#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||শেষ পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
ফাহিমের পিছু পিছু অনিমেষও আসে ফাহিমের বাসায়। দরজায় দাঁড়িয়ে সামিরা রহমান ও ফাহিমের কথোপকথন শুনে বেশ কনফিউজই হয়ে পড়ে সে। পরে ফাহিমের সম্মুখে এসে প্রশ্ন করলে সে একবিন্দুও লুকায় না, সব বলে দেয়।
অনিমেষ ভীতু গলায় তাকে প্রশ্ন করে,
“তাহলে তুমি কার সাথে থাকতে চাও বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছো?”
“অবশ্যই চৈতালি। এক ছাদের নিচে একসাথে বসবাস করলে নিঃসঙ্গ, প্রতারিত হৃদয়ের কারো প্রতি মোহ তৈরি হবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। তার উপর পূর্ণ আমার যত অপূর্ণ চাওয়া ছিল নিজের বৈবাহিক সংসার থেকে সব পূর্ণ করছিল। মোহ একটা তৈরি হয়েছিল তা সত্য।
তবে পূর্ণতা সবসময়ই আমার চাহিদা ছিল। চাহিদা কখনোই ভালোবাসার চেয়ে বড় হয় না। কিন্তু এভাবে বিবেকের কাছে হেরে আমি কী করে চৈতালির কাছে…?”
“তুমি চৈতালির কাছে যাও। আমি পূর্ণতার বাড়িতে যাচ্ছি। আমার ওয়াদা কোনো ভাবেই মেয়েটার জীবন নষ্ট হতে দিব না।”
অনাকাঙ্ক্ষিত খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে ফাহিমের চোখজোড়া। কিছু একটা ভেবেই কাগজ কলম নিয়ে বসে সে।
অনিমেষের কাছে আবেদন করে,
“তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর ক্ষমতা নেই আমার। আরেকটা আবেদন করে এই চিঠিটা পূর্ণতাকে দিয়ো।”
“ঠিক আছে, বাহিরে গাড়ি ড্রাইভার সহ অপেক্ষা করছে। তুমি খান বাড়িতে চলে যাও। আমি আসছি।”
___
ব্যালকনিতে আনমনেই বসে আছে চৈতালি। দৃষ্টি স্থির তারাময় আকাশটির দিকে। হুট করেই কেউ নিজের উষ্ণ বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়। সচকিত হয়ে পিছনে ঘুরে চৈতালি।
অবাক কণ্ঠে অস্ফুটভাবে বলে উঠে, “ফাহিম?”
ফাহিম নৈশব্দে জড়িয়ে ধরে তাকে। চৈতালিও পরম আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে।
“তুমি এসেছো ফাহিম? আমি জানতাম তুমি আসবেই, তুমি তো আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো।”
“এতটা কষ্ট নিয়ে কেন ছিলে চৈতি? একবার আসতে আমার দোয়ারে চৈতি। বুঝাতে তুমি বদলে গেছো।”
ফাহিমের বচন শ্রবণগত হতেই চৈতালি তড়িৎ গতিতে তার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ছলছল চাহনি তার চোখজোড়ায়।
“তুমিই তো বলেছিলে আমাকে ক্ষমা করা যায় না। আমি টাকার মৌমাছি, যেদিকে টাকা দেখি সেদিকেই যাই। তোমার পরোয়া করি না কত কী! তবে ফিরে কেন যেতাম?”
কথাটা শুনেই ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে ফাহিম। কী অভিমানী কণ্ঠ যে আজ রমণীর!
“আমার রাগ, তোমার প্রতি বিক্ষুব্ধ হওয়া কি জায়েজ ছিল না? আমি যা বলেছিলাম তা কি মিথ্যেই ছিল? অভিমান, রাগ আমার ছিল। ভাঙানোর দায়িত্ব তোমার ছিল। তুমি কী করলে? নিজের অহং নিয়ে বসে থাকলে।”
“মোটেও এটা ভেবো না ফাহিম। আমি দাম্ভিকতায় তোমার দরবারে যাইনি, এমন নয়। যাইনি হীনমন্যতায়, যাইনি অনুতাপে, যাইনি লজ্জায়। যতবার তোমার প্রতি হাত বাড়াতে গিয়েছি ততবার আমি আদৌ তোমার যোগ্য কি না এই প্রশ্নে, এই দ্বিধায় বাধাগ্রস্ত হয়েছি। আমার অপরাধটা এত বড়, কী করে তোমার কাছে যেয়ে ক্ষমার আবেদন করতাম? তার উপর আমার প্রেগন্যান্সির কমপ্লিকেশনস্…”
ফাহিম পুনরায় বুকে আগলে নেয় প্রেয়সীকে। এই রমণী যে একান্তই তার। শুধায়,
“বাচ্চা হওয়া, না হওয়া আল্লাহর কাছে। তাই অতীতের সব কথা বাদ দাও। এখন আমাদের আবার এক হওয়ার দিন এসেছে। যাবে না আমার সাথে? আমাদের সংসারে?”
