আলো আঁধারের লুকোচুরি পর্ব -০৫

#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_05
#Writer_NOVA

রুহানি না’ইফ দিয়ে আঙুলের নখে আঁচড় কা’টতে কা’টতে সামনের ব্যক্তির দিকে নজর দিলো৷ মধ্য বয়স্ক লোকটার ভয়ার্ত মুখটা দেখে এই মুহুর্তে তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সে পণ করেছে হাসবে না। মুখে গম্ভীরতা বজায় রেখে তীরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।

‘নাম কি?’

লোকটা মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। সে নাম বলবে না। কিছুতেই না। তা লক্ষ্য করে রুহানি বাঁকা হাসলো। মনোযোগ সহকারে নাইফের আগা দিয়ে নখের ভেতরের ময়লা পরিষ্কার করতে লেগে পরলো। এরপর আচমকা সামনে থাকা মরিচের গুড়ার বাটি থেকে এক খাবলা তুলে লোকটার মুখে ছুড়ে মারলো। লোকটা হাউমাউ করে চেচিয়ে উঠলো। মাসুম মুখ ভোঁতা করে বললো,

‘সোজা কথার মানুষ না।’

থেমে চুলের মুঠি শক্ত করে টেনে বললো,
‘নাম জিজ্ঞেস করছে বলিস না কেন?’

লোকটা ছটফট করতে করতে বললো,
‘বলছি, বলছি।’

‘জলদী বল।’

‘পানি!’

রুহানি চোখের ইশারা করতেই মাসুম চুলের গোড়া ধরে সামনের ঠান্ডা পানির বোলে মাথা চুবালো। বেশ কিছু সময় পর নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য উঠিয়ে আবারো পরপর চুব দিলো। ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে মুখের জ্বালাপোড়া খানিকটা কমলো। রুহানি ঠান্ডা দৃষ্টি বিনিময় করে বললো,

‘এবার বল।’

‘শফিক গাজী।’

‘কেন এমনটা করছিস?’

‘আমাকে বলা হয়েছে করতে।’

‘কে বলেছে?’

শফিক গাজী থম মেরে গেলো। মাসুম চোখ লাল করে খেঁকিয়ে উঠলো,

‘উত্তর দে শালার পো।’

শফিক গাজী ভীতিকর ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বললো,

‘সালমান।’

রুহানি হাতের নাইফটাকে কায়দা করে সামনের হোয়াইট বোর্ডে ছুঁড়ে মারলো। একদম সই জায়গায় গিয়ে সেটা গেঁথে রইলো। এগিয়ে এসে শফিক গাজীর গাল চেপে ধরে চেচিয়ে উঠলো,

‘সমুন্দির পোলারে কই পাবো?’

‘বৌ বাজারের উত্তর গলিতে একটা হার্ডওয়্যারের দোকান আছে। ঐটাই ওর।’

‘যদি না পাই?’

‘১০০% গ্যারান্টি দিতেছি পাবেন।’

রুহানি মাসুমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘শালারে টর্চার সেলে আটকায় রাখ।’

শফিক গাজী আৎকে উঠলো,
‘আমি তো সব বলে দিলাম।’

রুহানি চোখ পাকিয়ে মুখ তেঁতো করে বললো,
‘এত বছর যেই থালায় খেয়ে সেই থালা ছিদ্র করেছে তাকে কি করে বিশ্বাস করবো? আগে সালমাইন্নারে হাতে পাই। তারপর তোরে ছাড়বো। নিয়া যা, মাসুম।’

শফিক গাজীর ভুড়িতে জোরেশোরে একটা ঘুষি মেরে বললো,

‘ভুড়ি বাইরা গেছে। কমাইতে হইবো। মাত্র একবেলা খাবার দিবি।’

রান্নাঘর থেকে থালাবাসনের ঝনঝন শব্দ পেতেই তড়িঘড়ি করে সেদিকে পা বাড়ালেন আজিম সারোয়ার। এসে দেখলেন কাজের পরিচারিকা মিতু কাচুমাচু হয়ে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের ইশারায় কি হয়েছে জানতে চাইলে মিতু গাল ফুলিয়ে দেখালো। অর্থাৎ তাদের বাসার গিন্নি এখন রেগে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। হঠাৎ স্ত্রীর এমন রণমুর্তি দেখে আজিম সারোয়ার ভড়কে গেলেন। পর মুহুর্তেই তার চোখ গেলো ডাইনিং টেবিলে বসা মেয়ে তুষ্টির দিকে। যার এতকিছুতেও কোন হেলদোল নেই। সে উপন্যাসের বইয়ে ডুব দিয়ে রুটি ছিঁড়ে ভাজির সহিত মুখে চালান করছে। মেয়েটা সাহিত্য পাগল। বই পেলে আর কিছু লাগে না। পা চালিয়ে মেয়ের কাছের চেয়ার টেনে বসলো। কেচৎ করে শব্দ হওয়ায় তুষ্টি মুখ তুললো। চোখ সরু করে বাবার দিকে তাকালো৷ আজিম সারোয়ার ফ্যাস ফ্যাস গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে তোর মায়ের?’

