#কালো_রাত্রির_খামে (২৩)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
আত্মসমর্পণ করেছে তানবীন! থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে বর্ণনা দিয়েছে কী ঘটেছিল সে রাতে। স্বীকার করে নিয়েছে তার করা আঘাতের কারণে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে। সে বাবার খু’নি!
গত রাতে রফিকুল খন্দকারের কাছে থানা থেকে ফোন আসে। তানবীন থানায় গিয়ে কী কী বলেছে সে ব্যাপারে অবগত হন তিনি। এমন খবর ছিল রফিকুল খন্দকারের কাছে অপ্রত্যাশিত ও সেই সাথে অনেক আনন্দেরও। তানবীন না থাকলে তার ভাই শরিফুল খন্দকারের সব সম্পত্তি বলতে গেলে তারই হবে। রফিকুল খন্দকারের দু চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে লোভনীয় স্বপ্নে। মনে শুরু হয় বিপুল সুখের হাতছানি। এত বড়ো সুযোগ যে আর হাত ছাড়া করা যায় না। যা যা ঘটেছে সেসব যেন তার সৌভাগ্যের দ্বার খুলে দিতেই ঘটেছে। তিনি ছুটে গেলেন থানায়। সুযোগ বুঝে তানবীনের স্বীকারোক্তির পাশাপাশি তিনি তানবীনের বিরুদ্ধে মামলা করলেন বাবাকে হ’ত্যা করার জন্য।
রাতেই জানাজানি হয়ে গেল ঘটনাটা। মিডিয়ার কান অবধি পৌঁছনো মাত্রই সারা দেশই জেনে গেল। আকর্ষণীয় হেডলাইনে খবর ছাপা হলো।
‘ছেলের হাতে বাবা খু’ন’
‘বাবা মারা গেলেন ছেলের আঘাতে’
‘মায়ের জন্য বাবাকে খু’ন’
‘মাকে বাঁচাতে গিয়ে বাবাকে খু’ন করলো ছেলে’
‘বাবাকে খু’ন করে থানায় আত্মসমর্পণ ছেলের’
আরও কত আকর্ষণীয়ভাবে যে নিউজ ছাপা হলো!
জামাল হোসেন যখন জানলেন রফিকুল খন্দকার তানবীনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তখন তুমুল ঝগড়া বাঁধলো তাদের ভিতর। রফিকুল খন্দকারকে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো এই কেস উঠিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু রফিকুল খন্দকার নিজের সিদ্ধান্তে অটল। তিনি কেস তুলবেন না। উচ্চৈঃস্বরে মনের তৃপ্তি নিয়ে জানালেন তিনি,
“ও নিজের বাবাকে মেরে ফেলেছে। ও একটা জানোয়ার। আমারও প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল আমার ভাইয়ের মৃত্যুটা নিছকই দুর্ঘটনাবশত নয়। ওটা পরিকল্পিত হ’ত্যা। এখন তো দেখছি তাই-ই। ও ওর বাবাকে পছন্দ করতো না। ওরা মা-ছেলে সব সময় সুযোগ খুঁজতো আমার ভাইটাকে মে’রে ফেলার। এখন সুযোগ বুঝে মে’রে ফেলেছে। যে আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে ওই জানোয়ারকে আমি শাস্তি দিয়েই ছাড়বো। ওকে ফাঁ’সিতে ঝুলাতে আমার যতদূর অবধি যেতে হবে আমি যাব।”
জামাল হোসেন অনেক রাগ করেই বেরিয়ে যান রফিকুল খন্দকারের বাসা থেকে। যাওয়ার আগে অবশ্য বলে গেলেন, ওই পরিস্থিতিতে অনিচ্ছাকৃত একটা খু’নের জন্য তার ভাগনেকে কে ফাঁসিতে ঝুলায় তিনিও দেখে ছাড়বেন।
__________________
তুরিন যখন জানতে পারে তার ভাই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে, তখনই ছুটে আসে থানায়। সে এটা জানতে পারে সকালে। মামারা রাতেই খবর পেলেও তুরিনের থেকে গোপন করে রাখা হয়েছিল।
গারদের ভেতরে হাত বাড়িয়ে তুরিন আঁকড়ে ধরলো ভাইয়ের শার্টের কলার। তার চোখে অশ্রুর ঢল। ভীষণ অভিমান চাপা গলায় বললো,
“এটা কী করলে ভাইয়া? হ্যাঁ? এটা কী করলে? শেষ করে দিলে সব। শেষ! কক্ষনো ক্ষমা করবো না তোমায়। কক্ষনো না!”
