#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩৮তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
বাসন্তী ভ্রু কুঁচকে ফেলে এসব দেখে। ড্রাইভারের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাতেই দেখে সে নত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বাসন্তীর বুঝতে বাকি রইলো না এই কাজ করেছে। গম্ভীর মুখেই ফুলগুলো এক সাইডে চাপিয়ে গাড়িতে বসে সে। কী মনে করে যেন চিরকুটটা হাতে তুলে নেয় সে।
উদাস মনে চিরকুটটা খুলতেই,
“ও গো উদাস মনা কন্যা প্রিয়তমাসু বসন্তকুমারী,
আমার হৃদয় পোড়ার গন্ধও কি বলে না বড্ড ভালোবাসি?”
এই ছোট্ট দুই চরণের বাক্যে কী ছিল কে জানে? বাসন্তীর উদাস মনে জাদুর মতো কাজ করলো। উত্তেজনায় ধুকধুক শব্দটা বেড়েই চলেছে।
আপন মনেই বিড়বিড়ায় সে,
“ও গো গম্ভীর মুখো শাস্তিপ্রাপ্ত প্রিয়তমেষু,
হৃদয়ের গহীনে আমি আজও তোমারেই তো পুষি।”
জানালার দিকে তাকাতেই দেখতে পায়, তাদের গাড়ির সাথে পাশে তালে তাল মিলিয়ে আরেকটি গাড়ি চলছে। গাড়িতে বসে থাকা মানুষটি বাসন্তীর খুব অপ্রিয় প্রিয়জন তথা নায়িম। তাই তো তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয় রমণী। নিকাবের আড়ালে তার মুখশ্রী শুধু বাঁকা দুই ঘোলাটে চোখই দৃশ্যমান
যুবক একটু আশাহত হয় সত্য, কিন্তু পরাজিত হয়নি। বরং, বাসন্তীর দিকে তাকিয়েই সে গেয়ে উঠে,
“ছটফট করে মনটা আমার,
সুখ গেল মরিয়া।
প্রেয়সীটা পাষাণ হইসে
দেয় না মোরে দেখা।”
বাসন্তী ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে নায়িমের দিকে তাকায়। নায়িম চোখ টিপ দিয়ে বাঁকা হাসে। রমণী খেয়াল করে ড্রাইভার এবং মধু মিয়াও মিটিমিটি হাসছেন।
সে হুংকার দিয়ে বলে,
“গাড়ির স্পিড বাড়াও! বাসায় যেতে হবে নাহিবার কাছে!”
ড্রাইভার তাড়াতাড়ি গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে নায়িম্ব্র গাড়িকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়। এতক্ষণ ইচ্ছে করেই কম গতিতে চালাচ্ছিলো, দুটো গাড়ির তাল মিলানোর জন্য।
বাসন্তী নাকের পাটা ফুলিয়ে মনে মনে শুধায়,
“যখন আমি প্রেয়সী তখন তুমি হৃদয়হীন মানব,
যখন তুমি প্রেমিক তখন আমি অভিমানী,
ভাগ্যের লিখনটা এমন কেন হলো?”
___
– পূর্ণতা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গভীর ভাবনায় ডুবে। হুট করেই এক ছায়ামূর্তির আগমন হয় তার চোখের সম্মুখে। একটু অবাক হয় সে।
ছায়ামূর্তিটি হাসির ছন্দে বলল,
“চিন্তা কোরো না। আমি তোমারই অংশ, তোমার বিবেক। তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে এসেছি। সারাজীবন ভালোর পথে চলে, আজ এত নিচে নেমে গেলে? এতটা পাপের বোঝা নিয়ে থাকতে পারবে?”
বিব্রত হলো না পূর্ণতা। বরং, তার চোখে-মুখে আবিষ্কার হলো তাচ্ছিল্যের হাসি।
“ভালো থেকে, পর্দা করে, নিজের চরিত্রকে হেফাজত করে কী পেয়েছি? ধর্ষিতা হওয়ার ছাপ? পদে পদে নিজ পরিবার সহ প্রতিটি মানুষের কটূক্তি? দোষী না হয়েও এত অপমান, অবজ্ঞা, কষ্ট নিয়ে যেহেতু বেঁচে গিয়েছি। পাপের বোঝা নিয়েও বাঁচবো।”
“এতও সহজ না সবকিছু। নিজের করা অন্যায়ের ফল এই পৃথিবীতেই পেতে হয় তা কি ভুলে যাচ্ছো?”