চৈতালি মুখ লুকায় যুবকের বুকে। অস্পষ্টভাবে “হুম” উচ্চারণই তার সম্মতি।
___
অনিমেষের সাথে গাড়িতে বসে আছে পূর্ণতা। অনিমেষ মৃদু কণ্ঠে পানি এগিয়ে দিয়ে শুধায়,
“একটু পানি পান করবেন? ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।”
“না, ধন্যবাদ। ফাহিম কোথায়?”
“চৈতালির কাছে। আমি নিজে উঠিয়ে দিয়ে এসেছি গাড়িতে। তোমাকে এই চিঠিটা দিয়েছে ফাহিম।”
অনিমেষ ভাবছিল মেয়েটা কাঁদবে, ভাঙবে, রাগবে; কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। চমকিতও হয় না পূর্ণতা। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই চিঠিটা খুলে।
পূর্ণতা,
জানি আমার উপর রাগ তোমার, নিরাশ তুমি। তবে তুমি নিজেই একবার ভাবো আদৌ আমার মনে প্রিয়জন হিসেবে নিজের পৃথক জায়গা তুমি নিয়েছিলে? না, তুমি চৈতালি হয়ে চৈতালির জায়গা টুকু চেয়েছিলে। চৈতালির পোশাকাদি, পছন্দ আপন করে নিয়েছিলে আমাকে নিজের করতো। চৈতালি যেসব জায়গায় অপূর্ণ ছিল, তুমি সেসবে নিজেকে পারদর্শী দেখিয়েছো। আমি মুগ্ধ হয়েছি ঠিকই, মোহে পড়েছি ঠিকই। তবে মায়ায় পড়িনি। তুমি যা, তুমি তা হয়ে আমার সামনে থাকোনি। তুমি চুপচাপ থাকা মেয়ে, চেষ্টা করছিলে চৈতালির মতোন খুশমেজাজ, বাঁচাল, দুষ্টু সাজার।
আমি খুব করে ভাবলাম তোমার প্রতি আমার মনে বিন্দুমাত্র অনুভূতি আছে কি না? নাহ্, আমি তোমার প্রতি না, তোমার চৈতালিময় চরিত্রের প্রতিই বিমোহিত হয়েছিলাম। আমার প্রতারিত হয়েছিলাম চৈতালির দ্বারা। নিঃসঙ্গ, প্রতারিত হৃদয়কে তুমি উষ্ণতা দেওয়ায় একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম তোমার প্রতি। কখনো তোমাকে স্পষ্টভাবে না বলতে পারিনি। তবে প্রিয়জন হওনি, হয়েছিলে আমার প্রয়োজন। হয়তো একসময় প্রিয়জন হয়ে যেতে, তবে ভালোবাসার আবেগ আর টানটা অনেক বেশি। তোমার দিকে এগুনো সম্ভব হয়নি। আমাকে ক্ষমা করবে। কোনো দাবী রাখবে না দয়া করে।
ইতি,
ফাহিম
চিঠিটা পড়ে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল রমণী। বিরস মুখে বলল,
“তবে এখান থেকে আমাকে বাঁচানো কি মহান সাজার জন্য? আমি কোথায় যাব বা কী করব এখন তা তো একবার ভাবেনি কেউ।”
অনিমেষ বুঝলো পূর্ণতার অবস্থা। সত্যিই এই পশুর শহরে একদম একা হয়ে পড়েছে মেয়েটি। তবে মনে প্রশ্ন উঠলো, আদৌ কি ফাহিমকে ভালোবাসতো সে না কি শুধুই আশ্রয়ের আশায় এতটা?
