ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২২
.
আঁধার রাত্রি। বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে কিছু জোনাক পোকা মিটমিট আলো জ্বালিয়ে এদিকে আসছে আর যাচ্ছে। পদ্য রেইনট্রি গাছের গোড়ায় দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। নির্জন, নিস্তব্ধ এই স্থানে শব্দ বলতে নানান পোকা-মাকড়ের ডাক আর পদ্যের ফোঁপা কান্না। সে ঠিক বুঝতে পারছে না এখন কী করবে। তবে নাঈম ভাইয়ের বউয়ের কথাই ঠিক। উনার সঙ্গে কথা বলতেই এখানে এসেছিল। সত্যিই তো অনিক ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা ঠিক হবে না। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে তার জীবনের সঙ্গে জড়ানো অন্যায়। অনিককে ভালোবাসে সে, অবশ্যই ভালোবাসে। এখন নতুন এই আগন্তুককে সে বিয়ে করে দেহ ছাড়া আর কী দিতে পারবে? অনিক ছাড়া আর কারও স্পর্শে কি তার মন জেগে উঠবে? কখনও না। তাহলে কেন সে বিয়ে করতে যাচ্ছে? মন থেকে যাকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করতে পারবে না তাকে বিয়ে করা তো অন্যায়। কেন আরেকজনের জীবন নষ্ট করবে সে? এই একটা বিয়েই তো তিনটা জীবনকে এলোমেলো করে দেবে। সে নিজেই বা কি করে অনিককে ছাড়া এই দীর্ঘ জীবন কাটাবে? অনিকেরই বা কী হবে? পদ্য ভাবতে পারে না আর। কান্না আসে। বেপরোয়া কান্না। দুইহাতে মুখ ঢেকে নিজের কান্না সামলে রাখতে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে। মতিন সাহেব কখন রেইনট্রি গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন, পদ্য টেরই পায়নি। তিনি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন। খানিক পর এগিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ঘরে আয় তো মা।’
পদ্য কেঁপে উঠে মাথা তুলে তাকায়। বাবাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে৷ চকিতে চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বললো, ‘হ্যাঁ বাবা, আসছি।’
– ‘আয় আমার সাথেই আয়।’
পদ্য পিছু পিছু গেল। এখন কান্নার কারণ কী বলবে সে? বাবা স্পষ্ট শুনেছেন হয়তো। ঘরে এসে মতিন সাহেব বিছানায় বসে বললেন, ‘মনিসা এখান থেকে যা তো মা।’
মনিসা চলে গেল। মনিরা বেগম টেবিলে রাতের খাবার দিচ্ছিলেন। পদ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি হয়েছে? এই রাতেরবেলা বাড়ির পেছনে কেন গিয়েছিলি?’
মতিন সাহেব হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে পদ্যকে টেনে কাছে বসালেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বলতো মা কী হয়েছে। সত্য বলবি। তুই এই রাতের বেলায় রেইনট্রি গাছের গোড়ায় বসে কান্নার কারণ কী?’
পদ্য বাবার কাঁধে মুখ লুকিয়ে নাক টেনে বললো, ‘কিছু না আব্বা।’
– ‘কিছু না বলবি না। কিছু তো আছে। এত লুকোচুরি না করে বল। আব্বাকে বল, শুনি কি হয়েছে।’
– ‘আমার যাইহোক আব্বা, তোমাদের ইজ্জৎ যাবে এমন কিছুই আমি করবো না।’
– ‘কী বলিস মা এগুলো? কি হয়েছে বলতো? বল আব্বাকে।’
পদ্যের কান্নার তোড় আরও বেড়ে গেল। মনিরা বেগম পাশে বসে বললেন, ‘কী হয়েছে বল তো মা। তুই বাড়ির পেছনে বসে কাঁদছিলি না-কি? তোর হাবভাব দেখে তো ধীরে ধীরে বুঝতেছি কিছু একটা আছে৷ তুই আমাদের বলছিস না কেন?’
– ‘মা এগুলো শুনলে তোমরা কষ্ট পাবে। আমি যতই কষ্ট পাই। তোমরা যা চাও তাইই হবে।’
মতিন সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমাদের কষ্ট আর ইজ্জতের কথা বলছিস কেন মা? কী হয়েছে বলবি তো।’
মনিরা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন, ‘তোর কি এই বিয়েতে মত নাই? কোনো পছন্দের ছেলে আছে না-কি?’
