#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
–“হ্যালো,মিস বউফ্রেন্ড!”
আহনাফের কণ্ঠ শুনে আভা ধড়ফড়িয়ে বালিশ ছাড়লো। একাংশ কারুকাজ করা পালঙে পিঠ দ্বারা হেলান দিয়ে চমকিত কণ্ঠে বললো,
— ” আপনি?”
— “আমি ছাড়া কারো সাহস আছে তোমায় ডিস্ট্রাব করার?”
আহনাফের নির্লিপ্ত উত্তর শুনে আভা খানিক অবাক হলো। এই ছেলে অনেক শেয়ানা আছে! আভা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রুমজুরে পায়চারি করতে করতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। ঝড় হবে কি আজ? বেশ কদিন ধরে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই আকাশের মন খারাপ হয়। অযথাই আকাশের চোখ বেয়ে জল গড়ায়। আজও কি এমন হবে? আভা আবার প্রশ্ন করলো,
— ” আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়? আমি তো দেইনি।”
আহনাফ নিজে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে চোখ নিবদ্ধ রেখে উত্তর করলো,
— ” হবু বউয়ের নাম্বার হবু জামাইর কাছে থাকা কোনো ব্যাপার না, মিস বউফ্রেন্ড।”
আভা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না, নাম্বারটা তার একমাত্র মা-ই উনাকে দিয়েছেন। আভা ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। ওপাশের মানুষটা চুপ। আভা শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” কিছু কি বলবেন? ”
আহনাফ মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
— ” আচ্ছা, তুমি কখনো কারো দুঃখে খুশি হয়েছো? ”
আভা অবাক হলো। এটা আবার কিধরণের প্রশ্ন! আভা উত্তর করলো,
— ” না তো। ”
— ” কিন্তু আমরা মানুষরাও কখনো কখনো কারো দুঃখে খুব খুশি হয়। খুশির কারণে আমদের মন নাচতে থাকে। আন্দোলিত হয়। জানো সেটা? ”
— ” কিসব বলছেন? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ”
— ” এই ধরো তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করো। কিন্তু এটা কি জানো যখন বৃষ্টি হয় তখন আকাশের মন খুব খারাপ থাকে। সে তখন মন খারাপ করে হুহু করে কান্না করে। আর তার কান্নার ফোঁটা আমাদের কাছে বৃষ্টি হয়ে নামে। আর তুমি তখন খুশি হয়ে সেই বৃষ্টিতে ভেজো। ”
আভা অবাক হলো। চোখের পাপড়ি খানিক কেপে উঠলো।এমন করে ত কখনো ভেবে দেখিনি ও। লোকটার কথা দারুন তো! আভা নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। আহনাফও চুপ করে রইলো খানিক। একটা মেয়ের নিঃশ্বাসের শব্দও এত মধুর হয়! আহমাদ স্তব্ধ হয়ে শুনলো। মসজিদে আসরের আযান দিচ্ছে। একটু পরেই আভার ভাই আর বাবা নামাজে বের হবে। আভার খোঁজ করবে তখন। আভা তাই বললো,
— “ব.. আযান দিচ্ছে। ”
— “ওহ সরি। শুনিনি আমি। রাখছি তাহলে। নামাযে যেতে হবে। ”
আভা ছোট্ট করে বললো,
— ” আসসালামুয়ালাকুম। ”
আহনাফ ” বাই” বলতে যাচ্ছিল। আভার মুখে সালাম শুনে সে মৃদু হেসে বললো,
— ” ওয়ালাইকুম আসসালাম। রাখছি। ”
ফোন কেটে গেলো। “টুট টুট”। আজকে আর ঘুম হবে না। আভা রুমে এসে বালিশের কাছ থেকে দুমড়ে মুচড়ে রাখা ওড়না নিয়ে গায়ে জড়ালো। তারপর বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
ড্রইং রুম থেকে জুনায়েদ এর গলা শুনা যাচ্ছে। আভাকে জোর গলায় ডাকছেন তিনি। আভা মাথায় কাপড় দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলো বাবার দিকে।তার বাবা কাধে জায়নামাজ ঝুলিয়ে মার সাথে কথা বলছেন। আভার ভাই মিনহাজ টুলে বসে জুতো পড়ছে। আভা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো জুনায়েদ মেয়েকে দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন,
— ” কই তুমি? আমরা চলে যাচ্ছি। দরজা কে লাগাবে? ”
আভা কিছু বলার আগেই মিনহাজ এসে দাঁড়ালো বাবার পাশে। আভার মাথায় হুট করে এক চাটা মেরে বললো,
— ” সবসময় দরজা লাগানোর জন্য এই বুচিরে কেনো ডাকো তুমি। মা আছেন তো।”
আভা মাথায় হাত ঘষে গাল ফুলিয়ে বললো,
— ‘ ভাই, তোমারে সত্যিই একদিন আমি খুন করে ফেলবো। বারবার মাথায় মারো কেনো? দানবের মতন হাত, ব্যাথা লাগে। ”