মুখে কিছু বলল না সে। প্রস্তাব রাখলো,
“আপাদত, আপনাকে একটা হোস্টেলে রেখে আসি। আমি কয়েকদিন বাদে একবারের জন্য কানাডায় চলে যাচ্ছি, আপনিও চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় পূর্ণতা। ঢোক গিলে অনিমেষ।
“না, মানে আপনার স্টাডিস্ কমপ্লিট করতে পারেন সেখানে যেয়ে, পাশাপাশি চাকরিও। এছাড়া আর ভালো কোনো প্রস্তাব আমার কাছে নেই।”
পূর্ণতা কিছুক্ষণ ভেবে সায় জানায়। সবটা সে এবার ভাগ্য আর আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছে। ভালো হলে ভালো। খারাপ হলে খারাপ।
___
বাসন্তীর নামে আবার বেনামি চিঠি এসেছে। বাসন্তী জানে প্রতিটি চিরকুটের মূল কথা একই। তারপরও পরম উত্তেজনার সহিত চিরকুটটি খুলে সে।
প্রিয় বসন্তকুমারী,
লোকে বলে হেমলক থেকে মায়াময় বিষাক্ত না কি কিছু হয় না। কিন্তু আমরা দুজন, দুজনার কাছে হেমলক থেকেও বিষাক্ত। কারণ একে অপরকে ছাড়া ভালো নই আমরা, আবার একে অপরের সাথেও হয়তো ভালো ছিলাম না। আমার অতীতের, অসুখের বিষে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে তোমাকে। এখন আমি ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি তোমার বিরহের বিষে। বেঁচে থাকার স্পৃহা, প্রেরণাই যেন হারিয়ে ফেলছি ধীরেধীরে। আমাকে কি আর একটা সুযোগ দেওয়া যায় না বসন্ত? একটা সুযোগ? ভিখারি ভেবে দয়া করেই নাহয়।
ইতি,
তোমার অপ্রিয় কেউ।
চিঠিটা যেন বাসন্তীর হৃদয় নিংড়ে সবটুকু আনন্দ শুষে নিল। শুধু চাপা দুঃখ, কষ্ট রয়ে গেল। তবুও অত অত বিষাক্ত স্মৃতি কি এত সহজেই ভুলা যায়? কিন্তু আগে তো বারবার ভুলে যেতো নায়িমের সামান্য মিষ্টি কথায়। তবে এখন কেন এত আকুতির পরও হৃদয় গলছে না কেন তার?
নিজেকেই নিজে উত্তর দেয় বাসন্তী,
“অহং ও আত্মসম্মানবোধের জন্য। তোমাকে সবসময় নিজের এবং নিজের আত্মসম্মানবোধের উর্ধ্বেই রাখতাম না, বরং তোমাকেই আমি নিজের সম্মান ও অহংকার মনে করতাম। কিন্তু সেবার সব আশা-ভরসা তুমি চূর্ণবিচূর্ণ করার পর সেই স্থানটা হারিয়ে ফেলেছো।
আমি চাইলেও পারছি না তোমায় নিজের করতে এতটা শক্ত দেয়াল তুলেছো তুমি তিক্ততার আমাদের সম্পর্ক। তোমাকে ক্ষমা করেছি আমি, অভিযোগ নেই তোমার প্রতি, আজও ভালোবাসি। তবুও আমি পারছি না। আমার মনের জানালা-দোয়ারই হয়তো মিটে গিয়েছে, তাই তোমার প্রবেশও অসম্ভব হয়ে উঠেছে।”
বিকেল বেলা, বাসন্তী কাজ শেষে নিজের ঘরে ঢুকে দেখে পুরো ঘর গোলাপ ও রজনীগন্ধায় সাজানো। ফুলের মিষ্টি সৌরভে মৌ মৌ করছে সারা ঘর। একটু এগিয়ে যেতেই নায়িম বারান্দা থেকে বের হয়। বাসন্তী ও নায়িম একে অপরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
নায়িম তার হাত ধরে বলে উঠে,
“অনেক তো হলো রাগ, মান-অভিমান। এবার প্লিজ চলো শুরু করি না আবার নতুন করে।”
বাসন্তী আড়ষ্ট হয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়। নায়িমকে কী করে বলবে নিজের মনের কথা কিংবা আদৌ বলতে পারবে কি না তা তার নেই।
“বসন্ত, জানি আমার ভুলের ক্ষমা হয় না। তবে একটা সুযোগ নিজের ভুল শুধরানোর কি আমার প্রাপ্য নয়? তুমি তো আজও ভালোবাসো, তবে কেন নিজেদের সুখকে দেখার আরেকটা চেষ্টা করতে এত বাধা?”