মতিন সাহেব যোগ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, যদি থাকে বল। এতদিন থেকে বলছিস না কেন? তোর পছন্দের ছেলে থাকলে অনেক আগেই তো বিয়ে দিয়ে দিতাম। এখানে ইজ্জতের কি আর আমাদের কষ্টের কিরে মা? তোদের সুখ-শান্তি থেকে বড়ো আর কিছু কী আছে? তোদের সুখই তো আমাদের সুখ। আমাদের কষ্ট আর ইজ্জতের কথা ভেবে নিজে কষ্ট পাচ্ছিস কেন? সব বল আব্বাকে, বল।’
পদ্যের কী যে হলো। বুক ফেটে যেন কান্না আসছে৷ বাঁধ ভাঙা কান্না। তবুও ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলেই ফেললো, ‘অনিক আমাকে বিয়ে করতে চায় আব্বা। আমিও পছন্দ করি তাকে। তবুও তোমাদের কথা ভেবে ওকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছি, অপমান করেছি। কিন্তু আব্বা আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, আমার বিয়ে হলে ছেলেটা ম*রে যাবে। তোমরা প্লিজ আমার বিয়েটা ভেঙে দাও।’ পদ্য কথাগুলো বলেই এখান থেকে চলে গেল পাশের রুমে। এত কান্না পাচ্ছে কেন! সে বিছানায় গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে রইল।
মতিন সাহেব যেন বাকরূদ্ধ হয়ে গেছেন। শূন্যদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে মনিরা বেগম এগিয়ে গেলেন পদ্যের কাছে। গিয়ে মাথায় ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘কী বললি তুই পদ্য? তোর কী মাথা ঠিক আছে? অনিক তোর বয়সে ছোটো। সারাদিন আপু বলে ডাকতো। এই কথা মুখে আনলি কীভাবে? এতদিন যেহেতু চুপ ছিলি, বিয়ে পর্যন্ত চুপই থাকতি।’
পদ্য বালিশ থেকে মুখ তুলে বললো, ‘আম্মা, মুখ যখন খুলেছি তাহলে পরিষ্কার একটা কথা শুনে রাখো। আমি বিয়ে করবো না। বিয়ে ভেঙে দাও।’
– ‘তো কাকে করবি? যে আপু ডাকে তাকে? লোকে বাড়ি এসে থু থু দিয়ে যাবে। এসব কথা মুখেই আনবি না।’
– ‘আমি অনিককেও বিয়ে করবো না আম্মা। বিয়ে ছাড়াই থাকবো। বিয়ে ভেঙে দাও। এটাই আমার ফাইনাল কথা।’
– ‘ও আচ্ছা, মা-বাপ রাইখা এখন তুই ফাইনাল কথা বলবি, তাই না? দুই পয়সা রুজি করে খাওয়াচ্ছিস বলে মুখ ফুইটা গেছে তোর?’
– ‘এখানে রুজির কথা আসছে কেন আম্মা?’
– ‘রুজির জন্যই তো এত তেজ। না হইলে ছোট ভাইয়ের মতো একটা ছেলের সাথে পিরিত কইরা, মা-বাপকেও আবার শুনাইতি না। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েছিস।’
– ‘অকারণ প্যানপ্যান করবে না আম্মা। আমি কোনো তেজ দেখাচ্ছি না। অনিককেও বিয়ে করতে বলিনি। বলেছি বিয়েই করবো না।’
– ‘তো এক কথাই তো হইল। অনিককে ছাড়া বিয়ে করবি না।’
– ‘হ্যাঁ, তুমি যা বুঝো তাই।’
মনিরা বেগম দাঁত কটমট করে তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বের হয়ে গিয়ে মতিন সাহেবের সামনে দাঁড়ালেন।
– ‘চুপচাপ বসে আছো কেন এখন? মেয়েরে আরও আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তুলে রাখো।’
মতিন সাহেব তবুও চুপচাপ বসে রইলেন।
.
নাঈম অফিসে যাওয়ার পর আফরা পুনরায় অনিকের দরজার সামনে গেল। ভেজানো দরজা খুলে বললো, ‘কল বা মেসেজ কিছুই দেয়নি পদ্য?’
অনিক বালিশ থেকে মাথা তুলে বললো, ‘ভাবি কেন বারবার একই প্রশ্ন করছো? রাতে দুইবার, ভোর সাতটার সময় একবার, এখন আবার। সমস্যা কী? স্বপ্ন দেখো না-কি কিছু?’
আফরা দরজা লাগিয়ে আবার নিজের রুমে চলে এলো। মেয়েটি এখনও কল দেয়নি কেন? এত করে বুঝানোর পরও একটু বুঝলো না? অনিক আজ রাতের খাবারও খায়নি। ভোরে নাশতার জন্য ডাকলে বিরক্ত হচ্ছে৷ তার আলো না-কি অসহ্য লাগে। ছেলেটা কখনও একেবারে স্বাভাবিক, আবার কখনও রেগে যাচ্ছে। এভাবে কতদিন? এদিকে নাঈম আর তার বাবা আছে ইভাকে নিয়ে। ইভা যেন সব সময় সঙ্গে থাকে, কথা বলে। তাদের কথা হলো জো*র করে হলেও ইভার প্রেমে ফেলে ছাড়বে। পদ্যও চায় অনিক স্বাভাবিক হোক। সেটা যদি নতুন করে ইভার প্রেমে পড়ে হয়। তাতেও অসুবিধা নেই৷ কিন্তু এটা তো অনিশ্চিত। অনিক প্রেমে তো পড়ছে না। অন্যদিকে পদ্যের বিয়ে হতে চলেছে। একবার বিয়ে হয়ে গেল কি আর করার থাকবে? আফরার অস্থির লাগছে। পদ্যের উপরও মেজাজ খারাপ হচ্ছে। একটা ছেলে ক্রমশই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে কেউই বুঝতেই চাইছে না। একজন আছে কথা বললে প্রশ্রয় পেয়ে যাবে, তখন ভুলতে কষ্ট হবে। আর বাপ-ভাই আছে ইভাকে নিয়ে। আফরা ইভার রুমে গেল।
রুমে নেই সে। বারান্দায় গিয়ে দেখে রেলিঙ ধরে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি।
– ‘কিরে ইভা, ভার্সিটিতে গেলি না যে?’
