#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১১
এক রাশ বিরক্তি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি। এখন সাড়ে সাতটা বাজে। কি একটা কারণে বর্ণ ভাই আজ পড়াতে আসতে পারবেন না বলেছেন। একদমই পারবেন না এটা বলেননি, বলেছেন আমাদের বাসায় আজ যেতে পারবেন না। শুনে তো আমি খুশিতে আত্মহারা। আজ আর পড়তে হবে ভেবে সে কি আনন্দ আমার আকাশে বাতাসে! কিন্তু হঠাৎ মায়ের একটা কথায় আমি আকাশে বাতাসে উড়তে উড়তে ঠাস করে পড়ে গেলাম।
— বর্ণের কি যেন কাজ আছে তাই আজ আসতে পারবে না। কিন্তু তোর তো কোনো কাজ নেই। শুয়ে বসেই তো থাকিস। যা তুই গিয়ে পড়ে আয়। তাহলে বর্ণের কাজও হবে আর তোর পড়াও। তোকে খুব ভালো বলবে দেখিস, যা।
আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে বললাম–
— আজ না গেলে হয় না মা?
মা চোখ গরম করে তাকালেন। কড়া কন্ঠে আওড়ালেন–
— তুই কি যাবি? নাকি আমি দুই একটা লাগাব?
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–
— যাচ্ছি যাচ্ছি। এই বেচারা মেয়েটার ওপরই তো তোমরা সবাই মিলে অত্যা’চার করবে। ধুর! ভালো লাগে না।
বই খাতা গুছিয়ে চলে আসলাম। আন্টি দের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালাম। আন্টি দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে হাসি মুখে বললেন–
— এসো ছায়া। পড়তে এসেছ বুঝি?
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। ভেতরে ড্রয়িং রুমে একটা মেয়েকে বসা দেখলাম। আন্টি বললেন–
— ছায়া! এ হচ্ছে নীলা, আমার ননদের মেয়ে।
নীলা, এই সেই ছায়া যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।
মেয়েটা কেমন যেন করে তাকালো। আমি হাসি মুখে বললাম–
— ভালো আছেন আপু?
— হ্যাঁ।
এক কথায় জবাব দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি বুঝলাম না আমার ওপর বিরক্ত হওয়ার কারণ কি? আন্টি বললেন–
— বর্ণ ঘরে আছে। ওই যে ওটা। তুমি যাও।
নীলা আপু খ্যাক করে উঠে বললেন–
— মামি! বর্ণ ভাইয়ের কাজ আছে বলে আমাকে রুমে ঢুকতেই দিলো না। আর তুমি এই মেয়েকে তার রুমে ঢুকে যেতে বলছ? আমি তো নিজেদের লোক তাই আমাকে অ্যালাও করলো না, আর এ তো বাইরের কে না কে!
তিক্ত কথায় বুক ভারি হয়ে উঠলো। নীলা আপু ঠিকই বলেছেন, এতে কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। তবুও আমার খারাপ লাগছে। আমি মলিন কন্ঠে আন্টিকে বললাম–
— আমি তাহলে যাই আন্টি।
আন্টি কিছু বললেন না। আমি বের হয়ে যেতে গেলে পেছন থেকে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো–
— দাঁড়াও!
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কেন জানি না আমার খুব কান্না পাচ্ছে। বর্ণ ভাই এগিয়ে এসে বললেন–
— সব সময় ফাঁকি দেওয়ার চিন্তা! যাও আমার রুমে যাও। যেয়ে বই বের করো। আমি আসছি।
আমি ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি ধমকে উঠে বললেন–
— কি হলো? যাও।
আমি কেঁপে উঠে দ্রুত পায়ে তার রুমে ঢুকে গেলাম। উনি কখনও আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলেন না। হয় ঝাঁঝালো কন্ঠে বলবেন নাহয় ধমকে বলবেন আর নাহয় গম্ভীর কণ্ঠে বলবেন। বর্ণ ভাইয়ের রুমটা খুব পরিপাটি ভাবে সাজানো। রুমের মাঝ বরাবর বড় একটা বিছানা, বিছানার এক পাশে বড় একটা ওয়ারড্রব, ওয়ারড্রবের সোজাসুজি অপর পাশে ওয়াশ রুম, তার পাশে মাঝারি আকারের একটা ড্রেসিং টেবিল, এক কোণে পড়ার টেবিল এবং চেয়ার। জানালায় সাদার ওপর কালো ডিজাইনের পর্দা। বিছানার পাশ ঘেঁষে বেলকনির দরজা। বিছানায় তাকিয়ে দেখি অনেক বই মেলে রাখা। উনি কি পড়ছিলেন? উনি রুমে এসে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন–
— হা করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বই বের করো।
আমি মিনমিন করে বললাম–
— কোথায় বসবো?
