#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
২৪.
#WriterঃMousumi_Akter
রোশান স্যার দুই হাতে আমাকে আগলে ধরলেন।হঠাৎ যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম।দূর্বল শরীরে ওশানের ধাক্কায় মনে হচ্ছিল আমি কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে যাচ্ছি।হৃৎপিন্ড কাঁপছে।কিছুক্ষণ আগেও আমি ছিলাম অগ্নিকন্যা। হঠাৎ আবার দূর্বল হয়ে পড়েছি।রোশান স্যার কঠিন মেজাজে তাকিয়ে আছেন ওশানের দিকে।এখনি হয়তো ওশানকে ভস্ম করে দিবেন চোখ দিয়েই।রাগে উনার শরীর কাঁপছে।পাশেই একটা চেয়ার ছিল,পা দিয়ে টেনে এনে আমাকে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে।গেঞ্জির হাতা গোটাতে গোটাতে এগিয়ে গেলেন ওশানের দিকে।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওশানের নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে বললেন,
‘হাউ ডেয়ার ইউ টাচ হার? রাসকেল!শী ইজ মাই ওয়াইফ।যদি ওর শরীরে একটা টোকা দেওয়ারও চেষ্টা করিস,তাহলে তোর এই হাত আমি ভেঙে গুড়িয়ে দিব!
ওশানের নাক নিয়ে সাথে সাথে র**ক্ত গড়িয়ে পড়ল।রোশান স্যার এটুকুতে ক্ষান্ত হলেন না, ওশান কে আবার ও আঘাত করলেন নাক আর ঠোঁট বরাবর।ঠোঁট কেটে বেরিয়ে এলো র**ক্ত।ওশান জানে, বল-শক্তি কোনটাতেই সে তার ভাইয়ের সাথে পারবেনা।তাছাড়া যেভাবে রেগে আছে ওশানের প্রাণ বাঁচানোটায় দায় এই মুহূর্তে। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের রাগ মেটাচ্ছেন।ওশানের চোখে,মুখে কম হলেও ১০-১২ টা ঘুষি দিয়ে ওশান কে র**ক্তা**ক্ত করে ফেললেন।এতেও উনি শান্ত হলেন না।ওশানের গ* লা টি** পে ধরে রাখলেন।জিহবা খানিক টা বের হয়ে গিয়েছে।
শাশুড়ি তড়িৎ বেগে ছুটে গেলেন আর জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে বললেন,
‘ম** রে যাবে বাবা।ছাড় এবার।’
আমি কিছুই বলছি না।চুপচাপ দেখছি।কারণ ওশানের শাস্তির প্রয়োজন।এরই মাঝে শ্বশুর বাজার থেকে ফিরেছেন।বাজারের ব্যাগ ফেলে ছুটে এলেন।শ্বশুর -শাশুড়ি দুজনে মিলে উনার হাত ছাড়ালেন।রোশান স্যার রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
‘বলেছিলাম না যেদিন ধরব সেদিন ছা**ড়**ব না।এর আগে বহুবার ওয়ার্নিং দিয়েছি কানে যায়নি!তরীর সাথে যা করেছিস করেছিস আমি বারবার ছাড় দিয়েছি।কী ভাবতিস? আমি কিছুই জানিনা?সব আমার আড়ালেই হয়?আমি সব ই বুঝতাম শুধু মাত্র চুপ থাকতাম এই ভেবে যে, আস্তে আস্তে যদি সব ঠিক হয়ে যায়।সেপারেশন হয়ে গেলে রোহানের কষ্ট হবে।তুই নতুন বউ পাবি, তরীকেও বিয়ে দেওয়া যাবে ওই ছোট্ট বাচ্চাটার কী হবে?না পাবে মা,না পাবে বাবা।মা-বাবার সেপারেশন একটা বাচ্চার মনের উপর কী ভয়ানক প্রেশার পড়ে জানিস?তোর মত কুলাঙ্গার এটা কীভাবে বুঝবে!যার মা-বাবার সেপারেশন হয় সেই সন্তান জানে পৃথিবীটা কত বিষাক্ত।রোহান কোনদিন স্বাভাবিক একটা জীবন পাবেনা।শুধুমাত্র এই বাচ্চাটার জন্য আমি চুপ ছিলাম।কিন্তু আর নাহ!তুই তরীকে রেখে সারাহ’র গায়ে হাত দিয়েছিস।সারাহ’র দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালে আমি পৃথিবী দেখার জন্য তার চোখ ই রাখব না। “মাইন্ড ইট।”
শ্বশুর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘ছিঃ! ছিঃ! বড় ভাবির গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে!এই কুলাঙ্গারকে জন্ম দিয়ে সব থেকে বড় পাপ আমি করেছিলাম!’
