#কোনো_এক_বসন্তে
#Khadija_Akter
#পর্ব_১০
ছলছল চক্ষুযুগল সবার কাছ থেকে লুকাতেই বোধহয় জানালার কাঁচ নামিয়ে একরাশ হাহাকার নিয়ে দূর দিগন্তে তাকিয়ে রইলো চৌধুরী বাড়ির সবচেয়ে প্রাণবন্ত মেয়েটা!
সে এখনো জানে না,একটু পরেই তার জীবনে কি প্রলয় ঘটতে চলেছে!
————————————–
শপিং মলে এসে সাগর ভাইদের সাথে দেখা করার পর আমরা ভাগ ভাগ হয়ে যে যার মতো করে বিভিন্ন শপে ঢুকে গেলাম।
তিন্নি আপুকে সাগর ভাইয়ের ফ্যামিলি নিয়ে গেছে তাদের সাথে শপিং করাতে।আর আমরা এদিকটায় চলে এসেছি রাইসা আপুর হয়ে কেনাকাটা করতে।
আমি আর সাইকা সবার থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়েই এটা ওটা কেনাকাটা করছিলাম।আমার মনে কোনো ফুর্তি নেই।তাই হৈ-হুল্লোড় থেকে একটু দূরে থাকার জন্যই সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছি।
আর মূলত আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই সাইকাও আমার সাথে সাথে আছে।বেচারীর ধারণা আমার শরীর অসুস্থ তাই আমি এমন মনমরা হয়ে আছি।তাই সেও যেমন কেমন চুপসে চুপসে রইলো খানিকটা।
দুজনের নীরবে এক শপ থেকে অন্য শপ ঘুরতে ঘুরতে একসময় নীরবতা ভেঙে সাইকায় প্রথমে কথা বললো,তবুও কোনোরকমের ভূমিকা ছাড়াই!
–আচ্ছা তনয়া?এই ব্যাপারটা কি মেনে নেওয়া যায় বলতো?
–কোন ব্যাপারটা!
–এই যে আহিল ভাইয়ার সাথে রাইসা আপুর বিয়েটা!
কি থেকে যে কি হলো,হুট করে বিয়ে ঠিক করে দিল।
দুদিন পরে নাকি বিয়েও,আমার কেমন অদ্ভুত লাগছে।
সোহেলী আন্টি আর কোনো মেয়ে পেলো না,রাইসা আপুকে বাদ দিয়ে?হুহ..
–যার কপালে যে আছে,তার সাথেই তো বিয়ে হবে।
–কিন্তু তাই বলে আহিল ভাইয়ের মতো এমন ফ্রেশ মাইন্ডেড পারসোনের সাথে ঐ কুটনী রাইসা আপু!
আর সোহেলী আন্টির মতো নিরীহ মানুষটাকে কিনা রাইসা আপুর মতো মেয়েকে বউ হিসেবে সহ্য করতে হবে!উফফ..
সাইকার মুখে আহিল ভাইয়ের নামটা শুনতেই আবারও বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
কোথায় এখন আহিল ভাই?
নিশ্চয়ই রাইসা আপুকে নিয়ে তাদের হলুদের শপিং করতে ব্যস্ত!
বুকটা চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
গাড়ি থেকে নামার পর আর আহিল ভাইয়ের চোখে চোখ রাখিনি।আমি জানি,সে চোখে দেখবো শুধু আনন্দের ঝিলিক আর ঠোঁটে মুচকি হাসি!
গাড়ি থেকে নামার আগে অবশ্য শেষ আরেকবার তাকিয়েছিলাম আহিল-রাইসা কাপলটার দিকে।লুকিং গ্লাসে চোখাচোখিও হয়েছিল আহিল ভাইয়ার সাথে।আমার চোখে ছিল স্পষ্ট বেদনা আর মনে নানান রকম প্রশ্ন!’কি করছেন আপনি আহিল ভাই এটা!কেন করছেন!আপনার কাঁধে মাথা রাখার অধিকার তো শুধু আমার,আপনি না আমাকে ভালোবাসেন!তাহলে রাইসা আপু কিভাবে এতো নির্বিঘ্নে শুয়ে আছে আপনার কাঁধে!আমার যে নিজেকে খুব বেশি অসহায় লাগছে আহিল ভাই!”