তিনি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বিছানায় বই মেলে রাখা বই গুলো গুছিয়ে এক পাশে সরিয়ে ফেললেন। ইশারা করা আমাকে সেখানে বসতে বললেন। আমি চুপচাপ বসে বই বের করলাম। উনি নিজে পড়ছেন পাশাপাশি আমাকে পড়াচ্ছেন। আমি বললাম–
— আপনার তো পড়ার ডিস্টার্ব হচ্ছে। আমি আজ নাহয় যাই?
তিনি চোখ রাঙিয়ে বললেন–
— আমি তোমাকে বলেছি যে আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে?
আমি মাথা ডানে বায়ে নাড়ালাম। তিনি দ্বিগুণ চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম–
— না।
— তাহলে চুপ চাপ পড়ো।
আমি বিনা বাক্যে পড়তে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দরজায় নক হলো–
— আসবো বর্ণ?
বর্ণ ভাই বিরস কন্ঠে অনুমতি দিলেন–
— আয়।
নীলা আপু রুমে প্রবেশ করেই আমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। নীলা আপু হাতে থাকা কফির মগ দেখিয়ে বললেন–
— তুমি বলেছিলে না কফি দিতে? তাই নিয়ে আসলাম বর্ণ।
— রেখে যা। আর তোকে না বলেছি আমাকে নাম ধরে না ডাকতে? আমি না তোর বড়? ভাইয়া বলবি।
নীলা আপু কিছু বললেন না। আমার পাশ কাটিয়ে কফির মগ রাখতে যেয়ে ভুল বশত না ইচ্ছে বশত জানি না, প্রায় আধা কাপ ফুটন্ত কফি পুরোটা আমার বাম হাতে পড়লো। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলাম–
— আহ্!
নীলা আপু তড়িঘড়ি করে বললেন–
— স্যরি স্যরি, আসলে ধাক্কা লেগে পড়ে গেল। ইশ্ তোমার বিছানা টা নষ্ট হয়ে গেল!
বর্ণ ভাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার হাত ধরে ফেললেন। আমার চোখে পানি টলমল করছে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছি। ইতোমধ্যে হাত লালবর্ণ ধারণ করেছে। বর্ণ ভাই হাতে ফু দিতে লাগলেন। গলা উঁচিয়ে বললেন–
— ও’র হাত পুড়ে গিয়েছে। আর তুই বিছানা নিয়ে পড়ে আছিস! তোর কাজ শেষ। তুই এবার যেতে পারিস।
— কিন্তু বর্ণ!
— বললাম না যা!
নীলা আপু আমার দিকে একবার রাগী চোখে তাকিয়ে চলে গেলেন। আমি জড়ানো গলায় বললাম–
— খুব জ্বলছে।
বর্ণ ভাই দ্রুত পায়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলেন। স্যাভলন বের করতে দেখে আমি আঁতকে উঠে বললাম–
— না, ওটা দিবেন না। ম’রে যাবো আমি।
— কিচ্ছু হবে না।
— না, খুব জ্বলবে।
— হুশ! এই দিকে দেখো। আমার চোখের দিকে তাকাও। তাকাও!
আমি চোখ তুলে ওনার দিকে তাকালাম। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। উনি নরম কন্ঠে বললেন–
— ভরসা আছে আমার ওপর? আমি কি তোমাকে কখনও ব্যথা দিতে পারি? কিচ্ছু হবে না। আমি আস্তে করে মলম লাগিয়ে দেবো। একটুও টের পাবে না। প্রমিস!