বাসন্তী ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেলে। কম্পিত কণ্ঠে বলে,
“একজন নারীর অহং কখনো ভাঙতে নেই। তার ক্ষমা হয় না। কারণ নারীর কোমল হৃদয়ই সেটার স্বীকৃতি দেয় না। তোমার ভালোবাসা, তুমি, তোমার প্রতি বিশ্বাস আমার অহং আর আত্মসম্মান ছিল। যখন তুমি সেদিন আমার অহংকে গুড়িয়ে দিলে না, সেদিন সেই বাসন্তীরও মৃত্যু হয়েছিল। জন্মেছিল এক নতুন বাসন্তী, যার হৃদয়ে তোমার জন্য ভালোবাসা তো আছে, কিন্তু আক্রোশ তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি। যে তোমাকে ভালো তো বাসে, কিন্তু যার অহং তুমি নও। যার ভালোবাসা হারে তারই আত্মসম্মানের প্রখরতার নিকট।
তোমাকে ক্ষমা করেছি আমি। তবে বিশ্বাস করো বহুবার তোমায় আপন করে নিতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। কারণ কী জানো? তা আমার আত্মসম্মানকে আঘাত করে। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না তোমার আমাকে প্রতিবার হতাশ করা। ভুলতে পারি না তোমার আমাকে ভালোবাসাকে অস্বীকার করা। ভুলতে পারি না আমায় করা অপমান, অবজ্ঞা, আঘাত। হ্যাঁ, এটা সত্য তোমাকে ছাড়া কাউকে আপন করে নেওয়া অসম্ভব। তবে যেদিন পর্যন্ত ঐ বিষাক্ত স্মৃতিগুচ্ছ না ঘোলাটে হচ্ছে, মুছে যাচ্ছে ঐ অবধি তোমাকে আপন করা সম্ভব নয়।”
নায়িম বাসন্তীর কথার বিপরীতে আর একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। করে না সে মার্জনার আবেদন। হতাশ চোখে, ছলছল নয়নে গৃহ ত্যাগই হয় তার কর্ম।
___
অনিমেষ পূর্ণতাকে নিয়ে সারাজীবনের জন্য কানাডা চলে যাচ্ছে আজ। নায়িম, বাসন্তী ও নাহিবা এসেছে তাকে এয়ারপোর্টে রেখে আসতে। যাওয়ার পথে চৈতালির বাড়ির সম্মুখে গাড়ি থামায় অনিমেষ। নায়িমকে ইশারা করে বেড়িয়ে পড়ে সে।
বেল বাজাতেই চৈতালি দরজা খুলে। অনিমেষ খেয়াল করে আজ রমণীর পরনে আর রঙহীন পোশাক নেই। বরং রগরগে লাল রঙের শাড়ি। মুখেও হাসি লেগে আছে।
“আপনি? ঘরে আসেন অনিমেষ।”
“না, না, আজ বড্ড তাড়া আমার। কানাডা চলে যাচ্ছি সারাজীবনকার মতোন। বিদায় নিতে আসলাম। সাথে কিছু দিতে। ”
বলেই একটা মোড়ানো কাগজ নরম হাতে গুঁজে দিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে দৌড়ানোর ভঙ্গিমায় বেড়িয়ে যায় সে।
চৈতালি হতবাক। ঘটনার আকস্মিকতায় এমন হওয়ায় অস্বাভাবিক কিছু নয়। সোফায় বসে মোড়ানো কাগজটি খুলে সে। গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
প্রিয় কদমফুল,
তোমাকে প্রথম যখন দেখি তখন তুমি সদ্য কিশোরী। নায়িমের সাথে যেয়ে তোমায় দেখা। সে কী দুষ্টুমি খেলা করছিল তোমার চোখজোড়ায়! হাত ডুবিয়ে নয়, যেন মন ডুবিয়েই কাঁচা আম খাচ্ছিলে তুমি। আর ইচ্ছে করে আঁটিটা আমার দিকে মারলে। বিশ্বাস করো মনে দাগ কেটেছিলে তুমি গভীর ভাবে সেদিন। বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথায় সারাটা রাত্রি নির্ঘুম আমার। চোখ বন্ধ করলেই ভাসছিল তোমার চেহারা। এই নব অজানা অনুভূতির আগমনের ভয়ে নায়িমকেও কিছু বলিনি।
