এক শহর ভালোবাসা পর্ব ১১

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_১১
#সুরাইয়া_নাজিফা

“সৃজন তুই? ধ্যাত ছাড় তো। এসব কি ধরনের ব্যবহার করছিস । ”

আমি বুকে হাত দিয়ে বড় বড় দুটো নিঃশ্বাস নিলাম আর বেঞ্চে বসে পানির বোতল বের করে দুই ঢোক পানি খেয়ে নিলাম । সৃজন আমার পাশে বসে বললো,

“হেই তুই সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছিস। আরে আমি তো ফাজলামি করছিলাম। ”

“রাখ তো ফাজলামি। একে ক্লাসে কেউ ছিল না সেই অবস্থায় হুট করে কেউ এসে যদি এভাবে চোখ ধরে আমি বুঝবো কি করে। এখনি যদি আমাকে না ছাড়তি তাহলে ভয়েই আমি হার্ট এট্যাক করতাম ছাগল। ”

সৃজন কানে হাত দিয়ে আমার সামনে হাটু গেড়ে বললো,
“আচ্ছা এইবারের মতো মাফ করে দে জানু আর এমনটা করবো না স্যরি। ”

“হয়েছে আর এতো স্যরি বলতে হবে না। বাট তুই না বললি তুই আজকে আসবি না তাহলে আসলি কেমনে?”

“আজকে এতদিন পর তুই ভার্সিটিতে আসবি আর আমার সাথে দেখা হবে না সেটা তো হতে পারেনা তাই চলে এলাম আমার জানেমানের সাথে দেখা করতে। ”

কথাটা বলেই সৃজন আমার পাশে বসে পড়ল। তখনই পিছন থেকে আরেকজন এসে আমাকে ঝাপটে ধরল। তবে এবার আর আমি ভয় পেলাম না কারণ এটাকে আমি খুব ভালো করেই জানি। তানিশা আমাকে ছেড়ে আমার সামনে এসে বললো,

“কনগ্রাচুলেশন বেইবি।অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল তোর নতুন জীবনের জন্য।”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
“ধন্যবাদ।”

“শুধু ধন্যবাদে কাজ হবে না ট্রিট কবে দিচ্ছিস বল?”

আমি অবাক হয়ে বললাম,
“বিয়ের দিন না গান্ডি-পিণ্ডি গিলে আসলি তারপরেও আবার ট্রিট কিসের। ”

“তাতে কি হয়েছে।একবার খেয়েছি আরো একশবার খাবো। ফ্রেন্ড মানে আমাদের সবসময়ই ট্রিট চাই। ফ্রেন্ডদের কাছে ট্রিট নেওয়ার জন্য কোনো কারণ লাগে না। ”

“ওহ তাই নাকি সোনা তাহলে আজকে তুই ট্রিট দিবি। অনেকদিন পর আমি এসেছি তাই আমার ওয়েলকাম ট্রিট দে।”

“যা ফইন্নি আমার উপর চাপাই দিচ্ছিস তুই এতদিন পর আসছোস তোর ট্রিট মিস করছি এখন তুই দিবি। ”

“আমি বলেছি যখন তুই দিবি তাহলে তুই দিবি আর কোনো কথা না। ”

আমি আর তানিশা এই কথা নিয়ে চেঁচামেচি করছিলাম তখনই সৃজন বললো,

“চুপ কর তোরা দুজনেই। আমি আছি আমার জ্বালায় আর উনারা আছে খাওয়া নিয়ে। ”

আমরা দুজনেই সৃজনের দিকে তাকিয়ে একসাথে বললাম,
“তোর আবার কি সমস্যা।”

সৃজন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমার সমস্যাটাই তো বড় সমস্যা। আমার ভালোবাসার কথাটা বলার আগেই আমার ভালোবাসার মানুষটার বিয়ে হয়ে গেল এর থেকে কষ্টের আর কিছু আছে?”

আমি অবাক হয়ে বললাম,
“তোর আবার ভালোবাসার মানুষ কে কখনো বলিসনি তো?”

