আরো একটি বসন্ত পর্ব -০২

#আরো_একটি_বসন্ত
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_২

শুদ্ধ বাসায় ফিরে আগে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকল। পুরো শরীর ঘেমে জবজব করছে৷ এখন গোসল না করলেই নয়।
সে পরণের টি-শার্ট খুলতেই তার নজর পড়ল বুকের দিকে।
তার বুকের বাঁ পাশে রয়েছে বড় সড় কাটা দাগ। যেটা বিগত কয়েক বছর পূর্বের অস্ত্র পাচারের ফল। শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে
পুরনো কথা স্মৃতির পাতায় জমা রেখে গোসল সেরে বেরিয়ে আসল। তখনই কলিংবেল বেজে উঠল। সে ঝটপট পোশাক পরে দরজা খুলে দেখে শীতল দাঁড়িয়ে আছে। হাতে হটপট। নিশ্চয়ই শীতলের মা খাবার পাঠিয়েছেন। সে খাবে না বলে এসেছে তারপরেও.., উনি পারেনও বটে। তখন শুদ্ধ কিছু বলার আগেই শীতল তাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। যেনো প্রচন্ড তাড়ায় আছে। শুদ্ধও কথা না বাড়িয়ে দরজা আঁটকে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে। হঠাৎ শীতল এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বুকে নাক ডুবিয়ে জোরে শ্বাস টেনে বলল,

-” আপনার শ্যাম্পুর গন্ধটা সেই লাগে আমার।”
-”চুলে শ্যাম্পু করেছি বুকে নয়। এখন সর, সর বলছি।”
-”আর একটু প্লিজ।”
-”শীতল এবার বেশি বেশি হচ্ছে। ”
-”শুদ্ধ ভাই কিসের বিনিময়ে আমাকে ভালোবাসবেন?”
-”কোন দুঃখে তোকে ভালোবাসব?”
-“দুঃখে নয় আপনি আমায় সুখে ভালোবাসুন।”
-”তোকে ভালোবাসলে দুঃখ ছাড়া কপালে কিছুই জুটবে না। এখন সর নয়তো..! ”

একথা বলে শুদ্ধ তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো। শীতল ওর ব্যবহারে কাঁদো কাঁদো হয়ে শুদ্ধর দিকেই তাকিয়ে রইল। এই মানুষটা আসলেই পাষান, নিষ্ঠুর। শুদ্ধ ভেজা তোয়ালে মেলে শীতলের আনা খাবার খেতে বসল। ডানে বামে না তাকিয়ে
খেতে থাকল আপনমনে। তখন শীতলও বসল শরীরঘেষে, মাথাও রাখল শুদ্ধর কাঁধে। অতঃপর নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানালার বাইরে। তবে চাঁদ দেখছে না দেখছে সামনের বিল্ডিংয়ের বেলকনিতে থাকা একজোড়া কাপলকে। তারা বেলকণিতে বাঁধা দোলনায় পাশাপাশি বসে আছে। মেয়েটির কাঁধে ছেলেটি মাথা রেখে বই পড়ছে। হয়তো ছেলেটি তাকে কিছু পড়ে শোনাচ্ছে। আর মেয়েটি হাতে থাকা কিছু খাবার ছেলেটির মুখে গুঁজে দিচ্ছে।আহা, কি সুন্দর সেই দৃশ্যখানা।
শুদ্ধ ততক্ষণে তার খাওয়া শেষ করে ফ্রিজ থেকে কেক আর মিষ্টি এনে শীতলের সামনে রাখল। শীতল তাকিয়েও দেখল না। অন্যদিন সময় হলে নিজেই গিয়ে ফ্রিজ ঘেঁটে বের করে
খেয়ে ফেলতো। তারপর বায়না জুড়তো এই আনবেন সেই আনবেন। কিন্তু আজ কেন জানি নিশ্চুপ হয়ে আছে।বাঁচাল মেয়েটার এমন নীরাবতা দেখে এবার শুদ্ধই মুখ খুলল,

-”সিগারেট খেতে দেই নি তাই মন খারাপ?”
-”না।”
-”তবে?”
-”একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?”
-”হুম।”
-” আপনারা ছেলেরা এত খারাপ কেন?”
-” তা তো জানিনা। ”
-”ওহ।”