এরপর নায়িমকে ছাড়াই না জানিয়ে বহুবার তোমার বাড়ির সামনে গিয়েছি। আড়াল হতে তোমায় দেখেছি। কারণ জানতাম তুমি আমার হওয়ার নয়, মাঝে যে ধর্মের বিশাল দেওয়াল। এরপর পড়ার চাপ বাড়লো, উকিল হতে হবে মায়ের ইচ্ছে। পড়ায় ডুবে তোমাকে ভুলার প্রচেষ্টা। না ভুললেও, ভুলে থাকতে ভালোই কাজে দিল এই উপায়। দিন কাটতে কাটতে লাগলো।
একদিন নায়িমের থেকে শুনলাম তুমি এসেছো, তোমার সংসার হয়েছে। আহত হলাম, খুশিও। পরে শুনলাম বিপথগামী, তোমার সংসার ভাঙার পথে। আমি যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়লাম। আমার অবুঝ কিশোরীর এত ধ্বংস যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। যখন দেখলাম তুমি শুধরেছো নিজের কাছে ওয়াদা করলাম তোমাকে তোমার ভালোবাসা, সংসার ফিরিয়ে দিব। উপরওয়ালার কৃপায় ফিরাতে পেরেছি এতেই আমার সন্তুষ্টি। এখন তুমি ভালো থাকো, সুখে থাকো এটাই একমাত্র আমার চাওয়া।
ইতি,
অনিমেষ।
চিঠিটা পড়তে পড়তেই অশ্রু জমে উঠলো চৈতালির নেত্রে। এতটা নিঃস্বার্থ ও গভীরভাবেও কেউ ভালোবাসতে পারে বুঝি?
___
দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গিয়েছে অনিমেষের যাওয়ার। কানাডার এক মুসলিম এতিম ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে পূর্ণতার অনিমেষ। আজ ছয়মাস হলো বিয়ের। জীবনটা কাটছে রমণীর স্বপ্নময় ভাবে। জীবন থেকে প্রায় নিরাশ হয়েই বসেছিল পূর্ণতা। এই ছেলেটা এসে আবার রঙে মাখিয়ে দিল তার জীবনে। অনিমেষের কাছে সদা কৃতজ্ঞ সে।
—
আজ একবছর হলো ফাহিম চাকরি হারিয়েছে কোম্পানি বন্ধ হওয়ার কারণে। এখন একটা শো-রুমে সেলসম্যানের কাজ করে যত টুকু বেতন পায় তাতেই দিন চলে। এই অভাবের দিনে চৈতালি আবার যেন সেই পুরাতন চৈতালি হয়ে গিয়েছে। সারাদিন খিটখিটে মেজাজ, একটু বাদে বাদেই টাকা-পয়সা নিয়ে খোঁটা, তার মাকে গালিগালাজ। কাজের বুয়াটা বাদ দিয়েছে প্রায় আটমাস। অফিসের সব কাজ করে ফিরে বাড়ির কাজ এবং মায়ের সেবা দুটোই ফাহিমের করা লাগে। ভয় লাগে ফাহিমের আজকাল ভীষণ মেয়েটা যদি আবার ছেড়ে চলে যায়। বোনটাও যে চৈতালিকে ফিরিয়ে আনার কারণে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে বহু আগেই। খালা কসম কেটে গিয়েছে এ বাড়িতে পা রাখবে না। এই সময়ে আবার চৈতালি চলে গেলে ফাহিম একদম নিঃস্ব হয়ে পড়বে। যদিও আগের মতোন তেমন মানুষের গায়ে পড়া ভঙ্গিমা এখনও করতে দেখেনি সে।
প্রায়শয়ই ফাহিম অতিরিক্ত দুঃখে মনে মনে বলে উঠে,”আজ চৈতালিকে ডিভোর্স দিয়ে, পূর্ণতাকে বিয়ে করলেই বোধহয় ভালো থাকতাম। আসলে খালা সত্যিই বলেছিল, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না, স্বভাব যায় না না মরলে।”
