#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৭
|৯|
নির্ঝরের কেবিনে খেয়া বসে আছে।নির্ঝর নেই এখানে।সে ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে বাইরে।খেয়া উঠে দাঁড়িয়ে কেবিনের চারপাশ ভালো মতো দেখতে শুরু করলো।
কাচের জানালার সামনে থেকে বেশ কিছুক্ষণ সে বাইরে তাকিয়ে রইলো।কাচের ভেতর দিয়েও প্রকৃতি দেখার আলাদা আনন্দ আছে।
নির্ঝরের অফিসটি ছয় তলায়।নিচ দিয়ে ব্যস্ত নগরী।কত ব্যস্ত সবাই।একমাত্র খেয়াই দিন দিন অসাড়,নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।
বড় করে শ্বাস নিল সে।
ঘুরে টেবিলের কাছে আসল।আজকের খবরের কাগজ।সে হাত বাড়িয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিল।
খবর কাগজ সরাতেই একটা ডায়েরি নজরে এলো।নির্ঝর ডায়েরি লিখে?ডায়েরিতে কি লিখে?
বেশ কৌতূহল নিয়েই সে ডায়েরিটা হাতে নিল। পরপর পেইজ উল্টালো।
প্রথম পেইজে কিছু একটা লেখা হয়েছিল।কিন্তু কি লেখা হয়েছিল তা বোঝার উপায় নেই।কারণ তার উপর কলমের ঝড় বয়ে গেছে।
নিচের তারিখটা অক্ষত আছে।আজ থেকে প্রায় এক বছর আগের তারিখ।
খেয়া পরের পেইজ উল্টাল।পনেরো-বিশটা পেইজের মতো ছেঁড়া।ডায়েরিটার এমন করুন দশা কেন?
ছিঁড়ে ফেলা পেইজ গুলোর অজানা লেখা পড়তে না পারায় বেশ মন খারাপ হলো তার।বাকি অংশে কি লেখা আছে পড়ার জন্য দ্রুত পাতা উল্টাল।
মাঝামাঝি জায়গা একটা ছন্দ লেখা।
“তুমি অন্য কারো মোহে আকুল?
দেখতে পাও না এই আমি তোমাতে কতটা ব্যাকুল!”
এই লাইন দুটো খেয়ার বেশ পছন্দ হলো।তার মানে সত্যি নির্ঝরের ছন্দ মেলানোর রোগ হয়েছে?
পরের পেইজ উল্টানোর আগেই পেছন থেকে নির্ঝরের কন্ঠ কানে আসলো।
__’কি করো?’
খেয়া ডায়েরিটা বন্ধ করে পেছন ঘুরে সামান্য হেসে বলল,
__’কিছু কি করার কথা?’
নির্ঝরের নজর খেয়ার হাতের ডায়েরিটার উপর পড়তেই ভয়ার্ত চোখে তাকাল।দৌঁড়ে এসে ডায়েরিটা একপ্রকার কেড়ে নিয়ে বলল,
__’পড়েছো কিছু?’
__’পড়তে দিলেন কই!তার আগেই এসে হাজির।’
নির্ঝর বড় করে শ্বাস নিল।
__’বাঁচলাম।’
__’সামান্য ডায়েরিতে হাত দিতেই বাঁচা মরার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? ‘
__’ও তুমি বুঝবে না।’
__’বুঝিয়ে বললে তো বুঝবো, নাকি?’
__’তুমি কি সত্যিটা শুনতে চাও?নাকি কথার কথা জিজ্ঞেস করছো?’
খেয়ার ভেতর দিয়ে শীতল রক্ত বয়ে গেল।ইদানীং সে কি বাড়তি কথা বলে?ডায়েরিতে কি লেখা আছে কেন জানতে চাইবে?