তানবীন কলার থেকে বোনের হাত ছাড়িয়ে এনে দুই হাতের মাঝে আঁকড়ে ধরে বললো,
“এটাই শেষ পর্যন্ত আমার করার ছিল, নয়তো মরার ছিল। কী ভীষণ যন্ত্রণা, কী ভীষণ অপরাধবোধ হয় ভিতরটা জুড়ে তুই জানিস না। এখন একটু শান্তি লাগছে।”
তুরিন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“যা করলে ঠিক করলে না। একদম ঠিক করলে না। আমার কথা ভাবলে না একবার?”
“ভেবেছি, অনেক ভেবেছি। বললাম না, তুই খুব ভালো থাকবি? মামারা আছে, খালামনিরা আছে, তাদের সঙ্গে সুখী থাকবি।”
“কিন্তু তুমি তো থাকবে না! আমি আদৌ সুখে থাকবো?”
“নিশ্চয়ই।”
তুরিন ভাইয়ের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
“তোমার মুখ দেখলেও আমার রাগ লাগছে।”
তানবীন মামাকে বললো,
“ওকে বাড়ি নিয়ে যাও মামা।”
_____________________
সারা দিনে তেমন কিছু খেতে পারেনি রাত্রি। বিবশ কেটেছে সারাদিনটি। মস্তিষ্কে সারাটা ক্ষণই তানবীনের দুশ্চিন্তা। এটা কী করলো তানবীন? তুরিন কীভাবে থাকবে এখন? রাত্রি গিয়েছিল তানবীনের সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য, কিন্তু তাকে দেখা করতে দেওয়া হলো না। তদন্ত চলছে এখন। রাত্রির খুব ভয় হচ্ছে। কী শাস্তি হবে তানবীনের? তানবীনের চাচাও না কি মামলা করেছে তানবীনের বিরুদ্ধে, ব্যাপারটা তো এখন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। চিন্তায় চিন্তায় চরম মাথা ব্যথা শুরু হলো রাত্রির। সে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ঘুমাতে চাইলো। কিন্তু চিন্তা তার চোখে ঘুম নামতে দিলো না।
হঠাৎ কারো উচ্চৈঃ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ঘরের ভিতরে নয়, বাইরে থেকে। চোখ বুজে ছিল রাত্রি। শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“হয়েছে কী?”
“আমি দেখে আসছি।” বলে শ্রাবণী চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো।
আস্তে আস্তে বেশ কয়েকজনের একসঙ্গে মিশ্রিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। উঠে বসলো রাত্রি। বিল্ডিংয়ে বড়ো কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে। সে রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিল, দরজায় শ্রাবণীর সঙ্গে মুখোমুখি হলো। শ্রাবণী দৌড়ে ছুটে এসেছে বলে হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“বাবা সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে!”
রাত্রি আঁতকে উঠলো এ কথা শুনে। দৌড়ে বের হলো ঘর থেকে। দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি থেকে পড়েছে। তৃতীয় তলার ভাড়াটিয়া আঙ্কল দেখেছেন প্রথমে। মাথা ফে’টে অনেক রক্ত বের হচ্ছে! এমন দৃশ্য সহ্য করতে ভীষণ কষ্ট হলো রাত্রির। সকলের সহযোগিতায় তাকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। অয়ন বাসায় ছিল না, খবর পাওয়া মাত্র ছুটে এলো হাসপাতালে।
রাত্রি পাথরের মতো নিস্তব্ধ বসে আছে। চোখের পানি শুকিয়ে লেগে রয়েছে গালে। বর্তমান সময়টা খুব বাজে যাচ্ছে! যেন অভিশপ্ত! মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনের শক্ত গড়নটা ভেঙে যাচ্ছে। তাদের মাথার উপর হাত রেখে কেউ বলার নেই, ‘চিন্তা করো না, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এনামুল শিকদারের পা ভেঙে গেছে এবং মাথা ফেটেছে। যে কয় টাকা হাতে ছিল সব খরচ হয়ে গেল তার চিকিৎসায়। কী যে হয়ে গেল আচমকা!
____________________
পড়ন্ত বিকেল। রুফটপে একটি মেয়ে বসে আছে। পিছন থেকে দেখলেও মিশাতের চিনতে এক মুহূর্ত লাগলো না। এ শহরে এখনও পর্যন্ত প্রথম ও একমাত্র বন্ধু তার। সে ঘরে না ঢুকে শ্রাবণীর কাছে গেল। শ্রাবণীর নেত্রদ্বয় হতে জলের ফোয়ারা নামছে। একটু যেন বিচলিত হলো মিশাত। তটস্থ কণ্ঠে বললো,
“কাঁদছো কেন?”
