#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩০
বাইরে আজ শীতের প্রকোপ যেন ইউরোপীয় শীতের অনুভূতি দিচ্ছে। দুপুরে কুয়াশা একটু কম ছিলো কিন্তু বিকেল শুরু হতেই চারপাশ আঁধারে ঘিরে আসছে। মৈত্রী আজ শাড়ি পরে তৈরি হয়ে আছে। ইরিন পরশুর কথা বললেও মৈত্রীর খালা আবার বিদেশে চলে যাবে বলে নাইওর নেওয়ার দিন এক এগিয়ে দিয়েছে। যেহেতু ইরশাদকেও সিলেটে যেতে হবে নতুন চাকরির সুবাদে তাই আগেই সে গিয়ে সবটা দেখে আসবে। অফিস থেকে তাকে থাকার জন্য যে বাসা অফার করা হয়েছে মূলত সেটা দেখে কি লাগবে না লাগবে সব গোছানোর জন্যই আগে যাওয়া। অফিস থেকেই তারা জানিয়েছে কি কি সুবিধা তাকে দেওয়া হচ্ছে আর তার পেছনে স্যালারি থেকে কতোটা কে-টে নেওয়া হবে। মৈত্রীদের নিতে খুব বেশি মানুষজন আসেনি আত্মীয় বলতে মৈত্রীর নানী, খালা, মুজিব, ফখরুল, মিশু শেলি আর খুব কাছের বলে অরুণিমার শ্বাশুড়ি আর শিপলু এসেছে। দুপুরে খাওয়ার পর সবাইকে মোটামুটি রেস্ট করতে দেওয়া হয়েছে বলে মৈত্রী আর ইরশাদও নিজের ঘরে এসেছিলো৷ তখন ইরশাদ ছোট্ট একটা ব্যাগে নিজের কাপড় গুছিয়ে নিতে নিতে মৈত্রীকে বলল, “মন খা-রা-প নাকি!”
“না”
“মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে মন খারাপ ”
“আপনি আজ না গেলে হয় না? আমাদের বাড়ি চলুন আজ কাল না হয়…”
“উহুম, সময় কম হাতে। যত তাড়াতাড়ি ওখানে সব গোছানো হবে তত তাড়াতাড়ি তোমাকে নিয়ে যেতে পারব৷ আম্মু কি বলেছে জানো তো!”
মৈত্রী মাথা নাড়লো, সে জানে৷ ইরিন কাল বলেছেন, মৈত্রীকে শুরুতেই সাথে পাঠাবেন হোক নতুন জায়গা। দরকার পড়লে পরিচিত কাজের লোক জোগাড় করে দেবেন তবুও ইরশাদ এই শীতে একা একা থাকবে তা তিনি চান না। মৈত্রী নিজেও চায় না একা থাকতে৷ কি হলো কে জানে মাত্র কয়েক দিনেই এই মানুষটিকে ছাড়া তারা একদম থাকা মু-শ-কি-ল। ইরশাদ ব্যাগ গোছানো হলো মৈত্রীকে দু হাতের মাঝে জড়িয়ে ধরলো। মৈত্রী চুপচাপ তার বুকের ওপর মুখ রেখে চোখ বুজলো। তীব্র পুরুষালী এক ঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগছে। এই ঘ্রাণটা সে ইরশাদকে জড়িয়ে ধরেই পেয়েছিল। মিষ্টি, মাতাল করা এই সুবাসে শুধু পারফিউম নয় যেন ইরশাদের শরীরেরই নিজস্ব একটা ঘ্রাণ মিশে আছে। ইরশাদ মৈত্রীর বুঁজে রাখা চোখের পাতায় চুমু খেয়ে নিলো।
“মন খা-রা-প করতে হবে না। সেখানে আমার কাজ আশা করি দু দিনেই হয়ে যাবে তারপর সোজা তোমাদের বাড়ি গিয়ে উঠব। আম্মুও তো বলল তোমাকে এবার এক সপ্তাহ থাকতে দিবে সেখানে।”