সৃজন গালে হাত দিয়ে চিন্তার ভঙ্গিতে বললো,
“বলার সুযোগ দিলে তো বলবো। ভাবলাম গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করার পর তোকেই বিয়ে করব বাট তুই কি করলি প্রথম বর্ষেই বিয়ে করে নিলি। এতো কিসের তাড়া ছিল তোর এখন আমার কি হবে? ”

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“যা তো সর এখান থেকে। এসব চাঁপা অন্য কোথাও গিয়ে মারিস তাহলে হয়তো সেই মেয়েকে পটাতে পারবি আমার সামনে না। তোর স্বভাব আমি খুব ভালো করেই জানি। ”

সৃজন নিজের কপাল চাপড়ে বললো,
“এটাই হলো কপাল যখন ফ্লার্ট করি তখন সবাই সিরিয়াসলি নেয় আর যখন সিরিয়াসলি বলি তখন সবাই ফ্লার্ট ভাবে। ”

তখনই তানিশা সৃজনের মাথায় ব্যাগ দিয়ে একটা বারি মেরে বললো,
“উঠ এখান থেকে এইটা আমার জায়গা। তোর কপালে সোহা তো বহুত দূর কি বাত হে রাণু মন্ডলও জুটবে না।তুই যতো মেয়ের মন ভেঙেছিস তার অভিশাপ লাগবে না ভেবেছিস।”

সৃজনও উঠে দাঁড়িয়ে তানিশার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললো,
“যাই জুটুক সেটা তোর থেকে ভালো হবে রাক্ষসী। ”

তানিশা খিলখিল করে হেসে বললো,
“হ্যাঁ এজন্যই তো এখন দেবদাসের খেতাব পেয়েছিস।কয়দিন পর পারুলের জন্য মরেও যাবি হারামী। ”

এদের কথা শুনে প্রচন্ড রেগে বললাম,
“কি ফালতু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিস। চুপচাপ বস এখনি ক্লাস শুরু হবে। ”

তারপর ওরা দুজনেই চুপচাপ বসে পড়ল।আস্তে আস্তে সব স্টুডেন্টারাও ক্লাসে চলে আসলো। কিছুক্ষন পর ক্লাস শুরু হলো। টানা দুইটা ক্লাস হওয়ার পরে জানতে পারলাম আর ক্লাস হবে না তাই আমরা তিনজনই বেরিয়ে করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রচন্ড সূর্যের তাপ পড়ছে তবে শীতের জন্য সূর্যের তাপটা আশীর্বাদ মনে হচ্ছে। আর আমরা ইচ্ছা করেই সূর্যের তাপটা যেখানে বেশী পড়ছিল ওখানে গিয়েই দাঁড়ালাম।কারণ ক্যাম্পাসে শীতের চাঁপটা অনেক বেশী। আমাদের তিনজনের সাথে সীমা আর নদীও আসল আড্ডা দিতে। আমরা পাঁচজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম হঠাৎ সীমা বলে উঠল,

“সোহা তোর মুখের দুইপাশ এমন কালো হয়ে গেছে কেন? ”
আমি সীমার কথা শুনে চমকে উঠলাম,
“কালো হবে কেন?”
তখন সৃজনও বলে উঠল,
“হ্যাঁ জানেমান তোর মুখ অনেকটা কালো লাগছে।”
সৃজনের কথার টোন ধরে নদীও বললো,
“হ্যাঁ সৃজন ঠিক বলছে। ”

আমি ওদের কথা বুঝতে পারছিলাম না বলে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিলাম। তখনই তানিশা আমার অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে আমাকে টেনে নিয়ে আসল ওয়াসরুমে।আমাদের সাথে সীমা আর নদীও আসল। তারপর আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,

“দেখ নিজের চোখেই। ”

আমি আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চোখ চড়কগাছ। আমার মুখের দু’পাশে কালো বর্ণের দাগ পড়ে গেছে কিন্তু এটা কিভাবে হলো।

সীমা হেসে বললো,
“আমি সকালেও দেখেছিলাম বাট তখন এতটা বুঝা যাচ্ছিল না বলে আমলে নেইনি।আমি একটা জিনিস বুঝি না তোকে দেখলে সব ছেলেরা এমনিতেই টেরা হয়ে থাকে তারপরেও তুই কেন এসব ছাইপাস বিউটি প্রডাক্ট ইউজ করিস । আরো সুন্দর হয়ে ছেলেদের আকর্ষন করার জন্য নাকি?”

