আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৬
———————————————
নাদের মিয়া গাজী মিয়ার বড় ছেলে ৷ বয়স পয়ত্রিশের আশেপাশে হবে ৷ নাদের মিয়া মা কে সুস্থ পেয়েছিল ৷ মায়ের সইয়ের মেয়ে হনুফার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল যখন তার বয়স ছিল বারো আর হনুফার বয়স ছিল দশ ৷ দুই সই শখ করেই ছোট ছোট বাচ্চাদুটোর বিয়ে দিয়েছিল ৷ সুফিয়া বেগম পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে চওড়া পাড়ের শাড়ি পরে ছেলের বউকে বগলদাবা করে এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াতেন ৷ নাদের মিয়ার সাথে হনুফার বন্ধুত্বটা ছিল দেখবার মতো ৷ দুজনে মিলে খেলতো , পাল্লা দিয়ে পুকুরে সাঁতার কাটতো ….
ধীরে ধীরে খেলতে খেলতেই বন্ধুত্বটা প্রেমের দিকে ঘুরে যায় ৷ ষোলো বছরের হনুফা আর আঠারো বছরের নাদের মিয়ার মধ্যে তখন তুমুল প্রেম ! এক বাড়িতে থেকেও দুজনে লুকিয়ে দেখা করে , হাঁট থেকে নাদের মিয়ার এনে দেওয়া কাঁচের চুড়ি রিনঝিনিয়ে বাজে হনুফার নরম কোমল হাতে …
এর মধ্যেই সুফিয়া বেগমের মাথার ব্যামো দেখা দিলো ৷ নাদের মিয়ার ছোট ভাই নাসির মিয়ার বয়স তখন দশ বছর ৷ নিপা তখন মাত্র তিন বছরের শিশু ৷ এর পরের দুই বছর হনুফা খুব সেবাযত্ন করেছিল শাশুড়ির ৷ পুরো সংসারের দায়িত্ব তখন হনুফার কাঁধে ৷ সুফিয়া বেগমের সই মালেকা বানু একসময় মেয়ের এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তাকে নিয়ে চলে গেলেন বাড়িতে ৷ ছয় মাস বিভিন্নভাবে গাজী মিয়া আর নাদের মিয়া চেষ্টা করেছে হনুফাকে ফিরিয়ে আনতে , মালেকা বানু হনুফার সাথে তাদের দেখা পর্যন্ত করতে দেননি ৷ ফলাফল , তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো ৷
ছাড়াছাড়ি হবার পর নাদের মিয়া আর বিয়ে করতে রাজী ছিল না , তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একদিন হনুফা ঠিক ফিরে আসবে ৷ কিন্তু যখন লোক মারফত জানতে পারলো হনুফার বিয়ে হয়ে গেছে কেমন একটা জেদ চেপেছিল তার মাথায় ৷ মনে মনে ভেবেছিল এই গ্রামেই আর থাকবে না ৷ বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে ৷ শহরে গিয়ে গার্মেন্টস এ একটা চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছিল সে ৷ দীর্ঘদিন , প্রায় বছর ছয়েক পর বাড়ি ফিরেছিল নাদের মিয়া ৷
বাড়ি ফিরে সে অবাক হয়ে দেখলো এগারো বারো বছরের ফ্রক পরা একটা মেয়ে চুলোয় ভাত বসিয়েছে ৷ শুকনো পাতা দিয়ে চুলোয় জ্বাল দিতে দিতে ফাঁকে ফাঁকে সে মিষ্টি কুমড়ো কেটে রাখছে একটা গামলায় ৷ পাশে কিছু চিংড়ি মাছ রাখা ৷ নাদের মিয়া অবাক হয়ে ছোট্ট একটা মেয়ের নিঁপুণ সংসারজ্ঞান দেখতে লাগলো… ভাতের মাড় গালাতে ধরে হঠাৎ নিপার চোখ গেলো বড় ভাইয়ের দিকে ….হাড়ি ফেলেই সে ভাইজান বলে দৌড়ে নাদের মিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এক মুহূর্তেই ৷ নাদের মিয়াকে দেখেই নিপা প্রথমেই তির হাতটা নিজের মাথায় রেখে কথা নিয়েছিল “ও ভাইজান আমার মাথাখান ছুঁইয়া কও আর যাবা না আমারে ফালায়া ….”
নাদের মিয়া মিটমিটিয়ে হাসে ৷ সেদিনও এভাবেই হেসেছিল … সময় কিভাবে এত দ্রুত যায় কে বলতে পারে ! সেদিনের দৌড়ে আসা বালিকার আজকে বিয়ের দিনক্ষন ঠিক হয়ে গেলো …. আর এক মাস পর নিপা চলে যাবে এই সংসার থেকে ৷ অবশ্য ভালোই হবে , এই সংসার নিপাকে সামান্য ভালোবাসাও দিতে পারেনি ৷ সারাদিন গাধার খাটুনি খেটেও বিনিময়ে কারো প্রশংসা পায়নি ৷ এরচেয়ে বরং নিজের সংসারেই যাক ৷ কথায় বলে এক জীবনে কষ্ট করলে আরেক জীবনে সুখ হয় ৷ বাপের বাড়ির জীবনে নিপা সামান্য সুখ পায়নি , স্বামীর কাছে নিশ্চয় সে আরাম আয়েশেই থাকবে ৷
হনুফার পর নাদের মিয়ার বউ হয়ে এসেছিল লাকী ৷ লাকী তাকে আট বছরের বিবাহীত জীবনে দুই ছেলের বাবা বানিয়েছে , কিন্তু এরচেয়ে বেশি কিছু তার কাছে পাওয়া যায়নি ৷ মাসের মধ্যে বিশ দিন সে বাপের বাড়িতেই থাকে ৷ দাদী পাগল এই ছুতো ধরে ছেলে দুটোকেও তাদের নানী বাড়িতেই রেখেছে ৷ অথচ তাদের পাগল দাদী তাদের চোখে হারায় ৷ আদর করতে চায় , কাছে ডাকে … বাচ্চাদুটোও মায়ের মতই হয়েছে , এরাও কখনও তাদের দাদীর কাছে আসে না , খানিকটা ভয়ে , খানিকটা ঘৃণায় …
হনুফা জীবন থেকে চলে যাবার পর নাদের মিয়ার জীবনের সেই অপূর্ণতাটা লাকী কোনদিনও পূরণ করতে পারেনি , হয়তো চেষ্টাও করেনি ….
আজ বিয়ের দিনক্ষন ঠিক হবে এই উপলক্ষে নাদের মিয়ার ছেলে দুটো এ বাড়িতে এসেছে ৷ দাদীকে ভালো না বাসলেও ফুফুর প্রতি তাদের ভালোবাসাটা টের পাওয়া যায় ৷ নিপা বারান্দায় বসে ছেলে দুটোকে গল্প শোনাচ্ছে , বড় ভালো লাগছে দেখতে….
লাকীর এসব কখনই ভালো লাগেনি ৷ ভালো লাগবেই বা কেন ? শ্বশুরবাড়ি একটা মেয়ে আসে স্বামীর হাত ধরে ৷ সেই স্বামীই তাকে কখনও ভালোবাসেনি , আপন করেনি … সে তো কম চেষ্টা করেনি ! শুধু শরীরের ভালোবাসা দিয়ে যে নারী হৃদয়ের তৃপ্তি মেটে না , এ জগতের কজন পুরুষ সেটা বোঝে !
চলবে…