মৈত্রী চোখের ইশারায় বোঝালো সে জানে। এক সপ্তাহে বাপের বাড়ির প্রথম নাইওর তারপর হয়তো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সিলেটে গিয়ে সংসার পাতবে। সন্ধ্যার দিকে মৈত্রীদের বিদায় দিয়ে ইরশাদ গেল মার্কেটে। ইরশাদ চাকরিতে জয়েন করার তিন দিন আগের ডেট পড়েছে ময়ূখ নোরার রিসেপশন ডেট। সেই সুবাদেই টুকটাক কেনাকাটা করতে হবে আব্বুর সাথে। ইরিন কাল যাবেন আরও কিছু গয়না তৈরির জন্য সাথে নোরাও যাবে৷ ইরশাদ মার্কেটে গিয়ে প্রথমেই একটা শাড়ি পছন্দ করে ফেলল মৈত্রীর জন্য পরে মনে হলো এই শীতে শাড়ি না লেহেঙ্গা হবে সুবিধাজনক পোশাক। তাই আবার তা পাল্টে লেহেঙ্গাই কিনলো৷ ময়ূখকে ফোন করে সাথে নিয়ে গেল কনভেনশন হল বুকিং এর জন্য৷ রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত সে কাজে ঘুরে ফিরে বাড়ি এসে আবার তৈরি হলো সিলেটের উদ্দেশ্যে৷ রাতের খাওয়া শেষে ইরশাদ রওনা দিল । ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফখরুল সাহেব ডাকলেন ময়ূখকে। ব্যাংকে যেতে হবে টাকা তুলতে ময়ূখ জানালো সে চলে যাবে। নোরা ময়ূখের ঘরে বসেই টুকটাক কাজ করছিলো ইরশাদের ল্যাপটপে। তার মম বিয়ের কথা জানার পর থেকেই বিভিন্ন ভাবে তাকে ফোর্স করছে দেশে ফেরার জন্য এখানে তার কোন ভবিষ্যত নেই। জীবনে কখনো কখনো সরল পথকে মানুষ নিজেই জটিল করে ফেলে। সেটা হতে পারে পথভ্রষ্টতা কিংবা তার করা চরম কোন ভুল। নোরা যা করেছে সে এখনো বুঝতে পারছে না ভুল করেছে নাকি পথভ্রষ্ট হয়েছে! যাই করে থাকুক না কেন তার জন্য হয়তো সে একা না ময়ূখকেও শেষ পর্যন্ত ভো-গা-ন্তিতে ফেলবে। নোরা তার মাকে আপাতত এই সান্ত্বনা নিয়ে থামিয়েছে, সে ফিরে আসবে মাস খানেকের মাঝে৷ এমনিতেও প্রফেসর তাকে দু একটা হু-ম-কি দিয়ে ফেলেছে৷
ইরশাদ সিলেট থেকে যেদিন ফিরলো সেদিন সে বাড়ি না এসে মৈত্রীদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলো। বাপের বাড়ি আসার তৃতীয় দিন চলে মৈত্রীর অথচ তার মনে হচ্ছিল কতদিন হয়ে গেছে সে ইরশাদকে দেখে না। ওই বাড়িতে তার কত পুরনো এক সম্পর্ক আছে এমনটাই মনে হয়েছে এই তিনদিনে। আজ তার ভারী মন খা-রা-প ছিল দিনভর ইরশাদ ব্যস্ত থাকায়। মৈত্রী সকাল, দুপুর মিলিয়ে প্রায় বিশ বারের মত কল দিয়েছে মানুষটা রিসিভই করেনি৷ এই নিয়ে শিপলুর মা বার কয়েক ক্ষে-পি-য়ে গেছে মৈত্রীকে৷ কি যে লজ্জা লাগছিল যখন অরুণিমা বলছিল, “স্বামীর সোহাগ মিস করছো বুঝি? ইরশাদ তো দেখি তার বউকে দু দিনেই পা-গ-লি-নী করে দিয়েছে!”