তানিশা বিরক্তির সাথে বললো,
“এসব কি ধরনের কথা বলিস সীমা। ওটা তোর স্বভাব ছেলেদের আকর্ষিত করার জন্য সাজা। সোহা তোর মতো মেকাপ সুন্দরী না যে ওকে সুন্দর হওয়ার জন্য কোনো বিউটি প্রডাক্ট ইউজ করতে হবে। ”

সীমাও একটু খিটখিট করে বললো,
“সত্যি কথা বললে সবারই গায়ে লাগে। ”

সীমার কথা শুনে আমি রাগান্বিত হয়ে কর্কশ কন্ঠে বললাম,
“ফালতু কথা বলিস না তো। আমি মুখে তেমন কিছুই ইউজ করিনা শুধু একটা রেগুলার ক্রিম ছাড়া। সেটাও আমি আজকে ব্যবহার করিনি। আমি বুঝতে পারছিনা হঠাৎ মুখটা কালো হওয়ার কারণ কি? ”

নদী বললো,
“কিছু না দিলে এমনি এমনি তো আর এমন হবে না। কিছু দিয়েছিস হয়তো মনে নেই। আচ্ছা মুখটা ধুয়ে নে।পেত্নী লাগছে। ”

ওদের সাথে আর কথা না বলে আমি আমার মুখটা পরিষ্কার করতে লাগলাম। অনেকক্ষন চেষ্টার পর কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে তবে এখন পুরা মুখটাই কালো লাগছে। তখনই আয়নার দিকে তাকাতে আমার মনে পড়ল যে সকালে আমি আমার ক্রিমটার পরিবর্তে শান যেই ক্রিমটা দিয়েছিল সেটা ইউজ করেছিলাম তাহলে ওই ক্রিমটারই সাইড এফেক্ট নয়তো। কিন্তু যদি ক্রিমটায় মুখ এমনই হবে তাহলে শান আমাকে দিলো কেন। আমার মধ্যে অগ্নিয়গিরির লাভা ফুটছে। রাগে পুরা শরীর কাঁপছে। আমি তাড়াতাড়ি করে মুখটা আমার ওড়ানা দিয়ে বেঁধে তানিশার থেকে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। তানিশা আমার পিছন পিছন আসতে আসতে বললো,

“কিরে কোথায় যাচ্ছিস? ”
“ট্রেন চলে আসবে এখনি বাসায় যাচ্ছি তোদের সাথে পরে কথা হবে। ”

কথাটা বলেই আমি আর এক মূহূর্ত দাঁড়ালাম না। তানিশা অনেকবার ডাকলেও শুনলাম না। একটা রিকশা নিয়ে জিরো পয়েন্টে চলে গেলাম। তারপর ট্রেনে করে ষোলশহর স্টেশনে পৌঁছাতেই দেখতে পেলাম ড্রাইবার আঙ্কেল গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। আর বাসায় আসার আগ পর্যন্ত আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছিল।আর মনে মনে শানকে অকথ্য ভাষা গালি দিতে লাগলাম। ফালতু লোক একটা। ওনাকে আমি বিশ্বাস করে ক্রিমটা ইউজ করেছিলাম আর উনি কি করল। বাসায় এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে রুমে চলে গেলাম। কারণ এখন যদি মায়ের সাথে কথা বলি তাহলে আমাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে । আর এখন আমার কাছে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। রুমে ঢুকে ধুম করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগলাম।


“মে আই কাম ইন মিস্টার আরিয়ান আরেফিন শান। ”

শান অ্যাকাউন্টের পুরাতন হিসাব গুলো দেখছিলো হঠাৎ করে মেয়েলি কন্ঠ শুনে চোখ তুলে তাকালো। তাকাতেই দেখতে পেলো ঐশী দাঁড়িয়ে।শান ঠিক করে বসে বললো,

“এসো না ঐশী। এতো ফর্মালিটি করছো কেন? ”

ঐশী ভিতরে ঢুকে চেয়ার টেনে চেয়ারে বসে বলো,
“যেখানে সম্পর্কটাই একটা বিজন্যাস ডিলের উপরে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে ফর্মালিটি তো থাকতেই হবে। ”