মিনহাজ আরো কিছু বলবে তার আগেই জুনায়েদ সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন,
— ” মিনহাজ, নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো। ”
মিনহাজ আর বাক্যক্ষয় না করে বেরিয়ে গেলো বাবার সাথে। আভা দরজা লাগিয়ে মায়ের পিছু পিছু এলো।
আভার মা রান্নাঘরে এসে ড্রয়ার থেকে একটা পেঁয়াজ আর বটি নিয়ে মাটিতে বসলেন। আভাও পাশে বসলো। আভার মা পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বললেন,
— ” এখানে বসে না থেকে রেডি হও। বেরুতে হবে তোকে। ”
আভা অবাক হলো। মায়ের দিকে চেয়ে বললো,
— ” বেরুবো?কোথায়? ”
— ” আহনাফ আসবে। এনগেজমেন্টের আংটি বানাতে যাবে তোকে নিয়ে। বেশি দেরি হলে পরে ঠিক টাইম মত বানিয়ে দিবে না। কেনো বলে নি ও তোকে? ”
আভা মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে জানেনা। আভার মা মেয়ের মুখের দিকে একপলক তাকালেন। তারপর আবার পেয়াঁজ কাটায় মনোযোগ দিয়ে বললেন,
–” আহনাফের মা ফোন দিয়ে বলেছেন। ”
— ” কিন্তু মা, আমি একা যাবো? ”
— ” না। মিনহাজ আছে। আজকে ওর অফিস নেই। ফ্রি আছে। ও যাবে তোর সাথে। ”
আভা ঠোঁট উল্টিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। এ আবার কোন মসিবত! বিয়ে মানেই একগাদা ঝামেলা। এখন আবার রেডি হও , বাইরে যাও, জার্নি করো। মহা মসিবত! আভা বিরক্ত মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। আভার মা মেয়েকে বসে থাকতে দেখে পুনরায় তাগাদা দিয়ে বললেন,
— ” যা। রেডি হ। আহনাফ এসে যাবে এখনি।”
আভা হেলদুলে উঠে দাঁড়ালো। নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বিড়বিড় করলো,
— ” বিয়ে মানেই ঝামেলা। ওহে প্রভু, বিয়ে নামক চিরন্তন জঞ্জাল এই পৃথিবী থেকে উঠায়া নাও। উঠায়া নাও। ”
_____________________
আহনাফ গাড়ি নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আভা রেডি হয়ে মিনহাজের রুমে বসে আছে। মিনহাজ ঝড়ের গতিতে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। আভা একসময় বিরক্ত হয়ে বললো,
— ” মা কখন থেকে বলেছে রেডি হওয়ার জন্যে। আর তুমি বসে বসে ঝিমিয়েছো। এখন বুঝো ঠেলা। ”
মিনহাজ তাড়াহুড়োর মধ্যে কপাল কুচকে আভার দিকে তাকালো। বললো,
— ” এখন সব আমার দোষ! তোর অকাজের হবু আরো কিছুসময় পর আসতে পারলো না। বউকে দেখার তর সইছিলো না। আহা! কি প্রেম। ”
আভা উঠে দাঁড়ালো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ভাইয়ের হাত ঘড়ি নিয়ে এগিয়ে দিলো মিনহাজের দিকে। মিনহাজ হাত ঘড়ি পড়ছে তখন আভা বললো,
— ” উনার আরো এক ঘন্টা আগে আসার কথা ছিলো।এক ঘন্টা লেট করে এসেছে। তাও তুমি এই কথা বলছো। ”
মিনহাজ শরীরে পারফিউম স্প্রে করতে করতে বললো,
–” কি প্রেম। একজন নাচতে নাচতে বাসার নিচে গাড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকজন তার দোষ ঢাকার জন্যে নিজের আপন ভাইয়ের সাথে তর্ক করছে। পাপ লাগবে তোর উপর। দেখিস! ”
আভা এবার কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। ভাইয়ের হাত টেনে জোর করে বাইরে নিয়ে আসলো। মা-কে ডেকে সদর দরজা বন্ধ করার কথা বলে ভাই বোন নিচে বেরিয়ে গেলো।
বাড়ীর গেটের বাইরে আসতেই দেখলো আহনাফ গাড়ীর সাথে হেলান দিয়ে কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। তার পরনে একটা সাদা টিশার্ট, তার উপর একটা কালো লেদার জ্যাকেট আর জিন্স। আভা আহনাফকে একনজর দেখেই চোখ নামিয়ে নিলো। আহনাফ মিনহাজ আর আভাকে দেখে ফোন কেটে পকেটে ঢুকিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। আহনাফ আর মিনহাজ পরস্পর কোলাকোলি করে হালচাল জিজ্ঞেস করলো। আহনাফ এতক্ষণে একবারও আভার দিকে তাকায় নি। মিনহাজের সামনে আভার দিকে তাকানো ব্যাপারটা বড্ড লজ্জাজনক। কিন্তু আহনাফের মনে আভাকে একনজর দেখার জন্যে আকুপাকু করছে। আজ কেমন লাগছে আভাকে? সুন্দর নাকি ভয়াবহ সুন্দর?