ইরশাদ যখন পৌঁছুলো মৈত্রী তখন রান্নাঘরে। বাড়িতে সবাই জেনেছে ইরশাদের সিলেট শিফট হওয়ার কথা। রোকসানা তাই ইচ্ছে করেই প্রতিবেলা মৈত্রীকে রান্নাঘরে ডাকেন৷ সহজ সব পদ রান্না শিখাচ্ছেন, কা-টাকু-টিও বাদ নেই। মৈত্রীও আগ্রহ নিয়ে তা শিখছে। এখনো এ বেলায় সে রাতের জন্য দু পদের ভর্তা করলো। ইরশাদ ভাই এসেছে সে কথাটা মিশু গিয়ে রান্নাঘরে বলতেই কেমন মৈত্রীর কান্না পেল। রোকসানা আচারের বৈয়াম কেবিনেট থেকে নামাতে নামাতে মৈত্রীকে বললেন, “সে কি জামাই আসবে তুমি তো বললে না! রাতের খাবারে আমি তো শুধু ভর্তা ভাজি করলাম!”
বিয়ের অনুষ্ঠানের পর এই প্রথম শ্বশুর বাড়ি এসেছে ইরশাদ। নতুন জামাই পাতে ভালো মন্দ না দিলে নাক কা-টা যাবে ভেবেই রোকসানা অ-স্থি-র হয়ে উঠলেন। তিনি মৈত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ঘরে যাও ইরশাদকে দেখো কি লাগে না লাগে। এ্যাই মিশু তুই শেলিকে ডাক আমাকে কিছু পেয়াজ মরিচ কেটে দিক।” তড়িঘড়ি কথাটা বলে রোকসানা ফ্রিজ খুললেন, মুরগি, গরু দুটোই দ্রুত হাতে রেঁধে ফেলবেন ভাবছেন৷ মৈত্রী তা দেখে বলল, “মামনি তাড়াহুড়ো করতে হবে না। রাতের বেলা এত কিছু খাবে না হয়ত!”
“ওমা মেয়ে কি বলে। খাক না খাক সেটা বড় কথা না জামাই প্রথমবার এসেছে…”
“তাহলে আমি বরং চলেই যাই৷” মৈত্রী আর রোকসানা কথার মাঝেই ইরশাদ এসে দাঁড়ালো রান্নাঘরের সামনে। মুখের ওপর জানিয়ে দিলো এখন ভারী সব রান্নার আয়োজন করলে সে এখনই বাড়ি চলে যাবে। বাধ্য হয়ে রোকসানা শুধু ভর্তা ভাজি আর ফ্রিজে থাকা ইলিশ মাছের পিস ভেজে দিলো৷ ইরশাদও তৃপ্তির সাথে বড় বড় দু পিস মাছ ভাজা আর বেগুন ভর্তায় খাওয়া শেষ করলো। মুজিব সাহেবের ভালো লাগলো না রোকসানাও কেমন একটু দোনোমোনো করে শেষে ঘন দুধে সেমাই রেঁধে দিলেন। পরদিন ইরশাদ জানালো সে মৈত্রীকে সাথে নিয়ে যেতে চায়। তাই হলো দুজনে বিকেলেই চলে গেল নিজের বাড়িতে৷
ইরশাদ -মৈত্রী বাড়ি না থাকায় ময়ূখ রাতে সবার অগোচরে ইরশাদের ঘরে ঘুমিয়েছে। কিন্তু আজ তারা ফিরে আসায় সেই সুযোগ নেই। আজ তাকে নিজের ঘরেই ঘুমাতে হবে এবং নোরার পাশেই। মন মস্তিষ্ক কিছুতেই সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না৷ সময় তো চেয়েছে নোরার কাছে কিন্তু নোরাকে আপন করা কি আদৌও সহজ হবে? সে ইরশাদের মত শীতল মানুষ নয়, সবরকম পরিস্থিতিকে সহজেই এক্সেপ্ট করা তার ধাঁতে নেই। নইলে সে এতোটাও অবুঝপনা করত না মৈত্রী ইরশাদের বিয়ের সময়। নিজের অধৈ-র্য্য আর বেপ-রো-য়া স্বভাবই তাকে কতগুলো