ছলছল চোখে তাকিয়ে শ্রাবণী উত্তর দিলো,
“এই মুহূর্তে আমরা অনেক কষ্টে আছি মিশাত ভাই। আমার বাবা কালকে নানা চিন্তা ও চাপে মাথা ঘুরে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে, মাথা ফেটেছে!”
এ কথা মিশাত এর আগে কারো কাছেই শোনেনি। এক বিল্ডিংয়ে থেকেও এত বড়ো দুর্ঘটনা সম্পর্কে না জানার জন্য নিজেরই খুব বিরক্ত লাগলো। হয়তো এটা যখন ঘটেছে তখন সে ছিলই না, মানুষ যখন এ ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে তখনও হয়তো সে ছিল না। মিশাত দুঃখপ্রাপ্ত কণ্ঠে বললো,
“কখন ঘটলো এটা?”
“গত রাতে। কী হচ্ছে আজকাল! বাবার এমন এক্সিডেন্ট ঘটলো, দুলাভাইও পুলিশের হেফাজতে। জানি না কী হবে! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, ভয় করছে।”
শ্রাবণী আবার কাঁদতে লাগলো।
মিশাত বুঝতে পারছে না কী বলে সান্ত্বনা দেবে। কিন্তু কিছু একটা বলতেই হবে। কিন্তু কী বলবে? কীভাবে বলবে?
মিশাত শ্রাবণীর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বললো,
“কেঁদো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর ভালো করবেন।”
মিশাতের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো। একটা কিছু সে শ্রাবণীকে দেওয়ার জন্য কিনে রেখেছে। কিন্তু এর আগে শ্রাবণীর দেখা পায়নি বলে দেওয়াও হয়নি। এটা দেওয়ার উপযুক্ত সময় কি না বুঝতে পারছে না। তবে মনে হলো দিলে হয়তো মেয়েটার মন ভালো হবে।
“কান্না বন্ধ করো।” বলে মিশাত চিলেকোঠায় গেল। এরপর একটা ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলো সে।
শ্রাবণী ততক্ষণে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়েছে। উঠে দাঁড়ানো মাত্রই মিশাত সামনে এসে দাঁড়ালো। ব্যাগটা শ্রাবণীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“এটা তোমার জন্য।”
“কী এটায়?”
শ্রাবণী ব্যাগ নিয়ে ভিতরটা দেখলো। একটা লাল ড্রেস। সে বিস্ময়ান্বিত চোখে তাকালো মিশাতের দিকে।
মিশাত বললো,
“বলেছিলাম তো, আমার প্রথম পাওয়া বেতনে তোমাকে একটা পোশাক কিনে দেবো।”
“আপনি বেতন পেয়েও গেছেন? একমাস হলো কখন?”
“উহুঁ, একজন পুরোনো গার্ডের অগ্রিম বেতনের দরকার ছিল। তাকে যখন বেতন দিলো আমাকেও সেই সঙ্গে দিয়ে দিলো।”
“ওহ।”
শ্রাবণী জামাটা বের করলো। খুব সুন্দর! সে নিজের যে জামাটা কাঁচি দিয়ে কে’টে ফেলেছিল সেই জামাটার মতোই সুন্দর। শ্রাবণীর চোখে জল এলো। একটা পর মানুষও তাকে এত ভালোবেসে তার জন্য পোশাক কিনলো?
“পছন্দ হয়েছে?” মিশাত জানতে চাইলো।
শ্রাবণী মাথা দুলালো। অশ্রু ভেজা চোখে তাকিয়ে বললো,
“এই যে আপনি আপনার প্রথম পাওয়া বেতনে আমাকে একটা লাল পোশাক কিনে দিলেন, তার বিনিময়ে আমি আমার সারাজীবন আপনার নামে উৎসর্গ করলাম মিশাত ভাই। আপনি বড়োলোক না হলেও আমি আপনাকেই বিয়ে করবো।”
মিশাত বাকহারা হয়ে গেল। কোনো কিছু উপহার দেওয়ার বিনিময়ে এমন করে তাকে আর কেউ কখনও বলেনি।
__________________
আজ রাত্রি তানবীনের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। তুরিনের মামার সঙ্গে কথা বলেছে সে, মামা কথা বলে রেখেছেন থানায়।
একা গেল না রাত্রি, শ্রাবণীকে সঙ্গে নিয়ে গেল। রাত্রির সামনে বিচলিত বোধ করছে তানবীন। রাত্রির দৃষ্টিতে ক্লেশ। বুকের ভিতর যন্ত্রণা হচ্ছে। এই মানুষটার জন্য কখনও এত বেশি কষ্ট পাবে সে কখনও ভাবেনি।
তানবীন বললো,
“কেমন আছো রাত?”
