#কালো_রাত্রির_খামে (২৯/শেষ পর্ব)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
রাত্রি একা বসে আছে আদিলের রুমে। বাইরে অনেক মানুষজন থাকলেও এ রুমে কেউ নেই। এ রুমে সে এর আগেও এসেছে, কিন্তু আজ রুমটাকে চেনা যাচ্ছে না। খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। রাত্রি নিজেও সেজে আছে। খয়েরি শাড়ি, ওড়না, গয়না পরে কনে সেজে বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ হলো নিজের বাড়ি থেকে এ বাড়িতে এসেছে সে। সঙ্গে শ্রাবণীকেও নিয়ে এসেছে। এতদিন এ বাড়িতে এসেছে মালিহার টিচার হয়ে, আজ এসেছে মালিহার ভাবি হয়ে। অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। শেষমেশ বিয়েটা হয়েই গেল। একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো তার জীবনে।
দরজা খোলার শব্দ হলে নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসলো রাত্রি। ভেবেছিল অপরিচিত কেউ হবে, নতুন বউ দেখতে এসেছে। কিন্তু না, এসেছে আদিল।
আদিল এসে প্রথমে জানালা বন্ধ করে দিলো। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বাতাসের সাথে বৃষ্টির ফোঁটা ঘরের ভিতর এসে ঢুকছিল।
রাত্রির মনে হলো জানালাটা তারই বন্ধ করা উচিত ছিল। বোকার মতো কাজ হয়ে গেল কি?
আদিল বিছানার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“আমি এখানে বসতে পারি?”
নিজের ঘর, নিজের বিছানা, অথচ বসার জন্য কি না অন্যের পারমিশন চাচ্ছে। রাত্রি বললো,
“হ্যাঁ, বসুন।”
আদিল বসলো। তার খুব লজ্জা লজ্জা লাগছে। এতদিন যে মেয়েটাকে পাওয়ার বাসনা করেছে সেই মেয়েটা আজ তার ঘরে। তার বউ! অথচ সে লজ্জায় লাল। কিছু বলতে পারছে না, তাকাতে পর্যন্ত লজ্জা লাগছে। নিজের প্রতি নিজে খুব বিরক্ত সে।
রাত্রি তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। তানবীন বলেছিল বিয়ের দিন বৃষ্টি হবে, এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখবে। আজ সত্যই বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু বিয়েটা তার সঙ্গে হয়নি। আর এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিও দেখা হলো না।
আদিল রাত্রিকে অন্যমনস্ক খেয়াল করলো। মন খারাপ হলো তার। মনে হলো রাত্রি তানবীনের কথা ভাবছে। একদম বিষয়টা মানতে পারলো না সে। কিছুক্ষণ রাত্রির দিকে তাকিয়ে রইল একটানা। লজ্জা লাগছে না আর। খারাপ লাগছে। কষ্ট হৃদয়ে বললো,
“আমার হৃদয়ে যাকে পুষি, তার হৃদয়ে অন্য কারো পোষ আমি মানবো না রাত্রি। আমি অত উদার নই।”
রাত্রি আদিলের দিকে তাকালো। আদিলের কথার অর্থ বুঝতে তেমন সমস্যা হলো না তার। বললো,
“অন্য কাউকে হৃদয়ে পুষবো বলে কি আপনাকে বিয়ে করেছি?”
আদিলের খুব ভালো লাগলো রাত্রির এই কথাটা শুনতে। তার মনে হয় দীর্ঘদিন হৃদয়ে লালিত কোনো বাসনা পূর্ণ হয়ে গেছে। সে হাতে নাড়াচাড়া করতে থাকা জবা ফুলটি রাত্রির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“আজও কি নিবেন না?”
রাত্রি আজ নিজ থেকেই জবা ফুল গ্রহণ করলো। বললো,
“এতদিন আমার কাছে শুধু কালো রাত্রির খামে ভরা কষ্ট, যন্ত্রণা আর দুঃখ এসেছিল। যেসব আমি কখনও চাইনি। কিন্তু এই প্রথম না চাইতেও একটা রঙিন খাম এসে গেল জীবনে। আমি চাই সে খামের ভিতর ভালোবাসা থাকবে, শান্তি থাকবে, আনন্দ থাকবে। আপনি কি রঙিন খাম ভরা সুখ হবেন আদিল?”