“এভাবে বলছো কেন ঐশী। শুধু বিজন্যাস ডিল কেন হবে? আমরা দুজন কিন্তু খুব ভালো বন্ধুও তুমি সেটা ভুলে যাচ্ছো। ”

“না কিছু ভুলিনি।বন্ধুত্বটা বাহিরে অফিসে আমরা শুধুই বিজন্যাস পার্টনার। যাইহোক ঐদিন আমরা যেই ডিলটা পেয়েছি সেটা নিয়েই ডিসকাস করতে এসেছি তোমার সাথে । তোমার কি সময় আছে? ”

“ঐশী স্বাভাবিক ভাবে কথা বলো। দেখো আমি সত্যি দুঃখিত আমি তোমার মনে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি কখনো তোমাকে সেই নজরে দেখিনি কারণ আমি অন্য কাউকে ভালোবাসতাম। ”

“আমি সেটা আগেই ভুলে গেছি আরিয়ান।তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আর আমি এতো দূর্বল মেয়ে নই যে একটা সামান্য বিষয় নিয়ে ধরে বসে থাকবো। তবে হ্যাঁ একটা আক্ষেপ থেকে যাবে যে এতোটা ভালোবাসার পরেও তোমার মতো এতো ভালো একটা মানুষের ভালোবাসা পেলাম না। তুমি আমার জীবনে প্রথম পুরুষ যে আমাকে রিজেক্ট করেছো। আর সেটা আমি সবসময় মনে রাখবো। আচ্ছা অনেক কথা হয়ে গেছে এইবার কাজে ফোকাস করি।”

বলেই নিচের দিকে তাকিয়ে ঐশী ফাইল বের করতে লাগল। আসলে ফাইল বের করাটা তো কেবল মাত্র অজুহাত। ও চাইছে যেন ওর চোখের পানিটা শানের চোখে না পড়ে।

শান ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
“তুমি তাহলে আমার কোম্পানির সাথেই কাজ করছো? ”

ঐশী শানের দিকে তাকিয়ে খানিকটা হাসল। তারপর বললো,
“তুমি কি ভেবেছিলে আরিয়ান আমি ডিলটা ক্যান্সেল করে দেবো?কেন?তুমি আমাকে রিজেক্ট করেছো বলে? নো আরিয়ান নো। পার্সোনাল লাইফ একদিকে আর বিজন্যাস একদিকে। আমি কখনো দুটোকে একসাথে গোলাবো না। এই ডিলটা ক্যান্সেল করলে শুধু যে তোমার লোকশান হবে তা কিন্তু নয় আমারও হবে তাহলে আমি কেন করব? আমি এতোটাও বোকা নই। আর আমার যথেষ্ট মনের জোর আছে তোমার সাথে কাজ করার।”

শান খুশি হয়ে বললো,
“আই আ’ম প্রাউড অব ইউ ঐশী। আমি তোমার থেকে এটাই আশা করছিলাম।”

ঐশী শানের বিপরীতে আর কোনো কথা বললো না। ফাইল বের করে শানকে ডিলের ডিটেলস বুঝিয়ে দিতে লাগল ।শান যখন ঐশীকে রিজেক্ট করে তখন ঐশীর ও রাগের মাথায় ঠিক একই কথা ভেবেছিল যে ও শানের সাথে সব বিজন্যাস পার্টনারশিপ ক্যান্সেল করবে। চলে যাবে এখান থেকে অনেক দূর। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবল এখান থেকে চলে গেলে তো সবকিছু চুকেই যাবে। ও আর শানকে কখনো দেখতে পাবে না।বিজন্যাসের জন্যেও যদি কিছুটা সময় একসাথে থাকা যায় ক্ষতি কি। অন্তত কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রিয় মানুষটাকে চোখের সামনে দেখতে পাবে ব্যাস এটাই শান্তি। ভালোবাসা মানে তো শুধু এই না যে যাকে আমরা ভালোবাসব তাকে সবসময় নিজেদের সাথেই বেঁধে রাখব। বরং ভালোবাসার প্রকৃত অর্থই হলো ত্যাগ।তাকে মুক্ত আকাশে ছেড়ে দেওয়া যাতে সে নিজের সুখটা খুঁজে নিতে পারে। আর তার সুখের জন্য এতটুকু ত্যাগ বড় কিছু নয়।

ডিলের ডিটেলস বলতে বলতে হঠাৎ করেই ঐশী বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করলো। শান তাড়াতাড়ি করে পাশে থাকা পানির গ্লাসটা ঐশীর দিকে এগিয়ে দিলো। ঐশী তাড়াতাড়ি করে পানিটা খেলো। শান বললো,

“কি হয়েছে? ঠিক আছো এখন? কি ভাবছিলে এতো?”

