১.
হবু দুলাভাই ওরফে ইশান স্যারের সামনে বউ সেজে বসে আছি আমি। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছি না। কে জানতো বিয়ের আগ মুহূর্তে বড় আপা এমন কান্ড ঘটিয়ে বসবে! বিষয়টা একদম কল্পনাতীত ছিলো আমাদের জন্য। আজ সকালে পার্লারে যাওয়ার পর থেকে খোঁজ পাওয়া যায় নি আপার। লোকজন পাঠানো হয়েছিলো। বাবাও লাগাতার ফোন করছিলেন।এক পর্যায়ে তিনি অস্থিরও হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আপা ফোন তুলেন নি। এমন নয় যে রিং হয় নি। প্রথমে বেশকয়েকবার রিং হয়েছিলো, কিন্তু পরক্ষণেই বন্ধ দেখাচ্ছিলো। অধিক চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন বাবা। লোকজন তখন কানাঘুষো শুরু করে দিয়েছিলো। আপা পালিয়েছে। বাবার সাথে আমিও অসাড়ের মতো বসে পড়েছিলাম। আপা টাও শেষমেষ মায়ের পদচিহ্ন অনুসরণ করলো? এরইমধ্যে কেউ একজন বলেছিলো, ‘বড় টা চলে গিয়েছে না জানি ছোট টাও না চলে যায়। যেমন মা তেমন মেয়ে। বুঝি না বাপু..’
সেই মুহূর্তে বাবা ভয়ংকর রেগে গেলেন। কোনোদিক বিবেচনা না করে আপার পরিবর্তে আমাকে বিয়ের পিড়ীতে বসিয়ে দিলেন। বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলাম আমি।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিলো পাত্রপক্ষ এ নিয়ে কোনোরুপ দিরুক্তি করে নি। এমনকি আজেবাজে ঝামেলাও করেন নি। তবুও তাদের মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তারা কতটা আশাহত হয়েছেন। ইশান স্যারকে তো একফোঁটা কথা বলতে দেখে নি। রাগী থমথমে মুখে বসেছিলেন তিনি। আর আমি? আমি বসেছিলাম বিষণ্ণ চেহারায়। অন্যকারো মুখেও হাসি -তামাশার ছিঁটেফোঁটাও ছিলো না। এমন মনে হচ্ছিলো, চারদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার। আমার জন্মের সময়ও নাকি ঠিক এমন অন্ধকার ছিলো সবার মুখশ্রীতে। কারণটা অবশ্য মেয়ে হয়ে জন্মেছিলাম বলেই। শুনেছিলাম ছেলে সন্তানের আশায় ছিলো পরিবার-পরিজনরা। সেখানে যেনো আমি মেয়ে হয় জন্মে হাতে হাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছিলাম। তখন কারো উপর অভিমান করতে না পারলেও এখন এইসময়ে ঠিকই অভিমান করলাম। ভীষণ অভিমান,হুহ্! বাবা কীভাবে পারলো এমনটা করতে? আমার কি কোনো মতামত নেই? মানলাম মা চলে যাওয়ার পর থেকে বাবা আমাকে পছন্দ করেন না। তাই বলে মতামত ছাড়া বিয়ে দিয়ে দিবেন? আচ্ছা মতামত বাদ দিক, আমার বয়সের দিকে তো নজর করতো।
আমি ভীষণ রাগ করলাম। বিদায়ের সময় বাবার দিকে একবার ফিরেও তাকালাম না। সবার আগে নিজে নিজে এসে গাড়ীতে বসেছিলাম। লোকজন হয়তো অবাক হয়ে দেখছিলো। জানি সাথে হয়তো কুৎসা ও রটিয়েছিলো। রটাক, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। এখন এসব কথা বললেও কিছু না আর না বললেও কিছু নয়। মানুষ অতি সামান্য পরিমাণ দুঃখ পেলেও কাঁদে আর আমি অতি দুঃখেও পাথর হয়ে যাই। এক ফোঁটাও কাঁদি