বস্তুত, মানুষের মন, মস্তিষ্ক ও আচারণ জটিল থেকেও জটিলতর। অনুতাপ সবসময় সারাজীবনকার হয় না। কিছু অনুতাপ হয় সাময়িক। পুনরায় একই পরিস্থিতিতে ফেললে আবার খোলস ছাড়তে সময় খুব ক্ষুদ্রই লাগে। চৈতালির ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে।
তবে এখন একটা স্বস্তির ও মেলবন্ধনের স্থান আছে ফাহিম ও চৈতালির। তাদের একমাত্র ছেলে মাগফিরাত। মাগফিরাতকে দেখলেই সব কটুকথা ভুলে যায় ফাহিম। চৈতালিও সারাদিনের গলাবাজি, রাগ, দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষার প্রতি আকর্ষণের বিরতি ঘটে ছেলের আধো আধো বুলি শুনে। হয়তো ছেলের বড় হওয়ার সাথে সাথেই শুধরাবে সে না কি এমনই থাকবে? কে জানে? মানব মনের রহস্য আজ অবধি তো কেউ উদঘাটন করতে পারেনি।
—
অনেক কিছু বদলে গিয়েছে বাসন্তী ও নায়িমের মাঝেও। এখন নায়িম খান বাড়ি ছেড়ে মোস্তফা বাড়িতে থাকে বাসন্তীর সাথে। বাসন্তীর আবেদনেই। এর পিছনে মূল কারণ অবশ্য নাহিবা। ‘দুনিয়ার সবার বাবা-মা একসাথে একঘরে থাকে, তার বাবা-মা কেন নয়?’ এই প্রশ্নবাণ থেকে বাঁচতেই এমনটা করে বাসন্তী। কারণ সে চায় তার মেয়ের ছেলেবেলা যাতে তার মতো নাহয়, বাবা-মা দুজনের সঙ্গ ও ভালোবাসাই যাতে নাহিবা পায়।
বাসন্তীর কক্ষে তো জায়গা হয়েছে নায়িমের। একই ছাদের নিচে, একই খাটে ঘুমায় দুজন। তবুও দূরত্ব যেন হাজার মাইলের। নায়িম যত্নশীল তার প্রতি, কিন্তু কখনো বাসন্তীর জীবনে দখলদারি করে না কিংবা স্বামীর অধিকার কখনো চাপায় না বাসন্তীর উপর। এই বিষয়টাতেই বারবার বিমোহিত হয় বাসন্তী। একজন পুরুষের সহ্যক্ষমতা কতটুকু হলে এমন করে তা-ই ভেবে পায় না সে। বাসন্তী নিজেও চায় এখন নায়িমকে নিজের করে নিতে, তবে কোথাও একটা বাধা, পুরনো ক্ষতের জ্বালা। সময়ের সাথে সাথে হয়তো এই বাধাও পেরিয়ে যাবে, ক্ষতও শুকিয়ে যাবে।
—
বিকেল বেলা, নিজের কুকুর জুলিয়াকে নিয়ে সোডিয়ামের আলোয় হেঁটে চলেছে অনিমেষ। তার মুখশ্রীতে ম্লান হাসি। দিনশেষে সুখ-দুঃখ, ভালো-খারাপ মিলিয়ে সবাই বেঁচে আছে নিজ নিজ সঙ্গীর সাথে। নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে শুধু অনিমেষের। বাবা-মাকে তো হারিয়েছে বেশ সময় হলো। আর প্রিয়জন, স্ত্রী, সঙ্গী? সে জায়গাটা সে কাউকে দিতে পারেনি। কিছু মানুষ এমনই হয় সবার জীবন রঙ, তুলির দ্বারা সাজিয়ে দেয়। অথচ, নিজে থাকে রঙহীন হয়ে।
#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||শেষ পর্ব|| (২)
-ঈপ্সিতা শিকদার
দেখতে দেখতে দশটা বসন্ত কেটে গিয়েছে, নাহিবা আজ পূর্ণাঙ্গ কিশোরী। এয়ারপোর্টে অপেক্ষারত নায়িম, বাসন্তী, নাহিবা, বিহান ও নীতি অনিমেষের উদ্দেশ্যে।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেখা মিলে অনিমেষের। সাথে ত্রিশ উর্ধ্ব বছরের একজন ভিনদেশী নারী ও জাম্পার পরনে এক চার-পাঁচ বছরের শিশু। কৃষ্ণাঙ্গ তার গায়ের রঙ, পরনে ডাস্কি পিংক জাম্পস্যুট। এই নারীটির নাম জানে সকলেই। অনিমেষের স্ত্রী ভিয়োনা ও একমাত্র ছেলে অর্নব।
