-”এতগুলো বসন্ত পার করে কতশত ছেলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে অবশেষে প্রেমে পড়েছি এক ক্যামেরা ম্যানের। সেই ক্যামেরাম্যান আবার যে সে ব্যক্তি নয় আমারই বড় ভাইয়ের বন্ধু।”
সাজসজ্জায় মন্ডিত বিয়ে বাড়ির এককোণে দাঁড়িয়ে শীতল এসব ভাবছে। হাতে ধোঁয়া ওঠা ব্ল্যাক কফির মগ। কিছুক্ষণ আগে শুদ্ধ তার কাছে ব্ল্যাক কফি চেয়েছে। শুদ্ধই হচ্ছে তার প্রেমের মানুষ, মনের মানুষ। বদরাগী ছেলেটাকে কেন দুঃখে মন দিয়েছিল কে জানে। যদি জানত মনের কথা জানাতেই শুদ্ধ তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে তবে ভুলেও সেদিন বলত
না, ”শুদ্ধ ভাই আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।”
আর একথার জবাবে শুদ্ধও সপাং করে একটা থাপ্পড় মেরে কান ধরিয়ে ওয়াদা করাতো না,
-”আমি তোর ভাইয়ের কে?”
-”বন্ধু। ”
-”তোর ভাইয়ের বন্ধু হলে সম্পর্কে তোর কে হই?”
-”ভাই।”
-”তাহলে এখনই কান ধরে বল আর কখনো এসব বলবি না। আর ভুলেও যদি বলিস তবে বিনাবিঘ্নে সুইপারের বউ হবি।”
-”আচ্ছা।”
-”ভালোবাসান ‘ভ’ বোঝে না আসছে ‘শুদ্ধ ভাই আপনাকে আমার ভালো লাগে, ফাজিল একটা।”
একথা বলে শুদ্ধ ওর মাথায় ঠুয়া মেরে চলে গেছে। সেদিনের পর থেকে সেও আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায় না। কী দরকার ষাঁড়টাকে খুঁচিয়ে গুঁতো খাওয়ার? ষাঁড়টা না নিজে ভালোবাসার কিছু বোঝে আর না তাকে বোঝায়। সেও যদি বোঝাতে যায় তখন সবাইকে বলে মান সন্মান ধূলিসাৎ করে
মজা লুটবে। এর চেয়ে চুপ থাকা শ্রেয়। এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে হাঁটা ধরল শুদ্ধকে খুঁজতে। খুঁজতে খুঁজতে শিশির
তাকে জানাল শুদ্ধ ছাদে। শীতল সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে দৃষ্টি বুলিয়ে মুখ ভেংচালো। শুদ্ধ মরিচ বাল্ব নিয়ে ছাদের রেলিং সাজাচ্ছে। ঘামে ভিজে একাকার অবস্থা। টি-র্শাটের বেহাল
দশা। সরু নাকটার উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তা দেখে শীতল মনে মনে হাসল। শুদ্ধর দাদীমা শুদ্ধর নাকটা ঘামতে দেখলেই বলেন, ”কর্তা তুমি দেহি বউ সোহাগী হইবা।” উনি যতবার একথা বলে শুদ্ধ চুপ করে শুনে। তবে তার খুব ইচ্ছে এই ব্যাপারে শুদ্ধের জবাবটা শোনা। কারণ শুদ্ধর বউ তো সেই হবে। হঠাৎ শুদ্ধর হাঁচিতে শীতলের ভ্র কুঁচকে গেল। এই ছেলে তার ভাবনার মধ্যেও ব্যাগড়া বাঁধিয়ে দিলো। একটুপর হাঁচিটা দিলে কী হতো? কিছুই হতো না শুধু শুধু ওর ভাবনার মধ্যে হাঁচি ঢুকিয়ে দিলো, আশ্চর্য মানুষ একটা। তখন নিচে
থেকে চেঁচামেচি শোনা গেল। ক্যাটারিংয়ের লোকদের সঙ্গে শিশির চেঁচাচ্ছে। এই ছেলেটা কাজের কাজ কিছুই করে না
শুধু চেঁচিয়ে বাসা মাথার করে। এখন যেমন ছাদ সাজানোর কাজ শুদ্ধর ঘাড়ে চাপিয়ে কেটে পড়েছে। একটুপর হন্তদন্ত হয়ে এসে বলবে, ‘বন্ধু পেরেছিস নাকি আমি হাত লাগাব?’