“ভালো থাকার মতো অবস্থা তো রাখেননি। ভালো থাকি কী করে?”
তানবীন কিছু বলতে পারলো না। তার দৃষ্টি জোড়া নত হয়ে গেল।
রাত্রি বললো,
“যা করলেন, তা করা কি খুব জরুরি ছিল?”
তানবীন দৃষ্টি নত রেখে বললো,
“ছিল। আমি আমার ভিতরের যন্ত্রণাটা সহ্য করতে পারছিলাম না।”
“আর এখন যেই যন্ত্রণাটা সকলকে দিচ্ছেন, সেটার কী হবে?”
“দুঃখিত এটার জন্য!”
রাত্রি ঝরে পড়া অশ্রুর ফোঁটাটা মুছে নিয়ে বললো,
“আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য।”
তানবীন চোখ তুলে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড কী যেন বোঝার চেষ্টা করে বললো,
“ডু ইউ লাভ মি, রাত?”
এবার সত্যিই ভীষণ কান্না পাচ্ছে রাত্রির। কী উত্তর দেবে? সে সত্যিই কেঁদে ফেললো। কিছু বলার জন্য ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন করা মাত্রই তানবীন বললো,
“আমার জন্য অপেক্ষা করো না রাত। অপেক্ষা মূল্যহীন।”
একজন কনস্টেবল এসে তাড়া দিলো, কথা আর দীর্ঘায়িত না করার জন্য।
রাত্রি তানবীনের থেকে দূরে সরে আসতে আসতে তানবীনের প্রশ্নের উত্তরটা মনে মনে জপলো,
‘ভালোবাসি কি না জানি না। কিন্তু যখন আপনি আমার থেকে দূরে সরে গেলেন, তখন আমার অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়েছে। মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারিয়ে ফেলেছি। এমন মনে হওয়াকে কি ভালোবাসা বলে?’
থানা থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরলো তারা। শ্রাবণী বোনকে দেখে মনে মনে আহত হচ্ছিল। কারণ কষ্ট চেপে রাখা মুখ দেখলেই বোঝা যায়, রাত্রির মুখও যে তেমন। ভীষণ কালো মেঘ যেন বিরাজ করছে মুখখানিতে। বাসায় এসে শুয়ে পড়লো রাত্রি। ঘুমাতে হবে। এখন ঘুম যদি তার সব দুঃখ-কষ্ট কেড়ে নিতে পারে। ঘরে অসুস্থ বাবা, দরিদ্রতা, আর সেই সঙ্গে তানবীনের চিন্তা, সব মিলিয়ে তাকে ভেঙেচুরে দিচ্ছে। ঘুম ভাঙলেই যদি দেখতে পারতো কিচ্ছুটি বদলায়নি, সব আগের মতো। চোখের কোণ বেয়ে জল নেমে বালিশ ভেজাতে থাকে। এ সময় হঠাৎ শ্রাবণী ডাকলো,
“আপু।”
শুনেও উত্তর দিতে চাইলো না রাত্রি। শ্রাবণী আবার ডাকলো। রাত্রি চোখ মুছে ফিরে তাকালো শ্রাবণীর দিকে।
“কী হয়েছে?”
“তোমার স্টুডেন্ট কল দিয়েছে।”
তুরিন দিয়েছে ভেবে মোবাইল হাতে নিলো রাত্রি। কিন্তু তুরিন নয়, মালিহা। কল রিসিভ করার মানসিকতা নেই এই মুহূর্তে। রাত্রি রিসিভ না করে মোবাইলটা রেখে দিলো। শ্রাবণী বললো,
“আমি রিসিভ করবো?”
“করো।”
শ্রাবণী রিসিভ করলো। তবে মেয়েদের কণ্ঠস্বরের বদলে একটা পুরুষালি কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
“আমি মরে গেলে আমাকে দেখতে আসবেন তো রাত্রি?”