শাশুড়ি বললেন, গায়ে হাত দিয়েছে কোথায়?ঝামেলার মাঝে ধাক্কা লেগে গিয়েছে।
উনি ওনার আম্মার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললে,
‘তুমিও মিথ্যা ও বলতে জানো আম্মা?’
‘না বাবা,আমিতো বউমাকে বলেছিলাম তুমি অসুস্থ মানুষ ওদের ঝামেলায় এসো না মা।’
‘আম্মা তুমি এসব জানতে না?তোমার ছেলে ঘরে বউ রেখে অন্য নারীতে আসক্ত জানতে না তুমি?’
‘জানতাম।’
‘শাসন করেছো কখনো?’
‘আমার কথা কি শোনে?’
‘কখনো বলেছ আমাকে বা বাবাকে?বলোনি।কারণ তুমি এর সম্পূর্ণ সাপোর্ট করে গিয়েছ।ছিঃ!আম্মা তুমি পরকিয়া সমর্থন করো!আমি একজন মটিভেশনাল স্পীকার। এসবের বিরুদ্ধে মটিভেশন দিয়ে থাকি।মানুষ তো আমার মুখে থু থু ফেলবে।যার আম্মা ছেলের পরকিয়া করে বিয়ে করাকে সমর্থন করে, তার ছেলে মটিভেশনাল বক্তব্য দেয়।’
শ্বশুর বললেন, ‘বিয়ে তোমার আম্মাকে দেওয়ার দরকার।আমার জীবনের সব থেকে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এই মহিলাকে বিয়ে করা।এই মহিলা কত খারাপ সেটা আমি ছাড়া কেউ জানেনা।সারা জীবনের লোভী মহিলা।আমি শাসন করতে গেলে উল্টো আমাকেই মা**র**তে আসে।জীবনের কী কুক্ষণে যে সম্পত্তির অর্ধেক এর নামে দিয়েছিলাম!কানের কাছে ফুসফুস করেছে তুমি যদি মরে যাও ছেলেরা আমাকে নাও দেখতে পারে।আমাকে লা**থি মেরে বাড়ি থেকে বের ও করে দিতে পারে।আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমার নামে কিছু সম্পত্তি দাও।আর তখন থেকেই ওর পাওয়ার বেড়েছে।ও জীবনে আমার আত্মীয়ের পাতে ভাত দিতে চাইনি।তোমার দাদুকে তো এ বাড়ি রাখা নিয়ে কত জুলুম করে।আমার ভাই -বোনদের থেকে আলাদ রেখেছে।এর বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে গেলেতো আমাকে আরেক টা বিয়ে করতে হতো।সংসারে আরেক অশান্তি শুরু হতো।তোমরা ভাবতে তোমাদের বাবার চরিত্রে সমস্যা ছিল এইজন্য দ্বিতীয় বিবাহ করেছে।তোমাদের মা ও তাই বুঝাতো।তোমরা সারাজীবন তাই ই জেনে আসতে।আমার ভাই-বোন,মা-বাবাকে কিছু দিলে চু**রি করে দিতে হয়েছে আমার।
‘বাবা আম্মার বিষয়ে আমি সব-ই জানি।আম্মা তো আম্মাই। সন্তান হয়ে তার বিচার কীভাবে করি?তার পায়ের নিচে তল বেহেশত।তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলাও পাপ।”
শাশুড়ি শ্বশুরের দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘এখন সব দোষ আমার।ঠিক আছে আমি খারাপ।এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। বিয়ে করলে না কেনো তখন ? আমি কি ধরে রেখেছিলাম?এখন ছেলে বৌমাদের৷ সামনে আমাকে খারাপ প্রমাণিত করছো!
