কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার পর্ব -০৮

কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ৮)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
নিজের ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আশফিয়া। মুখে এক চিলতে হাসি। চোখের দৃষ্টি তার পেটে। ডান হাতটা পেটের উপরিভাগ থেকে স্পর্শ একে বারবার নিচে নামাচ্ছে সে। মা হওয়া একটি মেয়ের কাছে অনেক বড় অনুভূতি। যা প্রকাশ করার উপায়ন্তর আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি, হবেও না। মাথা আঁচড়ে এলোমেলো চুলগুলো হাতখোপা করে নিল আশফিয়া। ঘন চুলগুলো পাতলা হয়ে গেছে তার। এই সময় এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে মুখের সৌন্দর্যও বেড়েছে দ্বিগুণ—এ সৌন্দর্য এক মায়ের!
সাজানো ঘর সাজাতে লাগল আশফিয়া। বসে বসে ক্লান্তি এসে গেছে তার। কাজ করার মতো কিছু নেই। গতকালকের মতো আজকেও নাস্তাটা তৈরি করে নিলে ভালো হতো। সময়ও কাটত। কিন্তু নাহিদা আগেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিল। আশফিয়ার উপস্থিতি যেহেতু নাহিদাকে একটু বিড়ম্বনায় ফেলে, তাই আশফিয়া শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরে ঢোকেনি।

দরজা লাগানোর শব্দ হতেই আশফিয়া বুঝল, তানজিম বেরিয়ে গেল। তৎক্ষনাৎ ঘর থেকে বের হয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিল সে। তানজিমের আশেপাশে আর যাওয়া হয় না তেমন। বলা যায় না, রাগের মাথায় কখন কী করে বসে!
নাহিদা খাবার টেবিলে থাকা খাবারগুলো ঢেকে রাখছিল। আশফিয়া তা দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘নাস্তা করেছ?’
নাহিদা তখন’ই উত্তর দিল না। একটু পর বলল, ‘না। তানজিমের সাথে বসে নাস্তা করার রুচিটা আসে না।’
‘আমার সাথে আসে?’
আশফিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই নাহিদা বিদ্যুৎ গতিতে উত্তর দিল, ‘তোমার সাথেও না।’
ফ্যালফ্যাল করে নাহিদার দিকে তাকিয়ে থাকল আশফিয়া। এই মেয়ে তো দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে!
চেয়ারে বসে নাহিদা খাবার থেকে ঢাকা সরাতে সরাতে বলল, ‘নাস্তা করবে না? বসো।’ আশফিয়াকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে তাকাল নাহিদা, ‘কী হয়েছে?’
চেয়ার টেনে বসল আশফিয়া, ‘একটু আগেই না বললে, আমার সাথে খাবার খেতে তোমার রুচি হয় না!’
নাহিদা মুচকি হেসে আশফিয়ার দিকে নাস্তার প্লেট এগিয়ে দিল। কোনো কথা না বলে নিজের ভাগেরটুকু খেতে লাগল। নাহিদার মুখের স্বচ্ছ হাসি দেখে খটকা লাগলেও প্রত্যুত্তরে হাসলো আশফিয়া।

খাবার শেষে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসি বিনিময় করল নাহিদা ও আশফিয়া। দু’জনের মনে কিছু কথা আছে, যা প্রকাশ করা দরকার বোধ হচ্ছে তাদের। কথাগুলো মন থেকে বের করলে শান্তি হতো। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে ভেবে চুপচাপ দু’জন-ই।
‘ফ্রিজে জুস আছে?’ মনে লুকানো একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে শেষে অন্য কিছু জিজ্ঞাসা করে বসল আশফিয়া।
‘হ্যাঁ।’ উঠে দাঁড়াল নাহিদা। ফ্রিজ থেকে জুসের বোতল বের করে আবার খাবার টেবিলে বসে পড়ল সে।

কলিং বেল বেজে উঠল। মুখে বিরক্তিকর শব্দ করে আবারও উঠে দাঁড়াল নাহিদা। দরজা খুলেই ইয়াসমিনের হাসিতে গদগদ মুখটা দেখে নাহিদার হাসি উবে গেল। আগে ইয়াসমিনকে দেখলে সে খুব খুশি হতো। পাশাপাশি বসে নানান গল্পে মেতে থাকত। বিল্ডিংয়ের সব খবর ইয়াসমিনের কাছে থাকত বলে গল্পও জমে যেত। নাহিদা ঘরে বসে পুরো বিল্ডিংয়ের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম খবরগুলোও পেয়ে যেত। তাছাড়া তানজিম যেহেতু সারাদিন অফিসে, সেহেতু ইয়াসমিনের সঙ্গ বেশ উপভোগ্য ছিল নাহিদার কাছে। কিন্তু আশফিয়া এখানে আসার পর থেকে ইয়াসমিনের কথার সুর আর আচরণ কেমন বিচ্ছিরি লাগে। তিনি যে নাহিদা সহ তানজিম, আশফিয়াকেও নজরে রেখেছে, তা তার কথাবার্তার ধরণ দেখেই বুঝা যায়। নাহিদা কারো নজরদারির মধ্যে থাকতে পছন্দ করে না। তাই হয়তো আরও বেশি খারাপ লাগে ইয়াসমিনকে।

আজ ইয়াসমিনকে ভেতরে ঢুকতেও বলতে হলো না। নিজেই ভেতরে ঢুকলেন। বৈঠকঘর পেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেলেন। আশফিয়াকে দেখে নাহিদার কানে কানে বললেন, ‘এই মেয়েকে কী পার্মানেন্টলি থাকতে দিয়েছিস?’
উত্তরে কিছু বলল না নাহিদা।
ইয়াসমিন খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নাহিদা, অপু বাড়িতে গিয়ে তোর খুব প্রশংসা করছিল। বলছিল, আজকেও বিকেলে আসবে ও। তুই কোথাও বেরোবি কি না, তাই বলতে এলাম। কোথাও বেরোবি আজ?’
এবারও নাহিদা চুপ থাকবে ভাবলেও চুপ থাকা গেল না। অপু ছেলেটা এমনিতে ভালো। কিন্তু মাঝে মাঝে তার চাহনি আর ফ্লার্টিংগুলো বেশ বিরক্তিকর। তাই মিথ্যা বলল নাহিদা, ‘হ্যাঁ আন্টি, বেরোবো আজকে।’
ইয়াসমিন একটু মন খারাপ করলেন, ‘কোথায় যাবি?’
‘শপিংমলে। তাছাড়া অনেকদিন হলো বেরোনো হয় না। এই সুযোগে একটু ঘুরাঘুরিও হবে।’
‘আগে বলবি না?’ একশত ভোল্টেজ বাল্ব ইয়াসমিনে মুখে জ্বলে উঠল, ‘অপুও তো সন্ধ্যায় শপিংমলে যেতে চেয়েছিল। তাহলে দু’জনে একসাথে যাস।’
‘না, না আন্টি। আমি একা যেতে পারব।’
‘আজকাল পথে-ঘাটে মেয়েদের একা চলা নিরাপদ না।’
এতক্ষণ আশফিয়া চুপচাপ সব কথা গিলে নাহিদার অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করল। পরে বলে উঠল, ‘আশফিয়া একা কোথায়? তানজিমও যাবে অফিস শেষে।’
কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল নাহিদা। কিন্তু আশফিয়ার কথাটাও তেমন সুবিধা করতে পারল না।
ইয়াসমিন বললেন, ‘তাতে কী? তবুও অপু যাবে। একা একা বাড়িতে বিষণ্ণ থাকে ছেলেটা আমার। ভাই-ভাবির সাথে থাকলে ভালো সময় কাটবে। আমি গিয়ে তাহলে অপুকে বলি। বিকেলে ঠিক সময়ে বেরোস কিন্তু!’
নাহিদার গাল টেনে বেরিয়ে গেলেন ইয়াসমিন। কিছু বলার সুযোগ’ই দিলেন না।

হতাশ হয়ে বসে পড়ল নাহিদা।
আশফিয়া জিজ্ঞাসা করল, ‘মিথ্যা বললে কেন?’
‘অপু ছেলেটাকে আমার খুব বেশি পছন্দ নয়।’
‘কেন?’
‘ইনডিরেক্টলি ফ্লার্ট বেশ ভালো করে।’
‘সমস্যা কী? তুমিও ফ্লার্ট করবে!’ হাসল আশফিয়া, ‘সে কী তোমাকে পছন্দ করেছে নাকি?’
‘একজন বিবাহিতা মেয়ের মাঝে কী এমন থাকতে পারে, যার জন্য একজন অবিবাহিত ছেলে তাকে পছন্দ করবে?’
‘শরীর।’
সরাসরি আশফিয়ার এমন কথায় হকচকিয়ে গেল নাহিদা। কী বলবে ভেবে পেল না।
বিষয়টাকে হালকা করার জন্য হাসল আশফিয়া। জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘মজা করছিলাম। তবে এটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো কথা না।’
‘তোমার এটাই মনে হয়?’
আশফিয়া নিজের পেটের দিকে ইশারা করল, ‘বিশ্বাস হয় না এখনও? ছেলেদের তুমি আসলে চেনোই না।’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। সেজন্য তানজিমকেও চিনতে পারিনি।’
__________

দুপুরের সময় বিকেলে গড়াতে না গড়াতেই অপু এসে হাজির। চোখ মিরমির করে চুপচাপ বসে আছে নাহিদা। তাকে দেখলে মনে হচ্ছে, নিরীহ একজন নারী বসে আছে। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হলেও তার সীমানা সম্পর্কে অবগত নয় নাহিদা নিজেও। এমনিতেই গতকাল রেগে ছিল তানজিম। নাহিদা যদিও ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি। তবে এবার অপুর সাথে এভাবে শপিংমলে গেলে যে তুলকালাম কাণ্ড হবে না তার গ্যারান্টি নেই।

অপু অনেক্ষণ ধরে নাহিদাকে চুপ থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে? তুমি চুপ কেন?’
নাহিদা একটু অসুস্থতার ভঙি করল, ‘আমি একটু অসুস্থ।’
‘সকালেই তো তুমি ঠিক ছিলে।’
‘সকালে ঠিক থেকেছি মানে যে বিকেলেও ঠিক থাকব, এমন কিছু না।’
নাহিদার অল্প কঠিন স্বর অপু বুঝল। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘আরে চলো। ভাইয়া নেই তো কী হয়েছে? ভাবিকে কী করে সামলাতে হয়—আমি ভালো জানি। পরে তো ভাইয়ার সাথে দেখা হবেই।’
নাহিদার ইচ্ছে করল বলতে, ফ্লার্ট বন্ধ কর। কিন্তু বলতে পারল না। অপু যে পরোক্ষভাবে ফ্লার্ট করছে, তা যদি নাহিদা বুঝতে পেরেছে ভাব করে, তবে অপু সরাসরি ফ্লার্ট করতে শুরু করবে। সাহস বাড়বে তার।
অপু ট্রে থেকে খাবার তুলে মুখে দিল৷ আড়চোখে বারবার তাকাল নাহিদার দিকে।
অপুর চাহনি এড়াতে শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়াল নাহিদা। বলল, ‘আমি বরং রেডি হই।’
খুশি হলো অপু। চোখ বন্ধ করে অস্পষ্ট ইশারা করে বোঝালো, সে প্রচণ্ড খুশি হয়েছে।

আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল আশফিয়া। অনেকদিন পর দিনে এত সুন্দর ঘুম হলো তার। প্রথমেই পেটের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাসল সে। অতঃপর উঠে বাথরুমে গেল। বাথরুমে খুব বেশিই সাবধান হয়ে থাকতে হয় তাকে। সিঁড়ি থেকে পড়ার মতো দুর্ঘটনা আর একবার ঘটলে বেশ বিপদ হয়ে যাবে।
টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরের দরজা খুলল আশফিয়া। অপুর সাথে যাবে না বলে নাহিদা একা কী যে বলছে কে জানে! মাত্র’ই এক পা বাইরে বের করেছে আশফিয়া। তখন’ই বৈঠকঘরে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলল সে। বুকটা হাহাকার করে উঠল। সে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল, এটা সাজ্জাদ না? হ্যাঁ। কিন্তু সাজ্জাদ এখানে কী করছে? দরজায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল আশফিয়া। এই ছেলেটাই সবচেয়ে বেশি দায়ী আশফিয়ার জীবন নষ্ট করতে। আশফিয়া কখনও ভাবেনি, এই ছেলের মুখোমুখি আবার কখনও দাঁড়াতে হবে। ছেলেটা যেন আশফিয়াকে না দেখে, সেজন্য আশফিয়া ঘরে ঢুকতে চাইল। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া এক পা কিছুতেই ঘরে ঢোকাতে পারল না সে। মনে হলো, এই পা যেন একটা পাহাড়ের সমান ভারী হয়ে গেছে। আর সেই পা বয়ে ঘরে ঢোকানোর শক্তি আপাতত আশফিয়ার নেই!

‘অপু, চলো।’
নাহিদার স্বরে চকিত তাকাল অপু। নাহিদাকে এই প্রথম শাড়িতে দেখছে সে। গোলগাল মুখে মেক-আপের ছোঁয়া। সুন্দর মেয়েটিকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে এই নারীর সাজে।
‘খুব সুন্দর!’
‘কী?’ কপাল কুঁচকে ফেলল নাহিদা।
‘তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।’
এবার নাহিদার মনে হচ্ছে, এভাবে সেজে তৈরি হওয়া একদম ঠিক হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, ‘সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরব।’
‘টেনশন করো না।’
আশফিয়ার ঘরের দিকে তাকাল নাহিদা। ঠিক সেই সময় ঘরে ঢুকে গেল আশফিয়া। বড় একটা শ্বাস নিল সে। বাহির থেকে নাহিদার কণ্ঠ কানে এলো, ‘আমরা বেরোচ্ছি৷ দরজাটা আটকে দিও।’
আশফিয়া বুঝল, কথাটা তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা। তাই সে গলাটা একটু চেপে ধরে বলল, ‘তুমি বাইরে থেকে আটকে দিও।’
‘আচ্ছা।’

সাজ্জাদ’ই হলো অপু!
ভয়, রাগ, ঘৃণা আর নানানরকম চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আশফিয়ার। কিছুতেই অপুর সামনে যাওয়া যাবে না। নইলে বড় ভুল হয়ে যাবে! অপু ছেলেটা মোটেও ভালো নয়। নাহিদা তার সঙ্গে গিয়ে কোনো ভুল করে ফেলল না তো? নাহিদা তো বুঝেছিল, অপু তাকে নানানরকম হিন্ট দিচ্ছে। এমতবস্থায় যদি অপু তার সাথে খারাপ কিছু করে! অবশ্য এরকম ছেলেদের থেকে ভালো কিছু আশা করা বোকামি।
নাহিদাকে জানানো উচিৎ ভেবে তার নাম্বারে কল করল আশফিয়া। ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন, সে নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here