ফ্যাকাসে মুখে হেঁসে ওর দিকে তাকায় ইভা। তারপর বলে, ‘দুলাভাই গতকাল ভোরে বললেন কয়েকদিন ভার্সিটিতে না গিয়ে অনিককে একটু সময় দিতে।’
– ‘ও আচ্ছা।’
ইভা বুকে হাত বেঁধে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আপু আমি ভাবছি তোমাদের এখান থেকে চলে যাব।’
আফরা কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘আরে কেন? কী হয়েছে?’
– ‘তোমাদের কী মনে হয় আমাকে? আমি রাস্তার সস্তা মেয়ে? শুরু থেকেই তোমরা আমাকে অনিক ভাইয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলে৷ আমি যেন উনাকে মুগ্ধ করতে পারি৷ বৈরাগী এই পুরুষকে যেন সংসারের দিকে ফেরাতে পারি। মাঝে মাঝে অপমানবোধ করতাম। কিন্তু কেন যেন মানুষটা আমাকে চম্বুকের মতো নিজের দিকে টেনে রেখেছিল। তাই নিজের অজান্তেই তোমাদের কথামতো চলেছি। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, অনিক ভাইকে আমার শেষদিকে অনেক ভালো লাগতে শুরু করেছিল। কিন্তু গতকাল ভোরে নাঈম ভাইয়ের ফোনালাপ থেকে বুঝলাম অনিক ভাই অন্য কাউকে ভালোবাসে। এখন তারা মরিয়া উঠেছে আমি যেন বেশি করে মিশি। তাদের ছেলেকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনি। তোমরা আমাকে উনার ভালোবাসার মানুষ আছে সেটা বলোনি। নাঈম ভাইও কাল গ্রামে ফোনে কথা বলে রান্নাঘরে এলেন। এসে সেটা গোপন রেখে বললেন, ‘ইভা অনিককে সময় দিয়ো। কি যে করো তুমি৷ অনিককে প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাবাতে পারো না? তোমার মতো সুন্দরী থাকতে তালতো ভাই বিয়ে করতে চায় না। এটা কিছু হইল?’
তুমি বুঝতে পারছো কথাগুলো? এসব কী? তোমাকে কেউ এরকম বললে কেমন লাগতো। যাইহোক, অন্যের বিষয় জানি না। আমার ইগোতে লাগছে এসব। এতদিন নিজেকে যা সস্তা করেছি, এনাফ। আর আমি পারবো না। তুমি জানো? গতকাল সন্ধ্যায় কেন বাইরে নিয়ে গেছি তোমার দেবরকে? সেটাও নাঈম ভাইয়ের জন্য৷ উনি মেসেজ দিয়ে বলেছেন। আমার ধারণা ওরা দু-দিন পর বিরক্ত হয়ে বলবে, ‘ইভা অনিকের রুমের দরজা বন্ধ করে কাপড় খুলে ওর সামনে বসে থাকো গিয়ে। দেখি শা*লার ব্যাটা কীভাবে ঠিক থাকে।’
মানে পুরো বিষয়টা আমার খুবই আত্মসম্মানে লাগছে আপু। আমি নিতে পারছি না৷ শুধু মাত্র অল্প হলেও অনিক ভাইয়ের প্রতি আমার দূর্বলতা ছিল বলে এতদিন মেনে নিয়েছি। ইভেন আমি উনার একটা উপন্যাসের চরিত্রের মতো হতে চাইতাম। কিন্তু এখন নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাই। উনি আরেকজনকে ভালোবাসে, এটা জানার পরও আমি কীভাবে এসব করবো? আমারও তো একটা মন আছে৷ আজ তোমার দেবরের যে অবস্থা। সেটা আমারও তো হতে পারে দু’দিন পর..।’ আর বলতে পারলো না ইভা। মুখ লাল হয়ে চোখ ফেটে জল এলো। আফরা এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথায় বুলিয়ে বললো, ‘স্যরি ইভা, আমি নিজেও এতটা গভীরভাবে ভাবিনি। তোর সাথে সত্যিই অন্যায় হচ্ছে।’
– ‘আপু একটু আগে আব্বাকে কলে বলেছি। আমি বাড়ি চলে যাব। বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে ভার্সিটিতে আসব।’
– ‘কী বলিস এসব? এখানে থাক, আমি নাঈমকে বলবো তোকে আর এসবে না জড়াতে।’
– ‘না, আপু। তুমি আর জোরাজুরি করো না। আমাকে যেতে দাও। আর ওদেরকে বলবে বাড়িতে গেছে। মাস খানেক থাকবে। আর কিছু বলার দরকার নেই।’
– ‘সত্যিই চলে যাবি?’
– ‘হ্যাঁ, একটু পরই বের হব।’
আফরা আর কিছু না বলে নিজের রুমে চলে এলো। মাথা ধরছে। সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কী করবে না করবে কিছুই বুঝতেই পারছে না। তার এত সমস্যা কী? নিজের বাপ-ভাইই যদি না বুঝে সে একা কী করবে? দীর্ঘ সময় এভাবে শুয়ে থাকার পর আবার উঠে গেল অনিকের দরজার সামনে। খানিকক্ষণ ইতি-উতি করে দরজায় ধাক্কা দিয়ে খুলতেই অনিক বিছানা থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, ‘আবার কি ভাবি?’
