কুয়াশার মতো, পর্ব:১

0
1367

গল্পঃ- কুয়াশার মতো।
পর্বঃ- ০১ (প্রথমাংশ ও দ্বিতীয়াংশ একসঙ্গে)

– মা বললো ” তোর স্বামীর জন্য রোজরোজ ভাত রান্না করি নাকি? প্রতিদিন রাতে এসে বসে থাকে, লজ্জা সরম কিছু নাই নাকি?

– সে কি ভাত চাইছে মা?

– না চাইলে ও তো আমরা বুঝি, তাছাড়া ড্রইং রুমে বসে থাকলে ডাইনিং রুমে বসে কীভাবে খাবো আমরা?

– আমার সঙ্গে যেভাবে কড়া কথা বলো সেভাবে ওর সঙ্গে বলতে পারো না মা? আমি তো পছন্দ করে বিয়ে করিনি, তোমাদের পছন্দের ছেলে।

– আমার হয়েছে যত জ্বালা, তোর বাবা নিজের রুমে বসে বকবক করে। সে নিজেও কিছু বলতে পারে, কিন্তু তা না করে সবকিছু আমার উপর।

– সত্যি করে বলো তো মা, তুমি আর বাবা আমাকে কি আর ওর সঙ্গে সংসার করতে দেবে না?

– পাগল নাকি তুই? তোর বাবা ডিভোর্সের সকল ব্যবস্থা করতে বলেছে উকিলকে।

– তাহলে কি আমি ওর সামনে গিয়ে আজকে সরাসরি বলে দেবো যে আর কোনদিন আমাদের বাড়ি যেন না আসে। তার ডিভোর্স পেপার সে বাসায় পেয়ে যাবে, বলবো মা?

– পারবি শাকিলা? সেটাই বলে দে, প্রতিদিন আর সহ্য করতে পারি না।

– ঠিক আছে যাচ্ছি আমি।

ড্রইং রুমে বসে বসে সকাল বেলার পুরনো পত্রিকা খুলে পড়ছে সাজ্জাদ, আমার স্বামী। আমি তার সামনে যেতেই সে দাঁড়িয়ে গেল, বাসা থেকে চলে আসার পড় এটাই আমাদের প্রথম দেখা। সে ঠিক প্রতিদিন আসে কিন্তু আমি কোনদিনই সামনে আসি না।

সেই চেহারা নেই, চোখ গুলো কেমন কোটরে ঢুকে গেছে, সম্পুর্ণ পোশাক যেন অন্যরকম। এভাবে এর আগে কখনো দেখিনি ওকে,

– আমি বসতে বসতে বললাম, কেমন আছো?

– ভালো।

– চা-নাস্তা করা হয়েছে?

– শুধু চা দিয়েছিল।

– তো বাসায় যাবে কখন? প্রতিদিন এতো রাত করে বসে থাকো, বিরক্ত লাগে না?

– না, আর তোমার জন্য তো অপেক্ষা করি। তুমি সামনে এলে তো বসে থাকতে হতো না, আমার সঙ্গে তুমি কথা বলো না কেন?

– কথা বলতে ইচ্ছে করে না তাই বলি না।

– তোমার নাম্বার বন্ধ করে রাখছো।

– হ্যাঁ, তাহলে বুঝতেই পারছ তোমার সঙ্গে কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই বলে তো বন্ধ।

– আমার ভুল হয়ে গেছে।

– কিসের ভুল সাজ্জাদ? আজব।

– তাহলে আমাকে রেখে কেন এখানে আছো, তুমি কি আমার সঙ্গে থাকবে না শাকিলা?

– না সাজ্জাদ, তুমি তো জানো সরাসরি কথা বলা আমার বেশ পছন্দের। আজও তোমার সামনে আসার কোন ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু তুমি প্রতিদিন রাতে এসে বসে থাকো, বিশ্রী লাগে।

– আমার কি করা উচিৎ?

– তুমি কি জানো হয়তো মা-বাবা সবাই তোমার প্রতি খুব বিরক্ত?

– হ্যাঁ জানি, কিন্তু তুমি তো আমাকে পছন্দ করো ভালোবাসো, তাই আসি।

– যদি বলি আমিও তোমার প্রতি খুব বিরক্ত তবে কি আর আসবে না?

– মনে হয় আসবো না, কিন্তু আমি জানি তোমার কোনদিনই বিরক্ত আসবে না।

– তোমার জানায় ভুল আছে, আমি তোমাকে এখন খুবই বিরক্ত মনে করি। নাহলে অনেক আগেই তোমার সঙ্গে চলে যেতাম, নাহলে একা একা বাসায় যেতাম।

– চুপচাপ।

– একটা কথা বলবো?

– হুম বলো।

– তুমি আর এসো না, বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে বাবা আমাদের বিষয় কথা বলেছেন। তিনি মনে হয় শীঘ্রই ডিভোর্সের সকল কাগজপত্র নিয়ে আসবে।

– ওহ্, তোমার ইচ্ছেতে?

– হ্যাঁ।

– আমি কি আমার অপরাধ জানতে পারি?

– তোমার কোন অপরাধ নেই, তুমি অতিরিক্ত ভালো মানুষ। আর সেটাই তোমার সমস্যা, তবে বাবার সমস্যা হচ্ছে তোমার কারণে নাকি বাবার অফিসে একটা সমস্যা হয়েছে।

– হ্যাঁ কিছুটা, আমাদের একটা কাজ তোমার বাবার অফিসের করার কথা ছিল। তাদের কাজের মান ভালো না তাই আমি কাজটা অন্য কোম্পানি কে দিতে বলেছি আমাদের স্যার কে।

– তোমার কি উচিৎ ছিল না বাবার কথা শোনা?

– কাজের সময় কাজ, বাসায় এলে শশুর জামাই সম্পর্ক, তাই আগে কাজ।

– এটাই সমস্যা, যাইহোক আমি তোমার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা করি।

– তাহলে আমার সঙ্গে চলো।

– সেটা সম্ভব না, আগেই বলছি। বাবার যেমন সমস্যা তার অফিসে, আমারও তেমন কিছু সমস্যা আছে বাসাতে। তবে বলতে চাই না।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

– তুমি এখন চলে যাও, আর কোনদিন আসার দরকার নেই।

– ভাত খেয়ে যাই?

– না, বাসায় গিয়ে খেও, তোমার জন্য এখানে অতিরিক্ত রান্না করা হয় না।

– তোমার জন্য তো হয়? সেখান থেকে নাহয় একটু খেতে দিলে।

– সাজ্জাদ…? অদ্ভুত কথাবার্তা সব।

– আচ্ছা সরি, এমনিতেই ফাজলামো করেছি। তো ভালো থেকো সবসময়।

সাজ্জাদ উঠে দাঁড়িয়ে গেল, দরজা খুলে একাই বের হয়ে গেল। আমি দরজা বন্ধ করার জন্য এগিয়ে গেলাম, পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম,

– বাসায় রান্না করো নাকি হোটেলে খাও?

– সাজ্জাদ ঘুরে তাকাল, বলল, কোনটাই না। হোটেলের খাবার সহ্য হয় না, আর বাসাতে কেন যেন রান্না করতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন শুকনো খাবার খেয়ে চলে যায়, আর রাতে তো তোমাদের বাসায় খেতাম। আজ থেকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

সাজ্জাদ সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল, আমি দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে চলে গেলাম। ঘন্টা খানিক পড়ে বাবার চিৎকারে রুম থেকে বের হলাম, বাবা বলল,

– ইচ্ছে করেই চাবি ফেলে গেছে, চাবি নেবার বাহানা ধরে আবার আসবে।

– বললাম, কি হয়েছে বাবা?

– সাজ্জাদ বাসার চাবি ফেলে গেছে মনে হয়।

– তাহলে চিৎকার করো কেন? এলে আবার দিয়ে দেবে তাতেই তো হয়ে যায়।

– কোন দরকার নেই, চাবি নিচে গিয়ে দারোয়ান এর কাছে রেখে আসবো। সে এলে দারোয়ান তাকে চাবি দিয়ে দেবে।

আমি চুপচাপ রুমে চলে গেলাম, বাবা চাবি নিয়ে চলে গেছে নিচে। অন্ধকার রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জীবনের হিসাব মেলাতে লাগলাম।

রাত দুইটা।
দরজা খুলে নিচে গেলাম, দারোয়ান কাকা বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আমি তাকে ডাক দিতেই তিনি ধড়ফড়িয়ে উঠলেন।

– কে কে কে?

– কাকা আমি শাকিলা।

– ওহ্ তুমি?

– কাকা আমার হাসবেন্ড এসেছিল?

– না আসেনি এখনো।

– যদি আসে তাহলে তাকে চাবি দেবার সময় বলবেন আগামীকাল সকালে আমি বাসায় যাবো। সে যেন সকাল বেলা আমাকে নিতে আসে, বাসায় যেতে হবে না, রাস্তায় দাঁড়ালে হবে।

– আচ্ছা।

|
|

সকাল বেলা মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে শুনি বাড়ির দারোয়ান কাকা আমাকে ডাকছে। আমি মনে মনে ভাবলাম যে সাজ্জাদ হয়তো চলে এসেছে আমাকে নিতে। নিশ্চয়ই সে নিচে দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য, কাপড়চোপড় টুকটাক রাতেই গুছিয়ে রেখেছি। কোনরকমে হাতমুখ ধুয়ে ব্যাগ নিয়ে বের হলাম, মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

পিছন থেকে বারবার ডাকছে আমি শুধু বললাম, নিজের সিদ্ধান্তটা নিজে একটু নেবো।

নিচে এসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে, সাজ্জাদ আসেনি। ভোরবেলা এসে একটা চিঠি রেখে গেছে, দারোয়ান কাকা সেটাই দেবার জন্য আমার খোঁজ করছেন।

তেমন কিছু লেখা নেই, শুধু লেখা আছেঃ-

” অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল ব্যস্ত শহর ছেড়ে কোন এক নদীর চরে কিংবা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো। আজ সেই ইচ্ছে পুরণ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, বাসার সবকিছু তোমার নিজের হাতে গড়া। সেগুলো তুমি গ্রহণ করে নিও, একটাই আফসোস ‘ তুমি কেন আমার সঙ্গে এমনটা করলে সেই উত্তরটা জানতে পারি নাই। ”

|
|
|

– মা আমার হাত ধরে বললো ” আমি তো ইচ্ছে করে সাজ্জাদকে নির্লজ্জ বলিনি, রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। তুই বাড়ি ছেড়ে যাসনে শাকিলা, সাজ্জাদ ঠিকই ফিরে আসবে। ”

– আমি ঠান্ডা মাথায় বললাম, ” সে ফিরে আসুক বা না আসুক, আমি তোমাদের বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকবো না মা। তোমরা মা-বাবার দিকে তাকিয়ে আমি ওর সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। ”

– সেখানে একা একা কি করবি? তারচেয়ে বরং আমাদের সঙ্গে থাক, ও ফিরে এলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

– মা তুমি আমকে এমন কোন অনুরোধ করিও না যেটা রক্ষা করতে পারবো না। বাবা বাসায় এলে তাকে বলে দিও আমার বাসায় যেন ভুলেও না যায়। ভুল করে যদি রাস্তায় কোনদিন দেখা হয়ে যায় সেদিন যেন মেয়ে বলে পরিচয় দিতে না আসে। কারণ সে কিছু বললেও আমি কিন্তু তাকে না চেনার ভান করে এড়িয়ে যাবো।

– এসব কি বলছিস তুই? নিজের মা-বাবার সঙ্গে এসব কথা বলতে পারলি তুই? আমরা কি তোর কেউ না শাকিলা?

– ঠিক এই কথা মা, ঠিক এই কথা বলে সেদিন তুমি আর বাবা আমার মুখে তালা দিয়েছো। আমি সাজ্জাদের মতো একটা ছেলেকে বিনা কারণে অবহেলা আর অপমান করে চলে এসেছি। মাগো আমার কি দোষ? সাজ্জাদের কি দোষ?

– তোর স্বামীর কোন দোষ নেই?

– না নেই, আমার স্বামীর কোন দোষ নেই। যত দোষ সব তোমার স্বামীর মা, তোমার স্বামীর সকল দোষ। শুধু মা-বাবা বলে অন্যায় জেনেও সাজ্জাদ কে আমি দুরে রাখতে গেলাম। কিন্তু আর না, যদি সারাজীবন ওই বাসায় একা একা পার করতে হয় তবুও আর ফিরবো না।

– পাগল হয়ে গেছিস? কি বলিস এসব?

– ঠিকই বলছি, এগুলো অনেক আগেই দরকার ছিল বলার। মানুষ জাতি বড় অদ্ভুত মা ” সঠিক সময়ে সঠিক কাজটা করতে কেউ চায় না, কিন্তু পড়ে সব হারিয়ে বেঠিক সময়ে অনেক বাসনা ও যন্ত্রণা নিয়ে আফসোস করে। ”

নিজের ব্যবহৃত সবকিছু নিয়েই বাড়ি ত্যাগ করে রাস্তায় বের হলাম। আমার ছোটবোন আমার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা পর্যন্ত এসেছে, একটা রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার বোনের নাম সুমনা, সুমনা আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট।

– সুমনা বললো, আপু আমি যদি মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাই তাহলে আমাকেও কি পরিচয় দেবে না?

– তোর কথা আলাদা, তবে আমার কাছে গিয়ে কি করবি তুই? পড়াশোনা ভালো করে কর, আর তুই সবসময় মা-বাবার কথা বিবেচনা করে কাজ করবি। হুট করে তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে পড়ে আমার মতো আফসোস করবি না।

– ঠিক আছে আপু, যদি আমার কোন সিদ্ধান্ত নিতে বা বুঝতে সমস্যা হয় তাহলে তোমার সঙ্গে আলাপ করবো।

– কোন দরকার নেই, তখন বাবা বলবে আমার বুদ্ধিতে তুইও বদলে গেছো।

– আচ্ছা ঠিক আছে আমিই ভেবে নেবো।

– এখন বাসায় যা।

– আপু?

– বল।

– আমার মন বলছে তুমি বাসায় গিয়ে দুলাভাইকে পাবে, গিয়ে দেখবে সে তোমার জন্য রান্না করে বসে অপেক্ষা করছে।

– কিন্তু বাসার সবগুলো চাবি আমার কাছে।

– সে নিশ্চয়ই নতুন চাবি বানিয়েছে, তোমাকে নেবার জন্য এমন বুদ্ধি করেছে।

– তাই যদি হয় তাহলে তোকে আমি বাসায় নিয়ে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো।

– সত্যি তো আপু?

– সত্যি সত্যি সত্যি।

– তাহলে দেরি না করে চলে যাও, গিয়ে দেখো তোমার জামাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

|
|

বাসায় তালা ঝুলছে, সুমনার কথা শুনে আমি সত্যি সত্যি ধরে নিয়েছিলাম সাজ্জাদকে বাসায় পাবো। অনেকটা আশাহত হয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করলাম, চারিদিকে তাকিয়ে কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। সবকিছু খুব সুন্দর করে সাজানো আছে, সাজ্জাদ গোছালো জীবন পছন্দ করে। বিয়ের আগে থেকে সে এই ফ্ল্যাট ভাড়া করে একা একা থাকতো। সাধারণ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বিয়ের পড়ে যখন এ বাড়িতে এসেছিলাম সেদিন বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের জন্য হয়তো এতটা সাজানো, কিন্তু এরপর ঠিক যতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে তার মধ্যে কোনদিন অগোছালো দেখিনি।

রান্না ঘরে গিয়ে চুলো ধরিয়ে চায়ের জন্য গরম পানি দিলাম। বাসার প্রতিটি রুমের মধ্যে হাঁটলাম, কেমন ছমছম করছে। এর আগেও এভাবে ফাঁকা বাসায় একা একা দিনের পড় দিন পার করেছি। তখনও খারাপ লাগতো, কিন্তু দিনশেষে সাজ্জাদ বাসায় ফিরবে এই কথাটা মনের মধ্যে গাঁথা ছিল।

চায়ের কাপ নিয়ে বেলকনিতে বসে আছি, হাতের মধ্যে সাজ্জাদের লেখা সেই চিঠি। চিঠির শেষের কথাটা যেন বারবার প্রশ্ন করে আমাকে, সাজ্জাদ বলেছে ” তুমি কেন এমন করলে সেটাই জানতে পারলাম না। ”

রুমের মধ্যে গিয়ে হঠাৎ করে নজরে গেল সাজ্জাদ তার অফিস আইডি কার্ড যেখানে রাখতো সেখানে কার্ড নেই। আমাদের বিবাহিত সংসার জীবনে কোনদিন সাজ্জাদকে এই আয়নার সামনে ছাড়া কার্ড রাখতে দেখিনি।
বাসা থেকে বের হলাম, গন্তব্য সাজ্জাদের অফিস। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে, যেহেতু অফিসের আইডি কার্ড বাসায় নেই।

অফিসে গিয়ে গেট দিয়ে ঢুকতেই সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলাম। লোকটাকে আমি চিনি, তার মেয়ের বিয়ের সময় সাজ্জাদের সঙ্গে আমি তার বাসায় গেছিলাম।

– আঙ্কেল কেমন আছেন?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো মা, আপনি সাজ্জাদ স্যারের বউ না?

– জ্বি আঙ্কেল, আঙ্কেল সাজ্জাদ কি অফিসে?

– হ্যাঁ এসেছিল, ঘন্টা খানিক আগে বের হয়েছে।

– বলেন কি? আবার কখন আসবে?

– জানি না, তিনি তো অনেক সময় এভাবে চলে যায়, কখনো দেরিতে আসে আবার কখনো কখনো তাড়াতাড়ি।

– ভিতরে গেলে জানতে পারবো? সজীব ভাই কি অফিসে আছে?

– হ্যাঁ, সজীব স্যার আছে।

– ঠিক আছে আমি যাচ্ছি তাহলে।

সাজ্জাদের অফিসের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বন্ধু হচ্ছে সজীব ভাই, দুজনে একই সেকশনে কাজ করে। তিনি প্রায়ই সাজ্জাদের সঙ্গে আমাদের বাসায় যেতেন, তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট।

– আরে ভাবি আপনি? অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনি কেন কষ্ট করতে গেলেন? আমি তো ছুটির পড়ে আপনার বাসায় গিয়ে আপনার পার্সেল দিয়ে আসতাম।

আমি অবাক হলাম, মনে মনে ভাবলাম কিসের পার্সেল? কে দিয়েছে?

– বললাম, সাজ্জাদ কোথায় সজীব ভাই?

– মানে কি ভাবি? সাজ্জাদ বললো সাজ্জাদের কোন আত্মীয় নাকি অসুস্থ তাই সেখানে যাবে। ফিরতে দুদিন দেরি হবে আর আপনি নাকি তার সবকিছু জানেন। আপনি অসুস্থ তাই আপনাকে নিয়ে যেতে পারছে না।

আমি তখন এক এক করে বিগত দিনের সবকিছু সজীব ভাইকে বললাম। সব শুনে তিনি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন, মনে হয় তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ সাজ্জাদ যেহেতু তার খুব ভালো বন্ধু তাই এই বিষয়গুলো অন্তত তার সঙ্গে শেয়ার করবে এটা তার ধারণা ছিল।

– সজীব ভাই বললো, ভাবি আমি যদি একটু হলেও বুঝতে পারতাম তাহলে কোনদিনই তাকে যেতে দিতাম না।

– আপনি বলেন না ওকে কোথায় পাওয়া যাবে?

– জানি না, তবে আমার বিশ্বাস সাজ্জাদ দ্রুত ফিরে আসবে। সাজ্জাদ কিন্তু আপনাকে প্রচুর ভালোবাসে ভাবি, আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারা অসম্ভব তার কাছে।

– আমিও জানি, কিন্তু ভয়টা অন্য যায়গা ভাই।

– কোন যায়গা?

– ও কখনো আমার সঙ্গে রাগ করতো না, আমি যদিও ভুল করতাম না। তবুও সামান্য কিছু হলেও কখনো রাগতো না, কিন্তু আজ যেহেতু এতকিছু হয়ে গেছে তখন ভয় হচ্ছে খুব।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে সজীব ভাইয়ের কাছ থেকে পার্সেল নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর আসি বলে পিছনে ফিরে হাঁটা শুরু করেছি, সজীব ভাই পিছন থেকে বললো,।

– একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি ভাবি?

– আমি ঘাড় ফিরিয়ে মুখে কিছু না বলে তার দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

– আপনিও তো সাজ্জাদকে খুব ভালোবাসতেন তাই না?

– আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, হ্যাঁ।

– তাহলে আপনি কেন বদলে গেলেন? সাজ্জাদ এর মতো আমারও জানতে ইচ্ছে করছে। তাছাড়া আপনার এমনটা করার কারণ জানতে পারলে বুঝতে সুবিধা হতো সে ফিরবে কি ফিরবে না।

– আরেকদিন বলবো সজীব ভাই, ভাববেন না এড়িয়ে যাচ্ছি। আরেকদিন সত্যিই আপনাকে বলবো সবকিছু।

|
|

বাসায় ফিরে আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হয়ে গেলাম, কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে বাসায় কেউ প্রবেশ করেছিল। বেলকনিতে বসে চা খেয়ে আমি সেখানেই চেয়ার রেখে গেছিলাম, চেয়ারের উপর খালি কাপ ছিল। কিন্তু চেয়ার এখন ভিতরে, আর কাপটা রান্না ঘরে রাখা।

পার্সেলের মধ্যে একটা চেকবই, সবগুলো পাতায় সিগনেচার করা। সঙ্গে একটা চিঠি, চিঠিতে মাত্র কিছু লাইন।

” আমার যতটুকু দরকার তা সঙ্গে করে নিলাম, বাকিটা তোমার জন্য রেখে গেলাম। সজীব খুব বিশ্বস্ত তাই ওর হাতেই রেখে গেলাম, যখন দ্বিতীয় বিয়ে করবে তখন নিজেকে ডিভোর্সি বলবে না। বলবে তোমার স্বামী মারা গেছে, কারণ এই সমাজ ডিভোর্সি শুনলে নিচু চোখে দেখে। ”

কতক্ষণ কান্না করেছি জানি না, কান্না করতে করতে কখন ঘুমিয়েছি তাও জানি না। যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন চারিদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার।

বাতি জ্বালিয়ে ফ্রেশ হলাম, সবকিছু কেমন যেন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। কখনো এতো রাতে একা একা ছিলাম না বাসায়, যেদিন সাজ্জাদের বাসায় ফিরতে দেরি হতো সেদিন আগেই বাড়িওয়ালার কাছে কল দিয়ে তার মেয়েকে আসতে বলতো।

বিছানায় আমার মোবাইল পড়ে আছে, সেটা হাতে নিয়ে দেখি ছোটবোন সুমনা অনেকবার কল করেছে। এতবার কল দেবার কারণ বুঝতে পারছি না, হয়তো বাবা বাসায় ফিরে রাগারাগি করেছে। কিংবা কল দিয়ে বলবে ” আপু তুমি হঠাৎ করে চলে গেছ আমার একা একা ভালো লাগে না। ”

– কলব্যাক করলাম, সঙ্গে সঙ্গে সুমনা রিসিভ করে বললো ” কল দিলাম রিসিভ করো না কেন? ”

– ঘুমাচ্ছিলাম, বল এখন।

– আপু দুলাভাই তো নোয়াখালী চলে গেছে।

– আমি আৎকে উঠে বললাম ” কে বলেছে? ”

– ফেসবুকে একটা ছেলে তার ছবি পোস্ট করেছে, আর তিনি বাসের ভিতরে ছিলেন। তার পাশের সিটেই দুলাভাই বসে ছিল, সেই ছেলেটা ক্যাপশন দিয়ে লিখেছেন ” চমৎকার একটা মানুষের সঙ্গে এবার ভ্রমণ করলাম, জীবনের স্মরণীয় একটা ভ্রমণ করলাম। ”

– সেই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা কি?

– আমি যোগাযোগ করেছি, তার মোবাইল নাম্বার ও রেখেছি। তুমি এক কাজ করো, তাকে কল দিয়ে শুধু বলবা তোমার নাম শাকিলা। আমি তাকে সবকিছু বলছি, সুমনার বোন বললেই চিনবে।

নাম্বার নিয়ে কল দিলাম, এখন রাত দশটা পার হয়ে গেছে। আরও আগে সুমনার কল রিসিভ করতে পারলে খুব ভালো হতো।

– হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।

– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, ভাইয়া আমি সুমনার বোন শাকিলা। সুমনা নামের কোন মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে আপনার?

– জ্বি আপু।

– ভাই সাজ্জাদ কোথায়?

– আপু সেই ভাইয়াটা দুধমুখা বাজার নেমে গেছে আর আমি এসেছি বসুরহাট। বাস থেকে নামার কিছুক্ষণ পরই আপনার বোনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আরেকটু আগে যদি কথা হতো তাহলে তো তাকে আমি অনুসরণ করতাম বা বিভিন্ন অজুহাতে নিজের বাসায় নিয়ে আসতাম।

– আমি তো ভাই নোয়াখালী কখনো যাইনি, তাই কিছু চিনি না। সেখানে সে কোথায় কার বাসায় যাবে সেগুলো কিছু বলেছে?

– বললো তার অনেক আগের পরিচিত কে যেন আছে, তার সঙ্গে দেখা করে তিনি আবার নাকি ভোলা চরফ্যাশন চলে যাবেন। তারপর সেখান থেকে চলে যাবেন মণপুরা দ্বীপে।

চলবে…

গল্পঃ-
কুয়াশার মতো।
পর্বঃ- ০১ (দ্বিতীয়াংশ)

লেখাঃ- মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here