শ্রাবণী চমকালো, ভয়ও পেল। এ কেমন অবস্থা? কল রিসিভ করা মাত্রই কেউ এমন কথা বলে? সে রাত্রিকে বললো,
“আপু কে যেন মারা যেতে চলেছে।”
রাত্রি সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো। ফোনটা দ্রুত শ্রাবণীর হাত থেকে নিয়ে কানে ধরলো। কিন্তু কলটি ততক্ষণে কেটে দিয়েছে। চিন্তার চাপে পাগল প্রায় অবস্থা হলো রাত্রির। একে তো সে কষ্টগুলো সামলে উঠতে পারছিল না, আর এর উপর এ নতুন কোন দুঃসংবাদ! শ্রাবণীর কাছে জানতে চাইলো,
“কে মারা যেতে চলেছে?”
“জানি না। একজন ছেলে বললো, ‘আমি মরে গেলে আমাকে দেখতে আসবেন তো রাত্রি?’ ”
রাত্রি বুঝতে পারলো এটা আদিল ছিল। আদিল ছাড়া কেউ না। আদিলের কি কিছু হয়েছে? না কি অযথাই এমন বলে উদ্ভ্রান্ত করার চেষ্টা করলো? আর সহ্য করতে পারছে না রাত্রি। সে কল দিলো মালিহার নাম্বারে। কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না।
(চলবে)#কালো_রাত্রির_খামে (২৪)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
এনামুল শিকদারের কাছে তার সন্তানসন্ততিরা বসে ছিল। অয়ন মাত্রই চলে গেল দরজা খুলতে। উপর তলার আঙ্কল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অয়নের দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“একটা লোক গেটের সামনে দিলো এটা, তোমার বাবার কাছে দেওয়ার জন্য।”
অয়ন খামটা নিয়ে বললো,
“অফিসের লোক?”
“হুঁ, তাই বললো। তোমার বাবার কী অবস্থা এখন?”
“ভালো আছে। পা ঠিক হতে সময় লাগবে।”
“আল্লাহ সবার ভালো করুক।”
উপর তলার আঙ্কল চলে গেলে দরজা লাগিয়ে খাম খুললো অয়ন। দেখতে দেখতে এসে বাবার রুমে ঢুকলো।
এনামুল শিকদার অয়নের হাতের খাম ও কাগজ দেখে বললো,
“কারো চিঠি?”
অয়ন কাগজের লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
“দরিদ্রের ঘরে খাম ভরে চিঠি আসে না, আসে দুঃখ আর না চাওয়া যন্ত্রণা!”
এরপর বাবার দিকে তাকিয়ে হাস্য মুখে বললো,
“তোমার চাকরিটা চলে গেছে বাবা।”
সকলেরই বুক ধক করে উঠলো। এটা যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছুই বলতে পারলো না।
রাত্রি অবাক চক্ষুতে অয়নকে দেখছে। ছেলেটা কি শকে হাসছে?
এনামুল শিকদার কিছুই বলতে পারলেন না। তিনি হেলান দিয়ে বসা ছিলেন, আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লেন। সব শেষ হয়ে গেল। সব! এতগুলো প্রাণের বেঁচে থাকার খুঁটি যেন ভেঙে গেল আচমকা। বেশ অনেকদিন ধরেই তার পোস্টে নতুন একজনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা হচ্ছিল। এখন যখন সে অসুস্থ হলো সুযোগ বুঝে অন্য কাউকে নিয়োগ দিয়ে ফেললো মানুষগুলো। এনামুল শিকদার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। চোখের কোণ বেয়ে তিক্ত ব্যথায় অশ্রু নামে তার।
কারো মুখে কথা নেই। মানুষগুলো কথা বলতেই ভুলে গেছে যেন!
আজ রাতে কেউই খেলো না। খাবে কী করে? এমন ঘটনার পর খাবার যে এমনিই নামবে না গলা দিয়ে। রাত্রি সিদ্ধান্ত নিলো সে আবারও চাকরির জন্য আবেদন করবে। যেকোনো একটা কাজ খুব দরকার তার। না হলে কীভাবে বাঁচবে তারা?
বৃষ্টির ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে রাত্রিকে। মনে হচ্ছে এই বৃষ্টির ঝাপটায় তার বুকের জ্বলনটা নিভে আছে। সে জানালা দিয়ে বাইরে হাত বাড়ালো। বৃষ্টি! তানবীন বলেছিল তাদের বিয়ের রাতেও বৃষ্টি হবে। রাত্রি মাথা ঘুরিয়ে তানবীনের দেওয়া ছাতাটার দিকে তাকালো। সবকিছু যেন চোখের নিমেষে পালটে গেল।
বাজ পড়তেই হাত সরিয়ে আনলো রাত্রি। জানালা বন্ধ করে দিলো। কান্না পাচ্ছে তার। ভবিষ্যতের চিন্তা করে মস্তিষ্কে যন্ত্রণা ধরে যাচ্ছে। কী আছে তাদের ভাগ্যে? জীবন কেন এত কষ্টের?