ঐশী গ্লাসটা পাশে রেখে কিছুক্ষন চুপ করে রইল। কি উত্তর দিবে ও শানের প্রশ্নের এটা বলবে যে আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। না না এতোটাও ছোট হওয়ার মানে হয় না কারো কাছে। ঐশীকে চুপ থাকতে দেখে শান টেবিলে হালকা একটা বারি মেরে বললো,

“ঐশী? কি ভাবছো?”
শানের কথায় ঐশীর ঘোর কাটল। শানের দিকে মুখ করে বললো,
“হুম কিছুই না। ”

তারপর দুজনেই চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষন পর ঐশী বলে উঠল,
“তোমার মতো একজন সুন্দর মন এবং ভালো মানুষের ভালোবাসা যে মেয়েটা পেয়েছে সে সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী। আমার তো এখন তাকে হিংসা হচ্ছে। যেই ভালোবাসার জন্য আমি এতো তপস্যা করলাম সেই ভালোবাসা সে এতো অনায়াসেই পেয়ে গেল আরিয়ান। ”

ঐশী একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ঐশীর ব্যবহারে শান বড্ড অস্বস্তি অনুভব করছে। আর প্রচুর বিরক্তও লাগছে কথা গুলো শুনতে কিন্তু কি বা করার আছে না চাইতেও যেই ঝামেলা ও সবসময় এড়িয়ে চলত সেই ঝামেলাতেই পড়ে গেছে। ভাবতেই নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে মন চাইছে শানের।

ঐশী আবার বললো,
“বাই দ্যা ওয়ে আরিয়ান বিয়েটা তো আমাকে না জানিয়েই করলে এখন কি বউটাও আমাকে দেখাবে না নাকি?”

“হুম কেন দেখাবো না। ”

শান নিজের ফোনটা ওপেন করল। তারপর গ্যালারিতে ঢুকে প্রাইভেট ফাইল থেকে সোহার ছবি বের করে ঐশীকে ফোনটা হাতে দিলো। ঐশী ফোনটা নিয়ে ছবিটা দেখেই না চাইতেও মুখ থেকে আপনাতেই বলে উঠল,

“মাশাআল্লাহ! আরিয়ান তোমার বউ কিন্তু একদম হুরপরী। আমারই চোখ আটকে যাচ্ছে আর তোমার কথা তো নাই বলি। এজন্যই বউয়ের জন্য এতো পাগল তুমি তাই না আরিয়ান। তোমার চয়েস আছে বলতে হবে। তোমাদের একসাথে খুব ভালো মানিয়েছে । ”
ঐশীর গলা ধরে আসছিলো বারবার কথা গুলো বলতে।

শান ঐশীর কথা মিষ্টি করে হেসে বললো,
“ধন্যবাদ ঐশী। ”

ঐশী হাসার চেষ্টা করে তাড়াতাড়ি ফোনটা শানকে দিয়ে বললো,
“এতো সুন্দর লাগছে তোমাদের যে আমারই না নজর লেগে যায়।আচ্ছা শান আমার শরীরটা আজকে ভালো লাগছে না। কালকে ডিলটা নিয়ে ভালো করে কথা বলবো ওকে। ”

শানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঐশী দ্রুত শানের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।একদম হাওয়ার বেগে বেরিয়ে গেল। শান শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। ঐশী এতো দ্রুত হাটছিলো। যেন মনে হচ্ছে ও হাটছে না দৌড়াচ্ছে।নিচের ফ্লোরে এসে যখনই গেইট থেকে বের হবে তখনই মাথায় সজোরে ধাক্কা খেলো কারো সাথে। ঐশী ওখানেই মাথা ধরে বসে পড়ল। আর ছেলেটা মাথার সাথে সাথে গেইটের সাথেও বারি খেলো।ছেলেটা চিৎকার করে বলে উঠল,