“ভুল বললে এই পৃথিবীতে খারাপই ভালো থাকে, ভালোরা খারাপ। পাশের বাড়ি কাকী আমার চরিত্র নিয়ে দশ কথা শুনিয়ে যায়। আমার চরিত্রে বারবার কালিমা লেপণ করে। অথচ, তার নিজের মেয়েই দিন নাই, রাত নাই বাড়ির বাহিরে যায় প্রেমিকদের সাথে। কই? সে তো রেপ হয়নি। হয়েছি আমি। আর বলবে নাই বা কেন? এতকিছুর পরও তার মেয়ের বিয়ে দিতে তেমন কাঠখড় পোড়ানো লাগেনি।
এমন কী আমাকে রেপ করা ঐ কুত্তাটাও লকআপের বাহিরে বের হয়ে বুকেরপাটা ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেই জানোয়ারটারও বিয়ে হয়েছে, সন্তান-সংসার সব হয়েছে। দুনিয়া, সমাজ সবাই তার অপরাধটা ভুলে গেছেই প্রায়।
অথচ, আমি যে কি না জীবনও কোনোদিন কাউকে কটূক্তি অবধি করিনি, কোনো হারাম সম্পর্কে জুড়া তো দূরে থাক, কোনো নন-মারহামের সাথে কথা অবধি বলিনি। এমন কী যাকে ভালোবেসেছি তাকে আড়চোখে দেখা ছাড়া, কথাও কখনো বলিনি।
তবুও তো আমিই আজ ধর্ষিতা। যেখানে এসব জানোয়ার, এমন কী আধুনিক পতিতারাও বুক ফুলিয়ে চলে, আমায় থাকতে হয় ঘরে লুকিয়ে। ভালো হয়ে দেখেছি। দুনিয়া আমার সাথে ভালো করেনি। উল্টো যারা খারাপ, তারাই সুখে আছে, সম্মানিত সবার নিকট।”
“এক পরপুরুষকে নিজের করতে এক পরপুরুষকে এতটা আকৃষ্ট করা…? তাও যে পুরুষ আগে থেকেই বিবাহিত তার সাথে!”
“সতী থেকে তো দেখেছি, কিছুই জুটেনি কপালে অপমান, কষ্ট, ক্ষত, অবজ্ঞা, কটূক্তি ছাড়া। এখন বেহায়া হয়ে নিজের আকাঙ্ক্ষাপূরণ করতে ক্ষতি কী? সবাই স্বার্থপর হয়ে নিজেরটা দেখেছে। বাবা তার ছেলের চাকরির জন্য আমাকে বিক্রি করতে দমেনি, মা তার সংসার বাঁচাতে আমাকে রক্ষা করতে আগায়নি। কই? তখন তো কারো গায়ে কাঁটা লাগেনি।
আমাকে যখন দিনের পর যা তা ভাষায় গালাগাল করতো বাবা, মা মারতো। ভাই অভুক্ত রাখতো। তখন কেউ এগিয়ে আসেনি। আর ফাহিম বিবাহিত তো কী হয়েছে? চৈতালি তো নেই এখানে। সে চলে গেছে। সে তো এসে আগলে নিচ্ছে না তার সংসার। সেখানে আমি নিঃস্ব মানুষ আগলে রাখলে ক্ষতি কী? বরং, আমি তো আর যত্ন করছি। তাহলে কেন তুমি খারাপ বোধ করাচ্ছো আমাকে?”
“হয়তো মেয়েটা অনুতাপে ফিরে আসছে না। আর যত যাই হোক সংসারটা আজও তার। তুমি বুঝো পূর্ণতা, যা অন্যের তাতে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।”
“চাইলেই সব নিজের হয়। চেষ্টা করতে ক্ষতি তো নেই। এমনেই তো আমার সব শেষ। একবার স্বার্থপর হয়ে সুখ ধরার চেষ্টা তো করতেই পারি। আমি ফাহিমকে জেতার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আর আমার ওয়াদা কখনো অমর্যাদা করবো না আমি ফাহিমের!”
