বিয়ের পনেরো দিনের মাথায় বিদেশে চলে গিয়েছিল সামির। আজ সে ঘরে ফিরবে। সুমেহরার বুক কাঁপছে। অজানা এক ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিটা মুহূর্ত। রোমাঞ্চকর এক ভয়। ভয়টা কীসের, তা সে জানে না।
বিয়ের রাতে হুট করে শোবার ঘরে এসেছিল সামির৷ সুমেহরা তখন বিছানায় চুপ করে বসে আছে। বুকে উথাল পাথাল ঢেউ। কী হবে, কী হবে ভাবনা। আরো কত কী! কিন্তু সবকিছু মিথ্যে করে দিয়ে সামির সোজা এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সুমেহরার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না। একটা কথাও বলল না। সেদিন রাতে সুমেহরা নিঃশব্দে অনেক্ষণ কেঁদেছিল। সামিরের অমতে বিয়েটা হয়েছে বুঝি!
কিন্তু তার ভাবনা দ্বিতীয় দিনই মিথ্যে প্রমাণিত হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে কী এক কাজে বেরিয়েছিল সামির। ফিরতে ফিরতে রাত হলো। সুমেহরা ভেবেই বসেছিল, সামির ঘর থেকে পালিয়েছে। কিন্তু সব ভাবনা মিথ্যে করে দিয়ে সামির এল। তার হাতে একগুচ্ছ কদম। আশ্চর্য! সুমেহরার কদম পছন্দ সেটা সে জানল কীভাবে!
‘এভাবে বসে আছো কেন? সোজা হয়ে বোসো। তুমি আমাকে ভয় পাও নাকি?’ এটাই ছিল সামিরের প্রথম কথা। প্রথম প্রশ্ন। কিন্তু সুমেহরা এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না।
সামির সুমেহরার কাঁধে হাত রেখেছিল। এই প্রথম স্পর্শ। বলেছিল, ‘ভয় নেই। আমিও তোমার মতোই একজন মানুষ।’ বলে কদমগুচ্ছ এগিয়ে দিয়েছিল।
এইবার একটু ভরসা পেয়েছিল সে। কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে ধীর গলায় বলেছিল, ‘আমাকে আপনার পছন্দ নয় বুঝি?’
কী জানি কেন, সেদিন সামির তার প্রশ্নের জবাব দেয়নি। উদভ্রান্তের মতো উঠে বেলকনিতে চলে গিয়েছিল। এক চিলতে বেলকনি। ওপাশে সরু রাস্তা। তারপর পাঁচ তলা ভবন। দ্বিতীয় তলায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে চুল শুকাচ্ছিল। সামির সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সেই মেয়েটিকেই দেখছিল কি?
মেয়েটার গায়ের রং ধবধবে ফরসা। গায়ে ওড়না নেই। মাথার খোলা চুলে টাওয়েল পেঁচাচ্ছিল। সুমেহরার গা জ্বলে যাচ্ছিল যেন। এ মেয়ে অবেলায় এখানে এল কেন? কেন এল?
সুমেহরা বেলকনিতে গিয়ে সামিরের পাশাপাশি দাঁড়াতেই মেয়েটা হনহন করে ভেতরে চলে গিয়েছিল। তখনও উদাসীন ভঙ্গিদে ধোঁয়া ফুঁকছে সামির। দৃষ্টি তখনও ওপাশের ভবনের দোতলায়।
পরিবার বলতে সামিরের মা শুধু। বয়স্কা মহিলা। ঘরের কাজ-কাম তার দ্বারা সম্ভব না। আগে অবশ্য একজন মানুষ ছিল ঘরের সব কাজ করে দেবার জন্য। বিয়ের তৃতীয় দিনই তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সব কাজ এখন সুমেহরা করবে। অথচ কেউ একবার জিজ্ঞেস করেনি, রান্নাবান্না পারো তো? ঘর পরিষ্কার করা, বাসনকোসন ধুয়ে দেবার অভ্যেস আছে তো?
আঠারো বছর পেরিয়ে সবে উনিশ বছরে পা রেখেছিল তখন। একরকম বাচ্চা মেয়ে। নিজেকেই ঠিকমতো সামলে রাখতে পারে না। সংসার সামলাবে কী! চুল বেনি করে দেওয়ার কাজটাও মা করে দিতেন। এখন হুট করে…
কষ্ট করে মানিয়ে নিতে হয়েছে। সারাদিন কাজকাম শেষ করে রাতের খাবারের পর এঁটো প্লেট ধুয়ে ঘর গুছিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে দেখত, সামির নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এক পাশে কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়ত। কিন্তু ঘুম চোখে আসে না। আসে জল। চোখের জল মুছতে মুছতে কখন গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ত, তা সে নিজেও জানে না। মাঝে মাঝে মনে হত, কেন সে এ সংসারে? ঘরের কাজকাম করে দেবার বিনিময়ে দু’মুঠো ভাত? তা তো সে বাপের বাড়িতেই পেত! তাহলে এখানে কেন? সে কি সত্যিই এ-বাড়ির বউ? না কি নামমাত্র কাজের লোক? এ-বাড়ির লোকেদের কাছে তার চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে না? কিংবা, বাকি সব মেয়েদের মতো তারও কি বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না?