– ‘যোগাযোগ করেনি পদ্য?’
– ‘এদিকে আসো তো তুমি।’
আফরা গিয়ে চেয়ারে বসে। অনিকও বিছানায় উঠে বসে বললো, ‘সমস্যাটা কী বলো তো? তোমার কেন মনে হচ্ছে তুমি বলতেই পদ্য আমার সাথে যোগাযোগ করে ফেলবে?’
আফরা অবাক হয়ে বললো, ‘তুমি জানলে কীভাবে আমি বলেছি?’
– ‘সেটা তোমার জানা লাগবে না।’
– ‘আসলে আমি ওকে কল দিয়ে অনেক বোঝালাম। মেসেজেও বললাম তবুও..।’
অনিক অট্টহাসিতে ঘর কাঁপিয়ে তুলে বিদ্রুপ করে বললো, ‘এত বুঝিয়েও কাজ হয়নি, তাই না? কাজ হবে না। এই মেয়ে একটা হৃদয়হীন নারী, পাথর মানবী.. ।’ এটুকু বলে থামে সে। তারপর একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে পুনরায় টান দিয়ে বলে, ‘নিশ্চয় অনেক বুঝিয়েছো। অনেক আবেগ, অনুভূতি আর মনের মাধুরি মিশিয়ে বুঝিয়ে ভেবেছো কাজ হয়ে যাবে। হবে না ভাবি। কাজ হবে না৷ অকারণ অস্থির হইয়ো না। শান্ত থাকো। মনে করো এই মেয়েকে কিছু বলা মানে এই ঘরের দেয়ালকে বলা, দেয়ালকে সারাদিন বললে কোনো জবাব পাবে? পাবে না…।’
‘চুপ করো অনিক, আর তুমি কী সারাদিন এই অন্ধকার রুমে এভাবে শুয়ে থাকবে? চেহারার অবস্থা দেখেছো কি হয়েছে? উঠে ফ্রেশ হয়ে কিছু খাও।’
অনিক মুচকি হেঁসে সিগারেট দেখিয়ে বললো, ‘এই যে খাচ্ছি।’
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলামছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৩
.
পদ্যদের বাড়িতে বেশ কয়েকজন মানুষ এসেছেন। বাজার থেকে ডাক্তারও আনা হয়েছে। মতিন মাস্টার রাতে হঠাৎ মনিরা বেগমকে বলেছিলেন ঘাড় ব্যথা করছে। চোখে অস্পষ্ট দেখছেন। একবার প্রস্রাব করতে উঠতে যেয়ে পড়েও গেলেন। মনিরা বেগম ধরে বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভোরে অবস্থা দেখে তিনি অস্থির হয়ে সবাইকে ডাকলেন। মতিন মাস্টার বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। বাঁ হাত আর পা অবশ হয়ে গেছে। মুখ একদিকে বেঁকে গেছে খানিকটা। সেখানে এসে লালা জমছে। মনিরা বেগম সাদা কাপড় দিয়ে বারবার মুছে দিচ্ছেন। পদ্য ডাক্তারকে বললো, ‘কী হয়েছে? হাসপাতাল নেয়া লাগবে তাই না?’
ডাক্তার মাথা নেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি নেওয়া দরকার৷’
মিরাজুল ইসলাম সাবেক মেম্বার থাকায় কেউ কেউ এখনও সে নামে ডাকে৷ রইসু মিয়া বললেন, ‘মেম্বার, লক্ষণ ভালো না। তাড়াতাড়ি পাঠানো দরকার।’
মিরাজুল ইসলাম পেছনে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, ‘বাজার পর্যন্ত নিতে হলে তো লোক লাগবে।’
– ‘আমি গিয়ে পলো আর দড়ি নিয়ে আসতেছি। দেখি মানুষও পাই কি-না। আপনি এক কাজ করেন। নাঈম, অনিক তো শহরে আছে ওদের কল দিয়ে জানান৷ এরা মহিলা মানুষ, কিছুই তো বুঝবে না।’
মিরাজুল ইসলাম ইতস্তত করে বললেন, ‘আচ্ছা আমি নাঈমকে বইলা দিচ্ছি।’
তিনি বাইরে গিয়ে নাঈমকে কল দিয়ে এসে মনিরা বেগমকে বললেন, ‘রেডি হোন ভাবি। আর টাকা-পয়সা নিয়ে যান। কখন কি লাগে বলা তো যায় না।’
মনিরা বেগম এসে তাড়াতাড়ি বোরখা পরতে পরতে বললেন, ‘এই মনিসা যেতে হলে রেডি হ।’
– ‘আম্মা আপু যাবে না?
– ‘ওর কথা মুখে আনবি না৷ এই সর্বনাশীর কারণে আজ এই অবস্থা।’
পদ্য বোরখা হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ‘আম্মা এখন এসবের সময় না। দয়া করে চুপ থাকো..।’
মিরাজুল ইসলাম ঘরে ঢুকছেন দেখে সে চুপ হয়ে গেল। মনিরা বেগমও আর কিছু বললেন না।
মিরাজুল ইসলাম বিছানায় বসে বললেন, ‘পদ্য মা, নাঈমকে শহরে গিয়েই কল দিয়ো। আমিও যেতাম। কিন্তু তার দরকার হবে না। নাঈম তো আছেই।’
– ‘আচ্ছা চাচা।’
– ‘নাঈমের নাম্বার আছে তো?’
