#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৪র্থ পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নায়িম বেশ কয়েক গ্লাস ড্রিংক সাবাড় করার পরও তাকে স্বাভাবিক দেখে অবাক হয়ে যায় তার সাথে থাকা মানুষগুলো। প্রডিউসার সাহেব মুখে বিস্ময়বোধক চিহ্ন এঁকে বললেন,
“বাব্বাহ্ নায়িম! কী পাক্কা খেলোয়াড় তুমি! এত ড্রিংক করার পরও তোমার নেশা হচ্ছে না।”
হেসে দেয় নায়িম। বারটেন্ডার পাশ থেকে তার হয়ে উত্তর দেয়,
“স্যার তো মকটেইল ড্রিংক করছে এতক্ষণ ধরে। নেশা হবে কী করে!”
নায়িম আর কোনো কথা না বলে উঠে পড়ে। তার যেতে হবে। এই ক্লাবটা উত্তরায়, আর বাসন্তীর এপার্টমেন্ট লালমাটিয়াতে। ভালোই দূর।
নীলচে বর্ণের মণি সমৃদ্ধ গভীর তীক্ষ্ম চোখজোড়া অন্ধদের ন্যায় কালো রঙা চশমায় ঢেকে নেয়, মুখ ঢাকে মাস্কে। অতঃপর নীল হুডি পরে গাড়ির বাহিরে পা রাখে সে। ফ্লাটে ঢুকে সবসময়কার ন্যায় আজও সর্বপ্রথম পা রাখে বাসন্তীর ঘরে।
নির্নিমেষ চাহনিতে থাকে ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় শুয়ে থাকা রমণীর দিকে। এই মেয়েটির মুখশ্রী তার নিকট সদাই কেমন যেন নিষ্পাপ ও পবিত্রতার ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ লাগে। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায় আলতো হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর আলমারির উপর থেকে ফাস্ট এইড বক্স নামিয়ে বাসন্তীর গায়ের প্রতিটি আঘাতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেয়।
“মায়া-মমতা হীন রাক্ষুসে মানব বসন্ত কুমারী, তুমি তা না জেনেই দিয়েছিলে হানা। তবুও কেন যে তোমায় মায়া দেখাতে ইচ্ছে করে মাঝেসাঝে?”
অনেকটা আক্ষেপের সাথেই হিসহিসিয়ে বলে নায়িম। ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে।
__
চৈতালি বুঝতে পারে নায়িম এসেছে। ছোট্ট একটা ম্যাসেজ পাঠায় সে তাকে আসতে বলে। দুঃখী দুঃখী চেহারা করে বসে থাকে যুবকের আগমনের আশায়।
নায়িম ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ফোনের আলো জ্বলছে। হাতে নিতেই দেখতে পায় চৈতালির ম্যাসেজ। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার। এমনিতেই জীবনে ঝামেলার শেষ নেই, তার উপর জুটেছে উটকো এক বোঝা। বাথরোব পরেই চলে যায় চৈতালির ঘরে। হালকা নক করে বলে,
“ডেকেছিলে?”
চৈতালি এগিয়ে আসে। তার মুখে মেকি বেদনার ছাপ, বিনীত তার ভঙ্গিমা।
“হ্যাঁ, আমি জানি বিরক্ত হচ্ছো। কিন্তু কী করব বলো? আমিও নিরুপায়। ব্যবস্থা করতে পেরেছো কিছু আমার জন্য?”
“চেষ্টা করছি। হলে আমিই জানাব। ততদিন তুমি নিশ্চিন্তে এই বাড়িতে থাকতে পারো।”
কথাটা কোনোরকম বলা শেষ করতেই। চৈতালি মিথ্যে কান্না কান্না ভাব নিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।
“তুমি যে কী উপকার করলে নায়িম… নাহলে বলো কোথায় যেতাম আমি একা মেয়ে?”