একথা বলে বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে শীতল ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। তার মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু অঝরে গড়াতে লাগল গাল বেয়ে। ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে শুদ্ধ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

-”কি আশ্চর্য কাঁদছিস কেন তুই?”
-”আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”
-”ভালোবাসাবাসির কথা বললেই দেখ তোর কী করি।”
-”না, অন্য কথা খুব পারসোনাল। বাসার কাউকে বলতে পারছি না। এখন আপনিই আমার শেষ ভরসা।”
-”সিরিয়াস কিছু?”
-”হুম।”

শুদ্ধ এবার শীতলকে তার মুখোমুখি দাঁড় করালো।আলতো স্পর্শে মুছে দিলো শীতলের অশ্রুজল। তারপর নমনীয় এক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল,

-”কি হয়েছে?”
-”রাতে আমি যখন ঘুমায় তখন মাঝরাতে কেউ আমার রুমে আসে।”
-”তুই বুঝলি কিভাবে?”
-”সে আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। আমি চায়লেও বাঁধা দিতে পারি না, চোখ খুলে দেখতেও পারি না। তবে তার স্পর্শ খুব চেনা মনে হয়। তার শ্বাস প্রশ্বাসসহ শরীরের গন্ধও মনে হয় আমার খুব কাছের কারো।”
-”এই দাঁড়া দাঁড়া তুই আমাকে ডাউট করছিস? এজন্যই তখন ওভাবে বুক নাক ডুবিয়ে শ্বাস নিলি?”
-”না, না, আমি জানি আপনি না তবে কে খুঁজতে হবে।”

শুদ্ধ সন্দেহের দৃষ্টিতে শীতলের দিকে তাকিয়ে রইল। সে সত্য নাকি মিথ্যা বলছে বোঝার চেষ্টা করছে। এই মেয়ে মারাত্মক ধুরন্ধর। এর সত্য মিথ্যা বোঝা এতটাও সোজা নয়। চোখের পানি ছেড়ে সত্যকে মিথ্যা করার প্রতিভা তার জানা আছে।
তাছাড়া শীতলের বলা ঘটনা ঘটার সুযোগই নেই। আর বাকি রইল ওর নিজের কথা, ওর যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সে তো অবগত নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। শুদ্ধ এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েকটা টান টান নিয়ে শীতলকে দিলো। শীতল ‘খাবো না’ বলে বেড়িয়ে পড়ল। শুদ্ধও দরজা আঁটকে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত শরীর এবার বিশ্রাম চাচ্ছে। আর শীতলের বলা কথাগুলো ভাববে কয়েকদিন পর থেকে। কারণ শীতল আজকাল উপন্যাসের বই আর মুভির প্রতি ঝুঁকেছে বেশি। হতে পারে সেসব পড়ে বা দেখে তার জন্য এই ফন্দি এঁটেছে।শুধুমাত্র তাকে পাওয়ার লোভে। আর মূখ্য কথা তাকে পেতে এই মেয়ের দ্বারা সব করা সম্ভব। হোক সেটা ভালোর মন্দের চুড়ান্ত পর্যায়। তাছাড়া একে বোকা ভাবা আর নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা সমান। তার বোকা বোকা চেহারা আর কর্মকান্ড দেখে বোঝার উপায়ই সে সিভিল গোয়েন্দার এক জুনিয়র সদস্য। যার সাহসিকতা দেখে উচ্চপদস্থ অফিসার
তাকে এই কাজে নিয়োজিত করেছে৷ অনার্স পড়ুয়া মেয়েটি আড়ালে আবডালে খুঁজে বেড়াচ্ছে রহস্যের এক গণ্ডি। যেটা
সমাধা করতে পারলে তাকে দেওয়া হবে, চমৎকার এক পদ।
তবে তার শর্ত অনুযায়ী তাকে কখনো জনসম্মুখে আনা হবে না কোনো পরিস্থিতিতেই না। সে আমজনতার কাছে সর্বদায় পরিচিত পাবে ‘আড়াল ‘ নামে।আর আড়ালকে ঘিরে থাকবে শুদ্ধ ও শিশির।

