ছায়াবর্ণ পর্ব -২৩+২৪+২৫

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৩

পর দিন আমরা গ্রাম ছেড়ে শহরে ফিরে এলাম। এবার নদী পথে এসেছি। নানাভাই ছাড়তে চায়ছিলেন না, কিন্তু ক’দিন পর ওনার জয়েনিং ডেট বলেই বাধ্য হলেন। তবে এটাও বললেন আমরা যেন খুব শীঘ্রই আবারও গ্রামে বেড়াতে যাই। বর্ণ ভাই নানাভাই কথা দিয়ে এসেছেন যে তিনি ছুটি নিয়ে অবশ্যই আবার যাবেন। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। বাড়িতে পৌঁছে লম্বা শ্বাস নিলাম। ফিরে এসে ভালো লাগছে। বাবা মা রা সবাই আমাদের আগে ওপরে উঠে গেলেন। পিছে রইলাম আমরা দুজন। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে বর্ণ ভাইদের ফ্লাট রেখে উঠতে গেলে তিনি গলার স্বর উঁচিয়ে বললেন–

— কোথায় যাচ্ছ তুমি?

আমি থেমে ওনার দিকে ফিরে বললাম–

— বাসায় যাচ্ছি।

তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন–

— এটা তোমার শশুর বাড়ি। ভুলে গিয়েছ? এখানেই থাকবে তুমি।

রোজ ওনার সাথে এক ঘরে এক বিছানায় থাকতে হবে ভেবেই বুক কেঁপে উঠল। শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম–

— আ আমি পরে আসি? আমার সব জিনিস পত্র তো ওপরে। ওগুলো নিয়ে আসি।

উল্টো ঘুরে সিঁড়িতে পা রাখতে নিলেই উনি কর্কশ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন–

— খবরদার! আর এক পা এগিয়েছ তো!

আমি অসহায় মুখে ওনার দিকে তাকালাম। কি মুশকিল! বাবা মাও আমাকে একা ফেলে চলে গেল! এখন এই শশুর বাড়িতেই ঢুকতে হবে মনে হচ্ছে। এক দৌড়ে ওপরে চলে গেলে কেমন হয়? আমার পালানোর চিন্তা উনি ধরে ফেললেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এসে খপ করে হাত ধরলেন। টেনে নিয়ে চললেন ভেতরে। চেঁচিয়ে আন্টিকে ডাকলেন। আন্টি রুম থেকে বের হয়ে এলেন। বর্ণ ভাই বললেন–

— ছেলের বউকে ফেলে চলে এলে! ছেলের বউ তো আর একটু হলে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছিল। তখন তোমার ছেলে বউ ছাড়া কীভাবে থাকত?

আন্টি হতভম্ব। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করলাম। আন্টি হতবাক কন্ঠে বললেন–

— বর্ণ! তুই কি বউ পাগল হলি বাবা?

তিনি কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বললেন–

— পৃথিবীর সব ছেলেরা বউ পাগল মা। এখন তুমি যদি বলো বাবা বউ পাগল না, সেটা আমি মোটেও বিশ্বাস করব না। তোমার ছেলের বউকে রুমে নিয়ে গেলাম।

আন্টিকে বিস্ময়ে ফেলে দিয়ে আমাকে টেনেই রুমে নিয়ে গেলেন। ওনার কার্যক্রম দেখে অবাক আমিও কম হচ্ছি না। রুমে এনে দরজা চাপিয়ে হাত ছেড়ে দিলেন। আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম–

— বাবা মাকে না জানিয়ে এখানে থাকা কি ঠিক হবে।

উনি এমন ভাবে তাকালেন যেন ভয়ংকর কোনো ভুল কথা বলে ফেলেছি। ওনার চাহনি দেখে জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করলাম। উনি ওয়ারড্রবের দিকে এগিয়ে তা খুললেন। জামা কাপড় নিতে নিতে বললেন–

— আমি আগেই ওনাদের বলেছি। কোনো আপত্তি নেই তাদের। তোমার মতো বোকা নই আমি। বুঝেছ?