আমি ওনার দিকে তাকিয়েই থাকলাম। কি সুন্দর ওনার বিলাই চোখ জোড়া! সাজানো ঘন কালো ভ্রু জোড়া! এত সুন্দর কেন উনি? আমাকে নিজের মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছেন কেন উনি? এ মায়া থেকে বের হওয়া যে অসম্ভব। এর মধ্যে উনি নিজের কাজ শেষ করে ফেললেন। পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে গজ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন। আমি এমন এক ঘোরে ছিলাম যে কিছু বুঝতেই পারিনি। উনি দুহাতে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললেন–
— কি? বুঝতে পেরেছ একটুও?
আমি মাথা দু’পাশে নাড়ালাম। তিনি আমার বই খাতা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলেন। বললেন–
— যাও, আজ তোমার ছুটি। আর কাল কলেজ যাওয়ার দরকার নেই। রাতে আমি পড়াতে যাবো। ঠিক আছে? সাবধানে থাকবে, হাতে যেন চাপ না পড়ে। বুঝেছ? যাও।
আমি ডান হাতে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম। আন্টি ড্রয়িং রুমেই ছিলেন। আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বললেন–
— তোমার হাতে কি হয়েছে?
— কিছু না আন্টি একটু কফি পড়ে গিয়েছিল।
— সেকি! কীভাবে?
— ও কিছু না আন্টি। আমি যাই।
আন্টিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি চলে এলাম। বাসায় এসে আরেক জ্বালা! মা ব্যস্ত হয়ে বললেন–
— ভালোই তো গেলি, হাতে ব্যথা পেলি কীভাবে?
আমি রুমে ঢুকে বললাম–
— কিছু না মা। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, খাবো না রাতে। ডাকবে না।
দরজা চাপিয়ে শুয়ে পড়লাম। হাতে চিনচিন করে ব্যথা করছে। ব্যথা সহ্য করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো। গায়ে ধুম জ্বর এসেছে। হাতের ব্যথা থেকেই এই জ্বরের আগমন। মা মাথার কাছে বসে কপালে কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছেন। বাবা মাকে বকাবকি করছেন–
— হাতে এতটা ব্যথা কীভাবে পেল ও? তুমি কোথায় থাকো?
মা বিরক্ত হয়ে বললেন–
— আপনার মেয়ে কি আমাকে বলে কিছু? তখন জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে ব্যথা পেলি, বললো না।
আমি ধীর কন্ঠে ডাকলাম–
— মা।
মা বললেন–
— ঘুম ভেঙেছে তোর! এবার কিছু খেয়ে ওষুধ টা খেয়ে নে ছায়া। নাহলে জ্বর কমবে না।
মা বাবা ধরে আমাকে উঠিয়ে বসালেন। মা গালে তুলে খাইয়ে দিলেন, রুচি চলে যাওয়ার ফলে খেতে পারলাম না। মা আর জোর করলেন না। ওষুধ খাইয়ে দিয়ে তারা চলে গেলেন।
পরদিন কলেজে যেতে পারলাম না। এমনকি বিছানা থেকে উঠলাম প্রর্যন্ত না। মা এসে প্রতি বেলা আমাকে জোর করে গালে তুলে খাওয়ালেন। ঘুমিয়েই কাটলো আমার সারাদিন। রাত সাতটা কি আটটা বাজে, আমি অর্ধ ঘুমে রয়েছি। এমন সময় হাতে শীতল স্পর্শ পেলাম। একটা শীতল হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার পোড়া হাত। আমি চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। ঘুম যেন চোখে এঁটে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কপালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। দেখতে পেলাম না কাউকে। যতক্ষণে আমি চোখ মেলে তাকিয়েছি ততক্ষণে রুমে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে।