জবাবে শুদ্ধ বিরক্তমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিবে। আর শিশির মুখভর্তি হেসে গল্প জুড়ে দিবে। তারপর নিচে গিয়ে এমন ভাব নিবে যেনো সেই সব করেছে। এদের দুই বন্ধুর সমস্ত কাজ কারবার তার মুখস্থ। তাছাড়া বাসায়
এখন অনেক কাজ। কারণ আগামীকাল তার বাবা-মায়ের বত্রিশতম বিবাহ বার্ষিকী। এই উপলক্ষেই বাসায় ছোট করে আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু শুদ্ধর কথা ছোট খাটো নয় করলে ভালো করে করতে হবে নয়তো বাদ। পরে ওর কথায় সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।
তখন শুদ্ধ কারো উপস্থিত টের পেয়ে বলল,
-”খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে সাহায্য কর আমায়।”
-”পারব না আমি। মগটা নিন, গিয়ে পড়তে বসতে হবে।”
-”কোন সাবজেক্ট পড়বি?
-”অর্থনীতি।”
-”এর আগে অর্থনীতিতে কত পেয়েছিলি মনে আছে?”
-” একশোতে পনেরো। আরো পেতাম স্যার ইচ্ছে করে নাম্বার দেয় নি।”
-”কেন দেয় নি।”
-”স্যারের বাগানের পেঁপে চুরি করে স্যারকেই উপহার দিয়েছিলাম তাই।”
একথা শুনে শুদ্ধর হাত থেমে গেল। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে এক পলক তাকিয়ে পুনরায় কাজে মনোযোগ দিলো। একে বলা না বলা সমান। কারো মাথার ব্রেণ এত ঘোলা হয় শীতলকে না দেখলে জানত না। তাছাড়া তার পড়ার সময় কই? সে তো মহাব্যস্ত মানুষ। কোথায় কোন প্যাঁচ লাগাবে সারাদিন সেটাই ভাবতে থাকে। শুদ্ধকে নিশ্চুপ দেখে শীতলও আর কথা না বাড়িয়ে শুদ্ধর কাজ দেখতে থাকল। ততক্ষণে কফি শবরতে পরিণত হয়েছে। অথচ শুদ্ধকে দেওয়ার কথা তার স্মরণেই নেই। শুদ্ধও না চেয়ে কাজ শেষ করে ছাদ থেকে নেমে গেল। তখন শীতল মুখ ভেংচিয়ে কফিটুকু ঢকঢক করে গিলে গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল,
‘একটু প্রেম চাইলাম প্রেম দিলে না
তোমার সনে কিসের পিরিতি।’
শীতল শেষ সিঁড়িতে নামতে গিয়ে দেখে তার বাবা দাঁড়িয়ে। এবার সে গান থামিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে গেল৷ যেনো ভীষণ জরুরি কাজ আছে তার। এখন সেটা করতেই হবে।
আসলে এমন কিছু না করলে তার বাবা সন্ধ্যায় পড়তে না বসার জন্য ভাষণ শুরু করতেন। আর বিরস কন্ঠে বলতেন ‘এবারের সংগ্রাম.. এই না ভাষণ ভুল হয়েছে। এটা মুজিব দাদার ভাষণ। ওহ তার বাবার ভাষণ হবে, ”সময় জ্ঞান নেই এভাবে জীবন চলবে?”