মুখ গোমড়া করে বিছানায় পা উঠিয়ে বসলাম। সত্যিই আমি খুব বোকা। এখন আমার করনীয় কি? তিনি জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করলেন। চুপচাপ বসে রইলাম। ওনার এই ঘরে আমি আগেও এসেছি। সবটা আগের মতোই আছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি। মাথা থেকে ওড়না ফেলে দিলাম, গরম লাগছে। শাওয়ার নিলে মন্দ হতো না। কিন্তু উনি আমাকে আমার বাসায়-ই যেতে দিলেন না।
কিছুক্ষণ পর উনি শাওয়ার নিয়ে বের হলেন। আমি তাকালাম। ভাবতেই অবাক লাগে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে থাকা স্নিগ্ধ পুরুষটি আমার। একান্তই আমার! মুগ্ধ হলাম। উনি আমার সামনে এসে তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বললেন–

— যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো। চায়লে শাওয়ারও নিতে পারো।

কোনো কিছু না ভেবেই ওয়াশ রুমে চলে গেলাম। তার কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে শাওয়ার অন করে ফেললাম টের পেলাম না। যখন বুঝলাম, তখন আমি ভিজে জবজবে। আমার মাথায় হাত। এখন কি হবে? এখানে তো পরনের কিছুই নেই। চিন্তিত হয়ে কিছুক্ষণ ভেবে দরজা একটু খুলে উঁকি দিলাম। ওনাকে দেখতে পেলাম না। মৃদু আওয়াজে ডাকলাম–

— শুনছেন? বর্ণ ভাই!

তিনি আসলেন। বেলকনিতে ছিলেন হয়তো। ভ্রু কুঁচকে বললেন–

— এ ঘরে কি আমার কোনো বোন টোন ঢুকে পড়ল? ভাই ডাকল কে?

আমি জিভে কামড় দিলাম। আমতা আমতা করে বললাম–

— ইয়ে না মানে! আমি ডেকেছি। আমি সমস্যায় পড়েছি।

— দুঃখিত আমি তোমার ভাই না। তাই কোনো উপকার করতে পারলাম না।

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম–

— আরে! আপনি ভাই না, কিন্তু অন্য কিছু তো না কি? আপনি ছাড়া কে হেল্প করবে?

বুকে হাত গুজে বললেন–

— আমি তোমার কি?

অসহায় ভঙ্গিতে বললাম–

— পরে বলি? আমি ভুল করে শাওয়ার অন করে ফেলেছিলাম। এখন ভিজে জবজবে হয়ে আছি। এখানে আমার কোনো জামা কাপড়ও নেই। আগেই বলেছিলাম জিনিস পত্র গুলো নিয়ে আসি। কি করব?

পর পর দু’বার হাঁচি দিয়ে ফেললাম। ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে। উনি কিছুক্ষণ ভেবে ওয়ারড্রব থেকে ওনার একটা টি শার্ট এবং ট্রাউজার এনে এগিয়ে দিলেন। আমি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বললাম–

— আপনার জামা কাপড় আমার মতো বাচ্চার গায়ে হবে?

ওনার নিরুত্তাপ কন্ঠ–

— তাহলে ওয়াশ রুমে এভাবেই থাকো।

আমি তড়িঘড়ি করে বললাম–

— না না দিন। নেই মামার থেকে কানা মামাই ভালো।

জামা কাপড় নিয়ে দরজা লক করলাম। বাধ্য হয়ে টি শার্ট আর ট্রাউজার পরলাম। টি শার্ট হাঁটুর কিছুটা ওপরে পড়ল আর ট্রাউজার মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্লাজু পরেছি। গুটিয়ে ওপরে তুললাম। ছোট হাতার সবুজ রঙের টি শার্ট, সমস্যা হলো না। তবে কাঁধের এক পাশ দিয়ে নেমে যাচ্ছে বারংবার। ওনাকে আমার জামা কাপড় নিয়ে আসার কথা বলতে পারি না, কেমন দেখাই। আর নিজেও যেতে পারব না এই অবস্থায়!
ধীরে ধীরে দরজা খুলে বের হলাম। উনি বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন চালাচ্ছেন। এক পলক আমার দিকে তাকালেন। আবার ফোনের দিকে নজর দিয়ে বললেন–

— চুল ভালো করে মুছে ফ্যালো। আর জামা কাপড় বেলকনিতে মেলে দাও।

গুটি গুটি পায়ে বেলকনিতে গিয়ে জামা কাপড় মেলে দিলাম। চুল ভালো করে মুছে তোয়ালেও মেলে দিয়ে রুমে এলাম। আবারও তাকালেন। ঠোঁট চেপে হাসলেন মনে হলো! আমি মুখ কুঁচকে বললাম–

— আমাকে অদ্ভুত লাগছে তাই না? এখনও এর মধ্যে আর একটা আমিকে ঢোকানো যাবে।

তিনি ডাকলেন–

— এদিকে এসো। আমার পাশে বসো।

বিছানায় উঠে তার পাশে বসলাম। হাত বাড়িয়ে এলোমেলো ভেজা চুল কানের পিঠে গুজে দিলেন। মৃদু হেসে বললেন–

— তোমার এক নতুন রুপ দেখলাম। না জানি তোমার আর কত রুপ আছে!

