#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_10
#Writer_NOVA
দশ হাজার টাকা জলিলের দিকে এগিয়ে দিলো রুহানি। নতুন কচকচে নোটগুলো দেখে জলিল দেরী করলো না। ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো। একবার গুণে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। তারপর টাকার মধ্যে শব্দ করে চুমু খেলো। যা দেখে ফিচেল হাসলো রুহানি। মাসুম মুখ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘অভিনয় ভালো করে করছিস তো? বেটা টের পেয়ে গেলে কিন্তু তোর পিন্ডি চটকাবে।’
জলিল চোখ সরু করে ভাব নিয়ে বললো,
‘নাহিনের পার্টে এত সুন্দর করে অভিনয় করেছি যে আমি নিজেই কনফিউশানে পরে গেছি আমি কি জলিল নাকি নিহান। আর মন্ত্রী সাহেব কি ধরতে পারবে? উল্টো অনেক করে অনুরোধ করেছিলো থাকার জন্য।’
‘থেকে যাতি।’
জলিল জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো,
‘মাথা খারাপ নাকি? হায়নার গুহা থেকে কতখন বের হবো সেই চিন্তা করতে করতে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। আরো সময় থেকে নিজেকে বিপদে ফেলবো।’
মাসুম শব্দ করে হেসে উঠলো। রুহানি বিরক্ত চোখে তাকালো। এরপর ফিসফিস করে বললো,
‘আস্তে, ও ঘুমিয়েছে। উঠাস না।’
মাসুম মুখে হাত দিয়ে চুপ হয়ে গেলো। রুহানির কথায় জলিল গতকাল ইয়াসফির বাসায় নিহান সেজে গিয়েছিলো। রুহানি নেক্সট টার্গেট ইয়াসফির বাসা তল্লাশি করা। সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তাই আগে থাকতে পুরো বাসার সকল তথ্য জানার জন্য জলিলকে পাঠিয়েছিলো। এমনি এমনি তো পাঠানো যায় না তাই তার বন্ধু নিহান সাজিয়ে পাঠিয়েছে। নিহান যে মারা গেছে তা রুহানি জানতো। কিন্তু ইয়াসফি নয়।
রুহানি মাসুমের থেকে চোখ সরিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে জলিলকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কোন গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন?’
‘হ্যাঁ, আছে।’
‘জলদী বল।’
‘মন্ত্রী সাহেব নতুন গৃহ পরিচারিকা খুঁজছেন। তুমি চাইলে জয়েন হতে পারো।’
রুহানির মুখে এক চিলতে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো। সামনের দেয়ালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,
‘অবশ্যই যাবো। (একটু থেমে) মাসুম, আমার যাওয়ার সকল ব্যবস্থা কর। বেটাকে শায়েস্তা করার আগে কয়েকদিন আত্মা ভরিয়ে রান্না করে খাইয়ে আসি।’
মাসুম আতঙ্কের সহিত বললো,
‘তুই একা যাবি?’
‘হ্যাঁ, একাই যাবো।’
‘আমি তোর সাথে যাবো রুহ।’
রুহানি চোখ পাকিয়ে বললো,
‘একদম জেদ করবি না।’
এরপর দরজা দিয়ে খাটের দিকে তাকালো। সেখানে উপুর হয়ে পরে এক পুরুষ নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। চোখ নামিয়ে মাসুমের দিকে তাকালো।
‘ওর সেবাযত্নের জন্য হলেও ওর কাছে এখন তোর থাকা উচিত। দুজনেই চলে গেলে ওর দেখভাল কে করবে? শয়তান মন্ত্রী ওর শরীরের কি হাল করেছে দেখছিস? মুখে কালো কাপড় পেচিয়ে দিন-রাত মেরেছে। সারা শরীরে কালশিটে পরে গেছে। আমি তো গতকাল দেখে কান্না করে দিছি। জীবনে কল্পনা করিনি ওকে ফেরত পাবো। আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আমার কাছে ওকে ফেরত দিয়েছেন।’
‘আমিও ভাবি নাই রে রুহ, ও যে আমাদের মাঝে ফেরত আসতে পারবে।’
‘তুই ওর দেখাশোনা করবি। আমার অবর্তমানে ওর কোন ক্ষতি যাতে না হয়। তাছাড়া তোর এখানেই থাকা উচিত। যাতে আমি ভবিষ্যতে বিপদে পরলে তুই আমাকে সাহায্য করতে যেতে পারিস।’
‘হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস।’
রুহানি বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জলিলের দিকে নজর দিয়ে বললো,
‘মন্ত্রীর বাসার সব ডিটেইলস বল আমাকে।’
চায়ের কাপ নিয়ে ইয়াসফির রুমে ঢুকতেই ওমর দেখলো ইয়াসফি আগ থেকে উঠে বিছানায় বসে আছে। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে রেখেছে। ওমর দ্রুত পায়ে সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,
‘মাথাব্যথা কমেছে ভাই?’