ভুলের সম্মুখীন করলো! আজীবনের ভুলটা তো সে করেছে নোরাকে বিয়ে করে। দুজনের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা কিছুতেই মিল নেই৷ আর সবচেয়ে বড় কথা হলো দুজনের কেউই কম্প্রো-মা-ইজ শব্দটার সাথে একদমই আপোষহীন। জীবন নানারকম রঙ দেখায় তেমনটা দেখা ময়ূখের জীবনে শুরুই হলো বুঝি! ঘরে ঢুকে সে বিছানা করে একপাশে শুয়ে পড়ে নিঃশব্দে৷ নোরা দু দিন হয় খুব বেশিই ল্যাপটপে ডুবে থাকছে৷ ময়ূখ খেয়াল করলেও সেদিকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি৷ সে এখনো ঘুমাবে বলে চোখ বুজেছিল। ঘরের বাতি নেভানো হয়েছে বুঝতে পেরে চোখ খুলতেই আঁধারে তার বুকের ওপর নোরাকে অনুভব করলো৷ মেয়েটা বড্ড উ-গ্র তার যে মানসিক চাওয়ার চেয়ে দৈহিক আকৃষ্টতা বেশি তা সে উপলব্ধি করতে পারছে৷ আঁধার হাতড়ে নোরার ওষ্ঠপুট অনেকটা জ-ব-রদস্তিই দখল করেছে ময়ূখের ঠোঁট। সুস্থ স্বাভাবিক কোন পুরুষই বোধহয় এমন মুহূর্ত উপেক্ষা করতে পারে না। মেজাজ বি-ক্ষি-প্ত হওয়ার আগেই শীতল হয়ে গেছে নোরার এলোমেলো স্পর্শে। ময়ূখ খুব করে চাইলো এমনটা না হোক নোরা শুনলো না। সে তার ইচ্ছেমত চুমু খেলো ময়ূখকে, কম্বল জড়িয়ে নিঃশব্দে পড়ে রইলো ময়ূখের বুকে। এ মুহূর্তে আর সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো না মেয়েটাকে। নিস্তব্ধতার দেয়া ভে-ঙে নোরাই মুখ খুলল, “আমি চলে যাব তোমাকে স্বস্তি দিয়ে।”
“কবে?”
“তুমি খুব স্বা-র্থপ-র ময়ূখ। ভালো বাসো না তাই বলে এভাবেই চাচ্ছো আমি চলে যাই! আমি চলে যাব শুনে প্রথমেই তোমার ‘কবে’ মানে কতটা দ্রুত আমি যাই তা জানতে চাচ্ছো?”
“আমি সত্যিই সময় চাই। আমি তোমাকে কখনোই অস্বীকার করব না নোরা। আমার শিক্ষা, আম্মার দেওয়া শিক্ষা মেনেই বড় হয়েছি আমি। ভাইয়ের মত নরম কিংবা আদর্শ ফ্যামিলিম্যান নই কিছুটা উ-গ্র তবুও সম্পর্ককে সম্মান করতে জানি আমি৷ তুমি শুধু সময় দাও আমি ঠিক মানিয়ে নেব।”
“আমাদের রিসেপশনের দিন সন্ধ্যায় ফ্লাইট আমার।”
নোরা আগের চেয়ে জোরে ঠেসে রইলো ময়ূখের বুকে। মন খা-রা-প করে বলল, “আর মাত্র পাঁচ দিন তারপরই আমি চলে যাব আমাকে একটু আদর করে দিবে ময়ূখ।”
আকুল কণ্ঠ বড় কানে বাজে ময়ূখের৷ সে না চাইতেও নোরাকে আদুরে স্পর্শে আপন করে নেয়। জীবন তো একটাই আর তার গন্ডি কতটুকু কারো জানা নেই৷ কি হবে যদি নোরাকে আপন করে নেয়!
চলবে
(এত শীতে দু লাইন লিখলে মনে হয় দশ লাইন লিখছি 🥺। দ্রুত গল্প শেষ করে বিদায় নিব ভাবছি। বাই দ্য পথঘাট আপনারা সবাই কিপটা 😒)