কথাগুলো বলতে গিয়ে রাত্রির চোখে অশ্রু চিকচিক করছে। আদিল ভীষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। এমন করে কখনও কেউ তাকে সুখ হতে বলেনি। সে তো ধরেই নিয়েছিল সে সবার জীবনের অসুখ। কিন্তু আজ কেউ তাকে সুখ হতে বলছে। সে বললো,
“নিশ্চয়ই হবো।”
রাত্রির ভীষণ শান্তি লাগলো। সে কাউকে নির্দ্বিধায় নিজের সুখ হতে বলতে পারছে এবং সেই মানুষটিও তাতে সায় দিচ্ছে। এটা প্রশান্তির। রাত্রি বললো,
“হাত পাতুন।”
“কেন?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আদিল।
“কিছু দেবো আপনাকে।”
আদিল আর দ্বিরুক্তি না করে হাত বাড়ালো রাত্রির দেওয়া জিনিস নিতে।
রাত্রি হাতের মাঝে সেই বস্তুটা রাখলো। ভীষণ ক্ষুদ্র কাগজের টুকরো। আদিল কাগজটা দেখে খুব চমকিত চোখে তাকালো রাত্রির দিকে।
“এটা…”
রাত্রি বললো,
“হুম। আপনার থেকে চুরি করে নেওয়া সেই চারটা অক্ষর। L-O-V-E.”
আদিল বিশ্বাস করতে পারছে না এসব। তার কি আচমকা হ্যালুসিনেশন হচ্ছে?
রাত্রি আদিলকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব জর্জরিত দেখে বললো,
“কী হয়েছে?”
“আপনি বাস্তব?”
“না, আপনার জেগে জেগে দেখা তিনশ পঁয়ষট্টি নাম্বার স্বপ্ন আমি।”
আদিল হেসে ফেললো। বেশ কিছু সময় হাসলো সে। এরপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“ধন্যবাদ আপনাকে, পার্মানেন্টলি আমার জীবনে আসার জন্য। ধন্যবাদ, মূল্যবান এই চারটা অক্ষর ফেরত দেওয়ার জন্য। ধন্যবাদ, আমার তিনশ পঁয়ষট্টি নাম্বার স্বপ্ন হওয়ার জন্য। ভালোবাসি আপনাকে। অঙ্গীকার করলাম, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনাকে ভালোবাসবো।”
রাত্রির চোখ ভিজে আসে আবার। সে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের অশ্রু মুছে। কিন্তু তার চোখ ভিজে ওঠে আবারও। উষ্ণ অশ্রুতে ভিজে যায় তার গালও।
______________________
[তিন বছর পর]
স্ট্রোকের কারণে এনামুল শিকদারের অবস্থা খুব একটা ভালো না। ওনার এক পা এখন প্যারালাইজড। পাওনাদারদের চাপে চিন্তায় চিন্তায় এক বছর আগে স্ট্রোক করেছেন তিনি। প্রিয়ারাকেও ধরেছে অসুখে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ তিনি অসুস্থ। অয়ন ধীরে ধীরে কাজ করতে করতে এখন মোটামুটি ভালোই ইনকাম করছে। একটা বেকারি কারখানায় কাজ নিয়েছিল সে, এখনও সেখানেই আছে। এছাড়া রাত্রিও চাকরি করছে। চাকরিটা পারভীন ঠিক করে দিয়েছেন। চাকরির টাকাটা সে তিন ভাগের দুই ভাগ নিজের পরিবারকে দেয়। এতে আদিল অথবা পারভীন কেউই আপত্তি করে না।
পাওনাদারদের টাকা আস্তে আস্তে পরিশোধ করছে। শীঘ্রই হয়তো সবটা পরিশোধ হয়ে যাবে। মিথিলারও একটা বিয়ে দিতে পেরেছে। দেড় বছর হলো। তার স্বামী ছোটোখাটো একটা দোকান দেয়। ভালোই আছে। সাত মাস পর বাচ্চা হবে মিথিলার।
অয়ন আর শ্রাবণী মিলে রুটি বানাচ্ছে। অয়ন বেলছে, আর শ্রাবণী ভাজছে। প্রিয়ারার শরীর ভালো না। অয়ন তাকে রান্নাঘরে আসতে নিষেধ করেছে। তারপরও দেখা গেল প্রিয়ারা এসেছেন।
অয়ন বললো,
“আপনি কেন এসেছেন? বললাম না শুয়ে থাকুন? যান ঘরে যান।”