যত যায় করুক তার বাবার একই ভাষণ। শুনতে শুনতে ওর কানের পোকা গুলোও কবে বলে উঠবে, ”মি, শিমুল ডায়লগ চেঞ্জ করুন প্লিজ। একই ডায়লগে আমরা বোরিং হচ্ছি।”
মনে মনে এসব আওড়ে সে ড্রয়িংরুমে চোখ বুলিয়ে নিলো। আশেপাশে শুদ্ধকে না দেখে দুটো কমলা নিয়ে রুমে চলে গেল। তারপর শুদ্ধর রুম থেকে চুরি করে আনা সিগারেট বের করে দুষ্টু হাসল। এখন সে পরীক্ষা করবে এটার মধ্যে কী এমন আছে? আর এর ধোঁয়ার টেস্ট কেমন? মেয়েরা টক পছন্দ করে তাই তেঁতুল দেখলে হামলে পড়ে। তাহলে
সিগারেটে কী আছে যে ছেলেদের এটার প্রতি এত আসক্তি?চুরি-চারি, চিপায়-চাপায়, আড়ালে-সর্বসম্মুখে এটাই বা কেন খায়? এটা আজ পরীক্ষা করেই ছাড়বে। কিন্তু কথা হলো সিগারেটটা ধরবে কীভাবে? আগে আগুন জ্বালিয়ে মুখে নিবে নাকি ঠোঁট দিয়ে ধরে আগুন জ্বালাবে? মুভির হিরোরা যেমন করে তেমন। শীতল কয়েক মিনিট সিগারেটটা উল্টে পাল্টে ঘুরিয়ে দেখল। তখন হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি উদয় হলো। সে দৌড় দিয়ে তার আম্মুর ফোন এনে গুগোলে সার্চ দিলো, ”সিগারেট খাওয়ার কৌশল।”
সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো ছবিসহ ভিডিও সামনে আসল। সে মন দিয়ে কয়েকটা ছবি দেখে সিগারেট হাতে নিতেই কেউ একজন বলে উঠল,
-” এই সিগারেটখোর এদিকে আয়।”
শীতল চমকে উঠে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে কাউকে না পেয়ে
বেলকণিতে তাকাল। শুদ্ধ তার বেলকণিতে বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেঝেতে রাখা অনেকগুলো মরিচ বাল্ব। ওহ তারমানে সে এতক্ষণ ওর বেলকণিতে এসব সাজাচ্ছিল। সে শুদ্ধকে দেখে চটজলদি সিগারেট লুকাতে গিয়ে সিগারেট টা মধ্যখান থেকে ভেঙে দু ‘টুকরো হয়ে গেল। তা দেখে শীতল
করুণ চোখে তাকিয়ে রইল। তখন শুদ্ধ বলল,
-”সিগারেট কোথায় পেয়েছিস?”
-”আপনার রুম থেকে এনেছি।”
-”কেন?”
-”পরীক্ষা করতে।”
-”কিসের পরীক্ষা?”
-” সিগারেটের টেস্ট কেমন জানতে।”
-”তা এমন ভাবনা তোর মাথায় এলো কীভাবে?”
-”আসার জন্য আপনিই দায়ী।”
-“আমি কি করেছি?”
-”আপনি আমার থেকেও সিগারেটকে বেশি গুরুত্ব দেন। কেন আমার আগে সিগারেট আপনার ঠোঁট ছুঁবে? আমিও এখন আমার ঠোঁট পুড়িয়ে সমান সমান করব।”
-”তোর মাথায় ঘিলু বলে কিছু আছে?”
শুদ্ধর একথা শুনে শীতল জবাব দিলো না। বরং হাতে থাকা সিগারেট শুদ্ধর দিকে ছুঁড়ে মেরে হনহন করে বেরিয়ে গেল।
তার মেজাজ এখন তিরিক্ষি। কোথাও শান্তি নেই, যেখানেই যাবে শুদ্ধ এসে হাজির হবে। এই মানুষটা তাকে শান্তি দিবে বলে মনেও হয় না। কি দরকার ছিল ওর বেলকনিতে এসে খামটি মেরে বসে থাকার? শীতলকে যেতে দেখে শুদ্ধও ওর কাজ সেরে বেরিয়ে এলো। ফুলোরাণী নিশ্চিত গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। আজকে আর তার দেখার পাওয়ার সম্ভবণাও নেই। তবে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করার জন্য তার শাস্তি তোলা রইল। বলে কী না, ”সেও ঠোঁট পুড়িয়ে সমান সমান করবে। এত্ত বড় সাহস!”
তারপর শীতলের মাকে জানিয়ে শুদ্ধ ওর ফ্ল্যাটে চলে গেল। পাশের বিল্ডিংয়ের তিন তলার প্রথম ফ্ল্যাটে থাকে সে, একা। শিশির অনেকবার বলেও তাকে তার বাসায় থাকতে রাজি করাতে পারে নি। মূলত শুদ্ধই তা চায়নি। কারণ বিবাহযোগ্য মেয়ে বাসায় থাকা সত্ত্বেও অবিবাহিত এক ছেলেকে বাসায় রাখা দৃষ্টিকটু, অশোভনীয়। এমনকিছু হলে আজ নয় কাল তাকে নিয়ে কথা উঠবেই। তাই আগে সচেতন হওয়া ভালো।
তাছাড়া সে কখনোই চায় না তার কারণে শীতলের বদনাম রটুক। মেয়েটার দিকে অকারণে বাজে আঙুল তুলুক। সে
আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে। তবে কলঙ্ক চিরস্থায়ী।
আর এই চিরস্থায়ী কলঙ্ক শীতলকে কখনো স্পর্শ না করুক, কখনো না।
To be continue………!!
#আরো_একটি_বসন্ত
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১