বাইরে থেকে আন্টি ডাকলেন। রাতে খাওয়ার জন্য ডাকছেন তিনি। আমি টি শার্ট টেনেটুনে কাঁধের ওপরে তুলে বললাম–

— আমি এই অবস্থায় কিছুতেই বাইরে যাব না। আপনি যান। আর সন্ধ্যায় খেয়েছিলাম তখন, এখন আর খাব না।

তিনি চেঁচিয়ে বললেন–

— খাব না মা। ক্লান্ত লাগছে খুব। তোমার ছেলের বউও খাবে না।

আন্টি কিছু বললেন না। লজ্জায় মরিমরি অবস্থা আমার! না জানি আন্টি কি ভাবছেন? উনি উঠে দরজা লক করে এলেন। বিছানায় উঠে আমার কোমর জড়িয়ে কাছে টানলেন। বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। ফিচেল কন্ঠে বললেন–

— আপনি বলো কেন? তুমি করে বলতে পারো না?

আমি ঢোক গিলে বললাম–

— আপনি আমার কতটা বড় জানেন? এতো বড় একজন কে তুমি করে বলব!

আরেকটু কাছে টেনে নিলেন। হাত ঠেকে গেল ওনার বুকে। বললেন–

— তোমার মা আর তোমার বয়সের ডিফরেন্স কত?

— বাইশ বছর।

— তাও তাকে তুমি করে বলো। আর বাবার বয়সের ডিফরেন্স কত?

— ত্রিশ বছর।

— তাকেও তুমি করে বলো। তাহলে আমাকে বলতে সমস্যা কোথায়?

তার লজিক ঠিকই আছে। তবে আমিও একটা লজিক দিলাম–

— আমার মা থেকে বাবা আট বছরের বড়। মা বাবাকে এখনও আপনি করে বলে। আর আপনি তো আমার থেকে দশ বছরের বড়। বুইড়া ব্যাটা! আপনাকে দেখে কেউ বলবেই না যে আপনার বয়স সাতাশ। আমার তো মনে হয় বাইশ তেইশ বছরের যুবক।

শেষের কথাগুলো বলেই মুখ চেপে ধরলাম। সর্বনাশ! মনের কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল। উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–

— কি বললে তুমি!

— ইয়ে মানে, না মানে।

কাঁধ বেয়ে টি শার্ট আবারও নেমেছে। তিনি মুখ নামিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। জমে গেলাম। কাঁধের উন্মুক্ত অংশে মুখ ঘষে ফিসফিস করে বললেন–

— ভয়ংকর অপরাধ করেছ তুমি।‌ এখন সেই অপরাধের শাস্তি দেওয়া হবে। ভয়ংকর অপরাধের জন্য ভয়ংকর শাস্তি।

থরথরিয়ে কেঁপে উঠলাম। উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লেন। গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করলেন–

— এখন স্বামী সেবা করো। ঘাড়, মাথা ব্যথা করছে খুব। টিপে দাও। আমি যতক্ষন না বারণ করব ততক্ষন টিপতে থাকবে।

আমি চোখ রসগোল্লার আকার করে বললাম–

— আমি এখন আপনার ঘাড় মাথা টিপব?

— হ্যাঁ। দ্রুত শুরু করো।

আমি মুখ গোমড়া করে আলতো হাতে মাথা টিপে দিতে লাগলাম। উনি চোখ বন্ধ করে নিলেন। স্নিগ্ধ মুখ খানির দিকে তাকালাম। এখনও আমার ভাবতেই অবাক লাগে এই সুদর্শন পুরুষটিকে একান্তই আমার!
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৪

সকালের আলো চোখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল। নিশ্চয়ই কেউ জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। আলতো চোখ মেলে বোঝার চেষ্টা করলাম যে আমি কোথায় আছি? কিছু মুহূর্ত পর সবটা মস্তিষ্কে ধরা দিল। চোখ বড় বড় করে লাফিয়ে উঠে বসলাম। আমি তো বর্ণ ভাইদের বাড়িতে আছি। রাতে ওনার মাথা চাপতে চাপতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কে জানে? আশে পাশে তাকিয়ে দেওয়ালে ঘড়ি আবিষ্কার করলাম। ঘড়িতে ঘন্টার কাটা আট এবং মিনিটের কাটা কুড়িতে। আমার চোখ কপালে। আমি এতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম? তাও আবার শশুর বাড়ির প্রথম দিন? না জানি আন্টি কি মনে করছেন!
আমি যখন আহাজারি করতে ব্যস্ত তখন ওয়াশ রুম খুলে বের হলেন উনি। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। আমি হাহাকার করে বললাম–

— বর্ণ ভাই! এত দেরি হয়ে গেল! আপনি আমাকে ডাকলেন না কেন?

তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। থমথমে কন্ঠে বললেন —

— আবার বর্ণ ভাই? আমি তোমার কোন জন্মের ভাই লাগি?

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আবারও ওনাকে ভাই ডেকে ফেলেছি, কি মুশকিল! মিনমিন করে বললাম–

— হয়ে যায়। কি করব?

উঠে দাঁড়ালাম। উনি সামনে এগিয়ে এসে বললেন–

— আমার নাম ধরে ডেকো।

তোয়ালে হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম–

— আমি পারব না। এতো বড় একটা মানুষের নাম ধরে ডাকা যায় নাকি?

উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তবুও হার মানলেন না। বললেন–

— আমাকে যা খুশি বলো কিন্তু ভাই ডেকো না প্লিজ। বউ এর মুখে ভাই ডাক শোনা সত্যিই অদ্ভুত! এখন যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। রাতে খাওনি, সকালেও খাওয়ার ইচ্ছে নেই?

হঠাৎ করেই আমার খেয়াল হলো আমার পরনে ওনার জামা কাপড়। আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম, টি শার্টের গলা কাঁধ বেয়ে নেমে আছে। ট্রাউজার মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চুল তো পাখির বাসা! এভাবে বাইরে যাব কীভাবে? বললাম–

— আমি এই অবস্থায় বাইরে যাব কীভাবে?

উনি সবে মাত্র ফোন হাতে নিয়ে বসেছিলেন। আমার কথা শুনে মুখ তুলে তাকালেন। মশকরা করে বললেন–

— কেন? ভালোই তো লাগছে। এভাবেই যেও সমস্যা নেই।

চোখ বড় বড় করে তাকালাম। মৃদু আর্তনাদ করে উঠলাম–

— নাহ!

ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। আমি ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি উঠে বেলকনি থেকে আমার জামাকাপড় নিয়ে এলেন। হাতে দিয়ে বললেন–

— এই নাও। শুকিয়ে গিয়েছে। চেঞ্জ করে এসো।

নিজের জামাকাপড় পেয়ে আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। অবশেষে ওনার এই দৈত্য মার্কা জামাকাপড় থেকে মুক্তি পাব। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে বের হলাম। চুলটা আঁচড়ে ওনার সাথে বের হলাম। আন্টি রান্না ঘরে ছিলেন। টেবিলের ওপর পরটা রেখে মুখে হাসি টেনে বললেন–

— উঠেছিস তোরা? তোর বাবা সকালে খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছে আর তার সাথে আমিও খেয়ে নিয়েছি। এবার তোরা খেয়ে নে। ছায়া! তোমার জন্য পরটা করেছি, খাও।

আন্টি রুমে চলে গেলেন।‌ খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার, শাশুড়ি ছেলের বউকে রেঁধে খাওয়াচ্ছে! উনি চেয়ার টেনে বসে খেতে শুরু করলেন। বললেন–

— কি হলো? খাও।

আমি ধপ করে বসে পড়লাম। একটা পরটার অর্ধেক খেতে খেতে ওনার খাওয়া শেষ। আমাকে টুক টুক করে খেতে দেখে বললেন–

— একটা পরটাও এখনও শেষ করতে পারলে না! দেখি এদিকে দাও।

আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মুখের সামনে তুলে ধরলেন। বললেন–

— খাও।

চুপচাপ মুখে নিলাম। ওনার হাতে খাওয়ার অভিজ্ঞতা আগে থেকেই আছে আমার। খেতে খেতে বললাম–

— আমি বাসায় যাব না?

— হ্যাঁ যেও।

— আপনি যাবেন না?

— না।

মন খারাপ করে বললাম–

— কেন?