“আমার শরীর এখন ভালো লাগছে। আমিই করে দিচ্ছি। তোমরা গিয়ে তৈরি হও।”
অয়ন অথবা শ্রাবণী কেউই গেল না। রুটি বানানো শেষ করে তারপরই গেল তারা।
অয়ন কোনো রকম খেয়ে আগেই বের হলো। গেট দিয়ে বের হয়েই দেখতে পেল রোশনিদের বাড়ির সম্মুখে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। সিএনজি থেকে একজন শাড়ি পরিহিত মেয়ে নামলো। মেয়েটাকে চেনাই দায় এখন। আগের মতো নেই। আগে চিকন ছিল, এখন মোটা হয়েছে। আগের চেয়ে সুন্দরও হয়ে গেছে। অয়ন ভেবেছিল রোশনির স্বামীকেও দেখতে পাবে, কিন্তু শুধু রোশনিই নামলো। আর কাউকে দেখা গেল না নামতে। রোশনির চোখও হঠাৎ অয়নের উপর পড়লো। তটস্থ হয়ে চলতে শুরু করলো অয়ন। মেয়েটার চোখে এখনও ভাসা ভাসা অভিমান। রোশনির শ্বশুর বাড়ি এখান থেকে ভালোই দূরে। শায়লা বেগম মেয়েকে বাড়িতে রাখেননি। অয়নের থেকে দূরে সরাতে মেয়েকে ইন্টারে পড়াকালীনই বিয়েশাদি দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
অয়ন রোশনির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রোশনি বললো,
“আমি সেই রাতটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। কতটা নিরুপায় হয়ে আপনার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। শুধু আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারব না বলে পালাতে চেয়েছিলাম আপনাকে নিয়ে। কিন্তু আপনি আমাকে গ্রহণ না করে দরজা থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন! মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন আমার থেকে! পরদিনই আমি অন্য কারো হয়ে গেলাম। আমাকে কেউই বুঝলো না। না আপনি বুঝলেন, আর না আমার মা বুঝলো। এখন আপনারা সবাই ভালো আছেন তো? সবাই খুব খুশি এখন?”
রোশনির কথাগুলো গাঢ় অভিমানে পূর্ণ। আর দাঁড়ালো না সে, বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। হাতে বড়ো সাইজের এক লাগেজ। অনেক দিন থাকবে মনে হচ্ছে।
রোশনি চলে যাওয়ার পরও অয়ন দাঁড়িয়ে রইল। গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার অন্তঃকরণ থেকে। মেয়েটা এখনও আগের মতোই আছে। একটুও বুদ্ধি-শুদ্ধি হয়নি। এখনও বুঝতে পারছে না অয়ন কেন তার থেকে সব সময় দূরে থেকেছে। তাকে দূরে থাকতে হয়েছিল। তার নিয়তিই যে এমন। নিষ্ঠুর! অয়ন হাঁটতে শুরু করলো। সময় মতো পৌঁছতে হবে তাকে।
__________________
মিশাত একটা চুলা কিনেছে। মাটির চুলা। বেশিদিন হয়নি। রান্নাবান্না করে খাবে বলেই এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু সে রাঁধতে গেলে ধোঁয়ায় চারিদিক ছেয়ে যায়। আগুন ধরাতে অনেক কষ্ট।
শ্রাবণী এসে দেখলো মিশাত চুলা ফুঁকছে। চুলাতে ভাতের পাতিল। ধোঁয়ার জন্য শ্রাবণী ওড়না দিয়ে সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে এসে সামনে দাঁড়ালো। খোলা ছাদে রান্নার দৃশ্য ভালোই লাগে দেখতে। কিন্তু ধোঁয়াটা খুব বিরক্তিকর। শ্রাবণী বললো,
“বিয়ের পর আমাকে এই চুলায় রান্না করতে হবে না কি?”