নি। উহু, কাঁদি নি বললে ভুল হবে কাঁদতে পারি নি। আমি আবার খুব বেশি কষ্ট পেলে কাঁদতে পারি না। আবার কখনো দেখা যায় খুবই তুচ্ছ বিষয়তেও কেঁদে দেই। এই যেমন সে-বার বাবা আপার জন্য কাঠগোলাপ ফুলগাছ এনেছিলো আর আমার জন্য লাল গোলাপ গাছ। আমি কেঁদে-কুদে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। এটা নিশ্চই কান্না করার জন্য বড় বিষয় নয়,তাই না? তবুও কেঁদেছিলাম। ভাবনা-চিন্তার সুতো লম্বা করলাম না। মাথা তুলে উপস্থিত ব্যক্তিকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ইশান স্যার বিয়ের পোশাক বদলাচ্ছেন। মুখের অবস্থা নাহয় বর্ণনা না করলাম। গটগট পা ফেলে এদিকেই আসছেন। আমি সোজা হয়ে বসলাম। ভান ধরলাম এমন যে তাকে দেখতেই পাই নি।
স্যার বিছানার কাছে এসেই প্রথমেই বললেন,
—সং সেজে বসে থাকার তো কোনো কারণ নেই। আমাদের লুতুপুতু প্রেম ছিলো না যে এমন তিনহাত গোমটা দিয়ে বউ সেজে বসে আছেন।
শরীরে যেনো সুই চুকলো। সুক্ষ ব্যাথা দাত চেপে হজম করলাম। শান্ত স্বরে বললাম,
— বাসর রাতে এভাবে বসে থাকতে হয়। এটাই নিয়ম।
স্যার ঝাঁঝালো গলায় বললেন,
—কে বানিয়েছে এমন নিয়ম? আমি তো শুনি নি। আর যদি বানানো হয়েও থাকে, সেটা তোমার আর আমার জন্য নিশ্চই নয়।
—- ভুল হয়েছে। আজ কেনো জীবনে আর কোনোদিন এভাবে আপনার সামনে বসবো না।
গরম তেলে রসুন বাগার দেওয়ার মতো জ্বলে উঠলেন স্যার। গলা উঁচু করে বললেন,
— মুখে মুখে জবাব দেওয়া। এতকিছু করার পরেও এত তেজ আসে কই থেকে? লাজ-লজ্জার এত কমতি তোমাদের মধ্যে? অবশ্য কাদের লাজ-শরমের কথা বলছি আমি? কামারের দোকানে কোরআান শরীফ পড়ার মতো। হাহ্!
মাথা তুলে কড়ে কথা বলার প্রস্তুতি নিতেই দেখলাম স্যার এখনো এদিকে আসছেন। আশ্চর্য তো! তার মানে কি আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম?ইশশ! বড্ড বোকা আমি। প্রথমেই বোঝা উচিত ছিলো। এ লোকটা এত কথা বলবে তাও অহেতুক এমনটা ভাবা তো দূর চিন্তা করাও উচিত নয়। আমার ধারনা ভদ্রলোকের দিকে বোম মারলে সে বোমও ফিরে চলে আসবে। এসেই অত্যন্ত দুঃখী গলায় বলবে, ‘ ওদিকে ছুঁড়ে আমার অপমান করো না। ‘
স্যার ঠিক এতটাই গম্ভীর। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তার কন্ঠনালী থাকা উচিত হয় নি। তার বদলে কোনো বোবা মানুষের থাকলে সে দিব্যি কথা বলে তার সদ্ব্যব্যবহার করতো।
ভদ্রলোক শান্ত কন্ঠে বললেন,
— আমার সাথে শুতে চাইলে বিছানায় শুতে পারো।
বাক্যটি কর্ণগোচর হতেই শরীর শিউরে উঠেলো। গা ঘিন ঘিন করতে লাগলো। আমার ফর্সা হাতের ঘুমন্ত লম্বা লম্বা লোমগুলোও জেগে উঠেছে। দাড়িয়ে পড়লাম। বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লাম। স্যার কালবিলম্ব না করে নিঃশব্দে বিছানায় একপাশ হয়ে শুয়ে পড়লেন। কোনোরুপ কথা বললেন না,শুধুই ফোঁসফোঁস করছিলেন। বুঝলাম,আপাকে আজেবাজে কথা শুনাচ্ছেন। এর কিছুক্ষণবাদেই তার গাঢ় নিঃশ্বাস শুনতে পেলাম। ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চই! বিষয়টা টের পেতেই মুখ চেপে ফু্ফিয়ে উঠলাম। এত বিশ্রি কথা না বলে যদি সিনেমার মতো বলতেন আমি তোমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে পারবো না, তুমি মেঝেতে ঘুমাও। বিশ্বাস করুন, আমি একটুও কষ্ট পেতাম না। কারণ ওটা স্বাভাবিক এবং এক্সপেক্টেড। কিন্তু এটা খুবই অস্বাভাবিক। এমন কথা কেনো বলবেন? তিনি কি বুঝাতে চান আমি তার সাথে শোয়ার জন্যই বিয়ে বসেছি নাকি আমি বাজারের মেয়েছেলে। ঠিক ধরতে পারলাম না এ কথায় এত কষ্ট কেনো পেয়েছি? মুখের উপর কড়া কথা শুনিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো কিন্তু দিলাম নি। আমি আবার সবার সাথে কথা বলতে পারি না, যাদের পছন্দ নয় তারা যদি মাইক দিয়ে চিল্লিয়ে কথা বলে তবুও আমি চুপ ই থেকে যাই। একচুয়েলি, আমি খুবই চাপা স্বভাবের মেয়ে। সবার সাথে হেসেখেলে কথা বলতে পারি না। কিন্তু মাধবি আপা আমার মতো না। সে খুবই হাসিখুশি। মুখের উপর কথা বলে দেয়। যা আমি পারি না। আমাদের দুজনকে দেখতে কিন্তু প্রায় একই রকম দেখায়। প্রথম প্রথম কারো সাথে দেখা হলে সে বলবে, ‘ এই দাড়াও দাড়াও,তুমি মাধবি নাকি প্রভাতি? কিংবা বলবে দেখি তো আমি তোমাদের চিনতে পারি কি না, তুমি মাধবি আর ও প্রভাতি তাই না…..’ এমন টাইপ কথাবার্তা। আমরা কিন্তু জমজ নই, তবুও আমাদের অদ্ভুত রকম মিল খুঁজে পায় লোকজন। এ নিয়ে এক সময় বাবার ভেতর গোপন গর্ভ টের পেতাম। সময়ের আবির্ভাবে তা বিলীন হয়ে বিরক্তির কারণ ঠেকেছিলো তাহার নিকট। যা স্পষ্ট ছিলো আমার কাছে।
মাধবি আপা আমার এক বছরের বড়। আমরা শুধুমাত্র দু-বোন। আর কোনো ভাই বোন নেই, মাও নেই। তিনি কই আছেন এ ও জানা নেই।দিনটা ঠিক মনে নেই। বৈশাখ কি জৈষ্ঠ্য মাসের পড়ন্ত দুপুরে স্কুল থেকে এসে শুনেছিলাম মা আনোয়ার চাচার সাথে চলে গিয়েছেন। আনোয়ার চাচা আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন। ইলেকট্রিক কাজকর্ম জানার সুবাধে আনোয়ার চাচার বেশ আনোগোনা দেখা যেতো আমাদের ঘরে। বাচ্চা বয়সে কি বুঝতাম? তবুও কোনো এক অজ্ঞাত কারণবশত সেই সময়ে তাকে আমার পছন্দ ছিলো না। কেনো করতাম না তা মনে নেই। তবে তিনি আসলে মা কে বেজায় খুশি দেখাতো।মা নতুন নতুন রেসিপি বানিয়ে আনোয়ার চাচাকে খেতে দিতেন। দেওয়ার পূর্বে আমাকে বা আপুকে একপাশে টেনে নিয়ে একটুখানি খেতে দিয়ে বলতো,’ হ্যা রে, কেমন হয়েছে? লবণ হয়ছে কিংবা ঝাল হয়েছে কিংবা মিষ্টি হয়েছে?এসব…’ আপুকে দেখতাম কালো মুখ করে বলতো ‘খুব মজা হয়েছে।’ আপুর কালো মুখের জোড়ালো কারণ ছিলো। কারণ টা হলো মা যেটুকু বানাতেন তা চাচাকে খেতে দিতেন। অবশিষ্ট থাকলে সেটুকুও পলিথিন ব্যাগে করে দিয়ে দিতেন। আমরা যে ছোটছোট দুটো বাচ্চা রয়েছি তার খেয়াল হয়তো থাকতো না। মাঝে মাঝে বাবাও ভালো কিছু রান্না হলে বলতেন মিয়া সাহেবকে একটু দিয়ে আসো। মা খুশিখুশি মুখে বাটিভর্তি তরকারী আমাদের দিয়ে পাঠাতেন। কিংবা তিনি নিয়ে যেতেন। যাবার সময় অবশ্য হালকা সেজে নিতেন। মা কে দেখতে তখন ইন্ডিয়ান নায়িকা মাধুরি থেকে কোনো অংশে কম লাগতো না। আজোও স্পষ্ট মনে আছে সেই মুখশ্রী। অথচ কতশতবার ভুলে যেতে চেষ্টা করেছিলাম।