তবে সে আন্দাজ করতে পারলো কার ব্যাপারে লেখা আছে।
কথা ঘুরানোর জন্য বলল,
__’আপনার অফিসের কাজ শেষ?যাবেন না?’
__’হুঁ!ল্যাবে একবার যেতে চেয়েছিলাম।তবে আজ আর যাবো না।’
__’আপনার ল্যাব ট্যাব নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।যন্ত্রপাতি দেখলেই মাথা ঘুরে।’
নির্ঝর হেসে দিল।ডায়েরিটা পুনরায় টেবিলের ড্রয়ারে রেখে বলল,
__’চলো তো!বাইরে বের হবো এখন।’
নির্ঝরের পেছন পেছন হেঁটে খেয়া গাড়িতে উঠলো।
|১০|
__’কোথায় যাবে?কোন পার্ক,রেস্টুরেন্ট নাকি নদী?’
__’আমার কোনো ইচ্ছে নেই।আপনার যেখানে যেতে মন চায় যান।’
__’তুমি কি কোনো কারনে আপসেট?যেতে চাচ্ছো না?না যেতে চাইলে সমস্যা নেই।গাড়ি ঘুরিয়ে বাসায় যাই।’
__’বেশি কথা না বলে গাড়ি চালান তো!’
বলেই খেয়া গাড়ির সিটে হেলান দেয়।নির্ঝর এক পলক খেয়ার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালানোতে মন দেয়।
আধ ঘন্টা পর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামায় সে।খেয়ার দিকে তাকায়।চোখ বন্ধ করে আছে।ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো!
নির্ঝর তাকে ডাক দেয় না।গাড়ি এক সাইডে পার্ক করে চুপচাপ বসে থাকে।
গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে সেও খেয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।খেয়া আজ নীল রঙের শাড়ি পড়েছে।নীল রঙটা কি মেয়েদের বেশি প্রিয়?
বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মেয়েদের নীল রঙের প্রতি আলাদা উইকনেস রয়েছে।বিশেষ করে অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
অল্প বয়স বলতে আবেগের বয়সটা!আচ্ছা, নীল রঙের সাথে আবেগ নামক অনুভূতির কোনো যোগসূত্র আছে?এর আগে কেউ কি গবেষণা করেছে নীল রঙ পছন্দের কারন?
তবে নীল শাড়িতে খেয়াকে বেশ মানিয়েছে।কি সুন্দর লাগছে তাকে?আচ্ছা, খেয়া কি সত্যিই এত সুন্দর নাকি শুধুমাত্র তার চোখে?
নির্ঝর নিজের অজান্তে খেয়ার দিকে একটু ঝুঁকলো।সে চাচ্ছে খেয়া মাথাটা তার কাঁধে রেখে ঘুমাক।
অতি সাবধানে সে খেয়ার মাথাটা নিজের কাঁধে রাখলো।খেয়ার মাথার চুল ছোট ছোট ক্লিপ দিয়ে খোঁপা করা।সে কিছুক্ষণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
হঠাৎ করে তার রাতের করা কাজটা আবার করার তীব্র ইচ্ছে জাগলো।খেয়ার গালে চুমু দেয়ার জন্য মুখটা নিচু করতেই ধপ করে খেয়া চোখ খুলল।
ব্যাপারটার জন্য নির্ঝর মোটেই প্রস্তুত ছিল না।সে হতভম্বের মতো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো।
খেয়া কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে।যেন বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে!
একটুপর যখন বুঝতে পারল সে নির্ঝরের কাঁধে মাথা রেখেছে, দ্রুত সরে বসল।শাড়ির আঁচল ঠিক করে বলল,
__’এসে গেছি?নামবো?’
__’হুঁ!’
খেয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।এটা একটা রেস্টুরেন্ট দেখে সে চিন্তিত গলায় বললো,
