#উষাকালে_ঊর্মিমালা
#পর্ব_২৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
ভোরের কুয়াশা কেটে ঝলমলে রোদের দেখা মিললো। মিললো না কেবল রাহাতের দেখা। মায়ের অসুস্থতার খবর টুকু হয়তো তার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। নয়তো মাকে একবার না দেখে থাকতে পারতোনা সে। খবর পৌঁছানোর মাধ্যমটিও যে অবরোধ ঘোষণা করলো। প্রতিবার ডায়ালেই সুমিষ্ট এক নারীকণ্ঠ ভেসে ওঠে। ‘আপনি যেই নম্বরে ডায়াল করেছেন, তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে’।
মেজাজ প্রচন্ড রকম খা*রা*প হলো শামীমের। সবাই কেমন নিজ জায়গা থেকে খেলায় অংশগ্রহন করে যাচ্ছে। অথচ চরকির মতো নাচতে হচ্ছে তাকে।
মায়ের অসুস্থতার এক সপ্তাহ কে*টে গেল। লিলি জানালো সে তার বাড়ি ফিরে যেতে চায়। আনোয়ার হোসেন তাকে আটকানোর কোন পথ খোলা দেখছেন না। কী বলে আটকে রাখবেন? কোন বলে এই বাড়িতে টিকে থাকবে মেয়েটি?
নতুন ঝামেলার সূচনা হলো লিলির যাওয়ার প্রসঙ্গ থেকে। তার পরিবার আক্রমণ করার বন্দোবস্ত চালু করলো। রাহাতের বিরুদ্ধে তারা থানায় মা*ম*লা করবে। শুধু রাহাত কেন, তাদের মতে রাহাতের পরিবারের প্রতিটি মানুষই তাদের কাছে দো*ষী। পরিবার থেকে প্রশ্রয় না পেলে একটা ছেলে এত বড় কান্ড ঘটানোর সাহস পায় কিকরে? এতদিন সবটা চাপা থাকলেও সত্যিটা আজ সবার মুখে মুখে রটে আছে।
লিলির বয়ানের কাছে মা*ম*লা টিকতে পারলোনা।
সে নিজ মুখে স্বীকার করেছে,
-“বিয়ের আগেই উনি আমাকে নিজের অমতের কথা জানিয়েছেন। সবটা দু’পরিবারের লোকজন জানে। জানার পরও তারা বিয়েতে বাধ্য করেছেন আমাদের। আমি নিজেও বিয়ের পর উপলব্ধি করেছি – আমাদের বোঝাপড়া ভালো নয়, ভবিষ্যতে পৌঁছানোর মতো কোন রাস্তা আমি দেখিনি। দুজনের মিউচুয়াল আলাপের মাঝেই আমরা আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
যদি দো*ষ থাকে, তবে রাহাত বা তার পরিবারের একার নয়। সমান দো*ষ আমার পরিবারেরও। তারা জেনে-বুঝেই বিয়ে দিয়েছেন। তবে কি শা*স্তি সবার প্রাপ্য নয়?”
লিলির বয়ানে কে*স নড়বড়ে হয়ে গেল। তার বাবা-মা বাধ্য হলেন কে*স তুলে নিতে।
বাবা-মা হিসেবে চিন্তা তাদের ও হয়। মেয়েটা প্রথমেই একটা কান্ড ঘটালো। সেটা এখনো লোকমুখে ছিঃ! ছিঃ! শব্দের ঝড় তুলছে। এখন আবার নতুন হেনস্তার পথ খোলসা হয়েছে। বিয়ে হতে না হতেই কেন স্বামী ছেড়ে চলে গেল? নিশ্চয়ই তারা মেয়েটার চরিত্র সম্পর্কে জেনে গিয়েছে।
লিলি নরম স্বরে বাবাকে বলল,
-“বাবা, আমি অ*ন্যা*য় করেছি। নিজেকে শুধরে নিয়ে সুখ খুঁজতে গিয়েও শূন্য হাতে ফিরেছি। আমার ভাগ্যের কোন একটা পাতায় হয়তো এমনটাই লিখা ছিল। আমি নিরাশ হইনি। এখনো ভরসা রাখছি আল্লাহর উপর। নিশ্চয়ই তিনি আমার ভবিষ্যতে ভালো কিছু রেখেছেন।”
মেয়ের প্রতি রা*গ থাকলেও সেটা পড়ে গেল। লিলির বাবা অনুভব করার চেষ্টা করলেন ‘অসময়ে মেয়েটাকে দূরে ঠে*লে দিলে, সে কোথায় যাবে? কে আছে আর মেয়েটার?’
দু’হাতে আগলে নিলেন বুকের মাঝে। লিলির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা গরম জল। সবার মতো করে ভেতরের যন্ত্রণাটা জাহির করা তার জন্য বড্ড বেমানান। সে কেন কাঁদবে? কাঁদবেনা আর।
★★★
দুঃসহ হয়ে উঠলো ঊর্মির জীবন। পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে এসেছে আজ। চলাফেরায় সাবধানতা। শরীরে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরে আসলেও মনের ঘরে উন্নতি নেই। সকাল-বিকাল রাহাতকে মনে পড়ে। বুকের ভেতর একটি কোণে ঘাপটি মে*রে থাকা মানুষটি হঠাৎই নড়েচড়ে ওঠে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। তাকে এতটা দুঃখ দেওয়ার ইচ্ছে ঊর্মির ছিলোনা। কেবল নমনীয় রূপ ঢেকে কঠোরভাবে নিজেকে প্রদর্শন করেছে, এড়িয়ে গিয়ে নিজের মূল্য বোঝাতে চেয়েছে। অথচ মানুষটি তাকে মূল্যহীন করে চলে গেলো। সত্যিই কি সে মূল্যহীন?
টপটপ বৃষ্টি নামলো চোখের আকাশে।
সংসারের ব্যস্ততায় কা*টে উষার সময়। মায়ের উপর নির্ভরশীল মেয়েটাও আজ একা হাতে সংসার সামলাচ্ছে। বিয়ের পর মেয়েদের দায়িত্ব বাড়ে, বড় হয় তারা। বাবার বাড়ি থাকাকালীন বয়স বাড়লেও বড় হয়না মেয়েরা। বিয়ে হলেই সে ঘোড়ার গতিতে বড় হয়ে যায়।
সকাল থেকে সংসারের কাজ, শাশুড়ীকে দেখাশোনা করা। যদিও নাসিমা বেগমের দেখাশোনার জন্য একজন মহিলা রাখা হয়েছে। তবুও উষা নিজের দায়িত্বটুকু পালন করে যায়। আগের নাসিমা বেগম আর বর্তমানের নাসিমা বেগমকে দেখলে মনে হবে এরচেয়ে ভালো শাশুড়ী দুনিয়াতে একটিও নেই। অথচ মাঝের সময়ের কথা মনে পড়লেই বিতৃষ্ণা লাগে। হুট করেই রা*গ চেপে বসে মনে। কোন অহমিকায় অন্ধ হয়ে গেলেন তিনি?
সবমিলিয়ে অধৈর্য হতে গিয়েও কোথাও একটা ভালোলাগা খুঁজে পায় উষা। স্বামী সুখই মেয়েদের আসল সুখ। শামীম বাসায় ফিরে তাকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। ভোরে নামায থেকে ফিরে হুট করেই বলে বসে ‘চল, হাঁটতে বের হব আমরা’।
ছোটখাটো ব্যাপারে যত্ন নেওয়া, তার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া, ব্যাপারগুলো ভীষণরকম ভালোলাগে উষার।
ভীষণরকম ভালো থাকার মাঝেও কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা টের পায় সে। এমন সংসার যে তার আপুরও ছিল। তবে সে কেন সুখী হলোনা?
উষা জানে, মেয়ের ভালো দেখার জন্য বাবা আবারও আপুকে বিয়ে দিতে চাইবে।
সে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেবে আপুকে। বললেই তো আর ভালোবাসা ভুলে অন্য কাউকে ভালোবাসা যায় না! সংসার করা যায় যায় না।
উষা এখন টের পায় ভালোবাসা কী? কেন মানুষ মরিচীকার পেছনে ছোটে। সে তো পূর্বে কাউকে ভালোবেসে দেখেনি। প্রথম প্রথম রাহাতের জন্য ঊর্মির কান্না দেখে তার বড্ড রা*গ হত। কী আছে এই ছেলের মাঝে? কেন তার আপুকে কাঁদতে হবে?