চেয়ারে বসলো রাত্রি। টেবিলের উপর মোবাইলটা দেখে আদিলের কথা স্মরণ হলো। যখন মালিহার ফোনে কল দিয়ে কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সে পারভীনের কাছে কল দিয়েছিল। শুনেছে আদিল খুব অসুস্থ। এরপর একবার কল দিয়ে খোঁজও নেওয়া হয়নি। অবশ্য না নেওয়াই ভালো। খোঁজ নিতে গেলে কী না কী মনে করবে তারা! কিন্তু আদিল অসুস্থ হলো কেন? রাত্রির মনে হচ্ছে আদিলের অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ সে! এমন চিন্তাও তাকে কষ্ট দিচ্ছে। চারিদিকের এত কষ্ট নিতে গিয়ে পাগল হয়ে যাবে তো সে!
তাদের কপালে কি সুখ নামক শব্দটি নেই? রাত্রির হঠাৎ মনে হলো, সুখ একটি প্রজাপতি। দরিদ্ররা কেবল ওই প্রজাপতির দিকে হাত বাড়িয়ে থাকতে পারে, কিন্তু ওই প্রজাপতি ছুঁয়ে দেখতে পারে না। ওই প্রজাপতি তাদের নাগাল থেকে বহু দূরে!
_________________
রফিকুল খন্দকার চেয়েছিলেন তানবীনের হয় ফাঁসি হবে না হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। তিনি খুব চেষ্টা করেছিলেন এগুলো নিশ্চিত করতে। কিন্তু তানবীনের শাস্তি হলো চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড! তিনি খুব আশাহত হলেন, ভেঙে পড়লেন। কী স্বপ্ন দেখলেন আর কী হলো। তবে ব্যাপার নয়, চৌদ্দ বছরের আগেই তিনি শরিফুল খন্দকারের সহায়সম্পত্তি দখল করে ফেলবেন। এত ভাগ্য করে যে সুযোগ পেয়েছেন, সে সুযোগ একদম হাত ছাড়া করা যাবে না। এর জন্য যা যা করা প্রয়োজন তিনি অবশ্যই করবেন। তবে তার ভয় জামাল হোসেনকে নিয়ে। জামাল হোসেন যদি তানবীনকে জামিন করানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে? তারা তো এমনি এমনি বসে থাকবে না নিশ্চয়ই। এ চিন্তা করেই রফিকুল খন্দকারের শান্তির ঘুমগুলো হারাম হচ্ছে। এমন সৌভাগ্য তার পায়ের কাছে এসেও এভাবে ফিরে যেতে পারে না। না না এটা না হোক, ওই জেলখানাতেই পচে মরুক তানবীন। যেন ছয় মাসের মাথায়ই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায় ও। তার একটু আগে-পরে মরলেও অবশ্য সমস্যা নেই। কিন্তু ও মারা যাক।
রফিকুল খন্দকার আরেকবার পিছন ফিরে তাকালেন। কারো আসার নাম গন্ধই নেই। তিনি ভিতরের দিকে এগোতে এগোতে বললেন,
“সবাই কি ঘুমিয়ে পড়ছো না কি?”
ঘরের অন্দর থেকে এবার একে একে সবাই বের হলো। স্ত্রী, পুত্র ও দুই কন্যা।
স্ত্রী দরজায় তালা মারলেন। তারা এখন সপরিবারে তানবীনদের বাড়িতে যাচ্ছে। ও বাড়িতে থাকা তাদের হক। অত বড়ো বাড়ি থাকতে কেন শুধু শুধু এই ছোটো বাড়িটাতে পড়ে থাকবে? ও বাড়িটা এখন তাদেরই। সবাই ট্যাক্সিতে উঠে বসলেই ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো।
কারো কারো জীবনের আনন্দ নিভে গেলে সেখান থেকেই অন্য কারোর জীবনের আনন্দ শুরু হয়। রফিকুল খন্দকারের জীবনেও এখন তেমন সময় চলছে। ভীষণ আনন্দের!
________________
রোদের তেজ পড়ে গেছে। উদাস চোখের উদাসী মেয়েটি বসে আছে ছাদে। চেয়ারটি কে রেখেছে ছাদে জানা নেই। তবে ধারণা করা যায় চিলেকোঠার মানুষটি রেখেছে। কারো চেয়ারে এমনভাবে বসে পড়া হয়তো ঠিক হয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কোনো কিছু ভাবার ক্ষমতা নেই। পৃথিবীটা কালো ধোঁয়ার মতো মনে হচ্ছে। বেঁচে থাকার মানেটাই সে আর তার জীবন হাতড়ে খুঁজে পাচ্ছে না। সবকিছু ভীষণ কঠিন মনে হচ্ছে। একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে বরাবরের মতোই চাকরিটা হবে না। কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছে না। আকাশের দিকে তাকালো রাত্রি। কেঁদে ফেললো। বৃষ্টি হোক। বৃষ্টির পানি তার চোখের পানি মুছে দিক। এই দুর্বিষহ জীবন ভালো লাগছে না।
মিশাত জানালা থেকে দেখছে রাত্রিকে। অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটা বসে আছে। মনে হচ্ছে কষ্ট বিলাস করছে। সবাই এখানে কষ্ট বিলাস করতেই আসে, আর সে মানুষের কষ্ট বিলাসের দৃশ্য দেখে। অথচ তার জীবনেও কষ্টের শেষ নেই। কত না খেয়েও দিন কাটাতে হয়েছে তাকে। নাইট গার্ডের চাকরিটা মেলায় এখন মোটামুটি ভালো আছে। কিন্তু ওই নির্মম কষ্টের দিনগুলো সে কখনও ভুলতে পারবে না। মিশাতের এমন দূর থেকে কষ্ট বিলাস দেখে যেতে ভালো লাগছে না। একবার কাছে গিয়ে কথা বলবে? সেটা করা কি ঠিক হবে? ঠিক-বেঠিকের হিসাব কষতে চাইলো না মিশাত। এ হিসাব কষতে বসলে তো জীবনের সবকিছুই ভুল বের হবে। তাহলে এ সামান্য ব্যাপারটা ভুল হলেই বা কী আসে যায়? মিশাত একটা টি-শার্ট পরে বের হলো চিলেকোঠা থেকে। রাত্রির পাশে এসে দাঁড়ালো। রাত্রি টের পায়নি। মিশাত যেই না বললো,
“শুনলাম…”
রাত্রি চমকে উঠলো হঠাৎ মিশাতকে লক্ষ করে। চোখের অশ্রু মুছলো দ্রুত।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে মিশাত আবার বললো,
“শুনলাম তানবীন ভাইয়ের না কি চৌদ্দ বছরের জেল হয়েছে?”
এক চিন্তার যন্ত্রণায় ভুগছিল এতক্ষণ, মিশাত যেন তানবীনের কথা উঠিয়ে সেই যন্ত্রণায় আরও মশলা যোগ করলো। যন্ত্রণায় দম বন্ধ হয়ে এলো রাত্রির। অশ্রু মুছে লাভ হলো না। সুন্দর আঁখি দুটি আবারও জল ঢেলে দিলো। কপোল বেয়ে গলা পর্যন্ত নেমে গেল অশ্রু ধারা। চৌদ্দ বছর মানুষটা বন্দি থাকবে? এ কথা ভাবলেই বুকের ব্যথা বেড়ে যায়। সে যে ভেবেছিল তানবীনের সঙ্গে সে নিজের সারাজীবন কাটাবে! কোত্থেকে কী হয়ে গেল! সে এমন ভেবেছিল বলেই কি তানবীনের সঙ্গে এমন হলো? কেন যেন সবকিছুর জন্য রাত্রির নিজেকে দোষী মনে হয়। আর এজন্য অপরাধ বোধেও দগ্ধ হয়।
মিশাত রাত্রির মুখের অভিব্যক্তি দেখে ঘাবড়ে গেল খুব। এটাও বুঝতে পারলো দুম করে এমন একটা কথা বলা চরম বোকামি হয়েছে। জীবনেও কি মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না তার? এমন বোকার মতো কাজ কীভাবে করলো? এমন বোকামির পর আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কী করা যায়? মিশাত হঠাৎ আঁতকে ওঠার ভাণ করে বলে উঠলো,
“ওহ, আমার ডাল পুড়ে যাচ্ছে!”