তুষ্টি উপন্যাসের বই উল্টে নিচুস্বরে উত্তর দিলো,
‘রোজ যা হয়।’

‘কি?’

‘দাভাইকে দেখার সাধ জেগেছে। তাকে না দেখা অব্দি মায়ের মাথা ঠান্ডা হবে না।’

‘তোর মা এমন বাচ্চামো কেন করে বলতো?’

তুষ্টি ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বললো,
‘ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে তুমি যদি মানুষ করতে তাহলে আজ বুঝতে৷ সারাদিন-রাত রাজনীতি নিয়ে পরে ছিলে। মাসের পর মাস চলে গেছে আমাদের কোন খোঁজ খবর নেওনি৷ একা তিনটা মানুষ লালন-পালনের কষ্ট তুমি কি বুঝবে?’

আজিম সারোয়ারের মুখ বন্ধ করে দিলো তুষ্টি। তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটাকে খেয়াল করলেন। বই পড়তে পড়তে একটু বেশি জ্ঞানী হয়ে গেছে মেয়েটা। কথাবার্তায় কেমন ফুপাতো ভাইয়ের মতো গম্ভীর্য বজায় রাখে। আজিম সারোয়ার মুখ কালো করে বললো,

‘একটা উপায় বের করে দে না।’

তুষ্টি পুনরায় উপন্যাসের বই খুলতে খুলতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত নিয়ে বললো,

‘যাও তো বাবা, আমায় বিরক্ত করো না। যদি পারো দাভাইকে এনে দাও। দেখবে সব সমস্যার সলিউশন হয়ে গেছে।’

আজিম সারোয়ার বেদানার শ্বাস ফেললেন। গিন্নি যা রেগে আছে যেকোনো সময় টর্নেডো আঘাত হানতে পারে। কিন্তু জেনেশুনে সুনামির সম্মুখীন হতেও তো তার ইচ্ছে করছে না। কি মুসিবত!

‘মেয়েটার কোন খবর পেলে?’

মিশি বেগমের কথায় পলাশ হায়দার ক্লান্ত চোখে নিভু নিভু চাহনিতে তাকালো৷ গত কয়েকদিন ছুটাছুটিতে তার শরীর চলছে না। অগোছালো কদম ফেলে টলমল পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে ধপ করে গদি ওয়ালা চেয়ারে বসে পরলো। মিশি বেগম সামনের ফিল্টার থেকে এক গ্লাস পানি এনে স্বামীর দিকে বাড়িয়ে দিলো। পিয়াল এক পলক বাবার দিকে তাকিয়ে ফ্রী ফায়ার খেলায় মন দিলো। গ্লাসের পানি শেষ করে হাত দিয়ে ঠোঁট মুছলেন হায়দার সাহেব। মিশি বেগম স্বামীর উত্তরের আশায় চাতক পাখির ন্যায় প্রহর গুণতে আরম্ভ করলেন।

‘তোমার মেয়ে এই তল্লাটে নেই।’

গ্লাস ফিরিয়ে নিয়ে মিশি বেগম উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘তাহলে কোথায় আছে?’

‘জানি না।’

মিশি বেগম আশাহত হলো৷ তার মনে হয়েছিলো পলাশ হায়দার যেভাবে কোমড়ে গামছা বেঁধে নেমেছিলো মেয়ের একটা খোঁজ নিশ্চয়ই বের করে ফেলতে পারবে। কিন্তু স্বামীর মুখ দেখে, কথা শুনে বুঝলো সেই আশায় গুড়ে বালি। স্বামীর পাশ ঘেঁষে বসে কাঁধে হাত রাখলো। আশ্বস্ত গলায় বললো,

‘তুমি চিন্তা করো না। আমাদের মেয়েটা যেখানে আছে ভালোই আছে৷’

‘চিন্তা করতে না চাইলেও কি চুপ করে বসে থাকা যায়? কতশত বাজে চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায়।’

বুকের অন্ত গভীর থেকে দীর্ঘ শ্বাস বেরুলো। মিশি বেগম কি বলে স্বামীকে স্বান্তনা দিবে নিজেও জানে না। যেখানে সে নিজেও মেয়ের চিন্তায় কাহিল। পলাশ হায়দার হতশার গলায় বললো,

‘ওর কিছু হলে আমি ঠিক থাকতে পারবো না মিশি।’