“না,পূর্ণতা। পরের সুখ ছিনিয়ে কখনো নিজের কপালে আনা যায় না। কখনোই না! তুমি কখনোই ফাহিমকে পাবা না।”
“না!” চেঁচিয়ে উঠে সে।
ঘুম ভেঙে যায় পূর্ণতার। সারা শরীর ঘামে গোসল হয়ে গেছে। কী অনাকাঙ্ক্ষিত এক স্বপ্নই না দেখলো সে!ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা এগারোটা, সব ভাবনা ছেড়েই বিছানা ছাড়ে সে।
___
অনিমেষ আপন মনে কোল্ড কফির স্ট্রয়ে ঠোঁট বসিয়ে পান করে চলেছে। ফাহিম বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তখনই ফাহিমের ফোনে একখানা কল আসে আননোন নাম্বার থেকে।
“হ্যালো, আমি পূর্ণতার বাবা বলছি। তোমাকে সোজা সোজা জিজ্ঞেস করছি, তুমিও আমাকে সোজাসাপটা উত্তর দিবে। তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাহিম দৃঢ় গলায় জবাব দেয়, “না।”
“বিরক্ত হচ্ছেন? আসলে এখানকার কফি আমার খুব পছন্দ।”
“আমার একটু তাড়া আছে, কী জন্য ডাকিয়েছেন তা খাণিক তাড়াতাড়ি বলেন।”
“চৈতালি… ”
“খুব ভালো আছে। ডিভোর্স চাই ওর নতুন সংসার পাততে, তাই তো?”
“আরে মিস্টার পুরো কথা তো শেষ করতে দিন। আপনার মিসেস আপনাকে ছাড়া একটুও ভালো নেই। সে প্রতি মুহূর্ত নিজের পাপের অনুতাপের দহনে পুড়ছে।”
“হুম, বেশ ভালো অনুতপ্ত সে। তাই তো আমার কল রিসিভ করেনি। একবারও আমার রাগ, অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করেনি। ওর কাছে আদৌ আমার, এই সম্পর্কের এক আনা মূল্য আছে কি না তা-ই সন্দেহ।”
“হয়তো অনুতপ্ত বলেই চাচ্ছে না আপনার কাছে ফিরে যেতে। এছাড়াও একটা কারণ আছে।”
অনিমেষ পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে। চৈতালির ফাহিমের কল কাটার পর তার ও নিজের কথোপকথন মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছে। সেটাই চালু করে শোনায়।
পুরো রেকর্ডিং শুনে ফাহিম স্তব্ধ। আনমনেই ভাবছে,
– তবে সত্যিই কি চৈতালি বদলে গিয়েছে? হয়ে গিয়েছে তার পুরনো চৈতালি, যার কি না প্রেমে পড়েছিল সে ছাত্রজীবনে? সেই সাদাসিধা মেয়েটি, যার সাজসজ্জাহীন রূপেই ঘায়েল ছিল সে।
অনিমেষ বুঝতে পার তার মনের অবস্থা। হাতে হাত রেখে আত্মস্থ করে বলে,
“দেখো এখনো, সময় আছে, ভালোবাসাকে হারিয়ে যেতে দিয়ো না। ভালোবাসা হলো ছোট্ট সূচের মতোন, আর পৃথিবী শস্যক্ষেত। এই পৃথিবীতে একবার তা হারিয়ে গেল, আর খুঁজে পাবে না কখনোই। চৈতালি আজ কানাডা চলে যাচ্ছে নায়িমের চাচার কাছে। আটকাবে না তাকে? আগলে নিবে না বুকে?”
