#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_১০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
ভোরের আকাশে আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ হলো। আভা এখনো কাথা মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। এক হাত মাথার নিচে রেখে গুটিশুটি মেরে বিছানায় শুয়ে আছে ও।
হঠাৎ আভা’র মা হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলেন। রুমে এসেই তিনি জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন। সঙ্গেসঙ্গে এক ছটাক আলো এসে ধাক্কা খেলো আভার মুখে। আভা ভ্রু কুঁচকে নিলো। আভা’র মা এবার জানালার থাই গ্লাস খুলে দিলেন। রোদের আলো এবার তীব্ররূপ নিলো। আভা বিরক্তিতে পাশ ফিরে ঘুমালো। সেইসাথে চোখ হালকা মেলে বিড়বিড় করে বললো,
— “প-র্দা দা-ও। ঘু-ম পাচ্ছে। ”
আভা’র মা এবার মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে একটানে শরীরের কাথা সরিয়ে ফেললেন। আভা প্রচুর বিরক্তিতে চোখ খুললো।মা তার গড়গড় করে বললেন,
— ” আহনাফের মা আসবে একটু পর, তোর এনগেজমেন্টের জিনিস দিতে। সাথে তোকেও দেখে যাবে। উঠে যা। উনি এসে তোকে ঘুমুতে দেখলে কি বিচ্ছিরি লাগবে দেখতে। উঠে যা,উঠ..উঠ।”
আভা ভ্রুতে ভাজ ফেলে খানিক চেয়ে রইলো নিজের মায়ের দিকে। তারপর একটা হাই তুলে ঘুমন্ত কণ্ঠে বললো,
— ” উঠছি, তুমি যাও। ”
আভা’র মা রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে আরো একবার ঘুম থেকে উঠার জন্য তাড়া দিয়ে গেলেন। আভা শুয়ে শুয়ে একবার এপাশ থেকে ওপাশ করে শেষ পর্যন্ত উঠে বসলো। বিছানা গুছিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
ওয়াশ্রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই বসার ঘর থেকে হইচই শুনতে পেলো। আন্টি কি তবে এসে গেছেন? আভা মুখ-চোখ ঠিক করে গায়ে ওড়না জড়ালো। মাথায় কাপড় দিয়ে বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
আহনাফের মা মিসেস শেখ আর আভা’র মা মিসেস জুনায়েদ একসাথে বসে গল্প করছেন। দুজনের হাতেই চায়ের কাপ। দূর থেকে মিসেস শেখকে দেখে আভার খুব শৌখিন মনে হলো। শরীরে জড়ানো নীল জামদানি শাড়ি। হাতে দুটো মোটা স্বর্ণের চুড়ি। ফর্সা গলায় চিকন চেইন। আহনাফ হয়তো ওর মায়ের মতই হয়েছে। একই গঠন দুজনের। তবে আহনাফের বাবাকে দেখা হয়নি এখনো। তাই এখনই গঠন যাচাই করা হয়তো ঠিক না। আভা তাই সেসব চিন্তা মাথাঝাড়া দিয়ে এগিয়ে গেলো দুই মায়ের দিকে।
— ” আসসালামুআলাইকুম আন্টি। ”
আভা মিসেস শেখের পাশে দাড়িয়ে সালাম দিলো। মুখেই সালাম দিলো ও। পা ধরে সালাম করা বাবার মানা,তাই। মিসেস শেখ আভা’র দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন। হাত দিয়ে উনার পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বললেন,
— ” এসো, বসো। ”
আভা খানিক ইতস্তত করে মিসের শেখের পাশে বসলো। হাত দুটো একসাথে নিজের কোলের উপর রেখে অনবরত কচলাতে লাগলো। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। নাকের নীচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এই মুহূর্তে মিসেস শেখকে তার একটা ভয়ংকর মহিলা মনে হচ্ছে। কিন্তু কেনো মনে হচ্ছে সে জানেনা।
হঠাৎ মিসেস শেখ দুহাতে কোলে রাখা আভার হাত ধরলেন। আভা চমকে উঠলো। নিজের হাতের দিকে একবার চেয়ে আবারও উনার দিকে তাকালো। মিসেস শেখ হেসে বললেন,
— ” আমি কিন্তু খুব বাজে শাশুড়ি হবো না আবার খুব ভালো-ও হবো না। ”
আভা খানিক ভয় পেলো। চোখের পাতা অস্বাভাবিকভাবে নাড়িয়ে বললো,
— ” মানে? ”
মিসেস শেখ হেসে আভার একসাথে রাখা দুহাত আলাদা করলেন। ঘর্মাক্ত হাতের দিকে চেয়ে আবারও আভার দিকে তাকালেন। বললেন,
— ” আমাকে অযথা ভয় পেলে আমি কিন্তু খপ করে ধরে ঝপ করে জড়িয়ে ধরবো। তখন তোমার ভয় সব ভ্যা ভ্যা করে পালাবে। সো বি কেয়ারফুল। ”
আভা কিছুক্ষণ মিসেস শেখের দিকে তাকিয়ে আচমকা ফিক করে হেসে ফেললো। আভার সাথেসাথে হাসলেন মিসেস শেখ-ও। আভা’র মা চোখ স্থির করে মেয়ে আর মেয়ের হবু শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে মুখে প্রশান্তি কাজ করছে তার। বুকের ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। এমন শাশুড়িও হয়? মেয়ের তো রাজকপাল..!
