#একটুখানি_আশা
#মেহরাফ_মুন(ছদ্মনাম)
#পর্ব ৫
রাশিদা আহমেদ একনাগাড়ে মুখ চেপে ধরে কেঁদে যাচ্ছে। পাশেই বাকিরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। মুন গিয়ে তাঁর মাকে জড়িয়ে ধরলো।
-‘মা তুমি এভাবে কান্না করলে আমার কী যেতে মন চাইবে? কান্না করো না তো, আমাদের প্রতিদিনই কথা হবে, আমাকে প্রতিদিন দেখতে পারবে।’ মুন দুইহাতে ওর মায়ের চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল।
-‘দেখতে পারবো কিন্তু ছুঁতে তো পারবো না।’
-‘আহা মা। কয়েকবছরেরই তো ব্যাপার।’
রাশিদা আহমেদ চোখ মুছে নিয়ে নাক টেনে বলল,’প্রতিদিন সময় করে কল দিবি, খাবার ঠিকমতো খাবি, খাবারের অনিয়ম করবি না একদম।’
মুন রাশিদা আহমেদকে জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়ালো। তাঁর ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে কয়েকবছর আর এই মাকে সে পাশে পাবে না, ছুঁতে পারবে না, জড়িয়ে ধরে মায়ের আঁচলের ঘ্রান নেওয়া হবে না, এটা-সেটার বায়না ধরা হবে না। মুন মনে মনে ভেঙে পড়ছে কিন্তু উপরে সে শক্ত। দূরেই বিদায় দেওয়ার জন্য শফিক আহমেদ দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো বা কান্না করছে, কান্না ঢাকার জন্যই ঐখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। মুন একে একে চাচা, চাচি থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা ধরলো। পাশেই আরিফা মুনের হাত ধরে আছে।
-‘আপু আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে আর কিছু সময় পর তোমাকে আর পাবো না।’
-‘আরে সবসময় কথা হবে আমাদের।’
-‘তোমাকে ছাড়া আমার একা একা লাগবে আপু।’
-‘কেন রিহান আছে না?’ মুন হাসি চেপে ধরে বলল।
আরিফা মুনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই মুন আরিফাকে জড়িয়ে ধরে হেসে উঠলো।
বাবার কাছে যেতেই তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’ঠিকমতো থাকবে মা। বাবার দোয়া সবসময় তোমার সাথে আছে।’
হঠাৎ উপরে মনিটর থেকে আওয়াজ আসলো বোর্ডিং আওয়ার শেষ, যাত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে স্পিকারে বলছে। মুন উঠেই সবাইকে সালাম করে নিলো। যাওয়ার সময় কোনো কথা বলতে পারছে না। এতক্ষন উপরে শক্ত থাকলেও এখন আর পারছে না। কান্নারা যেন গলায় আটকে আসছে। নিজেকে যতাসম্ভব শান্ত রেখে মুন সবাইকে বিদায় জানিয়ে ঢুকে পড়লো। অস্বচ্ছ কাঁচের দরজা দিয়ে কিছুসময় বাবা-মার দিকে তাকিয়ে রইল মুন। বাবা-মা ওখানে দাঁড়িয়েই হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে।কাঁচ দিয়ে ঝাপসা দৃশ্যটুকু আবদ্ধ করে নিলো মুন । এরপর পা বাড়ালো নতুন জীবন সন্ধানের উদ্দেশ্যে।
সবকিছু ঠিকঠাক করে প্লেন ছাড়তেই মুন জানালা দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে নিলো। এখন বাবা-মায়ের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু এটা যে তাঁর ইচ্ছে। ছোটকাল থেকেই এই ইচ্ছেটা মনের ভেতর পোষণ করে আসছিলো মুন। আহানের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর মনে করেছিলো সবকিছু এখানেই শেষ। কিন্তু না! সে আবার সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগটা আর হাত ছাড়া করতে চায়নি মুন। আর আহান আগে-পরে কিছুদিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যাবে। তখন সে আবারও আসবে। এতকিছুর পরেও এখানে থাকার কোনো মানে হয় না। সবকিছুর উপরই আল্লাহ ভরসা। মুন জানে না ওই ভিনদেশে সে কীভাবে থাকবে! অবশ্য ফুফি আছে। শুনেছে ফুফির না-কি দুইটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছে। ছেলে একটা মুনের বড় আর দুজন যমজ। দুজনেই মুনের একবছরের ছোট। ফুফিকে কলে দেখলেও এদেরকে দেখা হয়নি। মুন জানে না এদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে কীনা, মিলেমিশে থাকতে পারবে কিনা, অস্বস্তি হচ্ছে। মুন এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো।
সাউন্ড আর ঝাঁকুনি অনুভব হতেই মুনের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলেই দেখল প্লেন ল্যান্ড করছে আর সাউন্ডে বলছে। একে একে সবাই নামার পরে মুনও নামল। নেমেই দেখল একেকজন একেকদিকে চলে যাচ্ছে। সবকিছুর উপর মাথায় আসলো তাঁর ফুফি তাঁকে নিতে আসবে। কিন্তু আশে-পাশে খুঁজে ফুফিকে দেখতে পেলো না মুন। এখন জাপানের সকাল। মুন এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে কাওকে না পেয়ে এক জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। মুনের এখন ভীষণ ভয় লাগছে। এই অচেনা দেশে ওর ফুফি ছাড়া আর কেউ পরিচয় নেই। ফুফির বাসার ঠিকানাও নেওয়া হয়নি, ফুফি বলেছিলো উনি নিতে আসবে। মুন চারদিকে তাকালো। কান্না পাচ্ছে খুব। কী করবে ও এখন? ভাবতেই ভয়ে দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো মুনের। মুন মাথা নিচু করে রইল। হঠাৎ কারো কণ্ঠস্বর শুনে মুন মাথা উঁচু করে দেখল এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। মুন তাকাতেই ওকে উদ্দেশ্য করে বলল,’মুন? রাইট?’