‘যাওয়ার সময় ওই কু*লা*ঙ্গা*র কে নিয়ে যাও।আর আমি সব পুরুষকে পরামর্শ দিব বউ এর নামে যেন কেউ সম্পত্তি না দেয়।’
ওশান এবার আহত শরীরে গুঙিয়ে বলে উঠল, ‘আজ এর ফয়সালা হয়ে যাক।আমি তরীকে তিন তালাক দিয়েছি।আমি আর এক সেকেন্ড ও রাখব না তরীকে।তাতে যা হয় হোক।তোমরা অকারণ আম্মাকে দোষারোপ করছো।আম্মার কোনো দোষ নেই।’
‘তোমার আম্মা যে দুইটা ভাত খাচ্ছিল তা ভাল লাগছেনা।দাঁতে রস হয়ে গিয়েছে।এমন কষ্ট আসবে জীবনে ভাত ও পাবেনা।কথায় আছেনা” সুখে থাকলে ভূ**তে কিলাই।”এই মহিলার খুব খারাপ দিন আসবে।তরীর মত মেয়েকে পেয়ে গাঁধার খাটুনি খাটিয়ে নিল।তবুও বেচারি তরী ওর মন পেল না।এমন একদিন আসবে ও তরীর মর্ম বুঝবে।’
ওশান বলল, ‘আমি বেঁচে থাকতে আম্মার কোনদিন কষ্ট হবেনা।আমি এমন মেয়ে এনে দিব আম্মাকে মাথায় তুলে রাখবে।আম্মা তুমি কোথাও যাবেনা।ওই ফকিন্নির বাচ্চারে আমার মন থেকে তালাক দেওয়া হয়ে গিয়েছে।’
আমি আবার ও তেড়ে গিয়ে বললাম, ‘মুখ দিয়ে তিন তালাক উচ্চারণ করলেই কি অত সহজে তুমি রেহায় পেয়ে যাবে?
‘মুখে না হলে আমি কাগজে কলমে তরীকে ডিভোর্স দিব।আমার জীবন এটা, আমি কী করব, কী করব না সেটা আমার ব্যাপার। কেউ জোর করে আমার উপর কিছু চাপাতে পারবেনা।’
‘আমিও তরীকে বলব আইনের সাহায্য নিতে।দেখি তুই কত দৌঁড়াতে পারিস।আমি দৌঁড় করাব তোকে।আর একটা কথা আমি তরী নই, আমি সারাহ!একটু ভেবে চিন্তে লাগতে আসিস।ফলাফল খুব একটা ভাল হবেনা ওশান।আমাকে দূর্বল মেয়ে ভাবলে খুব ভুল হবে।এমন শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে।
তরী ও আর থাকবেনা তোর সাথে।’
তরীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি থাকবে ওর সাথে?’
‘না,ভাবি।আমিও ক্লান্ত।আর আমি ওর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিব না।ওর বিচার করবে আল্লাহ।’
তরী কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।রোশান স্যার তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে ওশানের দিকে তাকালেন।আমাকে ধরে নিয়ে রুমে চলে এলেন।আমি মন খারাপ করে বিছানায় বসে রইলাম।উনি আমার পাশে বসে কপালের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কপাল ফুলে উঠেছে কীভাবে?’
‘ও কিছুনা।’
‘বুঝতে পেরেছি।ওশান কে মা**র টা কম দেওয়া হয়ে গিয়েছে।’
আমি চুপ হয়ে রইলাম।মনের মাঝে অশান্তি লাগছে।কিছুই ভাল লাগছে না।কী করব এখন! আমি যদি এই মুহূর্তে কিছু মানুষের সমস্ত যন্ত্রণা মুছে দিতে পারতাম।তরীর সব যন্ত্রণা যদি মুছে দিয়ে একটা সুন্দর জীবন দিতে পারতাম!ছোঁয়াকে সব অশান্তি থেকে মুক্তি দিতে পারতাম তবেই বোধহয় শান্তি পেতাম।উনি কখন উঠে গিয়েছিলেন জানিনা।এক টুকরো বরফ এনে কপালে ডলে দিতে দিতে বললেন,
‘বা**ঘি**নীর মন খারাপ কেনো?’