মিশাত বললো,
“না না, তা কেন? গ্যাসের চুলা কিনে দেবো তোমায়। এই যে রাত-দিন কত খাটছি আমি, এরপরও কেন তোমাকে এই চুলায় রান্না করতে হবে?”
হঠাৎ আগুন জ্বললো চুলায়। মিশাতের মুখে হাসি ফুটলো। সে আরও দুটো কাঠ দিয়ে দিলো ভিতরে। শ্রাবণীর দিকে নিজের বসার মোড়াটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“বসো।”
শ্রাবণী বসে বললো,
“এই চিলেকোঠা কবে ছাড়ছেন? বাসা খুঁজে পাননি এখনও? আমাকে বিয়ে করবেন কবে?”
“বাসা তো পাচ্ছি না। আর বিয়ে কি এখন? আগে পরীক্ষাটা দাও।”
“সুরভি মঞ্জিল নামে যে বাড়িটা আছে না? ওখানে দেখলাম ভাড়ার নোটিশ টাঙানো।”
“তাই না কি? আমি তো খেয়াল করিনি। ভাড়া কত?”
“আমি কী জানি, আপনি গিয়ে কথা বলে দেখবেন। মনে হয় না বেশি হবে।”
“আচ্ছা কথা বলে দেখবো।”
শ্রাবণী ঝুড়িতে থাকা বেগুনগুলো দেখে বললো,
“এগুলো রান্না করবেন?”
“হুম।”
“ঠিক আছে, আমি কেটে দিচ্ছি।”
শ্রাবণী বেগুন কাটতে শুরু করলো।
মিশাত বললো,
“তুমি তো বিয়ের আগেই আমার বউ হয়ে যাচ্ছ শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমাতিথি।”
“সবাই তো জানে আমি আপনার বউ হবো। আমিও তাই আগে থেকেই বউ হওয়ার প্র্যাকটিস করছি। আপনি উঠুন, আমি রান্না করি।”
“থাক থাক এত বেশি প্র্যাকটিস করতে হবে না। তুমি শুধু বেগুনই কাটো, রাঁধতে হবে না।”
যতক্ষণ পর্যন্ত না মিশাতের রান্না শেষ হলো শ্রাবণী বসে থাকলো। মিশাত পুরো বিকেলই ব্যয় করলো রান্নার পিছনে।
__________________
প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আকাশে এখন রঙিন মেঘের ছড়াছড়ি। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ছাদ থেকে কাপড় তুলছে রাত্রি। হঠাৎ তার চোখ পড়লো রাস্তায়। প্রথমে খুব একটা খেয়াল করলো না। এরপর কী মনে হতেই আবার তাকালো। ভালো দেখা যাচ্ছে না এই সময়। আধো অন্ধকার, আধো আলো। তবে একটা ছেলে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটা দেখা যাচ্ছে। রাত্রির বুক ধক করে উঠলো। কেন মনে হচ্ছে ওটা তানবীন? রাত্রি যখন ভালো করে খেয়াল করে দেখতে চাচ্ছিল এই সময়ই ছেলেটা বাইক নিয়ে চলে গেল। ছেলেটা তানবীন কী করে হয়? তানবীন তো এখনও জেলে। কিন্তু তার অযথাই হঠাৎ আজ তানবীনের কথা মনে পড়লো কেন? বাসার সামনে তো অনেক বাইকই থামে, কিন্তু তা দেখে তো এমন মনে হয় না কখনও। রাত্রি মনের ভুল ভেবে নিচে নেমে এলো।
কিচেন থেকে আদিল ও মালিহার সমস্বর শোনা যাচ্ছে। দুই ভাই-বোন মিলে বিরিয়ানি রান্না করছে। পারভীন বাসায় নেই। উনি এক বোনের বাসায় গিয়েছেন।
রাত্রি বলেছিল সে রান্নায় সাহায্য করবে। কিন্তু ভাই-বোন কেউ তার সাহায্য চায় না। তারা দুজনই না কি সবটা পারবে।
রাত্রির সামনে বিরিয়ানি পরিবেশন করা হলো মাগরিবের নামাজের পর। খাওয়ার পরও যখন রাত্রি প্রশংসামূলক কোনো বাক্য বলছিল না তখন ভাই-বোন একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল। রাত্রি দেখছিল সবই।
আদিল তো এক প্রকার রাগ করেই রুমে চলে এলো। সে চেয়েছিল রাত্রি রান্না খেয়ে খুশি হোক, কিন্তু রাত্রি তো কিছুই বললো না। রুমে চলে আসার অনেকক্ষণ পরও রাত্রি রুমে আসছে না। রাত্রি কি এটাও বুঝতে পারছে না সে রাগ করেছে? খুবই অসহায় লাগছে আদিলের।
রাত্রির আসার শব্দ কানে এলেই আদিল ল্যাপটপ নিয়ে বসলো, যেন অফিসের কোনো কাজে ব্যস্ত সে।
“কী সমস্যা?” রাত্রি বললো।
“কী সমস্যা?”