‘একটু।’
‘দুপুরের মিটিংটাও তো ক্যান্সেল করলেন। দুই আসনের এমপি অনেকবার কল দিয়েছিলো। আমি ধরিনি।’
‘আজকে কোন ঝামেলায় যাচ্ছি না। সারাদিন রেস্ট করবো।’
‘কিন্তু ভাই…..
ইয়াসফি হাত দিয়ে ওমরকে থামিয়ে দিলো।
‘কোন কিন্তু নয়।’
‘ঠিক আছে।’
‘চা দাও।’
ওমর চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই ইয়াসফি হাত বাড়িয়ে নিয়ে চুমুক দিলো। গতরাত থেকে উত্তেজনা, রাগে তার মাথাব্যথা উঠে গেছে। তাই আজ কোথাও যায়নি। তার বন্ধু নিহান মারা গেছে তা জেনে যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার থেকে বেশি রেগে গেছে। এই কারণে যে কেউ তাকে নিহান সেজে ঘোল খাইয়েছে। এটা কিছুতেই ইয়াসফি মানতে পারছে না। মনে পরলেই সারা শরীর রাগে রি রি করছে।
ওমর তাকিয়ে তাকিয়ে ইয়াসফিকে কিছু সময় দেখলো। এক রাতের ব্যবধানে ছেলেটাকে কত অগোছালো, এলোমেলো দেখাচ্ছে। কি জানি নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। অথচ গতকাল রাতে বন্ধুর সাথে কত প্রাণোচ্ছল ছিলো। ওমর তো জানে না আসলে সেটা ইয়াসফির বন্ধু ছিলো না। তাই সে ভাবছে অন্য কথা।
ইয়াসফি চায়ের কাপ রেখে ওমরের দিকে ঠান্ডা চাহনি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ভাইরাল ভিডিওতে থাকা ছেলেটাকে উঠাতে বলেছিলাম।’
‘ভাই আমি ইরফান নামের ছেলেটাকে উঠিয়ে এনেছিলাম৷ আপনার অবিকল গেটআপ নেওয়া ছেলেটাকে পাইনি। আমার মনে হয় পাওয়া যাবে না। ছেলেটার মুখ তো মাস্ক, সানগ্লাসে ঢাকা ছিলো।’
‘ইরফান কি বললো?’
‘বললো রুহানি নামের একটা মেয়ে সবকিছুর সাথে সংযুক্ত। ইরফান কিছু জানে না। তাই আমি ওকে ছেড়ে দিছি। ও নিজেও নাকি মেয়েটাকে খুঁজছে।’
ইয়াসফি চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া রেখে ভ্রু কুঁচকে ওমরের দিকে তাকালো,
‘কি নাম বললে?’
‘রুহানি।’
ইয়াসফির নামটাকে চেনা চেনা মনে হলো। কোথায় জানি শুনেছে। কিন্তু কোথায় শুনেছে তা মনে করতে পারলো না। এক হাতে কপাল ডলে চোখ বন্ধ করে ব্রেইনের ওপর মৃদু চাপ প্রয়োগ করলো। ধীরে ধীরে ব্রেইন কাজ করলো। নামটার কথা মনে পরে গেলো। চোখ, মুখে বিস্ময় টেনে মৃদুস্বরে চেচিয়ে উঠলো,
‘রুহানি তাবাসসুম!’