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১২
দুদিন জ্বরে ভুগে আজ আমি সুস্থ। কলেজও গিয়েছিলাম আবার কোচিংয়েও। বই খাতা খুলে বসে আছি। বর্ণ ভাই একটু পরই পড়াতে আসবেন। দুই দিন এসে এসে ফিরে গিয়েছিলেন। বর্ণ ভাই একটু বাদেই এসে পড়লেন। আমি তাকে সালাম দিলাম। উনি জবাব দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। কিছু পর্যবেক্ষণ করে কপালে হাতের উল্টো পিঠ ছোঁয়ালেন, শীতল স্পর্শে চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। সেই হাত কপাল থেকে গাল স্পর্শ করলো এবং গাল থেকে গলা। তিনি হাত সরিয়ে নিলেন। উনি কি আমার জ্বর আছে কিনা সেটা দেখছিলেন? উনি বললেন–
— তোমার হাত দেখি।
আমি বোকার মতো ডান হাত দেখালাম। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন–
— গ’র্দ’ভ! আমি তোমার পোড়া হাত দেখতে চেয়েছি।
আমি বাম হাত দেখালাম। তিনি হাতটা আলতো করে ধরে ভালো করে দেখলেন। এখন আর ব্যথা নেই তেমন, দাগ আছে। তিনি বললেন–
— ঠিক মতো মলম লাগাবে।
— আচ্ছা।
— রিফাত নামের ওই ছেলেটা আবারও দেখলাম তোমার সাথে। বলেছি না এসব ছেলে টেলে থেকে দূরে থাকবে?
আমি চাপা স্বরে বললাম–
— আপনিও তো ছেলে! তাহলে কি আপনার থেকেও দূরে থাকবো?
তিনি চোখ রাঙিয়ে বললেন–
— কি বললে! কথায় কথায় কি তোমাকে পাল্টা কথা বলতেই হবে? রিফাতের সাথে মিশবে না। বুঝেছ?
— জ্বি।
তিনি পড়ানো শুরু করলেন। পড়ানো শেষে উনি চলে যাবার সময় আমি বললাম–
— নীলা আপু আপনাকে পছন্দ করে তাই না?
তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। থমথমে কন্ঠে বললেন —
— তোমাকে এ কথা বলেছে?
— না মানে, কেউ বলেনি। আপনি বড় হওয়া সত্ত্বেও আপু আপনার নাম ধরে ডাকে, আর আপনার দিকে কেমন করে যেন তাকায় তাই..
— তাই তুমি ধরে নিলে যে ওর আর আমার মধ্যে কিছু আছে? ছোট, ছোটর মতো থাকো। এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।
তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন। নিশ্চয়ই উনিও নীলা আপুকে পছন্দ করেন। নাহলে তো এভাবে বলতেন না। নীলা আপুই ওনার গার্লফ্রেন্ড হবে হয়তো। ওনার গার্লফ্রেন্ড আছে ভেবেই কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হলো। অনুভূতি টা মোটেও ভালো লাগার নয়, এটা বুক ভারি হওয়া অনুভূতি।
—
রানি মিটিমিটি হাসছে আর আমি গালে হাত দিয়ে তাকে দেখছি। এখন অফ পিরিয়ড থাকায় আমরা ফাঁকা ক্লাস রুমে বসে আছি। আমি রানির ওপর বিরক্ত, মহা বিরক্ত। হাত বাড়িয়ে রানির মাথায় গাট্টা মারলাম। রানি আর্তনাদ করে মাথায় হাত ঘসতে ঘসতে বলল–
— মারলি কেন?
— তখন থেকেই আনমনে হেসে চলেছিস! কারণ কি?
রানি এমন একটা ভান করলো যেন খুব লজ্জা পাচ্ছে। আমি আবারও ও’র মাথায় গাট্টা মারলাম। বললাম–
— এসব ড্রামা বাদ দিয়ে সোজাসুজি বল ঘটনা কি?
রানি দুই হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল–
— আসলে হয়েছে কি!
— হ্যাঁ কি হয়েছে?
— না মানে।
— কি মানে?
— আ’ম ইন অ্যা রিলেশনশিপ।
— ওহ!
রানি কি বলল পুরোপুরি বুঝে উঠে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললাম–
— ওয়াট!
রানি লাজুক ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। আমি হাহাকার করে বললাম–
— কে সেই হতভাগা? কার কপাল পুড়লো রে রানি?