এখন বোঝে মায়া আছে, ভালোবাসা আছে, টা*ন আছে। সে নিজেও শামীমের কাছ থেকে দূরে সরতে চায়না। তাহলে তার বোন কিভাবে স্বামীর ভালোবাসা ছেড়ে দূরে থাকতে চাইবে?
★★★
স্রোতের গতিতে মাস তিনেক কেটে গেলো।
রিয়ার চেহারায় আগের উজ্জ্বলতা ফিরলো। হুট করেই একদিন উষার কাছে এসে জড়তা ভেঙে বলে বসলো,
-“ভাবি, আমি একজনকে ভালোবাসি। তার পরিবার আমাকে দেখতে আসতে চাচ্ছে।”
উষা অবাক হলো। রিয়া তো আগে এমন কোন কথা তাকে বলেনি! হয়তো একেবারে ব্যক্তিগত। সে বলল,
-“বাবাকে বলেছো?”
রিয়া লজ্জায় মাথা নাড়িয়ে বলল,
-“তোমায় বলতেই আমার ভীষণ লজ্জা করেছে। বাবাকে কিভাবে বলি? তুমি ভাইয়াকে মেনেজ করবে আর ভাইয়া বাবাকে।”
অতঃপর করুণ গলায় বলল,
-“যেভাবে পারো তাদের রাজি করাও ভাবি। তার সাথে আমার কঠিন প্রেম, জীবন মরণের প্রেম। বড় কষ্টে সে তার পরিবারকে রাজি করিয়েছে।”
উষা রসিকতার ছলে বলল,
-“তলে তলে এতদূর? আমরা বললেই হরতাল!”
লাজুক হাসলো রিয়া।
তানভীর তাকে ধোঁ*কা দেয়নি। বাবা-মায়ের সাথে যুদ্ধ করে একপর্যায়ে তাদের রাজি করিয়েছে। প্রথম প্রথম বাসায় খাওয়া বন্ধ করেছে, কথা বলা বন্ধ করেছে, অতঃপর বাসায় যাওয়া বন্ধ করে কোনভাবে রাজি করিয়েছে তাদের। তাছাড়া মায়ের যেখানে আপত্তি ছিল, সেটা থেকে মুক্ত রিয়া৷
★★★
অফিস করে বাসায় ফিরলো শামীম। ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ফ্যান ছেড়ে বসলো। দু’হাতে আষ্টেপৃষ্টে ধরলো উষা। চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসলো শামীম। আলতো স্বরে বলল,
-“ময়লা শার্ট ছাড়াইনি তো।”
উষা গর্জে উঠে বলল,
-“তো? এভাবে ধরলে কী সমস্যা?
সারাদিনে কত মিস করি আপনাকে। কাছে পেয়ে একটু জড়িয়েও ধরতে পারবো না?”
শামীমের হাতজোড়া গিয়ে থামলো উষার পিঠে। একটু গভীর ভাবে বুকে জড়িয়ে মাদকাসক্ত গলায় বলল,
-“আমি মানুষটা তো তোমারই। যখন যেভাবে ইচ্ছে ধরবে, তাতে আমি বাঁধা দেওয়ার কে? তবে ময়লা শরীরে জড়িয়ে ধরবে?”
-“নিজে কী করেন? আমি রান্নাঘর থেকে ফিরলে তখন আমার শরীর ঘেমে থাকে না? আপনি তখন কিভাবে জড়িয়ে ধরেন?”