আভা’র মা সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মিসেস শেখ উনার দিকে তাকালে আভা’র মা হেসে বললেন,
— “আপনারা গল্প করুন। আমি কিছু একটা বানিয়ে আনছি।”
সৌজন্যতার জন্যে মিসেস শেখ বাঁধ সাধলেন। তাড়াহুড়ো করে বললেন,
— ” আরে বসুন তো। কিছু করা লাগবে না। আপনি এখন গল্প করুন আমাদের সাথে। ”
মিসেস জুনায়েদ মানলেন না। আভা আর আহনাফের মা’কে একা রেখে তিনি রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। মেয়ে কতক সময় হবু শাশুড়ির সাথে কাটাক। বিয়ের আগে কথাবার্তা হয়ে সহজ হয়ে নেওয়া ভালো।
মিসেস শেখ এবার আভার দিকে ঘুরে বসলেন। আভার মুখে চেয়ে বললেন,
— ” তুমি ভারী মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার তোমাকে কিন্তু অনেক ভালো লেগেছে। ”
আভা লজ্জামাখা মুখ নিয়ে হাসলো। মিসেস শেখ এবার মুখ দুঃখী করে বললেন,
— ” তুমি কিছু বললে না। তোমার আমাকে ভালো লাগেনি?”
আভা ব্যতিব্যস্ত হলো। তাড়াহুড়ো করে বললো,
— ” না, না।খুব ভালো লেগেছে।”
মিসেস শেখ মুচকি হাসলেন। কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে ধীরে-সুস্থে বললেন,
— ” জানো, আহনাফ যেদিন তোমার ছবি দেখিয়ে বললো, দুনিয়া উল্টে গেলে সে এই মেয়েকেই বিয়ে করবে,আমার না খুব রাগ হয়েছিলো। ছেলে আমার বরাবরই খুব জেদী। কখন কি পছন্দ হয়ে যায়, বলা মুশকিল। কিন্তু তার কথা শুনে তোমার ছবির দিকে যখন তাকালাম তখন একমুহূর্তে মনে হয়েছিলো, আহনাফের চয়েসের উপর ভরসা করা যায়। আহনাফের বাবাকে ছবি দেখালাম। তারও খুব পছন্দ হলো। ব্যাস, সেদিনের ঘটনা বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে গেলো।”
আভা অবাক হয়ে তাকালো মিসেস শেখের দিকে। আহনাফ তাকে আগে থেকেই পছন্দ করে সেটা ও বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু ছবি? সেটা কোথায় পেলেন? লুকিয়ে তুলেছেন? কখন?
কয়েক সেকেন্ড পর আভা’র মা হাতে একটা ট্রে নিয়ে বসার ঘরে এলেন। ট্রেটা সোফা সংলগ্ন টেবিলে রেখে দিলেন। ট্রে তে তিন প্লেট করে নুডলস এবং পুডিং রাখা। সাথে তিন গ্লাস ঠান্ডা পানি। আভা’র মা পুডিং খুব ভালো বানান। মেয়ের শাশুরিকে নিজের শ্রেষ্ঠ ডেজার্ট-টাই হয়তো খাওয়াতে চান।
আভা নিজে সবার হাতে নুডলসের প্লেট তুলে দিলো। আভা’র মা আর মিসেস শেখ খেতে খেতে পরস্পরের সাথে গল্প করছেন। আভা একপাশে বসে নুডলস খাচ্ছে আর ওদের কথা শুনছে।
মিসেস শেখের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আভা’র দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,
— ” এনগেজমেন্টের সব তোমার মায়ের কাছে দিয়ে দিয়েছি। সমস্যা আছে কিনা দেখে নিও। যদি কোনো সমস্যা হয় তবে ফোন দিও। ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিবো। এনগেজমেন্টের দিন। বুঝই তো। কত ব্যস্ততা! ঠিক আছে?”
আভা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বললো,
— ” মনে থাকবে আন্টি। ”
মিসেস শেখ হঠাৎ-ই ভ্রু কুচকালেন। বললেন,
— “আন্টি…? ”
আভা এই কথার উত্তরে কি বলবে ভেবে পেলো না। বিয়ে তো হয়নি এখনো। এখন তো আন্টি-ই ডাকবে। মিসেস শেখ আভাকে বিচলিত হতে দেখে হেসে বললেন,
— ” ঠিক আছে। আন্টি-ই ডাকো। তবে এই ডাকটা কিন্তু বিয়ের আগ অব্দি। বিয়ের পর মা-ই ডাকবে। মনে থাকবে? ”
আভা শান্ত হলো। ও নিজেও হেসে বললো,
— ” মনে থাকবে। ”
মিসেস শেখ সবাইকে বিদায় দিয়ে চলে গেলেন। আভা সদর দরজা লাগাতে গিয়ে ভাবলো,
মহিলাটা দারুন ছিলেন। যতটা খারাপ ভেবেছিলো ততটা খারাপ না। সত্যি বলতে উনাকে খুবই ভালো একজন শাশুড়ি বলা যায়। এসব ভেবেই আভার বুকের ওপর থেকে মস্ত বড় এক ভার নেমে গেলো। এখন শান্তি লাগছে।
#চলবে
গত পর্বে ভুলে কদম ফুলের কথা লিখেছিলাম। একজন ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে বকুল ফুল লিখেছি। গল্প কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না। হ্যাপি রিডিং।