রানি চোখ ছোট ছোট করে বলল–
— কি বললি?
আমি মেকি হেসে বললাম–
— না মানে জিজু কে?
— তোর আফীফ ভাই।
এবার আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চোখ বড় বড় করে বললাম–
— কিহ! আফীফ ভাই! তুই ভোলাভালা আফীফ ভাইকে ফাঁসিয়ে নিজের জালে জড়িয়ে নিলি? তোর বুক কাঁপলো না?
রানি আমার হাত টেনে ধরে বসালো। ব্যঙ্গ করে বলল–
— এ্যাহ! ওনার ভোলাভালা আফীফ ভাই! ব্যাটা নাম্বার ওয়ান বদ’মাইশ। ব্যাটা আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। আমার পিছু পিছু ঘুরে আমার কানের মাথা খেয়েছে। তারপর আমাকে প্রপোজ করেছে।
— আফীফ ভাই তোকে প্রপোজ করেছে? এসব কবে, কখন হলো?
— এই তো ক’দিন হলো।
— আমাকে বলিসনি কেন? আমাকে জেরা করে শুনতে হলো কেন?
রানি আমার হাত ধরে বলল–
— তুই তো অসুস্থ ছিলি। তারপর আমিও ভুলে গিয়েছিলাম রে।
— আচ্ছা বাদ দে। আফীফ ভাইকে তো একদম সহ্য করতেই পারতি না। আর এখন কি হলো?
রানি নুইয়ে মাথা নিচু করে বলল–
— হয়ে গেল। ব্যাটা এতো রোমান্টিক আমি আগে বুঝিনি। আমার কথা এখন বাদ। তুই কি জানিস তোকে নিয়ে কি হয়েছে?
আমি অবাক হয়ে বললাম–
— আমাকে নিয়ে আবার কি হলো?
— রিফাত আছে না? ও নাকি তোকে ভালোবাসে, সেটা সবার সাথে বলে বেড়িয়েছে। আর তুইও নাকি ও’কে লাইক করিস।
— কিহ!
— হ্যাঁ এসবই হয়েছে।
আমি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বললাম–
— বাদ দে। কদিন এসব হবে তারপর এমনি এমনিই সব বন্ধ হয়ে যাবে।
বর্ণ ভাই আমাকে আগে থেকেই বলেছেন রিফাতের সাথে না মিশতে। এখন তো আর ও’র দিকে তাকাবো প্রর্যন্ত না। ছেলে মেয়েতে একটু কথা বললেই কলেজে গুজব ছড়িয়ে যাবে! অদ্ভুত।
—
অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শেষ। বেশ ভালোই পরীক্ষা দিয়েছি, সব হয়েছে বর্ণ ভাইয়ের জন্য। আজ কোচিং বন্ধ। তাই ছাদে আসার সুযোগ পেয়েছি। কত দিন যে ছাদে আসতে পারি না, ঠিক নেই। কোচিং থেকে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায় আর তার কিছুক্ষণ পরেই বর্ণ ভাই পড়াতে আসেন। তাই আর আসা হয় না। ছাদা দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিলাম। চোখ বন্ধ করে শীতল হাওয়া অনুভব করলাম। সুর্য ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। পাখিরা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। হঠাৎ পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম। পিছু ঘুরে দেখি নীলা আপু দাঁড়িয়ে আছেন। আমি হেসে বললাম–
— আরে আপু! কেমন আছেন?
উত্তর দিলেন না। আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে বললেন–
— বাইরের লোক, বাইরের লোকের মতোই থাকো। ঘরের লোক হওয়ার চেষ্টা কোরো না।
আমি বুঝলাম না, জিজ্ঞেস করলাম–
— মানে?
নীলা আপু আক্রোশে ফেটে চার আঙুলে আমার গাল শক্ত করে চেপে ধরলেন। হিসহিসিয়ে বললেন–
— বর্ণের থেকে দূরে থাকবে। কি ভেবেছ আমি কিছু বুঝি না? বড়লোক ছেলে দেখেছ কি গলায় ঝুলে পড়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ! ছিঃ!
গাল ব্যথায় এবং আপুর কথার তিক্ততায় চোখে পানি এসে যাচ্ছে। আমি কোনো রকম বললাম–
— আপনি এসব কি বলছেন আপু?
তিনি এক প্রকার ঝটকা দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন–
— ঠিক বলছি আমি। আমি অন্ধ নই। কীভাবে যে বর্ণের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াও সবটা দেখি আমি। শুনে রাখো, বর্ণের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ফারদার তোমাকে যদি বর্ণের আশে পাশে দেখি তো মামাকে বলে তোমাদের এই বাড়ি থেকে তাড়াতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না। মাইন্ড ইট।
আমি জড়ানো গলায় বললাম–
— আপনি এসব ভুল ভাবছেন আপু। উনি শুধুই আমার টিউশন টিচার এবং আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে ছাড়া আর কিছুই না।
নীলা আপু বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন–
— হাউ ফানি! তুমি বললে আর আমি নাচতে নাচতে বিশ্বাস করে নিলাম। তুমিই তো একমাত্র বুদ্ধিমতী আর আমরা সবাই তো ঘাসে মুখ দিয়ে চলি তাই না?
আমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নীলা আপু বিরক্ত হয়ে বললেন–
— তোমার এসব নাটক আমার সামনে বন্ধ করো। যা বললাম তা যেন মনে থাকে। নাহলে তোমার বাবাকে অপমানিত হয়ে মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে বের হতে দেখবে।
নীলা আপু চলে গেলেন। আমি মুখে দুহাত চেপে কেঁদে উঠলাম। কি দোষ আমার? উনি এতো অপমান কেন করে গেলেন?
—
রাতে বর্ণ ভাই পড়াতে এলেন। আমার ফোলা চোখ মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলেন–
— চোখ মুখ ফুলে আছে কেন? চোখটাও দেখছি লাল হয়ে আছে! কি হয়েছে?
আমি থমথমে কন্ঠে বললাম–
— কিছু না।
তিনি এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। পড়ানো শেষে আমি বললাম–
— আমি আপনার কাছে আর পড়বো না। আপনি আর আসবেন না।
তিনি থমকে তাকালেন। গমগমে কন্ঠে শুধালেন–
— কেন? আমার পড়ানো ভালো লাগছে না?
— না, ভালো লাগছে না। আমি পড়বো না ব্যস।
তিনি শীতল কন্ঠে বললেন–
— কি হয়েছে? এমন হাইপার হয়ে আছ কেন?
আমি মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। আবারও কান্না আসছে। তিনি আমার হাত চেপে ধরে নিজের দিকে ফেরালেন। নরম কন্ঠে বললেন–
— আমার দিকে তাকাও।
আমি ঢোক গিলে তার দিকে তাকালাম। উনি বললেন–
— কি হয়েছে? বলো আমাকে?
আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম–
— কিছু না।
— কেউ কিছু বলেছে?
আমি মৃদু চেঁচিয়ে বললাম–
— না। আপনি আর পড়াতে আসবেন না। আসবেন না মানে আসবেন না। কথা বুঝতে পারছেন না আপনি? যদি আসেন তাহলে আমি কিছু করে ফেলবো বলে দিলাম।
বর্ণ ভাই রেগে গেলেন। টেবিলে থাবা বসিয়ে বললেন–
— মশকরা করছ আমার সাথে? হঠাৎ পড়বো পড়বো না করছ কেন? কিছুই বলছ না। আমি কি খারাপ পড়াচ্ছি? নাকি তোমার আমার কাছে পড়তে ভালো লাগছে না?
আমি কিছু বললাম না। মাথা নিচু করে রাখলাম। বর্ণ ভাই টেবিলে পুনরায় থাবা বসিয়ে রেগে মেগে বের হয়ে গেলেন। আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। বিড়বিড় করে বললাম–
— আপনি আমার সামনে আর আসবেন না। আমি আমার বাবাকে অপমানিত হতে কখনও দেখতে পারবো না। কিছুতেই না। আপনি নীলা আপুকে নিয়েই সুখে থাকুন।