– ‘হ্যাঁ, আছে।’
– ‘তাহলে আর কোনো অসুবিধা হবে না৷ আল্লাহর হাউলা।’
তারা তিনজনই রেডি হলো। মনিসাকে একা রেখে যাওয়া যায় না। ঘর তালা দিয়ে তারা বের হলো বেলা এগারোটার আগেই। দু’জন লোক মতিন সাহেবকে পলোতে বসিয়ে কাঁধে করে নিয়ে এলো রসুলপুর বাজারে। পুরো রাস্তায় মনিরা বেগম পদ্যকে কখনও দাঁত কটমট করে আবার কখনও চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। কারণ আজকের এই অবস্থার জন্য তো পদ্যই দায়ী।
.
নাঈম অফিসে যাওয়ার আগেই কলটা পেয়েছিল। মতিন সাহেব তারও স্যার। পাশাপাশি বাড়িও তাদের। তাই ব্যাপারটা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। অফিসে কল দিয়ে ছুটি নিয়েছে। অবশ্য অনিককে দিয়েও হয়ে যেত। কিন্তু মিরাজুল ইসলাম ফোনে বলেছেন অনিককে না জানিয়ে সবকিছু যেন সে করে। অফিসে যাচ্ছে না দেখে আফরা তাকে বলেছিল, ‘অফিসে যাবে না?’
সে জবাবে বলেছে, ‘না, পদ্য আছে না? ওর বাবা অসুস্থ। ওরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসবে। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। বুঝোই তো গ্রামের মানুষ, এর মাঝে পুরুষ কেউ সঙ্গে নাই।’
– ‘বলো কী! কী অসুখ?’
– ‘আব্বা যেসব বলেছেন। তাতে মনে হয় মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে।’
– ‘অফিসে না গিয়ে তাহলে ভালোই করেছো।’
– ‘হ্যাঁ, তা তো একটু করতেই হবে। উনি আমাদের স্কুলের স্যার। তাছাড়া পাশের বাড়ি হিসাবে তাদের সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল।’
– ‘অনিককে বলি, সেও জানে না হয়তো..।’
নাঈম হাত ধরে আঁটকে বললো, ‘দরকার নেই, আব্বা না করেছেন।’
আফরা সেই থেকে চুপচাপ বসে আছে। নাঈমের সঙ্গে কথাই বলছে না। এই বিপদে নাঈম না গিয়ে অনিক ছোটাছুটি করলে হয়তো পদ্য সহ ওর পরিবার তার প্রতি খানিকটা খুশি হতো। এই সুযোগও ওরা কাজে লাগাতে দেবে না।
নাঈম হাসপাতাল থেকে রাতে বাসায় ফিরে এলো। আফরার সাময়িক রাগ ততক্ষণে পড়ে গেছে। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী অবস্থা ওদের?’
নাঈম শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো, ‘টেস্ট-বেস্ট করেছে, হাসপাতালে থাকা লাগবে কিছুদিন। থেরাপি-টেরাপিও লাগবে।’
– ‘ওরা খাবে কোথায়?’
– ‘বাইরে থেকে খেতে হবে। পদ্যকে রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে দিয়েছি।’
– ‘আমি একবার দেখতে যেতে চাচ্ছিলাম।’
– ‘কাল অফিসে যাওয়ার আগে আমি ওদের দেখে যাব। তুমি তখন সঙ্গে যেতে পারো।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
– ‘একটা সমস্যা আছে। ওরা থাকবে কীভাবে বুঝলাম না৷ তিনজন সঙ্গে এসেছে।’
– ‘আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে। ওরা একেকদিন, একেকজন থাকলো রোগীর সাথে।’
– ‘তা ঠিক বলেছো। কিন্তু পদ্যকে তো আনা যাবে না৷’
– ‘আনলে সমস্যা কী?’
– ‘জানো না মনে হচ্ছে।’
– ‘তুমিও নাঈম বেশি বাড়াবাড়ি করছো।’
নাঈম হেঁসে বললো, ‘আরে আমার কী এখানে। আব্বা শুনলে রাগারাগি করবে।’
– ‘আব্বা শুনবে কীভাবে?’
– ‘না শুনলেও। তবে মনিসা আর চাচিকে তুমি কাল গেলে বইল। রাতে আমাদের বাসায় চলে আসতে। একদিন আমি নিয়ে আসলেই ওরা একা আসতে পারবে।’
আফরা কোনো জবাব দিল না। সোফায় বসে রইল। নাঈম ওর পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘তুমি অনিকের বিষয়টার জন্য অকারণ আমার সাথে কিছুদিন থেকে রাগারাগি করছো।’
– ‘আমি রাগারাগি করব কেন? তোমার ভাই, কিছু হলে তোমার ভাইয়ের হবে, আমার কী?’
নাঈম তাকে পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আচ্ছা পদ্যকে আনতে পারবে না বলে রাগ করছো তো? তুমি এটা ছাড়াও একটা ভালো কাজ করতে পারো।’
– ‘কী?’