এমনকি এখনো করছি। কিন্তু ভুলতে পারছি না। কেনো পারছি না জানা নেই। এটা নিশ্চই মনে রাখার জন্য কোনো সুখের স্মৃতি নয়, তাই না? সেজন্য আমিও ভুলে যেতে চাই।
চোখদুটো বন্ধ করে রেখেছি অথচ ঘুমের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাচ্ছি না। আজ আর বোধহয় ঘুম আসবে না। এই মুহূর্তে আপার জন্য আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। এমন তো নয় যে আপার প্রেমিক আছে,আপা তার সাথে চলে গিয়েছে। তাহলে আপা গেলো কই? আচ্ছা, কেউ অপহরণ করে নি তো? আপার কোনো ক্ষতি হয়ে গেলো না তো? ভাবতেই বুকটা মুচড় দিয়ে উঠলো। ইশশ আগে কেনো এসব ভাবি নি। তড়িঘড়ি উঠে বসলাম। বসার পরপরই একজোড়া সবুজ চোখ আমাকে নিবীড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখতে পেয়েই শিউরে উঠলাম। এত রাতে কি বা কে হতে পারে? আর এমনভাবে তাকিয়ে আছে কেনো? ভয়ে দিলাম গলা ফাটিয়ে চিৎকার।
‘আল্লাহ,আল্লাহ। আ আ আ….’
চিৎকারের সাথে লাফাচ্ছিও বটে। ইতোমধ্যে শরীর শিউরে উঠেছে। হাতের শিরা উপশিরায় কাটা দিয়ে উঠেছে। পা-জোড়া এলোমেলো ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক ফেলে চলেছি। আমি যখন খুব বেশি ভয় পাই তখন এমন করি। অবশ্য ভয় খুব কম সময়ে পাই। অদ্ভুতভাবে মা চলে যাবার পর আমার ভয়ের পরিমাণ কমে গিয়েছিলো। এর রহস্য আজোও জানা নেই আমার।
হঠাৎ আমার পা দুটো থেমে যায়। উহু, থেমে যায় নি, থামানো হয়েছে। একজোড়া পুরুষালী শক্তপোক্ত হাতের বাহু-বন্ধনে আটকে আছি। নড়াচড়ার কোনো উপায় নেই।ঘন তম্রিসাতেও হাতজোড়ার মালিককে স্পষ্ট চিনতে পারলাম। মুখ দিয়ে অস্ফুট সুরে বেরুলো “ইশান স্যার!” লোকটার শরীর থেকে অদ্ভুত ঘ্রাণ ভেসে নাকে লাগছে। চেতনা শক্তি কমে যাচ্ছে। হয়তো চেতনা হারিয়ে ফেলবো। সন্ধ্যা থেকে মাথা ঘুরাচ্ছিলো। বিয়ের টেনশন ভেবেই পাত্তা দেই নি। এখন তা তীব্র বিষধর হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে দাড়ানোর শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলছি। এক্ষুণি হয়তো ঢলে পড়বো। ঢলে পড়লে হবে না তো। আমার তো ইশান স্যারকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাতে হবে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ!যার উপর নির্ভর করছে জীবন-মরণ। চারপাশ ঘোলাটে হচ্ছে, একই বস্তুর ডাবল প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। কোনোরকম ইশান স্যারের প্রতিচ্ছবির দিকে হাত বাড়ালাম। অস্পষ্ট সুরে বললাম,
–‘স্্ স্যার….’
চলবে?
গল্পের নাম— #এবং_তুমি
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১