সে বারান্দার থাকা চেয়ারে আরাম করে বসলো। বাইরে গাঢ় অন্ধকার। সন্ধ্যা নামতে এখনো ঢেঢ় সময় বাকি। কালো মেঘের কারণে চারিপাশে নেমে এসেছে নিঝুম আঁধার। তবে পশ্চিম দিকে এখনো আলো উঁকি মারছে। পুরো পরিবেশটা মোহনীয়। এ যেনো আলো আঁধারের লুকোচুরি খেলছে। যেমনটা তার জীবন নিয়ে খেলা হচ্ছে। সে আলো আর অন্যজন আঁধার। দুজন মিলে লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত। কে জিতবে কে হারবে সেটা শুধু সময় জানে৷ পুরনো দিনে ফিরে গিয়েছিলো। ধ্যান ফিরলো রুহানির ডাকে।
‘নাও তোমার কফি।’
চোখ তুলে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। কফির মগ নিয়ে পাশে রাখলো। রুহানিকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো। রুহানি চেচিয়ে উঠলো,
‘আরে করছো কি? কফি পরে যাবে।’
সে কথার গ্রাহ্য করলো না। ফোলা চোখ, মুখ নিয়ে রুহানিকে জাপ্টে ধরে আছে। খোলা চুলে মুখ ডুবালো। এই মেয়েটা তার সকল মানসিক অশান্তির অবসান ঘটিয়েছে। যখন ইয়াসফির লোক ওকে মারতো তখন ও ভাবতো এতো যন্ত্রণা সহ্য করার থেকে মৃত্যু ওর জন্য শ্রেয়। পর মুহুর্তেই রুহানি মুখ মনে পরে যেতো। তখন মনে জোর আসতো, “না আমাকে বাঁচতে হবে। আমার রুহের জন্য হলেও বাঁচতে হবে।”
রুহানি উঠার জন্য হাসফাস করতে লাগলো। কিন্তু সে ছাড়লো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘আমার রুহ!’
রুহানির সকল ছটফটানি বন্ধ। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কতদিন পর সেই চিরচেনা ডাক। সময়টাকে বেঁধে রাখতে ইচ্ছে হলো তার। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। রুহ হাতের মগটা রেখে আদুরে ভঙ্গিতে গলা জড়িয়ে ধরলো।
‘তুমি ব্যাথা পাচ্ছো মাহ…..
সে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো।
‘হুশ, দেয়ালের কান আছে।’
রুহানি ভালো করে তার দিকে তাকাতেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। মুখে, চোখে, চুলে, দাড়িতে হাত বুলালো। কি অবস্থা হয়েছে ছেলেটার।
‘অমানুষটা তোমার কি হাল করেছে। বিশ্বাস করো আমি ভেবেছিলাম তোমাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবো।’
‘এতো সহজ রুহের প্রাণকে কেড়ে নেওয়া?’
দূর্বল ঠোঁট প্রসস্থ করে হাসলো। রুহানি বুকে মাথা রেখে হার্ট বরাবর চুমু বসালো। শার্ট সরাতেই উন্মুক্ত বুকে পোড়া ঘা এর দাগ দেখে চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠলো। সেখানে হাত বুলিয়ে শক্ত গলায় বললো,
‘অমানুষটাকে আমি ছাড়বো না।’
তিনদিন পরের কথা। ইয়াসফি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ আছে। অর্থবছরের জিডিপি বাড়ানোর প্রসিদ্ধে আলোচনা চলছে। হঠাৎ তার মোবাইলে একটা নোটিফিকেশন এলো। সে মোবাইলে না তাকিয়ে মিটিং-এ মনোযোগ দিলো। মিটিং শেষ হলো আরো আধ ঘন্টা পর। বের হয়ে মোবাইলের নোটিফিকেশন চেক করতেই তার চোখ দুটো কপালে উঠার অতিক্রম। সে তো এখানে তাহলে এই কাজটা কে করলো? দৌড়ে গাড়ির কাছে গেলো। ওমর তাকে দৌড়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে ভাই?’