– ‘এই কাজ করলে আব্বাও জানবে না। সেটা হলো ওদেরকে খাওয়ানো। আমি অফিস যাওয়ার সময় দিয়ে যাব। একটু বেশি করে দেবে যাতে পদ্য রাতেও খেতে পারে। আর চাচি মনিসা এখানে এসে থাকবে যেহেতু। রাতে খেতে পারবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
নাঈম ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘ইভা আর যাওয়ার সময় পেল না বুঝি? বললাম কিছুদিন অনিককে সময় দিতে।’
– ‘ও থেকেও কাজ হতো না নাঈম। অকারণ তোমরা এসব করছো। সিরিয়াস প্রেমে বিচ্ছেদ হলে কেউই স্বাভাবিক হয় না।’
– ‘কত দেখেছি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে রাতে দুই-তিনটা সিগারেট টেনে ভোরে সবকিছু ভুলে যায়।’
– ‘এগুলো তেমন সিরিয়াস না। সিরিয়াস প্রেম হলে বিচ্ছেদ কম হয়। পালিয়ে-টালিয়ে বিয়ে করে ফেলে। অথবা ছেলে-মেয়েরা অতিরিক্ত পাগলামি করলে পরিবার মেনে নেয়। আর যাদের নেয় না এরাই আত্মহ*ত্যা করে অথবা পা*গল হয়। কেউ কেউ স্বাভাবিক হলেও পুরোপুরি হয় না।’
নাঈম হেঁসে উঠে বললো, ‘তুমি অকারণ দুশ্চিন্তা করছো।’
– ‘নাঈম তোমরা কাজটা ঠিক করছো না। অনিক অনেক শক্ত ছেলে। সেও এমন ভেঙে পড়েছে বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? অফিসে যায় না। সারাক্ষণ অন্ধকারে বসে থাকে। উলটা-পালটা কথা বলে।’
– ‘তো আমি কী করবো বলো? পদ্য নিজেই তো মানেনি তাকে। এরপর আছে দুই পরিবার। ব্যাপারটা এত সহজ না-কি?’
– ‘তোমার ভাইয়ের বাঁচা-মরার প্রশ্নে তোমার কিছুই করার নেই?’
– ‘তুমি যেরকম ভাবছো এরকম কিছুই হবে না। কিছুদিন পর ভুলে যাবে।’
আফরা ওর বুকে মুখগুঁজে ফ্যাসফ্যাসে কেঁদে ফেললো। নাঈম অবাক হয়ে মাথায় হাত রেখে বললো, ‘আরে পাগল না-কি? হঠাৎ কাঁদছো কেন?’
– ‘অনিক মোটেও ভুলতে পারবে না। কিছু একটা করো নাঈম। আমি আজ অনিকের ডায়েরি পড়ে সারাদিন একা একা কেঁদেছি। এত কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার জন্য।’
– ‘কীসের ডায়েরি?’
– ‘গতকাল দুপুরে ওর রুমে গিয়েছিলাম৷ গিয়ে দেখি সে ঘুমিয়ে আছে। পাশে নীল ডায়েরি একটা। তুলে এনে পড়তে শুরু করে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। সহ্য করতে না পেরে রেখে এসেছি আবার। ইস কত ভালোবাসে ছেলেটা৷ অথচ পদ্যকে পাবে না? কিছুই কী করার নেই? আমাদের জন্য যা করার সবই তো করেছিল সে।’
– ‘তুমি সব সময় এত ইমোশনাল হও কেন বলো তো? আমাদের কি করার আছে এখানে?’
আফরা মাথা তুলে চোখ মুছে বললো, ‘তুমি তো যতটুকু করার তাইই করছো না। আব্বা যা বলেছেন তাইই শুনে যাচ্ছ।’
– ‘তো এখন কী পদ্যকে এখানে এনে রাখতে হবে? আনলে কী ওদের বিয়ে হয়ে যাবে?’
– ‘তুমি অনিককে ব্যাপারটা শুনতে দিচ্ছ না কেন? তাছাড়া পদ্য এ বাসায় আসুক তা চাচ্ছ না কেন? আব্বা তো দেখছেন না এগুলো? এই ছোটো কাজেই তো তুমি বিরোধিতা করছো।’
– ‘পদ্য এলে লাভ কী? এলেই কী সকল সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে? তাছাড়া পদই যেখানে অনিককে ফিরিয়ে দিয়েছে, তুমি কেন অস্থির হচ্ছ বলো তো?’
আফরা তাচ্ছিল্য করে হেঁসে বললো, ‘পদ্যও অনিককে ভালোবাসে, আমি ওর সাথে কলে কথা বলেছিলাম। মেয়েটা শুধু সমাজ আর পরিবারের কথা ভেবে প্রকাশ করছে না।’
– ‘বলো কী! সত্য না-কি?’
– ‘এখন কী বাড়িতে কল দিয়ে জানাবে না-কি? মেয়েটি তো তোমার ভাইয়ের কাছেও প্রকাশ করেনি।’
– ‘কিন্তু ওদের কি মাথায় সমস্যা? জানে না এর পরিণতি কী হবে?’