“নাকের ডগায় রাগ।”
আদিল নাকে হাত দিলো।
“কোথায়?”
“আচ্ছা, নেই তাহলে।”
রাত্রি চলে যেতে চাইলে আদিল বলে উঠলো,
“কিছু বলবে?”
“না।”
আদিল খুব আশাহত হলো। রাত্রি ঠিক তখনই বললো,
“রান্না ভালো হয়েছে।”
আদিল বললো,
“তাই? তাহলে ভালো রান্না খাওয়ানোর জন্য উপহার দাও।”
রাত্রি অবাক হয়ে বললো,
“কী উপহার দেবো?”
আদিল নিজের হাত রাত্রির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“কিস মাই হ্যান্ড।”
_____________________
পার্সেল এসেছে। রাত্রির নাম লেখা। রাত্রি দুদিন ধরে বাবার বাড়িতে আছে। যে পার্সেল পাঠিয়েছে সে জেনেশুনেই পাঠিয়েছে বলতে হবে। পার্সেলটা প্রথমে এসে পড়েছে শ্রাবণীর হাতে। শ্রাবণী চেয়েছিল সে আগে খুলে দেখবে কী আছে ভিতরে। কিন্তু আবার মনে হলো এটা অন্যায়। সে রুমে নিয়ে এলো।
রাত্রি পার্সেল দেখে ভাবলো আদিল পাঠিয়েছে। কিন্তু খোলার পর ভিতরে বেলিফুল আর সেই সঙ্গে চিরকুট ও লকেট চেইন দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। এটা তো সেই লকেট চেইন! যেটা আরও একবার বেলিফুলের সাথে পাঠানো হয়েছিল তার কাছে। সে পরে ফুলের সাথে এটাও ফেরত দিয়ে দিয়েছিল।
রাত্রি চিরকুটের ভাঁজ খুললো। পরিচিত হাতের লেখা। তানবীনের! দুটো চিরকুট। প্রথমটায় লেখা–
‘কতদিন হলো তোমাকে দেখি না, কতদিন হলো তোমার সাথে কোনো কথা নেই, কতদিন হলো তোমার চোখে চোখ রাখিনি! তবে আমি সব সময় তোমাকে ভালোবেসেছি। নিষ্ঠুর প্রকৃতির এই ‘কতদিন’ শব্দটি আমার ভালোবাসা লঙ্ঘিত করতে পারেনি।’
দ্বিতীয়টায় লেখা,
‘কেমন আছো রাত? ছাতাটা রেখেছো এখনও? যত্ন পাচ্ছে? না কি অবহেলা? আশা করি যত্নে আছে। ভালো থেকো সর্বদা।’
রাত্রি স্তম্ভিত হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কথা ফুটছে না। সব ভাবনা গুলিয়ে উঠছে। তানবীনের দেওয়া চিরকুট… মানে কীভাবে কী?
শ্রাবণী রাত্রির হাত থেকে চিরকুট নিয়ে পড়ে দেখলো। চিরকুট, বেলি ফুল আর চেইন দেখে যা বোঝার বুঝে নিলো সে। রাত্রির দিকে তাকিয়ে বললো,
“তানবীন ভাইয়া?”