অনিমেষকে দেখেই দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে নায়িম। বিহান ও নীতি “চাচ্চু”, “চাচ্চু” বলে জড়িয়ে ধরে। ভিয়োনিকা বাসন্তীকে অবাক করে সুদীর্ঘ সালাম দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম আপু। হাউ আ’ইউ?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি ঠিক আছি।”
“আপনারা কেমন আছেন? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
“নো, নো, খোনো অহসুভিদাহ্ হয়নি।”
বাসন্তী আরেকদফা ধাক্কা খায় ভিয়োনিকার বাংলা বলা শুনে। যদিও বাংলা বলার ধরনটা খুবই হাস্যকর ছিল। তবে বলেছে যে এ-ই বা কম কীসের? আরও কিছু কথাবার্তা চলে বাসন্তী ও ভিয়োনিকার মাঝে।
এদিকে অনিমেষ নায়িমকে খোঁচা দিয়ে বলে,
“‘আমাকে তো সারাজীবন বলে আসলি, দুটি সন্তানের বেশি নয় একটি হলে ভালো হয়’। আর নিজে তো তিন তিনটে নিয়ে বসে আছিস।”
“আল্লাহর দান বন্ধু সব। আমি তো ভেবেছিলাম বসন্তের মান বুঝি কখনোই ভাঙাতে পারবো না। এভাবেই জীবন যাবে।”
“এজন্যই তো আমি আইডিয়া দিয়েছিলাম। নাহিবাকে দিয়ে ওসব বলা তাহলেই তোকে ভাবী নিজেই ডাকবে। তুমি তো নাহলে সাধু সেজে বসে থাকতে চেয়েছিলে। আরে চোখের সামনে থাকলে আবার রাগ ধরে রাখা যায়। এজন্যই তো জ্ঞানীগুণীরা বলে গেছে, কায়া দেখলে মায়া বাড়ে।”
“হ্যাঁ, ভাই তুই-ই মহান বুদ্ধিজীবী। ঠিকই তো বিয়ে করে নিলে তলে তলে ভিয়োনা ভাবীকে।”
“ভিনদেশে নিঃসঙ্গ রাতে কাঁধে মাথা রাখতেও তো কাউকে চাই। মেয়েটাও আমার মতো বাপ-মা হারা ইমিগ্রেন্ট। একদম নিঃসঙ্গ, ডিপ্রেশনে ক্লাবে ক্লাবে মদের নেশায় ধুত হয়ে থাকতো। তাই ভাবলাম চার হাত এক করে নেই। আর আলহামদুলিল্লাহ্, সুখেই আছি।”
“পূর্ণতার কী অবস্থা?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিমেষ।
“দুই বছর হলো স্বামী মারা গেছে কার এক্সিডেন্টে। নিজের মেয়ে-ছেলে, চাকরি নিয়েই এখন তার জীবন।”
বাসন্তী খেঁকিয়ে উঠে তাদের কথার মাঝে,
“তোমার কি এখানেই সব কথা শেষ করবে না কি? বাড়ি যাবে না?”
নায়িম ভীতু দাসের ন্যায় মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। অনিমেষের মুখে দুষ্টু হাসি খেলা করে।
___
আজ নাহিবার জন্মদিন। বিশাল আয়োজন হয়েছে মোস্তফা বাড়িতে। হ্যাঁ, নায়িম আজও মোস্তফা বাড়িতেই থাকে। বাসন্তীর কাজ ও সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েই।
বাসন্তী মেয়ের বার্থডে উপলক্ষে বাসন্তী রঙের কাতান শাড়ি পরেছে। আঁচল গোছাতেই নায়িম বাথরুম একটা তোয়ালে পরে থেকে বের হয়।
স্ত্রীকে দেখেই বিমোহিত হয়ে যায় সে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এগিয়ে যায় বাসন্তীর দিকে। অর্ধভেজা গায়ে জড়িয়ে নেয় নিজের বসন্তকুমারীকে নিজের সাথে। কেঁপে উঠে বাসন্তী। সে কী এক আবেশ প্রেমের!
রিনরিনে কণ্ঠে কপট রাগ নিয়ে বলে,
“তৈরি হবে না? তোমার মেয়ে বিয়ের বয়সের হয়ে গিয়েছে। এসব ভীমরতি তোমাকে মানায় না জনাব?”