ইয়াসফি বিচলিত গলায় বললো,
‘তুমি এদিকটা সামলিয়ো আমি আসছি।’
বলে দেরী করলো না। গাড়িতে উঠে স্প্রীড বাড়িয়ে রাস্তার ধুলো উড়িয়ে সেকেন্ডের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেলো। ওমরকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। এক হাতে বিদ্যুৎতের গতিতে গাড়িতে চালাতে চালাতে অপুকে কল করলো।
‘হ্যাঁ, ভাই বলেন।’
‘তুমি এখন কোথায় আছো?’
‘আমি তো ভাই হাড়িভাঙ্গা এলাকায়। কেন ভাই, কোন সমস্যা হইছে?’
‘এখিনি চৌরাস্তায় দাঁড়াও। আমি এসে পিক করছি।’
কল কেটে গাড়ি চালাতে মনোনিবেশ করলো ইয়সফি। একেকটা সেকেন্ড তার কাছে একেকটা ঘন্টার সমান মনে হচ্ছে। কতখনে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতে পারবে সেই চিন্তায় মশগুল। ভয়ানক বিপদের আশঙ্কা করছে। মনে মনে প্রার্থনা করছে যাতে তার আশঙ্কা সত্যি না হয়। চৌরাস্তা থেকে অপুকে পিক করে নিলো৷ অপু গাড়িতে বসে ইয়াসফির অবস্থা অবলোকন করে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে ভাই? আপনাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? কোন সমস্যা?’
‘ফ্লোরার লাশের ড্রয়ার কেউ খুলেছে।’
অপু কপাল কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ফ্লোরা কে?’
‘যেই মেয়েটাকে আমি বরফে সংরক্ষণ করে রেখেছি ওর নাম ফ্লোরা। আমার ভালোবাসা।’
অপু মাথা দুলালো৷ এতোদিন পর ফ্রিজিং ড্রয়ারে থাকা লাশের নামটা সে জানতে পেরেছে। তবে সে মনে মনে খুশি হয়েছে। মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে বরফে রাখা তার পছন্দ ছিলো না। যাক আল্লাহ বাঁচিয়েছে।
‘আপনি জানলেন কি করে লাশের ড্রয়ার কেউ খুলেছে?’
‘আমি ঐখানে এমন ব্যবস্থা করে রেখেছি যে কেউ ঐ ড্রয়ার খুললেই আমার মোবাইলে নোটিফিকেশন চলে আসবে। আর আমার মোবাইলে কিছু সময় আগে নোটিফিকেশন এসেছে।’
অপু কথা বাড়ালো না। বেশি কথা বলে ইয়াসফির মাথা গরম করলে দেখা যাবে ওকে চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।
গন্তব্য স্থানে এসে গাড়ি ফেলেই ভেতরে ছুট লাগালো। অপু বিরক্তি নিয়ে গাড়ি পার্ক করতে গেলো। দৌড়ে ভেতরে ঢুকে দরজা দিয়ে উঁকি দিলো। রবিন তখন চাবি গুছাতে ব্যস্ত। ইয়াসফিকে দেখে ওর ভ্রু কুঁচকে গেলো। ইয়াসফির গলা শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বললো,
‘চাবি দাও।’
রবিন বিস্মিত হলো। ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কিসের চাবি স্যার?’
‘কিসের চাবি মানে? লাশের ড্রায়ারের চাবি। আর কেউ কি ড্রয়ার খুলেছিলো? আমার মোবাইলে নোটিফিকেশন এসেছে।’
‘স্যার আপনার কি ভুলে যাওয়ার রোগ আছে?’
‘না, কেনো?’
‘একটু আগে আপনি নিজে লোক নিয়ে এসে ফ্লোরা ম্যাডামের লাশ নিয়ে গেলেন। যাওয়ার দশ মিনিট হয়নি এর মধ্যে এসে চাবি চাইছেন? অদ্ভুত তো!
#চলবে
[সবাইকে জানাই পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। ইদ মোবারক ❤️।]