“আশ্চর্য এটা কি খোলা মাঠ পেয়েছেন যে এভাবে ছাড়া গরুর মতো দৌড়াচ্ছিলেন। উফ আমার মাথাটা ফাঁটিয়ে দিয়েছে। ”

ঐশী দ্রুত বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললো,
“স্যরি আমি দেখতে পাইনি আসলে আমার একটা কাজ ছিলো তাই তাড়ায় ছিলাম। ”

কথাটা শেষ হতে না হতেই সামনে যাকে দেখলো তাকে দেখে চিৎকার করে বললো,
“আআআপপপপনিনি।”

এতক্ষনে ছেলেটিও ঐশীকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ও মনে করার চেষ্টা করলো আরে এটা তো ঐ মেয়েটা যে ওকে ধন্যবাদ না দিয়েই চলে গেছিল। ঐশীর চিৎকার শুনে ছেলেটি সম্ভিত ফিরে পেল।ছেলেটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“আরে আপনি ঐ মেয়েটা না যিনি ঐদিন সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন। ”

ঐশী ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনার মাথার স্ক্রু কি ডিলা? কি ফাউল কথা বার্তা বলছেন পাবলিক প্লেসে। ”

“আপনি সুইসাইড করতে যেতে পারবেন আর আমি বললেই দোষ।”

“আর একটা বাজে কথা বললে না। ”
ঐশী পাশে একটা ভাঙা রড পড়ে ছিল ওটা হাতে তুলে বললো,
“এই রডটা দিয়ে মাথা ফাঁটিয়ে দিবো। এরপর বুঝতে পারবেন সুইসাইড কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? প্রত্যেক প্রকারের উদাহরণসহ। ”

ছেলেটা ভয় পেয়ে বললো,
“কি ডাকাত মেয়েরে বাবা একে তো ঐদিন সুইসাইড করা থেকে বাঁচালাম অথচ ধন্যবাদ না দিয়েই চলে গেল। আর আজকে দেখা হতে না হতেই মাথাটা অর্ধেক ফাঁটিয়ে দিয়েছে নিজের গরুর মতো শিং দিয়ে। এখন আবার পুরাপুরি হাসপাতালে পাঠানোর ধান্দা। বলি আমি আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছিলাম জানতে পারি?”

ঐশী রেগে নিজের হাত থেকে রডটা ফেলে দিয়ে বললো,
“দূর আমিই পাগল। নাহলে এই আধ পাগলে সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করি। ”
কথাটা মনে মনে আওড়িয়ে ঐশী বেরিয়ে যাচ্ছিল। তখনই ছেলেটা পেছন থেকে ডেকে বললো,
“ওহ ম্যাডাম একটা গুতো দিয়ে চলে যাচ্ছেন যে আমার মাথায় শিং উঠলে সেই দায় ভার কে নেবে। দয়া করে আরেকটা গুতো দিয়ে যান। ”

ঐশী নিজের পায়ের জুতাটা খুলেই ছেলেটার দিকে ছুড়ে মেরে বললো,
“আপনাকে দ্বিতীয় গুতো দিবে আমার জুতো। পাগল লোক একটা। ”

কথাটা বলেই ঐশী বেরিয়ে গেল। আর ছেলেটি ওখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভাগ্যিস ঠিক সময় মতো সড়ে গেছিল নাহলে সোজা ওর গায়েই পড়ত।

“ওহ মাই গড। এটা মেয়ে না অন্যকিছু। আল্লাহ জানে এই মেয়ে কোনো ছেলের কপালে নাঁচছে। তার জীবনটা পুরো নরক বানিয়ে ছাড়বে শিউর। ”


বিকালে শান বাসায় আসতেই দেখতে পেল শানের মা একা একা বসে আছে আর সিরিয়াল দেখছিল। কিন্তু সোহাকে দেখলো না। শান ওর মায়ের কাছে এগিয়ে গেল। শানকে দেখেই শানের মা টিভি ছেড়ে শানের দিকে তাকিয়ে বললো,