আহনাফ ড্রাইভিং সিটে বসলো। মিনহাজ আহনাফের পাশে আর আভা পিছন সিটে বসলো।
গাড়ি চলছে। মিনহাজ আর আহনাফ নানা কথা বলছে। কিন্তু আভা চুপ করে জানালার পাশ ঘেঁষে বসে আছে। বাতাসের কারণে তার চুল হালকা উড়ছে। মিনহাজ আহনাফের উদ্দেশ্যে বললো,
— ” তা,আজকের প্ল্যান কি? ”
আহনাফ এক হাত দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বললো,
— ” প্রথমে এনগেজমেন্টের আংটি বানাতে দেওয়া। তারপর একসাথে ডিনার।”
মিনহাজ এবার বাঁধ সাধলো। বললো,
— ” না, না। আংটি মাপ দেওয়া শেষ হলেই আমরা বাসায় চলে যাবো। আজকে ডিনার টা তুমি নাহয় আমাদের ওখানেই করে নিবে।”
— ” ভাইয়া, আজকে আমার পকেটের টাকা খরচ করেন। কদিন পর আমি যখন জামাই হবো তখন নাহয় আপনাদের অন্ন ধ্বংস করবো। বাট টুডে ইজ ম্যাই টার্ন। ”
মিনহাজ আহনাফের কথা শুনে হেসে ফেললো। আভা তাদের দুজনের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। কত জলদি মিশে গেলো এরা দুইজন। মিনহাজ সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না। সেক্ষেত্রে এই অপরিচিত লোকটার সাথে কত হাসিখুশি কথা বলছে। আসলেই। এই লোকটার মধ্যে এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। যে কাউকে আপন বানানোর ক্ষমতা!
প্রায় আধা ঘন্টা যাবৎ গাড়ি জ্যামে আটকা আছে। ঢাকা শহরের জ্যাম মানেই ভয়ংকর কিছু। সবাই ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। আহনাফ সবার অবস্থা লক্ষ করে গাড়ির জানালা বন্ধ করে এসি অন করলো। সবাই এবার যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এতক্ষণ গরমে অতিষ্ঠ হয়েছিল সকলে। আহনাফ একনজর মিনহাজের দিকে তাকালো। মিনহাজ জানালার দিকে মুখ করে আছে। আহনাফ এবার গাড়ির সামনে থাকা আয়নাটা আভার দিকে মুখ করে দিলো। এবার আয়নায় আভাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আহনাফ চক্ষু শীতল করে আভার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো কত দিন পরে দেখা!আভার চুলগুলো উড়ে এসে বারবার ওর মুখে পড়ছে। আর আভা বিরক্ত হয়ে চুল সরিয়ে দিচ্ছে। আহনাফের মনে হলো, সে যদি তার বউফ্রেন্ডের অবাধ্য চুল হতো, তবে সারাজীবন আভার চোখ,মুখ ছুঁয়ে দিতে পারতো।
জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আহনাফ এখনো গাড়ি চালু করছে না। পিছন
থেকে অন্যান্য গাড়ি বারবার হর্ন বাজাচ্ছে। একসময় মিনহাজ আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ এক ধ্যানে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। মিনহাজ আহনাফের চোখ অনুসরন করে আভার দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসলো।ছেলেটা ফেঁসে গেছে তার বুচি বোনের চক্করে, ভেবেই প্রশান্তির হাসি হাসলো মিনহাজ। মিনহাজ নিজেকে সামলে হালকা করে আহনাফকে ধাক্কা দিলো। আহনাফ এতে সম্ভিত পেয়ে চকিতে মিনহাজের দিকে তাকালে মিনহাজ মৃদু হেসে বলে,
— ” জ্যাম ছুটে গেছে। গাড়ি চালু করো। ”
আহনাফ এতে খানিক লজ্জা পেলো। মিনহাজের সামনে এমন ধরা খেয়ে যাবে বুঝেনি সে। আর দেরি না করে আহনাফ তাড়াহুড়ো করে গাড়ি চালু করলো। আভা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সামনে। কি হলো কিছুই মাথায় ঢুকলো না। আজব!
#চলবে