্ঠে বললো,
–মা বলেছেন তোমায় সাথে নিয়ে যেনো তবেই যাই।
–যাব না আমি তোমার সাথে।
আর তোমার মাকে স্পষ্ট করে বলে দিও,উনি যতই চেষ্টা করেন না কেনো উনার উদ্দেশ্য সফল হবেন না।
–মা বলেছেন তুমি যদি না যাও আমার সাথে,তাহলে মা অন্য ব্যবস্থা নিবেন!
–কি কি কি ব্যবস্থা নিবে তোমার মা?বলো?
#চলবে”