বলে সে ঘরের দিকে দৌড় দিলো। আসলে সব মিথ্যা। সে ঘরে রান্না করে না। রান্না করার কোনো ব্যবস্থা বা সামগ্রী তার নেই। সে হোটেলে ভাত খায়। কিন্তু অমন বোকামির পর এটা বলে ওখান থেকে কেটে পড়া জরুরিই ছিল।
মিশাত কেবল ঘরে ঢুকেছে এরই মধ্যে মিথিলাও ছাদে এসেছে। রাত্রিকে ডাকতেই এসেছে সে। মিথিলা আর আগের মতো নেই। ভাই-বোনদের সঙ্গে তর্ক করে না। বরং ভালো আচরণ করে। সেও গোপনে কাজের সন্ধান করছে। এভাবে আর বসে থাকা যায় না। সেও চায় এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে পরিবারকে সাহায্য করতে।
“নিচে চল শিগ্গির।”
“কেন? বাবার কিছু হয়েছে?” উৎকণ্ঠা হয়ে উঠলো রাত্রি।
“বাবার কিছু হয়নি। তোর ছাত্রী আছে না? ওই যে মালিহা। ওর মা এসেছে।”
পারভীন আন্টি এসেছেন? কিন্তু কেন? মনে মনে অবাক হলো রাত্রি। অবশ্য গেলেই তা বোঝা যাবে।
পারভীন বসার ঘরে বসে আছেন। রাত্রিকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। রাত্রি সালাম দিলো। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
“তোমার সাথে আলাদা ভাবে কথা বলা যাবে?”
রাত্রি কিছু বুঝতে পারছে না। তার সঙ্গে আলাদাভাবে কী বলার আছে? আদিলের কী খবর? সে কি আগের চেয়ে সুস্থ হয়েছে? রাত্রি তাদের রুমে নিয়ে এলো পারভীনকে। তাদের রুমটা সুন্দর না হলেও সব সময় পরিপাটি থাকে। পারভীনকে বসতে দিয়ে বললো,
“আদিল ভাইয়ার কী অবস্থা? উনি আগের চেয়ে সুস্থ হয়েছেন?”
পারভীন চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। অঝরে কেঁদে ফেললেন। ঘাবড়ে গেল রাত্রি। পারভীন হঠাৎ রাত্রির হাত দুটো ধরে বললেন,
“আমার ছেলেটাকে বিয়ে করবে রাত্রি?”
রাত্রি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। কী বলছেন পারভীন এসব? রাত্রি হাত সরিয়ে আনলো। বললো,
“এটা কী বলছেন আন্টি? আপনিই তো বলেছিলেন আদিল ভাইয়ার তার মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক। তাহলে এখন হঠাৎ…”
“আসলে সুজানার সঙ্গে ওর বিয়ে অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছিল। তোমার কাছে গোপন রেখেছিলাম সেটা। সুজানা ওকে বিয়ে করতে চায় না, আর আদিলও তো তাই। ওদের বিয়ে ভাঙার পর আমি তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এসে শুনি তোমার অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে ইতোমধ্যে। আমি আর প্রস্তাবটা রাখতে পারিনি। ভেবেছিলাম আদিল ধীরে ধীরে সব মেনে নিতে পারবে। কিন্তু ও এখন শারীরিক ও মানসিক ভাবে ভীষণ অসুস্থ। ও কী খারাপ অবস্থায় আছে তুমি না দেখলে বুঝবে না রাত্রি। দয়া করো! আমার ছেলেটাকে সুস্থ হতে সাহায্য করো।”
রাত্রির শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে। রাত্রি কম্পমান গলায় বললো,
“আমি…আমি তানবীনকে কথা দিয়েছি তার জন্য অপেক্ষা করবো।”
“নিউজে দেখেছি তার চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। চৌদ্দ বছর কারো জন্য অপেক্ষা করা কি সম্ভব?”
চৌদ্দ বছর! রাত্রি যেন সময়টার দীর্ঘতা মাপতে পারছে না। ভাবতে গেলেও বুকের ভিতরটা ভাঙে। পারভীন আবারও রাত্রির হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে বললেন,
“আমার ছেলেটা মরে যাবে! একটু সহায় হও। পরিস্থিতি গুরুতর না হলে আমি তোমার কাছে আসতাম না।”
রাত্রি কিছু বলতে চাইলে পারভীন বাধা দিয়ে বললেন,
“আমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলবো। সে রাজি হলে দয়া করে তুমি অমত করবে না। চৌদ্দ বছর কারো জন্য অপেক্ষা করা মানে অপেক্ষা করা নয়, জীবন নষ্ট করা। নিজের জীবনটাও নষ্ট করবে আর আমার ছেলেটাও…”
পারভীন কথা শেষ করতে পারলেন না। আরও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এরপর আবার চোখ মুছে বললেন,
“আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলি।”
পারভীন রাত্রির হাত ছেড়ে দিয়ে বের হয়ে গেলেন রুম থেকে। রাত্রি নির্বাক তাকিয়ে আছে। কী হচ্ছে এসব?
(চলবে)