‘আমি বা**ঘি**নী?’
‘তবে সন্দেহ আছে কোনো?এই অসুস্থ শরীরে যদি এত তেজ থাকে তাহলে সুস্থ থাকলে কী করতে আজ?’
‘আমার মাথা ঠিক ছিল না।রাগলে আমার মাথা কাজ করেনা।’
‘বুঝতে পেরেছি বিষয়টা।’
‘কী?’
‘আমার ফিউচার দেখতে পাচ্ছি।’
‘কী দেখলেন।’
‘রাগী চোখের স**র্ব**না**শ!’
‘আমার চোখে স★র্ব★না★শ?’
‘ভয়ংকর সুন্দর তোমার চোখ।আমি কখনো কারো প্রশংসা করিনি।এই প্রথমবার, তাও কোনো মেয়ের।’
‘কেনো প্রশংসা করলেন?’
‘স★র্ব★না★শা চাহনি দিলে প্রশংসা তো করতেই হয়।’
কী সব বলছেন উনি!আর আজ এত রেগে গেলেন কেনো?আমি যেন স্পষ্ট দেখলাম আমাকে ধাক্কা দেওয়াতে উনি রাগ কন্ট্রোল করতে পারলেন না।এসবের মানে কী?কেনো করলেন এমন।আমি যা ভাবছি সেটাও কী সম্ভব।ইশ কী লজ্জা!
আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি তরীকে একটা ফোন কিনে দিয়েছিলাম,চু**রি করে।কেউ জানে না।আপনি যে বললেন বাড়িতে ফোন রেখে এসছো ওটা তরীর ছিল। বাট তরী আপনাকে ভ**য়ে বলে নি।’
‘টাকা কোথায় পেলে তুমি?’
‘আমার কিছু জমানো টাকা ছিল।আর আমার এক ফ্রেন্ডের দোকান থেকে কিস্তিতে নিয়েছি।প্রতি মাসে দুই হাজার করে দিতে হবে।’
‘আর কত বাকি আছে?’
‘আট হাজার।’
‘দোকানদারের নাম্বার আছে?
‘কী করবেন?’
‘পেমেন্ট করে দিচ্ছি আমি।উনার বিকাশ নাম্বার টা জেনে দাও।’
‘আপনি দিবেন কেনো?আমি গিফট করেছি।আমি টাকা পরিশোধ করব।’
‘এই মুহূর্তে তো তোমার কাছে টাকা নেই।কীভাবে দিবে?’
‘কিস্তিতে নিয়েছি না।আস্তে আস্তে দিয়ে দিব।আপনার টাকা নিয়ে ঋণী হতে চাইছিনা।’
‘পরে শোধ করে দিও।’
‘আচ্ছা ফর্ম ফিল-আপ ৫০০০ ফোনের ৮০০০ এই ১৩০০০’।
‘আর বাকি টাকা?’
‘কীসের বাকি টাকা?’
‘তোমাকে বিয়ে করতে আমার যে খরচ হয়েছে সেটা কে দিবে?তোমাকে সাড়ে তিন লাখ টাকার গহনা +তোমার শাড়ি চুড়ি কসমেটিক্স অন্যান্য খরচ দিয়ে আরো দেড় লাখ গেছে।আমার শেরওয়ানি, বিয়ে উপলক্ষে দাড়ি শেভ করেছিলাম এসব খরচ ও লিখে রাখো।’
‘মানে কী?বিয়ে করেছেন নাকি ব্যবসা করেছেন।আমি এত টাকা কই পাব?’
‘আমি কীভাবে জানব সেটা?’
‘আপনাকে কি বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করুন?’
‘আমাকে দেখে ক্রাশ খাবা আবার বিয়ে করবা না তাতো হতে পারেনা।’
‘আপনাকে দেখে আমি কবে ক্রাশ খেয়েছি?
‘ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে কেনো?মেয়েদের অত্যাচারে কালো হয়েও শান্তি নেই।’
‘স্যার এর দিকে তাকালেও দোষ!আর আপনি মোটেও কালো নন।’
‘তাহলে?’
‘শ্যামসুন্দর!’
চলবে,,?
(