আমার মনের ভাষা বুঝতে পেরেছিল কিনা আহিল ভাই সেটা তো বুঝিনি তবে চোখের ভাষা যে স্পষ্টতঃ বুঝেও ইগ্নোর করে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সেটা আমি পরিষ্কার বুঝেছিলাম।আমি বুঝে নিয়েছি,শুধুই প্রতিশোধ ছিল লক্ষ্য আহিল ভাইয়ের!আমি যে এটারই প্রাপ্য!সময় থাকতে যে সুযোগকে হাতছাড়া করেছি!
ঠিক এই কারণেই একটু আগেও যে আমি খুশির জোয়ারে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসা কথা জানিয়ে দিতে পেরেছি বলে।সেই আমিই এখন একদম চুপচাপ,নিষ্প্রাণ,নিরীহ!
কোনো আনন্দ-উল্লাসের অভিব্যক্তি নেই আমার মুখে।
মনে মনে শুধু এটুকুই ভেবে রেখেছি,আহিল ভাইয়ের সামনাসামনি আমি হবোই,আর উনার বিয়ের আগেই হবো।
উনাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবো, “কেনো এমনটা করলো?এতো নিখুঁত অভিনয়ের কি দরকার ছিল?না বুঝে তখন নাহয় রিজেক্ট করেই দিয়েছিলাম।তাই বলে আমার বাচ্চা মনে প্রেম জাগিয়ে তারপর ধোঁকা দিয়ে প্রতিশোধ! ”
–আর দেখছিস রাইসা আপু কত নির্লজ্জ?বিয়ে হবে তো কি হইছে,তাই বলে গাড়িতে আমাদের সামনে অমন ঢলাঢলি করতে হবে আহিল ভাইয়ের সাথে?ইশ তর যেনো আর সইছে না তার…
সাইকা তখনও থেকে একমনে বকেই যাচ্ছিল।
ওর শেষের কথাগুলো কানে যেতেই নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বিদ্রুপের হাসি হেসে বললাম,
–শুধু রাইসা আপুকেই দেখলি!তোর আহিল ভাইও কম কিসে?দু’জনেই তো সমান ভাগিদার ছিল এই রোমান্টিক সীনে।
আমার কথা শুনে সাইকা কিছুটা থমকে গেল।ও হয়তো ভেবেছিল,আমি ওর সাথে তালে তাল মিলিয়ে রাইসা আপুর কীর্তন করবো।
কিন্তু তা না করে হুট করে আহিল ভাইয়ের দিকে আঙুল তুলায় ও একটু দ্বিধা-দ্বন্ধে পড়ে গেল যে ওর এখন কি বলা উচিত! আমার সাথে তাল মিলিয়ে ওর সুপার হিরো আহিল ভাইয়ের ব্যঙ্গ করা নাকি আমার বিরুদ্ধে গিয়ে আহিল ভাইয়ের পক্ষে গলা উঁচিয়ে লড়াই করা!
হয়তো আমার সাথে এই মুহুর্তে তর্কে জড়াতে চাইলো না বলেই সাইকা এখনকার মতো চুপ মেরে গেলো।
————————–
–হেই হোয়াট’স আপ তনয়া!সাইকা
–আরে আকাশ ভাই!
কিছুটা পরিচিত একটা উচ্ছ্বসিত পুরুষালি কন্ঠ সেই সাথে পাশে থাকা সাইকার প্রতুত্তর শুনে আমি ঘুরে পিছনে তাকাতেই দেখলাম রনি ভাইয়ের কলেজ লাইফের বন্ধু আকাশ ভাই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
কোনো একসময় আমাদের বাসায় খুব আনাগোনা ছিল এই আকাশ ভাইয়ের।তারপর রনি ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন নিয়ে বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর আকাশ ভাইয়ের আসা-যাওয়াও কমে গেছে অনেকটা।
অনেকদিন পর আজ আবার আকাশ ভাইয়ের সাথে দেখা!উনার চেহারায় বেশ পরিবর্তন আসলেও একটু কষ্ট হলো না আমার চিনতে।খুব সম্ভবত কাজিনের বিয়ে উপলক্ষে রনি ভাই-ই ডেকেছেন আকাশ ভাইকে এখানে।
সাইকার রেসপন্স পেলেও আমার রেসপন্স না পেয়ে আকাশ ভাই আগের মতোই হাসি মুখে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
–কি অবস্থা পিচ্চি তনয়া!চিনতে পেরেছো তো আমায়!হাহা…..
বেশ প্রানবন্ত হাসি হাসলেন আকাশ ভাই।
ভদ্রতাসুলভ উনার হাতটা ছুঁয়ে দিয়ে উনার সাথে কুশল বিনিময় করে নিলাম।
আমি সাইকা আর আকাশ ভাই নানান বিষয়ে গল্পগুজব করতে করতে একসময় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব কেনাকাটা করে নিলাম।
আকাশ ভাই অত্যন্ত ফ্রী মনের হওয়ায়,উনার হাসি-ঠাট্টার পাল্লায় পড়ে আমার মনের মেঘগুলো সাময়িক ভাবে কাটা পড়ে গেল।
আহিল ভাইয়ের চিন্তাটা আপাততঃ নামিয়ে রেখে শপিংয়ে মনোযোগ দিলাম।একটু পর রনি ভাইও এসে যোগ দিলো আমাদের সাথে।
বর-কনের গায়ে হলুদে যা যা লাগে মোটামুটি সবই কেনা হলো।কেনাকাটা শেষ করে আমরা সবাই একত্রিত হলাম মেইন পয়েন্টে,যেখানে সবার মিট করার কথা।
সবাই আসলেও আহিল-রাইসা কাপল মিসিং!
এদিক সেদিক তাকিয়েও আহিল বা রাইসা আপুকে কোথাও দেখতে পেলাম না।
আমরা সবাই অপেক্ষা করতে লাগলাম তাদের জন্য।
বর-কনে বাদে আমাদের সবার জন্য হলুদের প্রোগ্রামে শাড়ি-পাঞ্জাবি কেনা হয়েছে।
মেয়েদের সবার জন্য লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি,
আর ছেলেদের জন্য সোনালী কাজের মেরুন রঙের পাঞ্জাবি কেনা হয়েছে।
অপেক্ষা করতে করতে আমার চোখ গেলো পাশেই একটা শাড়ির শপের দিকে।
কেনাকাটা শেষ কিন্তু সবশেষে এসে আমার চোখ পড়লো একটা ঐ দোকানটার একটা শাড়ির দিকে!
কাঁচা হলুদ আর টিয়া রঙের মিশ্রণের অসম্ভব সুন্দর একটা সুতি শাড়ি!লাল ব্লাউজের সাথে পড়লে অসম্ভব মানাবে আমাকে।ইশ,আগে কেনো দেখলাম না এই শাড়িটা!তবে তো এটাই কেনা যেতো সবার জন্য!
এখন যদি আমি এটা কিনিও তাহলে পড়তে তো পারবো না।সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সবার অলক্ষ্যেই এগিয়ে গেলাম সেই শাড়ির দোকানটার ভিতরে।
শাড়ীটা উল্টে-পাল্টে দেখছি আর ভাবছি কিনবো কি কিনবো না।
–হেই তনয়া,শাড়ীটা পছন্দ হয়েছে?
কথাটা বলতে বলতে যে মানুষটা আমার ঠিক পিছনে এসে একদম ঘা ঘেষে দাঁড়িয়েছেন তিনি আকাশ ভাই!এতোটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছেন যে আমার শরীরটা একটু কেঁপে উঠলো।
তিনি কখন এসেছেন আমাকে ফলো করে সেটা খেয়াল করিনি।কিন্তু উনার এরকম হঠাৎ স্পর্শে অস্বস্তিতে আমার শরীরটা রি রি করে উঠলো।
আমি নড়াচড়া করতে যাব।তার আগেই ভীড়ে ধাক্কায় আকাশ ভাই তার দেহটাকে যেনো আমার দেহের সাথে আরও চেপে ধরলেন।তারপর খুবই স্বাভাবিক ও উচ্ছ্বল কন্ঠে আবারও বললেন,
–শাড়ীটা লাগবে তোমার তনয়া!
আমার মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে!আকাশ ভাই এটা কি করছে!উনি কি বুঝে এভাবে ঠেসে দাঁড়িয়েছেন আমার পিছনে, নাকি না বুঝেই!আর এতোটা ইজিলি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন যে আশেপাশের মানুষ সেইভাবে খেয়ালও করছেন না।উনি নিজেও যেনো কিছুই বুঝছেন না!
কিন্তু উনার স্পর্শ আমাকে ভীষণ অস্বস্তি দিচ্ছে!আমার কি এটার প্রতিবাদ করা উচিত?নাকি সিনক্রিয়েট হবে সেই ভয়ে কিছু না বোঝার মতো করেই দাঁড়িয়েই থাকবো!
এর আগে তো আকাশ ভাইয়ের চরিত্রে এরকম কিছু লক্ষ্য করিনি,যদিও তখন ছোটই ছিলাম।
নাহ্,আমার সাথে যা ঘটছে এটা নরমাল কোনো ব্যপার না!আকাশ ভাই ভীড়ের সুযোগ নিচ্ছে!ছিঃ
আমি মুখে কিছুই বললাম না।চাইছি না এই পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করতে কাজিনের বন্ধুর সাথে।এমনিতেই আমাকে নিয়ে পরিবারে এখন অশান্তির শেষ নাই!এখান থেকে চুপত সরে যাওয়াই বেটার…
ডান দিকে টার্ণ নিয়ে সরে আসতে যাব তখনি চোখ পড়লো একটা সরু প্যাসেজ দিয়ে রাইসা আপু আর আহিল ভাই এদিকেই আসছেন।আমার আর আহিল ভাইয়ের একসাথেই একইসময় চোখাচোখি হয়ে গেল।
আমার ঠিক পিছনেই একটা ছেলেকে এভাবে আষ্টেপৃষ্টে আমার সাথে লেগে থাকতে দেখে আহিল ভাই যেনো হুট করেই থমকে গেলেন।একবার আকাশ ভাইয়ের দিকে তারপর আবার আমার দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকালেন!
আমি জানি না,আমার কি হলো!আমি আহিল ভাইয়ের দৃষ্টি উপেক্ষা করলাম,খুব স্বাভাবিকভাবেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
আমি আর নড়লাম না,একটুও নড়লাম না!
সামনের দিকে হয়ে পুনরায় শাড়ীটা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম,হিমশীতল শরীরটাকে নিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে।
দেখুক,আহিল ভাই দেখুক!
জীবনের কোনো একসময়েও যদি তিনি আমাকে বিন্দুমাত্রও ভালোবেসে থাকেন,তাহলে আজ হয়তো আমার পাশে কোনো একজনকে এভাবে ক্লোজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনার খারাপ লাগবে।
উনিও বুঝুক এই যন্ত্রণাটা ঠিক কি জিনিস!যেটা আমি উনার সাথে রাইসা আপুকে দেখে প্রতিনিয়ত পেয়ে আসছি!
এদিকে আকাশ ভাই এসবের কিছুই খেয়াল করলেন না।উনি উনার মতো করে এদিক সেদিক তাকিয়ে হেসে হেসে কথা বলে যাচ্ছেন আর ক্রমশঃ আমার গা ঘেঁষে ঘেঁষে আসতে লাগলেন। আমি মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম শুধু।
শুধুমাত্র আহিল ভাইকে ফীল করানোর জন্য এই মুহুর্তে আমি যে কী নারকীয় মুহুর্তটা কাটাচ্ছি তার অসহায়ত্ব কেবল মাত্র আমিই বুঝতে পারছি।
যে মেয়ে তার জীবনে ঠিক একদিন আগে আহিল ব্যতীত আর কখনো কোনো পুরুষের খুব কাছাকাছি যায়নি,সেই মেয়েই কিনা অনেক দিন পূর্বের পরিচিত একটা পুরুষের গায়ের স্পর্শ চুপচাপ সহ্য করছি!
আমার কোনোরকম প্রতিবাদ না পেয়ে আকাশ ভাইয়ের দৌরাত্ম্য যেনো আরও বেড়ে গেলো।উনি আচমকাই একটা হাতে আমার কোমরে ছুঁয়ে দিয়ে মুখটা আমার ঘাড়ের কাছে নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“তনয়া,তুমি ছোট থেকেই অনেক সুন্দর ছিলে।দিনকে দিন আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছ!”
আমার কানটা রাগে আর অপমানে ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে যেনো!এবার আমার বোঝার বাকী রইলো না যে আমি স্পষ্টত্বই মলেস্টেড হচ্ছি!আকাশ ভাই যা করছেন বা বলছেন বুঝে শুনেই করছেন!
এতক্ষণে আমার বোধদয় হলো।এটা আমি কি করছি!আহিল ভাইকে জেলাস ফীল করানোর জন্য নিজের সাথে এই জঘন্য ঘটনা মেনে নিচ্ছি!
কোথায় সেই আহিল ভাই!সরাসরি ঘাড় ঘুরিয়ে ডানদিকে তাকালাম এবার,যেখানে আহিল ভাই থমকে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে উনি নেই!মানে উনার কোনো ফারাকই পড়েনি!
আকাশ ভাইয়ের এই ব্যবহারের মাশুল তো পরে উনাকে দিতেই হবে কিন্তু এই মুহুর্তে উনার এই ব্যবহারটা যে আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
আশেপাশে তাকিয়ে ফ্যামিলির কাউকে দেখতে না পেয়ে,আমার হঠাৎ করেই কেমন ভয় লাগতে শুরু করলো।আকাশ ভাইকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে ঝটপট উনার সামনে থেকে সরে আসতে চাইলাম।
কিন্তু একি!আকাশ ভাই যেনো সরছেনই না।দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন।উনি আমার অস্বস্তিটা বুঝতে পেরেও আবার হাসিমুখে আমার ঘাড়ের কাছে মুখটা নামিয়ে আনলেন কিছু বলার জন্য!
আমি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে নিজের চোখটা বন্ধ করে নিলাম।
চোখ বন্ধ করার সাথেই সাথেই প্রচন্ড জোরে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে চমকে গিয়ে চোখ খুলে তাকালাম।চারদিকে মানুষের দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু হয়ে গেছে।
আমার চোখ বন্ধ রাখা এই এক মুহুর্তের ব্যবধানে যেনো শাড়ির শপটার সামনের অংশটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল।চেয়ে দেখলাম বিপরীত পাশের একটা দোকানের স্ট্যান্ডকে আঁকড়ে ধরে আকাশ ভাই উঠার চেষ্টা করছেন।
আর আমার বামদিকে রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে আকাশ ভাইয়ের দিকে তীব্র ঘৃণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আহিল ভাই!
যতটা বুঝলাম,আহিল ভাই চলে যাননি তখন বরং আমাদের ফলো করছিলেন।
আমার সাথে এহেন ব্যবহার সহ্য করতে না পেরেই একসময় আমার অজান্তেই বামদিক থেকে এসে আকাশকে আঘাত করেছে।
আকাশকে উঠে দাঁড়াবার সময় দিয়ে আহিল ভাই আবারও রুখে গেল উনার দিকে।
দূরে রাইসা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে,আশেপাশের মানুষও দাঁড়িয়ে তামাশা দেখা শুরু করে দিয়েছে আর সবার সাথে আমিও যে এক অপরাধী নীরব দর্শক!