-“আচ্ছা, তোমার যা ইচ্ছে।”
বলে উষার নাক টিপে দিলো শামীম।
উষা বলল,
-“একটা কথা বলি? রা*গ করতে পারবেন না কিন্তু।”
শামীম চোখ জোড়া তীক্ষ্ণ করে তাকালো। পরক্ষণেই বলল,
-“রা*গ করার কথা হলে বলার দরকার নেই।”
-“আহা! শুনুন না।”
-“তো বলুন না।”
-“মজা করবেন না। আমি কিন্তু মজা করার মুডে নেই।”
-“আচ্ছা এবার সিরিয়াস কথাটি বলে ফেলুন।”
-“আসলে রিয়া আপুকে নিয়ে বলতে চাইছি। আপনি হুট করেই মেজাজ খারাপ করে ফেলবেন না। শান্ত হয়ে আগে শুনুন।”
-“আচ্ছা শুনছি।”
-“রিয়া আপু একটা ছেলেকে ভালোবাসে। তাদের রিলেশন দুবছরের বেশি সময় ধরে।”
শামীমের চেহারায় কঠোরতার ছাপ লক্ষ করে দুহাতে তার গাল শক্ত করে ধরে উষা বলল,
-“একদম মেজাজ গরম করবেন না। আগে সবটা শুনুন।”
ঠিক হয়ে বসলো শামীম।
উষা বলল,
-“ছেলেটা তার ফ্যামিলিতে বলেছে তাদের ব্যাপারটা। প্রথমে তার পরিবার মানতে না চাইলেও সে রাজি করিয়েছে। এখন তারা আসতে চাচ্ছেন। প্লিজ রা*গ না করে ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। যে সংসার করবে সে যদি খুশি থাকে তাহলে আমরা বাঁধা দেবো কেন? দেখা যাবে পরে তাকে জোর করেও বিয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা। সে বিয়ে করতে চাইবেনা। অথবা ধরে নিলাম তাকে কোনভাবে বিয়েতে রাজি করানো গেল, কিন্তু সে যদি মন থেকে সুখী হতে না পারে? তখন কি খুব আফসোস হবেনা আপনার? বোনের সামনে যেতে অপরাধবোধ হবেনা?”
তীক্ষ্ণ চোখে উষাকে আগাগোড়া দেখে শামীম সন্দিহান গলায় বলল,
-“কী ব্যাপার বলোতো? তুমি এত ননদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছো কেন? কোথায় আমায় সাপোর্ট দেবে তা না করে ননদকে সাপোর্ট দিচ্ছো?”
-“ননদকে সাপোর্ট দিচ্ছি, আপনাকে ঘু*ষ দেবো। রাজি হয়ে বাবাকেও রাজি করিয়ে ফেলুন প্লিজ! ওর ওপর দিয়ে ও তো কম দুঃখ-কষ্ট যায় নি। এবার আর কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। একটিবার তার চেহারার দিকে তাকিয়েছেন?”
শামীম ভাব নিয়ে বলল,
-“সবটা ঠিক আছে। তবে, আমি ঘু*ষ নিই না।”
-“আমি দিলে ঠিকই নেবেন।” বলে মুখ ভেংচি দিলো উষা।
ঠোঁট টিপে হাসলো শামীম। বলল,
-“আচ্ছা আগে যাচাই-বাছাই করে দেখি। যার-তার হাতে তো আর বোন তুলে দেওয়া যায় না।”
শামীমের কোলে মাথা দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো উষা। কপালটা এগিয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইলো। মৃদু হেসে ঠোঁটজোড়া তার কপালে ছোঁয়ালো শামীম।
উষা ঠিক করলো কাল একবার বাড়ি যাবে। আপুকে নিয়ে কত কত পরিকল্পনা তার। জীবনটা গুছিয়ে দিতে পারলেই সে শান্তি পাবে।
★★★
নাসিমা বেগম প্রতিনিয়ত ছটফট করে বাঁচেন। সন্তান হারানোর বেদনা বারবার আ*ঘা*ত করে বসে তাকে। টলটলে চোখের জলে বন্যা বয়ে যায়। আনোয়ার হোসেন এখনও কথা বলেন না। রাত্রি হলেই একপাশ হয়ে শুয়ে পড়েন। বলা চলে শোকে তিনিও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
#চলবে…….
(লিখতে গিয়ে কিছু চরিত্রের উপর আমার রা*গ হয়। পরক্ষণেই তাদের দুরবস্থ দেখে মায়া হয়।
যেখানে লিখতে গিয়ে আমারই রা*গ হয়, সেখানে পাঠকদের রা*গ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।)