অবশ্য এতসব প্রশ্নের নামমাত্র জবাব পেয়েছিল সে। সামির চলে যাবার আগে বলে গেছে। সে কথায় পরে আসছি।
একদিন হলো কী, সুমেহরা ঘরের সব কাজ মিটিয়ে শোবার ঘরে এল। এসে দেখল বিছানায় সামির নেই। কী আশ্চর্য! এ-সময় মানুষটা গভীর ঘুমে থাকে। আজ ঘুমায়নি। বিশেষ কিছু ঘটতে চলেছে কি!
বিশেষ কিছু ঘটেছিল কি না সেটা কিছুক্ষণ পরেই জানা যাবে।
সুমেহরা একবার বেলকনিতে দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন বোধ করল। হ্যাঁ, ঠিক তাই। সামির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিনও আজকের মতো ভীত ছিল সে। রোমাঞ্চকর এক ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তাকে। বুকে উথাল পাথাল ঢেউ। কী হবে কী হবে ভাবনা।
সুমেহরার পরনে ছিল গাঢ় বেগুনি শাড়ি। হাতে কাচের চুড়ি। কানে সোনার ঝুমকো। কেন জানি হুট করে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করল। চট করে গিয়ে দাঁড়াল সেখানে। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল নিজেকে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দেবে কি? না থাক!
ধীর পায়ে সামিরের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। অজান্তেই চোখ পড়ল ওপাশের বিল্ডিংয়ের দোতলায়। সেদিনও মেয়েটা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। সুমেহরার চোখাচোখি হতেই মেয়েটা ইতস্তত করে দ্রুত ভেতরে চলে গেল।
সুমেহরা রাগে, ঘৃণায়, অপমানবোধে বেলকনি থেকে প্রস্থান করবে ঠিক করল। তখনই সামির খপ করে তার হাত ধরে ফেলল। বলল, ‘জোছনা দেখে যাও।’
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত জোছনা দেখল তারা। একসময় সামির জিজ্ঞেস করল, ‘ঘুম পেয়েছে?’
‘হুঁ।’
‘ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।’
‘আপনি ঘুমাবেন না?’
‘ঘুম আসছে না।’
‘কেন?’
‘মাথা ধরেছে।’
‘আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?’
‘দেবে? দাও!’
সামির শুয়ে পড়ল। সুমেহরা তার শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সারা রাত। কী প্রশান্তি, কী ভালো লাগছিল তখন! ঘুমঘুম চোখে বারবার সামিরের ঘুমন্ত মুখখানা চেয়ে দেখছিল সে। এতদিন লজ্জায় ভালো করে তাকায়নি।
সুমেহরা ভাবল, এবার ধীরে ধীরে দূরত্ব কমবে বুঝি। কিন্তু হলো উল্টো। সে রাতের পরে তাদের দূরত্ব আরো বেড়ে গেল। কোনো রকম প্রশ্ন করলে সামির ঠিকঠাক জবাব দিত না। সব সময় গম্ভীর ভাব নিয়ে বসে থাকত। সুমেহরা একটু কাছে ঘেঁষতে চাইলে সামির আরো দূরে সরে যেত। সামিরের মা সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। একদিন তিনি নিজে থেকে বললেন, ‘কিগো, সামিরের সাথে ঝগড়া-টগড়া হইছে নাকি?’
সুমেহরা চুপ ছিল। কী বলবে? সে তো নিজেও জানে না, কী হয়েছে।
সামির বিদেশে চলে যাবার আগের দিন রাতে সুমেহরা বলে বসল, ‘বিয়েটা আপনার অমতে হয়েছিল কি? অমতে হলে বলুন, আমি আপনার জীবন থেকে সরে যাব।’
সামির সেদিন হেসে কুটিকুটি হয়ে বলেছিল, ‘অবশেষে রাগ এল তোমার? আমি তো ভাবলাম, তুমি রাগতেই জানো না!’
‘আমি আপনার পছন্দ না, তাই না?’
‘কে বলল পছন্দ না? পছন্দ না হলে বিয়ে করলাম কেন?’
‘তাহলে, এত দূরত্ব। এত নির্লিপ্ততা। এসবের মানে কী?’
‘আহাহা, রেগে যাচ্ছো কেন! চার বছরের কথা। চার বছর পর তো ফিরেই আসব! তখন থাকবে না কোনো দূরত্ব। থাকবে না নির্লিপ্ততা। হলো? এবার হাসো। তোমাকে এমন গোমড়ামুখো মানায় না।’
সেদিন অনেক কষ্টে একটু হেসেছিল সে। ভেতর থেকে খুব করে কান্না আসছিল। ইচ্ছে করছিল মানুষটাকে জোর করে রেখে দিতে। কেন যাবে সে এতদূর? কেন?
দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেছে। আজ সে ফিরবে। রওনা হবার আগে ফোন দিয়ে বলেছে, ‘কী আনব তোমার জন্য?’
সুমেহরা লাজুক ভঙ্গিতে বলেছে, ‘কিচ্ছু লাগবে না, শুধু আপনি চলে আসুন।’
(চলবে)
গল্প : #একমুঠো_সোনালি_রোদ (পর্ব : এক)
মো. ইয়াছিন