মুনের যেন এতক্ষনে কলিজায় পানি আসলো। সে তাড়াতাড়ি করে চোখের পানিটুকু মুছে নাক টেনে যুবকটির দিকে তাকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়লো। মুন বুঝতে পারলো ইনি হয়তো ফুফির বড়ো ছেলে।
যুবকটি মুনকে ইশারায় ওর পিছনে হাটতে বলে পা বাড়াতে নিলেই মুন ডাক দিল। মুনের ডাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই মুন তাঁর পাশের ব্যাগটা ইশারা করল। মুন এত ভারী ব্যাগটা তুলতে পারছে না।
যুবকটি ব্রু কুচকে মুনের সামনে এসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ইংরেজিতে বলল,’আমাকে কী চাকর মনে হয় যে তোমার ব্যাগ আমি বহন করব?’
মুন ওর কথা শুনে বোকা বোকা চাহনি দিয়ে ‘না’ বোধক মাথা নাড়ালো। ‘অতিথিকে কই সম্মান করে কথা বলবে তা তো দূর ব্যাগটা পর্যন্ত বহন করতে হচ্ছে, কেন কান্না করছিলাম একটু ভদ্রতা দেখিয়ে জিজ্ঞেসও করল না। একটু হেসে পরিচয়ও হলো না।’ মুন আপন মনে বিড়বিড় করে উঠলো।
যুবকটি আর কিছু না বলে ওভাবেই মুনকে ফেলে হাঁটা ধরলো। মুন তা দেখে কোনোমতেই ব্যাগটা নিয়ে ওর পিছনে দৌড় দিল।
গাড়িতে উঠতেই গাড়ি ছাড়লো যুবকটি। মুন আড়িচোখে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কাটলো।
গাড়ি এসে একটা সুন্দর বাড়ির সামনে এসে থামলো। যুবকটি গাড়ি থেকে নেমে মুনকে ফেলে আগে আগে হেটে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। মুন কোনোমতে ব্যাগটা নামিয়ে দরজার কাছে যেতেই ফুফি ব্যাগটা টেনে মুনের হাত থেকে নিয়ে একটা মহিলাকে ডেকে রুমে রেখে আসতে বলল। ফুফি মুনের মুখে হাত রেখে হাসি-মুখে বলল,’কত্ত বড়ো হয়ে গিয়েছিস আমার মুন মা-টা। কেমন আছিস মা? আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? রাফিন কোনোভাবে কী গাড়ি স্পিডে চালিয়েছে?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ফুফি। আরে না সমস্যা হয়নি। ঐটা কে?’
-‘এটা আমার বড়ো ছেলে রাফিন । পরিচয় হসনি?ছেলেটা একটু বেশিই গম্ভীর। আচ্ছা তুই আমার সাথে আয়। অনেক টায়ার্ড মনে হচ্ছে তোকে। আয় রুম দেখিয়ে দিই।’
মুন মাথা নেড়ে ফুফির পিছন পিছন হাঁটা ধরলো। রুমে ঢুকে ফুফি বলল,’তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি তারপর ঘুমাইস।’
-‘আরে না ফুফি। আমি ফ্রেশ হয়ে আগে একটু ঘুমাবো। আর ফুফি বাসায় কী কেউ নেই? কাওকে দেখলাম যে?’
‘ আর বলিস না! এই বাড়িতে একেকজন একেকসময়ে উঠবে ঘুম থেকে। সব আমার প্যারা। ছোট ছেলে-মেয়ে দুইটাও হলো বাবার মত। দুপুরে ঘুম থেকে উঠবে, কোথায় পড়াশোনা কোথায় কী? শুধু আমার বড়ো ছেলে রাফিন হলো আমার মত। সব কথায় শুনবে সে। তাই তো এত্তো সকালে ঘুম থেকে ডাকছিলাম আর উঠে তোকে আনতে গেছে। সবাইকে রাতে একসাথে পাবি তখন পরিচয় করিয়ে দিব। আচ্ছা এখন তাহলে ঘুমা মা ‘ বলেই ফুফি হাসিমুখে বেরিয়ে গেল।
মুন একটা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে এসেই শুয়ে পড়লো। বিছানায় শুতেই চোখে সব ঘুম রা এসে ধরা দিল।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন দয়া করে। ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত।)