মিশি বেগম আড়ালে চোখ মুছলেন। তার স্বামীকে সে কখনো এতোটা ভেঙে পরতে দেখেনি৷ বছর খানিক আগে যখন পুরো ব্যবসায় ধস নেমেছিলো তখনও সে ছিলেন পাহাড়ের মতো শক্ত ও অটল। অথচ সেই মানুষটা সময়ের ব্যবধানে মেয়ের চিন্তায় কাহিল হয়ে যাচ্ছে। কবে জানি নতুন অসুখ-বিসুখ বাধিয়ে বসে।

বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে হতাশার করুন সুর বেজে উঠলো পিয়ালের মনে৷ এতক্ষণ সে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও খেলায় মন দেইনি। কান খাড়া করে বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনেছে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতের মোবাইল শক্ত করে ধরে বিরবির করে উঠলো,

‘তুই তাড়াতাড়ি ফিরে আয় আপি। তোকে ভীষণ মিস করছি আমরা।’

পার্টি অফিস থেকে ফিরতে আজও দেরী হয়ে গেছে ইয়াসফির৷ এই ঝামেলা, ঐ ঝামেলা শেষ করতে করতে কখন যে সময় কেটে যায় বুঝতেই পারে না৷ রাজ্যের সব কাজ ওর জন্য জমিয়ে রাখে৷ গায়ে বাতাস লাগিয়ে ফেলেও রাখতে পারে না। মন্ত্রী হয়েছে আর প্যারা সামলাবে না তা কি হয়? দরজা দিয়ে ঢুকে ওমরের সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে নিলো। আগামীকাল কি করবে না করবে সেই বিষয়ে শিডিউল দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো৷ এখন একটা লম্বা গোসল দিবে৷ এরপর খেয়ে ঘুম। পেছন থেকে ওমর ডেকে উঠলো,

‘ভাই!’

ইয়াসফির পা জোড়া আটকে গেলো৷ ঘাড় ঘুরিয়ে ওমরের দিকে তাকালো। ওমর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রুর কাছটা চুলকে কাটা কাটা সুরে বললো,

‘আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।’

‘কে?’

‘আমি চিনি না। বললো আপনাকে চিনে৷ অনেকখন ধরে বসে আছে। আমি বলেছিলাম আপনার আসতে দেরী হবে। অন্য দিন আসতে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। আপনার সাথে দেখা না করে যাবে না।’

এক দমকা হাওয়ায় ইয়াসফির ফুরফুরে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। কত আশা নিয়ে সে ভেবেছিলো আজকের মতো কাজ শেষ। গোসল করে খেয়ে লম্বা ঘুম দিবে৷ সেই আশায় বাসা ভাঙছে৷ যথাসম্ভব নিজের বিরক্তি ভাব লুকালো৷

‘কোথায় সে?’

‘সোফায় বসে আছে।’

ইয়াসফি দেরী করলো না। ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেলো৷ ওমর লেগে পরলো রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে।

সোফায় বসে থাকতে থাকতে চোখ দুটো প্রায় লেগে এসেছিলো রায়হান খানের। জুতোর খটখট শব্দ শুনে চকিতে তাকালো৷ সামনেই ইয়াসফি চোখ লাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু বলার আগেই ইয়াসফির রাগী কন্ঠ শোনা গেলো।

‘আপনি আবার এসপছেন?’

রায়হান খান আজ ইয়াসফির রাগী স্বর ভয় পেলো না। তাড়াহুড়ো করে উঠে সামনে এসে দাঁড়ালো।হাত দুটো জোর করে আকুতিভরা কন্ঠে বলে উঠলো,

‘বাবা, আমার সন্তানটাকে ফিরিয়ে দাও। ওর সাথে এতো অবিচার করো না।’

ইয়াসফি মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো৷ অবিচার! সে করছে অবিচার? তাহলে এতোদিন তার সাথে সবাই যেটা করেছে সেটা কি ন্যায় বিচার ছিলো? তখন এই অবিচার শব্দটা কোথায় ছিলো? শুধু তার ক্ষেত্রেই এসব শব্দ কর্পূরের মতো উবে যায়?

‘আমার তোমার কাছে হাত জোর করছি। আমার সন্তানটাকে এবার ফিরিয়ে দাও।’

চোখ দুটো টলমল করে উঠলো রায়হান খানের৷ মনের সাথে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন যাতে চোখের পানি গড়িয়ে না পরে। তা দেখে ইয়াসফি নিঃশব্দে হাসলো৷ এরপর হাত মুঠ করে কাঠ কাঠ গলায় বললো,

‘ওর খবর আমি ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানে না। ওর কথা ভুলে যান। ওকে আপনি কখনো ফেরত পাবেন না৷ কখনো না।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here