পরদিন সকালবেলা শীতল ছাদে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছে। এটা তার রোজকার রুটিন। সে প্রকৃতি দেখে ব্রাশ করতে পছন্দ না করলেও আসে কিছু ঘটাতে, রটাতে, সঙ্গে নোট করতে।
এখন যেমন ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে থুথু ফেলেছে আর সেটা পড়েছে এক পথচারীর বাঁ কাঁধের উপর। সেই পথচারী দাঁড়িয়ে গিয়ে হাত দিয়ে পরখ করে দেখে সাদা ফেনা।কিসের
ফেনা জানতে নাকে শুঁকলেনও তারপর থুথু বুঝতে পেরে পরণের কাপড়ে হাত মুছে বিরবির করে চলে গেলেন। উনার কান্ড দেখে শীতল শব্দ করে হেসে উঠল। বোকা বুঝি একেই বলে। তবে তাকে বোকা ভাবাও বোকামি। কারণ সে গুপ্তচর।
পথচারীর বেশে তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছে। তখন শিশিরের ডাক শুনে দৌড়ে নিচে নামতে গেল শীতল। কিন্তু যেতে গিয়ে ওড়না আঁটকে গেল ক্যাকটাস গাছের কাঁটার সঙ্গে। শীতল টান খেয়ে পিছু ফিরে দেখে বেশ অভিমানী কন্ঠে বলল,

-”যার ওড়না ধরে টানার কথা সেই টানে না। অথচ তুই গাছ হয়েও এত রোমান্টিক আর শুদ্ধ ভাই মানুষ হয়েও এত বেরসিক।”

একথা বলে সে কাঁটা থেকে ওড়না না সরিয়ে ঘুরতে লাগল। বাংলার সিনেমার টোন মনে মনে বাজিয়ে নিলো, লা লা লা।
তখন ছ্যার ছ্যার করে ওড়নার কিছু অংশ ছিড়ে কাঁটার সঙ্গে লেগে থাকল আর বাকিটা শীতলের হাতে। পছন্দের ওড়নার এমন বেহাল অবস্থা দেখে শীতলে রেগে গিয়ে বলল,

-”তুইও বিটকেল শুদ্ধর মতো প্রেম বুঝিস না। রোমান্সের ‘র’ কে ঘেটে ‘ঘ’ বানাতে ওস্তাদ তোরা।”

একথা বলে গজগজ করে নিচে চলে নেমে এলো। তবে রুমে যাওয়ার পথে আচমকা শিশিরের পিঠে কিল বসাতে ভুললো না। কারণ সব দোষ তার। সে ডেকেছে বলেই দৌড়ে যাচ্ছিল আর যেতে গিয়ে ওড়না ক্যাকটাসে বেঁধেছে। ফলস্বরূপ এটা শিশিরের প্রাপ্য। বোনের আচমকা কিলে শিশির থম মেরে কিছুক্ষণ বসে তারপর গগণ বিদারী কন্ঠে বলল,

-”ওই আম্মুর বাচ্চা শীতল তুই আমাকে মারলি কেন?”

-”ওই আব্বুর বাচ্চা শিশির মেরেছি বেশ করেছি। তোর জন্য আমার ওড়না ছিঁড়েছে। এখনই আমাকে ওড়না কিনে দিবি। নয়তো আব্বুকে বলে দিবো তুই আর শুদ্ধ আমাকে দিয়ে কী কী করাস।”

-”এর জন্য স্যালারিও তো দেই।”

-”এই মাসে তুই সাতশ টাকা আর শুদ্ধ ভাই এগারো’শ টাকা কম দিয়েছিস। তোরা আগে টাকা শোধ করবি তারপর কাজে ডাকবি। নয়তো খবর আছে দু’জনের।”

এভাবে কথায় কথায় দু’জনের ঝগড়া লেগে গেল। তারপর ওদের আম্মুকে খুন্তির নিয়ে আসতে দেখে দু’জনেই দু’দিকে
দৌড়। ওদের যাওয়া দেখে ওদের আম্মু কিছুক্ষণ বকাবকি করে ফিরে গেলেন রান্নাঘরে। ততক্ষণে দু’জন যার যার রুমে
ঢুকে দরজা আঁটকে দিয়েছে। শীতল দৌড়ে এসে শুয়ে পড়ে
তার অগোছালো বিছানায়। তারপর ফোন হাতে নিয়ে দেখে
একটা মেসেজ এসেছে,

”দেখা হবে বিকাল পাঁচটায় সাতকানার মোড়ে।”

To be continue………..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here