উমা পর্ব -২১

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#২১তম_পর্ব

উমার কন্ঠে আজ কোন আড়ষ্টতা নেই, নেই কোনো জড়তা। অভিমানের প্রবল ঝড় তার ভেতরটাকে চূর্নবিচূর্ন করে দিচ্ছে। এতোকাল রুদ্রের কোনো কিছুই তাকে বেদনা দিত না, তবে আজ দিচ্ছে। হয়তো লোকটাকে কোথাও না কোথাও মনে ঠায় দিয়েছে সে। তাই তো এই অসহনীয় যন্ত্রণা সইতে পারছে না সে। রুদ্রের চোখে চোখ রেখে রুঢ় কন্ঠে বললো,
“আজ বলেই দিন কি চান আপনি? আর কতো যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে আমাকে? সেদিন তো খুব বলেছেন ভালোবাসেন। এই ভালোবাসার নমুনা? আর কতো লুকানো সত্য আছে? আর কতো গোপনীয়তা? আজ আমার উত্তর চাই।“

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“বেশ্, আজ তোমাকে সব খুলে বলবো আমি। তারপর নাহয় তুমি বিবেচনা করবে আমার মত মানুষের সাথে থাকা যায় কি না!”

উমা অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। লোকটাকে বোঝা বড্ড জটিল কার্য। এই দিঘীর জলের ন্যায় শীতল তো এখনোই সমুদ্রের মতো উত্তাল। রুদ্র নামটি যেনো যথার্থ তার জন্য। মহাদেবের ন্যায় তার বহু রুপ। এই যে কিছুক্ষন পূর্বেও কি উগ্র আচারণ ছিলো, অথচ এখন কি ভীষন নমনীয় কন্ঠে কথা বলছে। মনেই হচ্ছে না লোকটির মাঝে কলুষতার ছিটে আছে। রুদ্র খাটে বসলো। উমাকে তোয়াক্ষা না করেই একটা সিগারেট জ্বালালো। এই নিয়ে আজ তার সপ্তম সিগারেট। হবে নাই বা কেনো! কম মানসিক ধাক্কা পার করে নি সে। ইহজীবনে তৃতীয় বারের মতো থানা মুখো হয়েছে সে। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,
“আমি মানুষটা ভালো খারাপের প্রকারভেদে কখনোই পড়ি না। আমি সমাজের ভালো খারাপ দুইকেই নিজেকে ধারণ করে রেখেছি। ভালো মানুষের সাথে আমি ভালো তদ্রুপ খারাপের সাথে আমি জগন্য। আমি শাশ্বতের মতো অন্যায়কে দমন করতে চাই না। বরং অন্যায়ের মাঝে থেকে তাকে রাজত্ব করতে চাই। ছোটবেলা থেকে আমি দেখে এসেছি ক্ষমতা থাকলেই রাজত্ব। আর নারী কেবল ই শরীরের খোড়াক। বাবা কখনো মাকে ভালোবাসেন নি; প্রয়োজনে কাছে টেনে নিয়েছেন, প্রয়োজন ফুরাতেই তাকে দাসীর চেয়েও জঘন্য ভাবে ছুড়ে ফেলেছেন। আমার মায়ের তাতে অভিযোগ নেই। মূখ্য মেয়ে মানুষ কি না, স্বামী মানেই ভগবান। গ্রাম জানে বাবা পুত্রপ্রেমে অন্ধ, কিন্তু আমি জানি আমার সাথে এই অট্টলিকায় কি কি হয়েছে। আমার বাবার কাছে ক্ষমতাই সব, ক্ষমতার জন্য সে সবকিছু করতে পারে। তাই তো নিজের ছেলেকে আধারে আসামীর ন্যায় আটকে রাখতে তার একবার বুক কাঁপে নি। ছোট বেলায় বেশ ক্ষুদ্ধ হতাম, বাবা আমার এমন কেনো? সবার বাবা তো এমন নন। কিন্তু উত্তর পেতাম না। এরমাঝে আমাদের বাসায় শাশ্বতের আগমন ঘটলো। সে আমার মতো উগ্র ছিল না। খুব শান্ত, নমনীয় ছিলো। ওর প্রশংসা সর্বাদাই বাবার কাছে আসতো, আমিও ভালো হতে চাইতাম, কিন্তু কেনো যেনো হয়ে উঠতো না। একবার স্কুলের একটা ছেলের সাথে আমার বাজে ভাবে ঝগড়া বাদে। এক পর্যায়ে আমি ছেলেটার হাতে পেন্সিলের ভাঙ্গা অংশ ঢুকিয়ে দেই। ভেবেছিলাম বাবা খুব চটবেন। কিন্তু উলটো হলো, স্কুলে আমাকে লোকদেখানো বকুনি দিলেও বাড়ি এসে তিনি আমাকে বাহবা দিলেন। বাবার একটা কঠিন বাক্য আছে জানো তো,
“তুমি যদি মানুষকে পিসতে পারো তবেই আগাতে পারবে, নয়তো তোমাকে পিসিয়ে তোমার পেছনের জন এগিয়ে যাবে”

আমার বেড়ে ওঠা এই বাক্যকে কেন্দ্র করেই। বুঝতে পারলাম বাবা আমাকে পশু হিসেবে গড়ে তুলতে চান। বড় হতে লাগলাম, আমার দাম্ভিকতা আকাশ ছুলো। কাউকে পরোয়া করলাম না। কারন আমার বাবার ক্ষমতা তো আছেই আমাকে বাঁচাতে। বাবাও আমার সব কাজেই সন্তোষ প্রকাশ করতে লাগলেন। রাজনীতি আমাকে সর্বদা আকর্ষন করতো। তাই পলিটিক্যাল সাইন্সে ভর্তি হলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিলাম। আমার বেশ দাপট তৈরি হলো। নেতৃত্ব দিতে লাগলাম, সেখানে আমি অভিনব সিংহের পুত্র ছিলাম না। ছিলাম রুদ্র সিংহ রায়। আমার ভয়ে ছাত্ররা কাঁপতো। আন্দোলন, মারপিট যেনো আমার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক দলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ালাম। কিন্তু হুট করেই সব বদলে গেলো।“