“দিল তো বাচ্চা হ্যা জি। তোমায় নিয়ে আমার অনুভূতির তো একটুও বয়স হয়নি বসন্ত। বরং, আগের ন্যায়ই নবজাতক, সতেজ ও মোহনীয়। তোমাকে দেখলে আজও উন্মাদ হয়ে যায় হৃদয়।”
বাসন্তী মৃদু হাসে। তখনই দরজায় লাথি মেরে প্রবেশ করে বিহান ও নীতি। বাসন্তী চমকিত হয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় নায়িমকে।
“মাম্মা, মাম্মা, মাগফিরাত ভাইয়া না আমাদের চকলেট নিয়ে গেছে।”
“মাম্মা, এত্ত করে বকে দিব নে।”
তোমরা এখন পাপার কাছে বসো। পাপা তোমাদের তৈরি করে দেক। আমি ওদিকটা দেখে আসি। নায়িমকে ইশারা করে চলে যায় বাসন্তী।
নায়িম কপাল চাপড়ে শুধায়,
“এক ছিল আমার নাহিবা যে আমাদের এক করেছিল, আর হলি তোরা যারা আমাদের একসঙ্গে দেখতেই পারিস না।”
___
চৈতালি বারবার নিজের শাড়ি ঠিক করছে। ফাহিমকে জিজ্ঞেস করছে ঠিক লাগছে কি না। ফাহিম বেচারা সম্মতি জানাতে জানাতে বিরক্ত। মাগফিরাতও বিরক্ত মায়ের এই আচারণে।
অনিমেষের সাথে সাক্ষাৎ পার্টিতে। চোখাচোখি হতেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে অনিমেষ ও চৈতালি উভয়েই।
ফাহিমই নীরবতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছেন অনিমেষ সাহেব?”
“আলহামদুলিল্লাহ, বেশ। ঐ যে আমার স্ত্রী-সন্তান।” দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভিয়োনিকা ও অর্নবকে দেখায় সে।
“পূর্ণতার কী অবস্থা?”
“এই তো দুইটা বছর হলো ওর স্বামী মারা গেছে। এমনে চাকরি-বাকরি সবমিলিয়ে ভালোই আছে মেয়েটা বাচ্চা নিয়ে।”
“আহারে মেয়েটা সারাজীবন কষ্টই পেয়ে গেল।” দুঃখপ্রকাশ করলো ফাহিম।
অনিমেষকে কেউ ডাক দেওয়ায়। সে “এক্সকিউজ মি” বলে চলে গেল।
ফাহিম পাশে ঘুরে দেখে চৈতালি রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে। শুকনো ঢোক গিলে সে।
“কী হয়েছে?” হাসার ভঙ্গিমায়।
“বেশ তো মায়া লাগছে ঐ মেয়েটার জন্য। আবার মাঝেমাঝেই বলে উঠে তোমাকে বিয়ে না করে ওকে বিয়ে করলেই ভালো থাকতাম। তো যাও না, বিয়ে করো না যেয়ে মেয়েটাকে?”
ফাহিম আলতো জড়িয়ে ধরে চৈতালিকে।
“আমি কখনো তোমায় ছাড়তে পারি বলো বা তোমায় ছেড়ে থাকতে পারি?”
“কেন আমি তো কত খিটখিট করি, তোমাকে খোঁটা দেই বারবার, তবে?”
“হ্যাঁ, দুঃখবোধ হয় আমার প্রায়শয়ই তোমার আচারণে। তবে রাত্রিতে যখন ঘুমন্ত তোমার মুখশ্রী দেখি না বুকে, আর পাশে দেখি মাগফিরাতকে সব ব্যথার উপশম হয়। আর সবাই তো ভালো নিয়ে সংসার করে আমি নাহয় খারাপ নিয়েই থাকি। আমার কাছে তাই-ই অনেক।”
চৈতালি ফাহিমের বুকে মাথা রাখে। সে ইচ্ছে করে তেমন আচারণ করে না। এত অভাব-অনাটন এবং অনিশ্চয়তা দেখে অশান্ত ও ফ্রাস্টেটেড হয়ে পড়ে তার মন। তখন নিজের নিয়ন্ত্রণে আর থাকতে পারে না সে। যা তা বলে ফেলে। তবে এই মানুষটা বিপরীতে একটা কথাও উচ্চারণ করে না সব সহ্য করে নেয়।
একটু বাদেই নাহিবা তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো। সবাই মিলে কেক কেটে নিলো। আনন্দে, উৎসবে কেটে গেল দিনটা। এখন সবার নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরার পালা। দিনশেষে কেউ পেরেছে নিজের টক্সিক রিলেশনকে শুধরাতে, কেউ বা ব্যর্থ সৈনিক।
__সমাপ্ত__
(