__’আপনি না বললেন ঘুরতে যাবেন,তাহলে রেস্টুরেন্টে কেন?’
নির্ঝর গাড়ির চাবিটা পকেটে পুড়ে বলল,
__’তোমার মন মেজাজ আজ ভালো নেই। তাই সিদ্ধান্ত বদলেছি।খেয়েই চলে যাবো।’
__’আমার মন মেজাজ আর কোনোদিন ভালো হবে না।এমনই থাকবে সারাজীবন।’
__’মনের উপর কারো হাত নেই।এমনকি নিজের ও না।মন নামক শব্দটার ওপর কারো অধিকার খাঁটে না।ভবিষ্যতে দেখা গেল,তুমি আগের চেয়েও হাসিখুশি আর উৎফুল্ল হয়ে গেলে।শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার।’
__’আজকাল মনে হয় আমার মধ্যে মন নামক বস্তুটিই নেই!আবার তার পরিবর্তন।’
নির্ঝর মনে মনে বলল,
__’তোমার মনকে নতুন করে জাগাব আমি।একদিন তোমার মনে শুধু আমান বিচরণ থাকবে।এই নির্ঝর জুবায়ের থাকবে।আর সেটা তুমি নিজ মুখে স্বীকার করবে।’
পরিস্থিতি হালকা করার জন্য মুখে এক গাল হেসে বলল,
__’ Come over the hills
and far with me,
and be my love in the rain..
বলোতো এটা কার বাণী?’
খেয়া মুচকি হেসে বলল,
__’জানলেও বলবো না।’
__’তুমি জানোই না।নাও,এখন গাড়ি থেকে নামো।কিছু খেয়ে নিই।’
গাড়ি থেকে নেমে দুজন রেস্টুরেন্টে ঢুকলো।প্রবেশ পথের শুরুতেই ডান দিকের ফাঁকা টেবিলটাতে দুজন বসল।রেস্টুরেন্টে মানুষ অনেক কম।খেয়া স্বস্তি পেল!
__কি খাবে বলো?’
__’আমার মতামত চাইলে শুধু বলবো এক কাপ কোল্ড কফি।আর কিছু নাহ।’
খেয়াকে অবাক করে সত্যি সত্যি নির্ঝর দুটো কোল্ড কফি অর্ডার করলো।
কয়েক মিনিটের মধ্যে কফি এসে পৌঁছাল।খেয়া নেড়েচেড়ে একটু আড়ষ্ট হয়ে কফির কাপে চুমুক দিল।
খেয়া মাথা নিচু করে আছে।কোনো কথা বলছে না।নির্ঝর তাকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করলো না।
এই যে খেয়ার এত কাছাকাছি সে বসে আছে এতেই সে খুশি।
আধ ঘন্টা পর নুহার জন্য আইসক্রিম কিনে তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো।
গাড়ির কাছে হেঁটে যেতেই দেখে জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে।তার সাথে জাহিদের সমবয়সী একটা মেয়ে।
জাহিদ মেয়েটার হাত ধরে আছে।
খেয়া হাঁটা থামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লো।তার চোখ ছলছল করছে।ততক্ষণে নির্ঝরেও চোখে পড়েছে জাহিদকে।
নির্ঝর জাহিদকে ভালো করেই চিনে।বিয়ের আগে খেয়ার সাথে বেশ কয়েকবার দেখেছে।দু একবার তার সাথেও কথা হয়েছে।
জাহিদও বেশ অবাক হয়ে তাদের দুজন কে দেখছে।একটুপর কয়েক পা এগিয়ে এসে কুটিল হাসি হেসে বলল,
__’বাহ!আমি ডিভোর্স দিতে না দিতেই পুরনো প্রেমিককে জুটিয়েছ?খবর নিয়ে জানলাম তার বাসাতেই নাকি থাকো।তা বিয়ে সাদি করেই রাসলীলা শুরু করেছ নাকি লিভ টুগেদার?’
জাহিদের কথা শেষ হতে না যতক্ষণ, ততক্ষণে তার নাকে একটা ঘুষি পড়েছে।নির্ঝরের ঘুষি খেয়ে সে একটু ছিঁটকে পিছিয়ে গেল।
(চলবে)
আসসালামু আলাইকুম।
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। 🖤