রুদ্র থেমে গেলো, উমা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর দীর্ঘ নৈঃশব্দ্যতা। রুদ্র পরিশিষ্ঠ সিগারেটটা দানীতে রাখলো। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“নির্বাচনের জন্য নাম দেবার আগের দিন আমার ঘনিষ্ট বন্ধুর লাশ পাওয়া গেলো, ক্ষত বিক্ষত পানি খেয়ে ঢোল লাশটা পড়ে ছিলো আমাদের হলের পুকুরে। ওই দৃশ্য শুধু হৃদয় বিদারক ই ছিলো না। ছিলো চরম ভয়ংকর। মেরে হাসপাতালে পাঠানো আর পিটিয়ে হত্যা করার মাঝের পার্থক্যটুকু সেদিন বুঝেছিলাম। রক্ত তো আগেও লাগ্তো , পার্থক্য শুধু সেই মানুষের পরাণটা থাকে না। আমার শত্রু কে আমার জানা ছিলো না। তবে এটুকু বুঝেছি এই হত্যা আমাকে করার পরিকল্পনা চলছে। আমার বদলে আমার বন্ধুর জীবন চলে গেছে। আমি রাজনীতি ছেড়ে দিলাম। ওই ঘটনা ভলার জন্য মদ হাতে নিলাম। মাতাল হয়ে পড়ে রইলে মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে থাকে। বাবার কাছে চলে এলাম, বাবার এই কাজে যোগ দিলাম। আমার বাবা সবার কাছে আদরনীয় চেয়ারম্যান সাহেব হলেও তার ক্ষমতা, ঐশ্বর্যের রহস্য অন্যখানে। সে অবৈধ ভাবে বিভিন্ন জিনিস পাঁচার করে থাকেন, মাদকদ্রব্য, হাতিয়ার, বিভিন্ন পার্টস। বেনাপোল বর্ডার এবং মংলা থেকে তার জিনিস আসে। ভূমি দস্যু হিসেবেও তার বিশাল পরিচয়। বেনামী জমি দখলের রেকর্ড আছে। শহরের শেষ প্রান্তে একটা গ্রামের বেশ জমি দখল করে সেখানে তার বিশাল জুট মিল রয়েছে। কিন্তু এগুলো কিছুই বাবার নামে নেই। এই ব্রীজের কাজটাও বাবার কন্সট্রাকশন ই নিয়েছে। আমার কাজ এগুলোকে দেখে রাখা। তবে ব্রীজ ধসের কারণ আমি নই, ইঞ্জিনিয়ার শাহাদাত। সে মাঝে ঘাপলা করে। ও বাবার প্রতিপক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে এই কাজ করে, যেনো বাবা ফেসে যান। উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচনে যেনো বাবা হেরে যান। যখন তার এই কারসাজি ধরা পড়ে যায় তখন সে আমার ভয়ে পলাতক হয়ে যায়। আমি আগেই বলেছিলাম, আমি মানুষটা ভালো নই। তোমার মনে আছে আমি বিয়ের রাতে ঘর থেকে চলে গিয়েছিলাম?”
“জ্বী আছে”
“সেই রাতে আমার বাবার সাথে কিছু কথা কাটাকাটি হয় বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে, আমি বেড়িয়ে যাই। আমার কিছু খেচর আমায় খবর দেয় শাহাদাতের খোঁজ পেয়েছে। প্রথমত আমার মেজাজ খারাপ ছিলো, উপরন্তু শাহাদাতের কথা শুনতেই আমার মাথায় আগুন ধরে যায়। আমার ইচ্ছে হয় ওকে খুন করতে, আমি সময় নষ্ট না করে সেখানে চলে যাই।“
“আপনি কি উনাকে মেরে ফেলেছেন?”

কাঁপা স্বরে উমা প্রশ্নটি করে উঠে। রুদ্র মুচকি হেসে বলে,
“খুন করবো বললেই খুন করা যায় না। বুকে সাহস লাগে, যে মৃত্যু ভুলতে আমার মদের শরনাপন্ন হতে হলো সেই মৃত্যু কি এতোটা সহজ? না ওকে মারি নি। তবে বাঁচার মতো ও ছাড়ি নি। আমার যে মীর জাফরদের পছন্দ নয়”

রুদ্রের শান্ত কন্ঠ গায়ে কাঁটা দেয় উমার। রুদ্রের চোখজোড়া স্থির। সে তার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। রুদ্র এবার উঠে দাঁড়ালো, উমার মুখোমুখি হয়ে ধীর স্বরে বলল,
“আমি আগেও বলেছি, আজ আবার বলছি, আমি মানুষটা ভালো নই। খুব নিষ্ঠুর। কিন্তু আমার নিষ্ঠুরতা তোমার কাছে এসেই থেমে যায়। আমি এই প্রথম কাউকে মারি নি। আমি সেদিন যখন কাজে গিয়েছিলাম, বাবার কাজে তখন ও কাউকে মেরে এসেছি। সেই লোকটা এখন হাসপাতালে। আমি তো মারার জন্য ফেলে আসতে চেয়েছিলাম। দীপঙ্কর ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমি তোমাকে সব কিছু খুলে বললাম। এবার সিদ্ধান্ত তোমার………………

চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here