উনি পরটা মুখে পুরে দিয়ে বললেন–

— আমার একটু কাজ আছে বাইরে। আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে। তুমি যেও আর কাল চলে এসো।

পরটা চিবিয়ে গিললাম। মুখ গোমড়া করে বললাম–

— বিয়ের পর শুনেছি বর বউ মিলে বউ এর বাড়িতে বেড়াতে যায়। আর আমার ক্ষেত্রে কি হলো? বিয়ের পরদিন শশুর বাড়িতে আসলাম।

কিছু বললেন না। আমার কথায় ওনার কোনো যায় আসলো না। কিন্তু আমার তো একটা দিন ওনাকে ছাড়া থাকতে ভীষণ যায় আসবে। পানি খেয়ে বললাম–

— আচ্ছা, আমি এখন যেয়ে বিকেলে আবার চলে আসব। আর সব জামাকাপড়ও গুছিয়ে নিয়ে আসব।

ইতোমধ্যে ওনার খাওয়ানো শেষ। হাত ধুয়ে উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন–

— তোমার যেটা ভালো লাগে সেটা করো।

চলে গেলেন। আমি আন্টিকে বলে বাসায় গেলাম।
নিজের বাসায় গিয়ে মনে হলো না জানি কত জনম পর এসেছি। মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম–

— মা! বিয়ে হলো কি হলো না, তোমরা আমাকে পর করে দিলে? আমাকে ফেলে রেখে চলে এলে?

মা মুখ কুঁচকে বললেন–

— ভাবটা এমন করছিস যেন তোকে অন্য দেশে বিয়ে দিয়েছি। আছিস তো নিচের তলাতেই, যখন খুশি চলে আসবি। আর আমিও যখন খুশি তোকে দেখে আসব।

আমি মাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললাম–

— আমি কিন্তু থাকতে আসিনি। যারা আমাকে ফেলে রেখে চলে এসেছে তাদের বাসায় থাকবও না। জামাকাপড় গুলো নিয়েই চলে যাব। আমি এখন আমার রুমে যাচ্ছি।

রুমে চলে এলাম। আমার অভিমান দেখে মা মৃদু শব্দে হাসলেন।

এ বাড়ি অর্থাৎ আমার শশুর বাড়িতে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এসেই চমকে গেলাম। নীলা আপু সোফায় বসে আছেন। আমার আওয়াজ শুনেই তীক্ষ্ম দৃষ্টি আমার ওপর ফেললেন। তার দৃষ্টিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। আন্টি নিশ্চয়ই তাকে সব বলেছেন। আমি এগিয়ে বললাম–

— কেমন আছেন আপু?

আপু জবাব দিলেন না। মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে রুমে চলে গেলাম, যেটা বর্তমানে আমার এবং বর্ণের রুম। ওনার আসতে দেরি হবে। রুমে ঘুরঘুর করেই কিছুটা সময় কাটিয়ে দিলাম।
রাতে আন্টি খেতে ডাকলেন। আমি বের হয়ে দেখলাম আংকেল এবং নীলা আপু বসে খাচ্ছেন। ডাইনিং টেবিলে কাছে গিয়ে বললাম–

— আন্টি আপনারা খেয়ে নিন। উনি এলে আমি খেয়ে নেব।

নীলা আপু মুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে বললেন–

— হুহ! ন্যাকা!

কেউ না শুনতে পেলেও আমি পেলাম। আন্টি বললেন–

— বর্ণ কখন আসবে তার ঠিক নেই। তুমি খেয়ে নাও ছায়া।

— না না আন্টি ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করব, সমস্যা নেই।

আন্টি আর কিছু বললেন না। সকলে খেয়ে এক এক করে চলে গেল। নীলা আপু রাগে এক প্রকার ফোঁস ফোঁস করতে করতে গেলেন। আমি খাবার গুলো ভালো করে ঢেকে সোফায় বসে ওনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

হঠাৎ মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। আমি ধরফড়িয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠলাম–

— ভূ ভূমি’কম্প হচ্ছে! ভূমি’কম্প! আন্টি!

রাম ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেলাম। বর্ণ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন–

— চুপ! কি আবোল তাবোল বলছ? কোথায় ভূমি’কম্প?

আমি চোখ বড়বড় করে ওনার দিকে তাকালাম। কিছু মুহূর্ত পর বুঝতে পারলাম যে ওনার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর উনি এসে আমাকে ধাক্কিয়ে ডাকছিলেন। তাই ভেবেছি ভূমি’কম্প হচ্ছে! উনি আবারও বললেন–

— এখানে ঘুমিয়ে আছ কেন? রুমে জায়গা নেই?