রাত্রি দ্রুত নিজের মোবাইল হাতে নিলো। কী হচ্ছে এসব? তানবীন কি এখন মুক্ত? তবে কি সেদিন সন্ধ্যায় দেখা মানুষটা তানবীনই ছিল?
তুরিনের নাম্বারে কল দিলো রাত্রি। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো। প্রথমে কুশল বিনিময়ের পাঠ চুকিয়ে রাত্রি যেই না বললো,
“তোমার ভাইয়া…”
তুরিন এটুকু শুনেই বললো,
“আপনাকে হয়তো খবরটা বলা উচিত ছিল। ভাইয়ার জামিন হয়েছে এই কয়েকদিন হলো।”
রাত্রি কয়েক সেকেন্ড কিছু বলতে পারলো না। ভীষণ ভালো লাগছে তার এই খবরটা শুনে। চৌদ্দ বছর বন্দি জীবন কাটাতে হলো না তানবীনকে। এখন তো একটা ভালো জীবন কাটাতে পারবে সে। রাত্রি তানবীনের সুন্দর জীবনের জন্য শুভকামনা জানালো। রাত্রি জানতে পারলো তুরিন এবং তানবীন এখন নিজেদের বাড়িতে থাকছে। তানবীনের জামিনের পর তার বন্ধুরা মিলে চাচাদের যা-তা অবস্থা করে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। অবশ্য এটাই তো করা উচিত লোভী মানুষ গুলোর সাথে।
তানবীনের জামিনের খবরে সবাইই খুব খুশি হলো। রাত্রির ভাবতেই শান্তি লাগছে তানবীন এরপর থেকে মুক্ত থাকবে। জীবনটা অনেক সুন্দর হোক তার। অনেক ভালো থাকুক।
মোবাইলে কল এলো। আদিল কল দিয়েছে। জানালো নিচে আছে। রাত্রি বেরিয়ে পড়লো সবাইকে বিদায় জানিয়ে। আদিল রিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। রাত্রি উঠে বসতেই সেও বসলো। রিকশা চলছে। কিছুদূর আসার পর আদিল একটা জবা দেখিয়ে বললো,
“নেবে না কি?”
রাত্রি নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালেই আদিল জবাটি দূরে সরিয়ে ফেললো। রাত্রি একটু রেগে তাকালো, টেনে নিয়ে নিলো ফুলটি।
আদিল হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বললো,
“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“কী সিদ্ধান্ত?” কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো রাত্রি।
“আমি আবার অসুস্থ হয়ে যাব।”
“কেন?”
“সুস্থ স্বাভাবিকে আমাকে মানায় না।”
রাত্রি হেসে বললো,
“আপনি আসলে ইতোমধ্যে অসুস্থ হয়ে গেছেন। বেশ বুঝতে পারছি আমি।”
“না এখনও অসুস্থ হইনি, তবে হবো।”
আদিল রাত্রির দিকে তাকালো।
“আদিলের অসুস্থতার কারণ হবে মিসেস আদিল?”
রাত্রি চিন্তা করার ভঙ্গি করলো। যেন গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ভাবছে। হঠাৎ হেসে বললো,
“হুম, হওয়াই যায়।”
বলে সে হাতের জবাটি কানে গুঁজলো।
(সমাপ্ত)
_____________________
এই গল্পটা লেখা রীতিমতো এক যুদ্ধ ছিল আমার জন্য। একদমই লিখতে মন চাইতো না, তবুও তীব্র অনীহার মাঝে লিখে আমি এটাকে শেষ করেছি। শুধু এটা না, অন্য গল্পও লেখার চেষ্টা করে দেখেছি, তার বেলায়ও এক অবস্থা। লেখালিখির প্রতি মোটেই মনোনিবেশ করতে পারছি না। অথচ ভেবেছিলাম এসএসসি পরীক্ষার পর ফ্রি সময়ে আমি অনেক বেশি লিখতে পারবো। কিন্তু হলো উলটো। এখন আমি লেখায় মনই পাচ্ছি না! যাই হোক গল্পটা শেষ করতে পেরেছি, ভালো লাগছে।
ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। যারা এতদিন গল্পটার সঙ্গে ছিলেন তাদের ভালোবাসা জানাই❤️