“এসে গেছিস?”
“হুম এখনই এলাম। ”
“সোহার কি হয়েছে বলতো? তুই কি কিছু বলেছিস? ”
মায়ের কথা শুনে শান বিচলিত কন্ঠে বললো,
“না। ওর সাথে তো সকালের পর আমার দেখাই হয়নি কি বলবো?”
শানের মা চিন্তিত হয়ে বললো,
“জানি না। ভার্সিটি থেকে আসার পর একটা কথাও বলেনি কারো সাথে। ”
শান একটু চিন্তিত হলো যে হঠাৎ কি হলো মেয়েটার। সকালবেলা তো ভালোই ছিলো।

“আচ্ছা মা আমি দেখতেছি। ”

কথাটা বলেই শান উপরে চলে গেল। উপরে গিয়েই দেখল দরজা লক করা। শান দুই তিনবার নক করতেই দরজা খুলে দিলাম।শান ভিতরে ঢুকেই বললো,
“কি ব্যাপার দরজা লক করে বসে আছো কেন?”

আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ গিয়ে বেডের একপাশে বসলাম।সোহার এমন ব্যবহারে শানের অবাকের মাত্রা দ্বিগুন হলো। তাহলে শান যেটা ভাবছে সেটা সত্যি নাতো। সবটা বুঝতে পেরে যায়নি তো। শান এগিয়ে গেল সোহার দিকে। শান আমার পাশে বসে আমার হাতের উপর নিজের হাত রাখতেই আমি ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে উঠে দাড়ালাম। হাত সরাতেই শান আবার আমার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো।আমি রেগে বললাম,

“ছাড়ুন আমার হাত। ”
“কি হয়েছে তোমার কাঁদছো কেন?”
আমি শানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“আপনি জেনে কি করবেন হাত ছাড়ুন আমার।”
শান আরো দ্বিগুন জোরে আমার হাত ধরে আমাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বললো,
“যতক্ষন না তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিবে আমি তোমাকে ছাড়ছি না। ”
আমি শানের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“সকালে আপনি যে ক্রিমটা আমাকে দিয়েছিলেন সেই ক্রিমে সাইড এফেক্ট আছে বলেননি কেন?”
শান অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
“ক্রিমে সাইড এফেক্ট থাকবে কেন? ”
এবার আমি কান্না করেই বললাম,
“না থাকলে ওই ক্রিমটা ইউজ করার কিছুক্ষনের মধ্যে আমার ফেসটা পুরো কালো হয়ে গেলো কেন? শুধু আপনার জন্য আজকে ফ্রেন্ডেদের হাসির পাত্র হয়ে গেছি আমি। সবাই বলছে আমি ছেলেদের আকর্ষন করার জন্য, সুন্দর দেখার জন্য হয়তো উদ্ভট কোনো বিউটি ক্রিম ইউজ করেছি এজন্যই এমন হয়েছে। ”

আমি আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। শান আমার মাথাটা আলতো করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,

“কে বলেছে আমার মিষ্টি বউকে এমন কথা। আমার বউটা তো এমনিতেই ন্যাচারাল সুন্দরী। তার সুন্দর হতে কেন কোনো ক্রিম ইউজ করতে হবে। যে এই কথা বলেছে নেক্সট তুমি আমাকে দেখিয়ে দিও আমরা দুজনে মিলে ওকে কালো পেন্ট করিয়ে কালো বানিয়ে দিবো কেমন। একদম বাচ্চাদের মতো কেঁদো না। আমি তো তোমার ভালোর জন্যই ক্রিমটা দিয়েছিলাম। ওই ক্রিমটার জন্য কিছু হয়নি। আমি কেন জেনে শুনে এমন কিছু করব।হয়তো তোমার স্কিন প্রবলেম হচ্ছে। আর কিছু ইউজ করার দরকার নেই। ”

শান আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো আর কিসব উদ্ভট কথা বলছিলো।একদম বাচ্চাদের মতো আমাকে শান্তনা দিচ্ছিলো। এতে আমার কান্না ভুলে হাসি চলে আসছিলো। আমি নিজের কান্নায় এতো ব্যস্ত ছিলাম যে আমি খেয়ালই করিনি আমি উনার বুকেই মাথা দিয়ে আছি।

সোহার কান্নার বেগ কিছুটা কমতেই শান জোরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। যেনো আসন্ন কোনো বড় বিপদ থেকে হাফ ছেঁড়ে বাঁচল।
.
.
চলবে

বিঃদ্রঃ গল্পটা কেমন হচ্ছে জানাতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here