চৈতালির আবেদনময়ী পোশাক আচার-আচারণ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে নায়িমকে, সে চাইলে অন্যভাবেও পেতে পারে। ঘৃণায় আবার গা গুলিয়ে আসে যুবকের। বিবাহিত নারী কেন অন্য পুরুষের সংস্পর্শে আসা যেকোনো নারীর গা ঘেঁষাতে তার অতিরিক্ত ঘিন লাগে। ইচ্ছে তো করছে ঠাটিয়ে এক চড় মারতে, তবুও সয়ে তাকে সরিয়ে দেয় নায়িম।
নায়িমকে যে মহিলা বড় করেছিলেন তারই মেয়ে চৈতালি। এই মেয়ে তার আগা-গোড়া সব সত্যি জানে বলেই এতটা নীরব সে। নাহলে তো কবেই ঘাড় ধাক্কা দিত।
চৈতালি অনেকটা সময় নায়িমকে নানা সুখ-দুঃখের গল্প শুনিয়ে বসিয়ে রাখল। যখনই নায়িম উঠতে যাবে তখনই কিছু না কিছু বলে থামিয়ে দিত।
এর মাঝে বাসন্তী একবার ঘুম থেকে জেগে তাদের দেখে গেছে। তার এসবে সয়ে যেয়েও যেন যায়নি। নিস্তব্ধ অশ্রুর বিসর্জন দিতে দিতেই পুনরায় ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় সে।
___
কয়েক ঘণ্টা পর ছাড় পায় যুবক। চৈতালির থেকে নায়িম মেকি হাসি দিয়ে বিদায় নেয়। অনেক কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করেছে সে।
শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে সোজা গোসল করতে যায় সে। একদম সাবান দিয়ে ডলে ডলে গোসল করে সে। তারপর বক্সার পরে বাসন্তিকে ঝাপটে ধরে চোখ বুজে ফেলে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে অসম্পূর্ণ কাজের কথা। বাসন্তির বক্ষে মাথা এলিয়ে শবনমের র-ভিডিও কে.কে সহ বিভিন্ন নিউস মিডিয়ার লোকদের কাছে ফরওয়ার্ড করতে করতে বলে,
“তোমার নিষ্পাপ দেহে মিশে পাপ কাজ করছি বসন্ত কুমারী। আমার জগত পাপ, মিথ্যে, প্রতারণায় ঘিরে, আর আমার জগৎই তোমার একমাত্র আশ্রয়। এসবের সাথে তো তোমায় চলতেই হবে।
তবে ভুলেও এগুলোর রেশ মাত্র আমা যাবে না। তোমায় সদা পবিত্র, নিষ্পাপ, সরল মায়াজাল ও স্বস্তির অস্তিত্ব হয়েই থাকতে হবে আমার পাপিষ্ঠ জীবনে। থাকতে হবেই তোমায় বসন্ত কুমারী!”
___
ফজরের আজানে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে নায়িমের বাহুবন্ধনে পায় বাসন্তী।
“কতটাই না নিষ্পাপ লাগছে ঠোঁটের কিনারায় তিল যুক্ত এই পুরুষটিকে! কত নিরাপদই না বোধ হচ্ছে নিজেকে! কিন্তু সত্যিই কি আমি নিরাপদ? না কি সবটাই ধোয়াশা হৃদয়ের? কিন্তু হৃদয় তো কখনো ধোঁকা দেয় না তাহলে?”
ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছাড়ে বাসন্তী। সাত মাসের সন্তান গর্ভে নিয়েও নামাজ পড়তে, ইবাদত করতে কৃপণতা করে না। তবুও যে কেন আল্লাহ মুখ তুলে তাকায় না এ নিয়ে বিশাল আক্ষেপ তার।
ঘুম থেকে উঠে নিস্তার নেই তার। এখন নায়িমের ডায়াট চার্ট অনুযায়ী রান্না করতে হবে। আটটার মধ্যেই উঠে যাবে সে। তারপর হালকা পাতলা খেয়ে খাণিক রেস্ট নিয়ে ব্যয়াম করবে।
নিউজে বড় বড় করে লেখা আসছে, “কে.কে. এর গার্লফ্রেন্ডের গোপণ ক্লিপ ভাইরাল, অফার করেছেন তরুণ গায়ক নায়িমকেও”। ঘুম থেকে উঠেই বেডরুমের টিভি অন করে এই খবর দেখে কতটা পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে নায়িম তা তার চোখ-মুখে উপচে পড়া হাসি দেখেই বোঝা যায়।
সেই সাথে ফেসবুক নিউসফিডেও চোখ বুলাচ্ছে সে। সাধারণ জনতা বেশ খুশি এবং গর্বিত তার উপর এমন মেয়ের বাজে প্রস্তাবে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়াই। অনেক পজেটিভ নিউস হয়েছে তাকে নিয়ে। যেমন প্রথম আলো থেকে ” বর্তমান সময়ে এসেও নারী ও মাদক নেশা মুক্ত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী ব্যাচলর সেলেব্রেটি”। একদিনেই প্রায় আড়াই লাখ ফলোয়ার্স বেড়েছে তার।
নিজের খুশি নিয়ন্ত্রণে এনে মনে মনেই বলে,
“তুই ছোট ছোট খুশির চক্করে মূখ্য বিষয় ভুলে যাচ্ছিস। তোকে যে করেই হোক বসন্ত পাখির নতুন নতুন গজানো ডানা কেটে দিতে হবে। তা কী করে করবি ভাব?”