আমি হাই তুলে উঠে দাঁড়ালাম। ঘড়িতে এগারোটা বাজে। ডাইনিং টেবিলে ওনার খাবার প্লেটে বেড়ে দিয়ে বললাম–

— খেয়ে নিন। আপনার জন্য বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গিয়েছি।

উনি এসে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন–

— তুমি খেয়েছ?

প্রচুর ঘুম আসছে আমার। ঘুমে চোখ বুজে আসছে।‌ চোখ টেনে টুনে মেলে বললাম–

— না, খাব না। খুব ঘুম পাচ্ছে। আপনি খেয়ে নিন।

উনি ভ্রু কুঁচকে হাত ধরে টেনে বসালেন। খাবার মুখে ঠুসে দিলেন। না চাইতেও খেতে হলো। নিজে খেলেন পাশাপাশি আমাকেও খাওয়ালেন। রুমে গিয়েই আমি ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। উনি ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমাকে টেনে বুকে নিলেন। চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন–

— কাল থেকে কলেজ যাবে। আবার পড়াশোনা কনটিনিউ করতে হবে। বিয়ে হয়েছে বলে পড়াশোনা লাটে তুলবে যদি ভেবে থাকো, তাহলে সে চিন্তা বাদ দাও। আমারও কাল থেকে অফিস। সকালে বের হবো আর রাতে ফিরব। বুঝেছ?

আমি ঘুমের ঘোরে ‘উমম’ শব্দ করলাম। উনি বুঝে নিলেন যে আমি ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছি। মৃদু হেসে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন।
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৫

যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখলাম তিনি অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি। তার ফর্মাল লুক দেখে সকাল সকাল কয়েকটা হার্টবিট মিস করে বসলাম। আমাকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি ভ্রু নাচালেন। হকচকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। বিছানার দিকে এগিয়ে এসে ঝুঁকে কপালে নিজের শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিলেন। এলোমেলো চুল এক হাতে গুছিয়ে দিতে দিতে বললেন–

— আমি এখন বের হচ্ছি আর রাতে ফিরব। তুমি উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে কলেজ যাবে। আর রাতে আমার আসতে দেরি হলে অপেক্ষা করবে না, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। মনে থাকবে?

আমি মাথা দুলিয়ে বললাম–

— হু মনে থাকবে।

উনি স্মিত হেসে অফিস ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলেন। আমি হাই তুলে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আন্টি আর নীলা আপুকে পেলাম। আন্টি মৃদু হেসে আমাকে বসতে বললেন। নীলা আপুর দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখলাম তিনি চুপচাপ খাচ্ছেন, তবে তার কঠোর চোয়াল। হয়তো রেগে আছেন কোনো কারণে। খেতে খেতে আন্টি বললেন–

— বুঝলে ছায়া? আজ বাপ ছেলে একসাথে বের হয়েছে। দুজন এক সাথে ব্রেকফাস্ট করেছে। আমার যে কি ভালো লাগছিল।

আমি কিছু না বলে হাসলাম শুধু। আন্টি আবারও বললেন–

— আজ থেকে তো তুমি কলেজ যাবে, তাই না?

— হ্যাঁ আন্টি।

আন্টি মুখ গোমড়া করে বললেন–

— আন্টি? তুমি এখন আমার ছেলের বউ ছায়া। আমাকে আন্টি বলবে না। মামনি বলবে, কেমন?

— ঠিক আছে মামনি।

ব্রেকফাস্ট শেষে রেডি হয়ে নিলাম। মামনি কে বিদায় দিয়ে বের হলাম। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ভাবলাম সব কিছু ঠিকঠাক নিয়েছি কিনা আরেকবার দেখি। ব্যাগ হাতে নিয়ে বই খাতা দেখতে লাগলাম। আকস্মিক পেছন থেকে কেউ ধাক্কা দেওয়ায় নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আর্তনাদ করে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেলাম। হাত থেকে ব্যাগ ছিটকে পড়ে গেল। দুই তলা থেকে গড়িয়ে নিচে পড়লাম। মাথায় তীব্র আঘাত লাগার ফলে দেহ অবশ হয়ে এলো, চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারালাম।