ফাহিম মাথা ঝাঁকায়, নিঃস্তব্ধ তার চোখ-মুখ। কিছু বলবে তার পূর্বেই সশব্দে বেজে উঠে তার ফোন। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই সামিরা রহমান উৎকণ্ঠার সহিত দ্রুতো বাসায় ফিরতে বলে। কোনো বিপদ হয়েছে কি না ভেবে ফাহিমও বড় বড় পদচারণায় রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়।
যাওয়ার আগে শুধায়,
“ওকে একটু আটকে রেখো আমি আজই ফিরবো ওর কাছে।”
বাড়িতে ফিরে দেখতে পায় সামিরা রহমান মাথায় হাত দিয়ে চাপা কাঁদছেন। আতঙ্কিত হয় সে।
“কী হয়েছে? এভাবে আসতে বললে যে… আর তুমি কাঁদছোই বা কেন?”
“পূর্ণতাকে ওর বাবা-ভাই নিয়ে গেছে। ওর বাপ যে আধবুড়োটার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে, সে বড়োই গণ্যমান্য লোক। নেতা! নেতা! উনিই লোক নিয়ে এসে সবার সামনে হামিদ ব্যাপারীকে দিয়ে তোরে ফোন দেওয়ায়। তুই না বলার ওরে জোর করে নিয়ে চলে গেসে।
মেয়েটা কত কান্নাকাটি করলো তাও ফিরাতে পারলো না। তোর জন্য ঐ মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তুই জানিস ঐ আধবুড়ো ওর বাপের চেয়েও বড়ো বয়সে। কম করে হলে পয়ষট্টি হবে। হায় রে কপাল! এমন ভালো মেয়েটার সাথে…! সব গুছায়া যাওয়ার আগে তোরে একখান চিঠি লেখে গেছে।”
সামিরা রহমান ফাহিমের হাতে একটা ছোট্ট কাগজ ধরিয়ে দিলেন। একে চিঠি না বলে চিরকুট বলাই বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফাহিম চিরকুটটি খুলে দেখে তাতে গোটা অক্ষরে লিখা,
>< জানি পড়বেন কি না, তবুও লিখে যাচ্ছি। আপনি বিনা আর কারো নামে কবুল বলার আগে এই দেহ হয় রক্তশূণ্য হবে নাহয় বিষপূর্ণ। তবে মৃতুতে হবেই। - পূর্ণতা ফাহিমের পায়ের নিচ থেকে যেন জমিন সরে যাচ্ছে। এ কোন দ্বিধায় ফেললো তাকে সৃষ্টিকর্তা। একদিকে চৈতালিকে দূরে যাওয়া থেকে আটকাতে হবে, অপরদিকে পূর্ণতাকে মৃত্যু থেকে। এ যেন বিবেক আর ভালোবাসার যুদ্ধ। জয়ী হবে কে? ___ ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে নাহিবাকে কোলে তুলে নেয় বাসন্তী। অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দেয় ছোট্ট মেয়েটাকে৷ ছোট্ট শিশুটিও সারাদিন পর মাকে দেখে কী মায়াবী হাসিই না দিচ্ছে! সাহেরা বানু দরজায় নক করেন। বাসন্তী মেয়ের সাথে খেলতে খেলতেই ভিতরে আসতে ইশারা করে। "এই যে ছোটো বউমা, কে যেন এই বক্সটা বসার ঘরে রাইখা গেসে। উপরে তোমার নাম লিখা।" "যে পাঠিয়েছে তার নাম নেই?" "না, খালি তোমার নামই লিখা।" বাসন্তী নাহিবাকে রেখে বক্সটা হাতে নেয়। সাহেরা বানু প্রস্থান করেন। ছোট্ট কাগজের বক্স। খুলতেই দেখে ভিতরে দুটো চিরকুট। "বেনামি চিঠি পাঠিয়েছে প্রিয়তমা, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তারাই প্রকাশ করে দিবে চিঠিটি কার।" "আমি সেই তৃষ্ণার্ত কোকিল, বসন্ত। একটু আসবে? একপলকের দর্শন দিয়ে আমায় আনন্দিত করবে?" বাসন্তীর না ভেঙে অভিমান, না ক্ষতের জ্বালাতন। তবে ভালো লাগছে, ভীষণ রকমের সুখানুভূতি তার হৃদয়ে। প্রিয়জনের চিঠির মায়াই হয়তো এমন। তা সে প্রিয় যতোই অপ্রিয় হোক না কেন! চলবে...