___
ফাহিম অনেকটা বাধ্য হয়েই সাজিয়াকে কল করে। এছাড়া কোনো উপায় দেখছে না সে। প্রায় পাঁচেক সেকেন্ড রিং হওয়ার পর কলরিসিভ হয়। কিন্তু রিসিভ করে তার দুলাভাই।
“হ্যালো? ফোন দিয়েছো কেন? বুঝেছি বউ এখনো আসেনি।”
তার গম্ভীর সুরেই যে বিরক্তের ছোঁয় তা বেশ ভালোই বুঝে ফাহিম। বড়োই রাশভারী ও হিসাবী মানুষ তার দুলাভাই মইনুল, কারো সাথে মাত্রাতিরিক্ত খাতির বা মাখামাখি সম্পর্ক রাখতে অপছন্দ তার। সে যে-ই হোক, নিজের আপন মায়েরও বছরে একবার খোঁজ নেয় না। সেখানে সাজিয়ার রোজ রোজ আসা নিয়ে নির্ঘাত সে নাখুশ।
“আপু আছে?” ফাহিম খাণিকটা সময় নীরব থেকে জিজ্ঞেস করে। ফোনের অপরপাশে থাকা পুরুষটি নাক-মুখ কুঁচকে ফেলে স্ত্রীকে ডাক দেন।
“নেও তোমার ভাই শেহজাদার ফোন। আবার খাটাইতে ডাকছে।”
“আহা… এমন করে কেন? যাও টেবিলে ভাত দিয়েছি খেতে বসো।”
রাগে হনহন করে বেডরুম থেকে বেরিয়ে যান মৈনুল। সাজিয়া শান্ত গলায় শুধায়,
“দেখ, ভাই আমার নিজেরই স্বামী-সংসার আছে। এছাড়া তোর দুলাভাই কেমন ধরনের মানুষ তুইও জানিস। আমি কীভাবে রোজ রোজ…?”
চুপ করে থাকে ফাহিম। বোন যে একটা কথাও মিথ্যে বলেনি তা সম্পর্কে সে পুরোপুরিই জ্ঞাত। সাজিয়াও কিছুটা বিরতি নিয়ে মুখ খুলে।
“ঐ মেয়ে আর ফেরত আসবে না। ও সংসার করা মেয়েই না, যার এত টাকার খাই তারে দিয়ে কী আর সংসার হবে! আমি একটা মেয়ের কথা শুনলাম আজ মৈনুলের চাচীর থাকে, তুই বিয়েটা এবার…”
“টুৎটুৎ” কথাটা সম্পন্ন করার পূর্বেই এই শব্দ শুনতে পেল সাজিয়া। সে ক্রোধান্বিত হয়ে যায়। ভেঙচি কেটে বিড়বিড়ায়,
“মাইয়াগো মতো ঢং লাগায় একটা ভালোবাসার! আমার আর কাজ নাই, আমি যায়া উনার সংসার সামলাব, আর উনি বউরে মানাবে।”
ফোন কেটে মায়ের ঘরে উঁকি দেয় ফাহিম। তিনি গভীর তন্দ্রায় ডুবে। আনমনেই ভাবে,
“পুরুষদের জীবনটা এমন কেন? মেয়েদের প্রেমে ব্যর্থ হলে, ভালোবাসা হারালে কম-বেশি সবাই সহানুভূতি দেখায়, তার কষ্ট বুঝার চেষ্টা করে। অথচ, ছেলেরা এমন পরিস্থিতি পড়লে বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই এমন একটা ভাব করে যেন এসবে আমাদের কোনো কষ্টই লাগে না।
কোনো প্রভাবই পড়া উচিত না এতে আমাদের উপর, এসব একদম স্বাভাবিক যেন আমাদের জন্য। কী আশ্চর্য! আমরা কী মানুষ নই? না আমাদের হৃদয় নেই বা ব্যথা অনুভব করি না আমরা? এসবও বুঝি মেয়েদের জন্য তোলা?
এজন্যই এখন প্রেমিকার সুইসাইড হারের চেয়ে প্রেমিকের সুইসাইডের হার বেশি। কারণ তাদের কষ্ট কেউ বুঝতেই চায়। উলটা খিল্লিই উড়ানো হয় দেবদাশ সহ কত শত নাম দিয়ে।”
চলবে…