ডুবে যাচ্ছি সমুদ্রের গহ্বরে। হাজার চেষ্টা করেও ভাসতে পারছি না। হাত পা ক্রমাগত ঝাঁপিয়ে চলেছি, তবুও আমি ডুবে যাচ্ছি। শ্বাস নিতে পারছি না। আমি কি তাহলে আর বাঁচব না? শেষ চেষ্টা করে বড় শ্বাস নিলাম। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম আমি পানিতে না, অন্য কোথাও আছি। তাহলে এতোক্ষণ নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছিলাম। আমাকে চোখ মেলতে দেখে একটা মহিলা হম্বিতম্বি শুরু করল। চোখের পলকে হাজির হলেন বর্ণ! অস্থির দেখালো তাকে, এলোমেলো চুল, রক্তিম চোখ জোড়া, শুকনো মুখ। বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা হলো। তিনি আমার এক হাত মুঠোয় নিয়ে পাশে বসলেন। অনবরত ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ দিতে থাকলেন। আমার কন্ঠ যেন রোধ হয়ে এসেছে, অনেক কষ্টে দূর্বল কন্ঠে বললাম–

— আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? নিজের কি হাল করেছেন?

তিনি রক্তিম দৃষ্টি মেলে তাকালেন। ঠোঁট নাড়িয়ে বললেন–

— ঠিক আছ তুমি? কষ্ট হচ্ছে কোথাও?

হঠাৎ করেই পুরো শরীরে ব্যথা অনুভব হলো। সেই সাথে মাথায় তীব্র যন্ত্রনা। তবুও মুখে হাসি টেনে বললাম–

— আমি একদম ঠিক আছি। দেখুন আমার কিচ্ছু হয়নি।

তিনি ঢোক গিলে বললেন–

— আজ দুই দিন পর জ্ঞান ফিরেছে তোমার। গুরুতর আঘাত পেয়েছিলে মাথায়। আর ডান পা টা ভেঙে গিয়েছে।

তার কন্ঠ কেমন যেন কেঁপে উঠলো। আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম। আমি তো একটু আগেই সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলাম। এর মধ্যে দুই দিন কীভাবে হয়ে গেল? বাবা মা সহ বর্ণের বাবা মা হুড়মুড় করে প্রবেশ করলেন। মা আমাকে দেখেই আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না শুরু করলেন। বাবার চোখও বর্ণের মতো রক্তিম। না জানি দুই রাত চোখের পাতা এক করতে পেরেছিলেন কিনা? আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললাম–

— কাঁদছ কেন মা? আমি একদম ঠিক আছি।

মা চোখ মুছে বললেন–

— তুই কীভাবে পড়ে গেলি ছায়া? একটু কি খেয়াল করে চলাফেরা করতে পারিস না?

আমি বললাম–

— আমি তো ঠিকই ছিলাম। তবে মনে হয়েছিল পেছন থেকে কেউ যেন ধাক্কা দিল। কিন্তু আমার মনের ভুলও হতে পারে।

বর্ণের চোয়াল শক্ত হলো। টু শব্দটি করল না। তারা সবাই আমাকে দেখে চলে গেলেন তাকে রেখে। বাবা স্নেহের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন। আজই নাকি আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। হঠাৎ বর্ণ শক্ত কন্ঠে বললেন–

— তোমার মনের ভুল ছিল না। তোমার ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

আমি অবাক চোখে তাকালাম। আমার শত্রু কে? যে আমাকে মারতে চায়বে? বর্ণ ফের বললেন–

— তবে সে জানে না আমাদের ফ্লাটের সামনেই সিসি ক্যামেরা লাগানো। এবং তাতে সে ধরা পড়ে গিয়েছে। আমি ছাড়ব না তাকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম–

— কে আমার ক্ষতি চায়বে?

— নীলা! ওকে তো আমি পুলিশে দেব। শুধু তোমাকে একবার বাড়িতে নিয়ে যায়।

আমি আঁতকে উঠলাম। নীলা আপু! নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম–

— আপনি নীলা আপুকে কিচ্ছু বলবেন না। আর না পুলিশে দেবেন।

বর্ণ ক্রোধান্বিত কন্ঠে বললেন–

— কেন? তোমার কথা আমি কেন শুনব? আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেত? আমি কি নিয়ে বাঁচতাম?