– ‘আচ্ছা তুমি কী অন্ধ নাঈম? তুমি কী সত্যিই বুঝো না, না-কি অভিনয় করো? প্রেম কী এত ভেবে হয়? ওদের হয়ে গেছে। ওরা নিজেরাই বিপদে। পদ্য প্রকাশই করেনি। বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা? ওরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেও পারেনি। হিন্দু, মুসলিম ছেলে-মেয়েদের প্রেম হতে দেখোনি কখনও? কত হয়। ওরা কী জানে না আগে পরিণতি কি? গ্রামগঞ্জে এরকম অনেক ঘটনাই তো আছে। মানুষ হইচই করবে জানে তবুও তো প্রেমে পড়ে, বিয়ে করে। এগুলো একটু ভাবো।’
নাঈম হেঁসে উঠে বললো,
– ‘তুমি রাজি ওদের বিয়ে দিতে?’
– ‘হ্যাঁ, অবশ্যই রাজি। মানুষের চিন্তা করলে হবে? দুইটা মানুষ যদি আত্মহ*ত্যা করে তখন কেমন লাগবে? মানুষ বাঁচাতে পারবে তখন?’
নাঈম খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘পদ্যও অনিককে ভালোবাসে, সত্য বলছো?’
– ‘হ্যাঁ, তবুও মেয়েটা অনিককে বলেনি।’
– ‘বুঝেছি, আচ্ছা চলো তো। অনিকের সাথে কথা বলি।’
– ‘কী বলবে?’
– ‘এই বিষয়ে কথা বলি, বুঝাই৷ অফিসেও তো যাচ্ছে না। এভাবে কতদিন।’
– ‘যাও, তোমার যা ইচ্ছা করো।’
নাঈম উঠে অনিকের দরজায় এসে নক করে। কৌতূহল থেকে খানিক পর আফরাও উঠে এলো। কয়েকবার নক করতেই অনিক দরজা খুলে দিল।
‘ও ভাইয়া, আসো’ বলে সে বাতি জ্বেলে দিল। নাঈম চেয়ার টেনে বসলো গিয়ে৷ আফরা বিছানায়। নাঈম ক্ষীণ সময় পর বললো, ‘কিরে তোর হয়েছেটা কি? চেহারার এই অবস্থা৷ অফিসে যাচ্ছিস না, সারাদিন দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকিস।’
– ‘কিছু না ভাইয়া। এমনিই, ভালো লাগে না তাই।’
– ‘কিছু না মানে কী? আমি তো শুনেছি পদ্যের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই এমন করছিস।’
অনিক ঘাড় ঘুরিয়ে আফরার দিকে তাকায়। আফরা ফিক করে হেঁসে বললো, ‘আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। আমি কিছু বলিনি।’
নাঈম পুনরায় বললো, ‘তোর কাছে কেউ বয়সে বড়ো একটা মেয়েকে বিয়ে দিতে যাবে কেন?’
– ‘পদ্যই এসব না করে দিয়েছে ভাইয়া। সুতরাং এগুলো নিয়ে কথা বলে লাভ নেই।’
– ‘পদ্য রাজি হলেই বা কী করার? কী করতি?’
– ‘পদ্য রাজি হলে বিয়ে করে নিতাম।’
– ‘বয়সে বড়ো একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিতি? এলাকার মানুষ কী বলতো?’
– ‘এলাকার মানুষ কী বলতো তাতে আমার কী? এলাকার মানুষের চয়েজ মতো আমি জীবন-যাপন করবো না-কি?’
– ‘সমাজ বলতে তো একটা কথা আছে।’
– ‘কোন সমাজ? এরা তো মুসলিম সমাজই। মোহাম্মদ (সঃ) ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছরের খাদিজাকে বিয়ে করেছিলেন। তাহলে মুসলিম সমাজের আবার সমস্যা কী এখানে? তাছাড়া প্রচুর ডিভোর্সী নারীর দ্বিতীয় বিয়ে হয় বয়সে ছোটো পুরুষের সঙ্গে। তাহলে অবিবাহিত অবস্থায় করলে সমস্যা কী? এসব মূর্খের মতো প্রশ্ন আমাকে করো না ভাইয়া। তোমরা রুম থেকে যাও।’
নাঈম ইশারা দিয়ে আফরাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। আফরা খানিক পর টেবিলে ভাত দিয়ে অনিককে টেনে-টুনে খেতে নিয়ে গেল। খাওয়া শেষে বিছানায় যাওয়ার পর নাঈম বললো, ‘আসলেই, এগুলো তুচ্ছ বিষয় মানুষ বড়ো করে দেখে৷ মনের মিলই আসল। কিন্তু আমরা বুঝলেই কী হবে? লোকের মুখ তো আর বন্ধ রাখা যাবে না। পদ্যের ফ্যামিলিও রাজি হবে কি-না সন্দেহ আছে।’
আফরা ওর হাত ধরে বললো, ‘এইতো বুঝেছো, তাহলে পদ্যের আব্বা সুস্থ হলে তুমি একদিন কথা বলে দেখো না। মানতেও তো পারেন।’
নাঈম কোনো কথা বললো না। দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললো, ‘আচ্ছা তুমি আরও একদিন পদ্যকে জিজ্ঞেস করে দেইখো অনিককে পছন্দ করে কি-না। করলে না হয় আমরা দু’জন আব্বাকে রাজি করালাম। আব্বা তখন স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন।’
আফরা প্রচণ্ড খুশি হয়ে নাঈমকে জড়িয়ে ধরে গলায় চুমু খেল।
পরেরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আফরা রান্নাবান্না করে টিফিনবাক্সে খাবার নিল। নাঈম অফিসে যাওয়ার সময় সেও চলে এলো হসপিটাল। দু’বার নক করতেই পদ্য খুলে দেয় দরজা। দু’জন সালাম দিয়ে ভেতরে যায়। মতিন সাহেবের মাথার পাশে মনিরা বেগম বসে আছেন। পাশের বিছানায় আফরা আর নাঈম গিয়ে বসে। মনিসা আর পদ্য দাঁড়িয়ে আছে। আফরা পদ্যকে চিনতে পারছে। তবুও যেন শিওর হতে চাচ্ছে। সে মুচকি হেঁসে বললো, ‘তোমরা দু’জন দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো এসে।’
মনিসা এসে বসলো পাশে৷ আফরা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘তোমার নাম মনিসা?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘উনার নাম পদ্য?’