ফ্যামিলির সবাই বিশেষ করে রনি ভাইয়ের তৎক্ষনাৎ সেখানে উপস্থিতি তখনকার মতো ঘটনাটা সেখানেই থামিয়ে দেয়।
সমস্ত ঘটনাটা বুঝে নিয়ে রনি ভাই নিজেও ধিক্কার জানায় আকাশকে।
তারপর বেশ কিছুসময় পরে রনি ভাই অনুতপ্ত হয়ে এগিয়ে আসেন আমাদের দিকে।
একবার আমার দিকে চেয়ে তারপর তাকালেন আহিল ভাইয়ের দিকে।অত্যন্ত করুণ গলায় বললেন,
–আসলে আহিল ভাই,ও আমার বন্ধু!আমি ভাবতেও পারিনি ও এমন কিছু করবে।ও মাফ চাইতে প্রস্তুত আছে এখন……
হাত নেড়ে রনি ভাইকে থামিয়ে দেন আহিল ভাই।যেনো হুঙ্কার ঝরে পড়লো আহিল ভাইয়ের গলায়,প্রথমবারের মতো উনি কথা বললেন।রাগে উনার গলা গমগম করছে, অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে হয়তো উনি ইংরেজিতে বলতে শুরু করে দিয়েছে,
— Rony, I don’t want to hear any excuses! I don’t even want to know who he is.
This coward has no right to touch Tanaya! He has no right. He has no right at all.
I will give this culprit to the police…..
——————————–
গাড়িতে বসে আছি আহিল ভাইয়ের পাশে!
শুধু তিনি আর আমি;আমাদের গন্তব্য বাসা!
আহিল ভাইয়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না একদম,কথা তো দূর কি বাত।ভয়ে ভয়ে দু’য়েকবার যাও বা তাকিয়েছিলাম ঐ কঠিম মুখ,লাল চোখ-কান,-মুখ,থেকে থেকে ফুলে উঠা নাকের পাটাতন দেখে সাহস হয়নি কোনো কথা বলার।
ফ্যামিলির বাকী সবাই পরের দুই গাড়িতে করে আসছে।
ওখানকার ঝামেলাটা কোনোভাবে মিটে যাওয়ার আগেই আহিল ভাই সবার সামনের থেকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিলেন আমায় গাড়ির কাছে।
গাড়ির দরজা খুলেই একপ্রকার ছুড়ে ফেলেছেন আমাকে গাড়ির ভিতরে।
তবে আহিল ভাইয়ের আজকের এই রুডনেস আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি; একদম না!
আমি জানি,বাসায় যাওয়া মাত্রই এই ঘটনা নিয়ে আবারও হাঙ্গামা বাঁধবে!আবারও কালপ্রিট আমি!পরিবারে অশান্তি শুরু হবে আমাকে নিয়েই,তার উপর বিয়ে বাড়ি!
যতটা জানি,আকাশ ভাইয়ের পরিবার যথেষ্ট প্রভাবশালী!এর জন্যই হয়তো রনি ভাই চেয়েছিলেন আপোষে সবটা সমাধান করতে কিন্তু আহিল ভাই তো মাথা গরম করে চলে আসলেন!
এতো এতো দুশ্চিন্তার মাঝেও কেনো যেনো মনের ভিতর একটা ভালো লাগা কাজ করছে আমার!পাশেই ড্রাইভিং সীটে বসা মানুষটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো দিন শেষে রাইসা নয় বরং আমিই বসে আছি মানুষটার পাশে।
সামনে কি হবে না হবে আর না ভেবে সীটের মধ্যে মাথাটা ঠেকিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
#চলবে