দুর্বল হাত বাড়িয়ে ওনার হাতের ওপর রাখলাম। বললাম–

— দেখুন আমার তো কিছু হয়নি। নীলা আপু একটা ভুল করে ফেলেছে। সে হয়তো এমনটা করতে চায়নি তবে হয়ে গিয়েছে। তাকে আরেকটি সুযোগ দিন। প্লিজ? আমার কথাটা রাখুন।

বর্ণ মুখ এগিয়ে এনে কপালে আদুরে স্পর্শ দিলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–

— তুমি রেস্ট করো। এসব বিষয়ে পরে ভেবে দেখব। অযথা মাথায় চাপ দিও না।

কোনো কথা না বলে চোখ বুজে নিলাম। নীলা আপু ওনার ওপর দূর্বল ছিলেন, সেই জন্য রাগের বশেই হয়তো কাজটা করে ফেলেছেন। তাকে অবশ্যই দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া উচিত।

সেদিনই আমাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। হাঁটতে না পারার কারণে হাসপাতাল থেকে কোলে করে গাড়িতে তুলেছেন আবার গাড়ি থেকে সিড়ি বেয়ে দোতলা পর্যন্ত উঠেছেন। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি মানুষটিকে। দুটো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন, তবুও তিনি থেমে নেই। একটু বিশ্রামও নেননি। তার যাবতীয় সময় আমাকে সঁপে দিয়েছেন। নতুন চাকরি, একদিন যেয়েই আমার জন্য ছুটি নিয়েছেন। নীলা আপুও বাড়ি চলে গিয়েছেন। আমার জেদের জন্য তিনি নীলা আপুকে কিছু বলেননি শুধুমাত্র শাসিয়েছেন আর কাউকে তার কীর্তির কথা জানানওনি।
দিনরাত এক করে আমার খেয়াল রাখেন। কোথাও যাওয়ার হলে, হয় ধরে নেন নাহলে একদম কোলে তুলে নেন। তবে মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর থেকে আমাকে একদম ছাড় দেননি। নিয়মিত পড়াচ্ছেন, আমার এখন তিনটা কাজ। খাওয়া, ঘুম আর পড়া।
অফিস তো আর বেশিদিন বন্ধ দেওয়া যায় না। তিনি অফিস যাওয়া শুরু করেছেন। তার অনুপস্থিতিতে মামনি নাহয় মা দু’জনের একজন আমার সাথে থাকবেই। এটা তাঁর কড়াকড়ি আদেশ। পা ধীরে ধীরে ঠিক হচ্ছে। এবং দীর্ঘ একমাস পর আমি এখন পুরোপুরি হাঁটতে পারি। এতে আমার আনন্দের অন্ত নেই।

রাত আটটা বাজে, তিনি অফিসের কিছু ফাইল দেখছেন। শুক্রবার হওয়ায় বাড়িতে আছেন, অন্যান্য দিন দশটার আগে বাড়ি ফিরতে পারেন না। আমি মনের সুখে রুমে এ মাথা ও মাথা হেঁটে বেড়াচ্ছি। কখনও বা লাফাচ্ছি। তিনি ফাইল থেকে চোখ তুলে ভ্রু কুঁচকে বললেন–

— কি হচ্ছে?

আমি প্রফুল্ল কন্ঠে বললাম–

— দেখুন আমি কি সুন্দর হাঁটতে পারছি! একমাস বসে ছিলাম! ভাবা যায়? আমার তো মনে হচ্ছে এখন অলিম্পিকে অংশ নিলে জিতে যাব।

পুনরায় ফাইলে চোখ দিয়ে বললেন–

— সবে মাত্র ঠিক হয়েছে। বেশি লাফালে আবারও একমাস বসে থাকতে হবে।

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। আমি গুটি গুটি পায়ে ওনার পাশে ঘেসে বসলাম। ওনার কোনো হেলদোল হলো না। উৎসুক কন্ঠে বললাম–

— আপনি জানেন কাল কি?

— কাল আবার কি?

আমি দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে বললাম–

— কাল আমার জন্মদিন।

তিনি নির্লিপ্ত। ভাবলেশহীন ভাবে বললেন–

— ওহ্!

আমার মুখ কালো হয়ে গেল। শুধু ওহ্? আর কিছু না? মিনমিন করে বললাম–

— আমার জন্মদিন আর আপনি শুধু ওহ্ বললেন!

তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন–

— তো আর কি করব? কাজ করছি তো নাকি? যাও তো, এখন আমাকে ডিস্টার্ব কোরো না।

চোখ ভরে এলো। আমার জন্মদিন! আর উনি কাজ দেখাচ্ছেন? আমার কোনো মূল্যই নেই ওনার কাছে। ধপাধপ পায়ে ঘর ছাড়তে ছাড়তে বললাম সকল স্ত্রীদের অসাধারণ বাক্যগুলো–

— আমি আর এখানে থাকব না। কালই বাপের বাড়িতে চলে যাব।

চলবে..
{

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here