– ‘হ্যাঁ।’
আফরা মাথা তুলে পদ্যের দিকে তাকিয়ে রইল খানিক্ষণ। কী মায়াবী চেহারা মেয়েটির। এমন চেহারায় কখনও মেকাপ করতে হয় না। চোখ দু’টো প্রচণ্ড সুন্দর৷ ভ্রু এবং চোখের পাপড়ি ভীষণ কালো। একটা সাধারণ সেলোয়ার-কামিজ পরনে। ওড়না মাথায়। মোটেও অনিকের থেকে বড়ো মনে হয় না। ইস ওরও চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ সে এভাবে তাকিয়ে থাকায় পদ্য লজ্জা পাচ্ছে। আফরা চোখ ফিরিয়ে মনিরা বেগমকে বললো, ‘চাচি আমি টিফিন এনেছি৷ প্রতিদিন আপনাদের জন্য নিয়ে আসবো।’
– ‘না না মা, তোমাদের কষ্ট করতে হবে না। আমরা বাইর থেকে এনে খেতে পারবো।’
– ‘না চাচি, নাঈম অফিসে যাওয়ার সময় দিয়ে যাবে। আর এখানে তিনজন থাকা অসুবিধা। আপনারা একজন একেকদিন এখানে থাকুন। আর দুইজন আমাদের বাসায়।’
– ‘হ্যাঁ থাকাটা একটু সমস্যার। এক্সট্রা কিছু আনিওনি যে নিচে থাকবো।’
নাঈম বললো, ‘আমাদের বাসায়ই থাকতে পারবেন। আর যেকোনো দরকার হলে কল দিয়েন। আমি অফিসে থাকলেও আফরা আছে৷ আমি এখন যাই, অফিসের সময় হয়ে গেছে।’
– ‘আচ্ছা বাবা তুমি যাও।’
নাঈম চলে গেল। আফরা পদ্যকে বললো, ‘আসো, বাইরে গিয়ে একটু হেঁটে আসি’ বলে সে ওকে বাইরে নিয়ে এলো। হসপিটালের বারান্দা ধরে দু’জন হেঁটে এক মাথায়। সেখান থেকে বাইরে সবুজ মাঠ আর গাছগাছালি দেখা যাচ্ছে। আফরা রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে পদ্যের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি অনেক মিষ্টি দেখতে।’
পদ্য ফ্যাকাশে মুখে হেঁসে বললো, ‘আপনিও ভাবি।’
– ‘দু’জনেরই চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কেউ কারও থেকে কম পু*ড়ছো না।’
পদ্য কোনো জবাব দিল না। আফরা পুনরায় বললো, ‘যাইহোক, হসপিটাল এসে এসব কথা না বলি। আর আঙ্কেলের জন্য চিন্তা করো না ঠিক হয়ে যাবে।’
পদ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘তাই হোক, না হলে আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না।’
– ‘কেন? তোমার এখানে কী হয়েছে?’
– ‘আসলে আমি আপনার সাথে ফোনে কথা বলার পর আমি আব্বা-আম্মাকে অনিকের কথা বলে দিয়েছিলাম। আর আব্বার হাই প্রেশারের সমস্যা ছিল। হয়তো এসব নিয়ে চিন্তা করেই এমন হয়েছে..।’
বলতে বলতে পদ্যের গলা ধরে এলো। আফরা ওর হাত ধরে বললো, ‘এসব ভেবে মন খারাপ করো না পদ্য। যা হওয়ার হয়ে গেছে।’
পদ্য আফরাকে জড়িয়ে ধরে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘অনিককে একটু বুঝিয়ে বইলেন। আমার আসলে আর কিছু করার নেই ভাবি। বুঝতেই পারছেন এখন আব্বার কথার বাইরে যাওয়া অসম্ভব৷ ওকে আমিও ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি৷ মানুষটাকে খুবই দেখতে ইচ্ছা করে। তাকে কষ্ট দিয়ে আমিও সমানভাবে কষ্ট পাই ভাবি। কিন্তু কী করবো বলুন? আর কোনো পথ যে খোলা নেই৷ আমি আজ ভেবেছি আব্বার পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হয়ে যাব। অনিককে একটু দেখে রাখবেন, বোঝাবেন।’ বলতে বলতে পদ্যের কান্না আরও বেড়ে গেল। সঙ্গে কেঁদে ফেললো আফরাও।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম