তবুও তোমায় ভালোবাসি পর্ব ১৩+১৪

#তবুও ভালোবাসি তোমায়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৩

আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপ একটা হাসি দিয়ে বলল-

– কী রে আয়রা কেমন আছিস তুই?

আমি মুখে হাসির ফিনিক এনে বললাম

– অনেক ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?

– আমি তো আয়ানকে নিয়ে বেশ ভালোই আছি। আমি তো সেদিনেই আয়ানকে বিয়ে করে নিয়েছি। তোদের বাসার পাশের বিল্ডিংয়ে আমাদের নতুন সংসার শুরু করেছি। জানিস তো আয়ান একদম বদলে গেছে। আমাদের বিয়েতে ভেবেছিলাম তোকে দাওয়াত দেবো। কিন্তু হুট করে হয়ে যাওয়ায় আর দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ পাইনি।

আমি একটু অট্ট হাসলাম। তারপর একটু ক্ষীণ গলায় বললাম

– সমস্যা নেই। তোদের বিবাহ বার্ষিকী তে আমাকে দাওয়াত দিস। বড় একটা গিফট নিয়ে দাওয়াত খেতে যাব। অনেক মজা করে আসব।

আরশি আমার কথা শোনে ভ্রুটা কুঁচকালো। তারপর পাশে থাকা জাহিনের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল

– নতুন মাল পটিয়ে ফেলেছিস তাই না রে?

– একদম ঠিক ধরেছিস। এ মাল পটানোর বিষয়টা আমি তোর কাছে শিখেছি। কীভাবে ছয় বছর ব্যবহার করা একটা মাল তুই নিজের করতে পারিস ঠিক সেভাবেও আমিও এ মালকে নিজের করে নিয়েছি। এ ব্যপারগুলো তোর আর আয়ানের থেকেই শেখা। এজন্য তোদের দুজনকে ধন্যবাদ। যদি পটানো না শিখতাম তাহলে এ মানুষটাকে পেতাম না।

আরশির রাগটা যেন আমার কথায় বেড়ে গেল। সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিছুটা রেগে স্তম্ভিত গলায় বলল

– তা…. সে কী জানে তুই কেমন?

আমি আরশির কথার জবাব দিতে যাব এর মধ্যে জাহিন সাহেব বলে উঠলেন

– আপু আপনাকে তো চিনলাম না তবে আন্দাজ করতে পেরেছি আপনি কে। আমি আয়রার ব্যপারে সব জেনেই আয়রাকে পছন্দ করেছি। আপনি শুধু শুধু আয়রাকে এত সব কথা শোনাচ্ছেন। যদিও এতে আয়রার কিছু যায় আসে না। তবে আপনার একটা লাভ হচ্ছে আপনার মুখের ব্যয়াম হচ্ছে। এছাড়া আপনার কোনো লাভ আমি দেখছি না। শুধু শুধু আয়রাকে এত কথা বলে নিজের সময় নষ্ট করবেন না।আয়রার সকল বিষয়ে আমি অবগত।আর আয়ান সাহেবকে বলে দেবেন আমার যোগ্যতা আয়ান সাহেবের থেকে কম না। আয়ান সাহেব হীরা চিনতে ভুল করলেও আমি করিনি। আপনারা ভালো থাকবেন। আপনার আর আয়ান সাহেবের ভালো থাকায় আয়রা যেমন নাক গলাচ্ছে না ঠিক তেমনি আমাদের ভালো থাকাতেও নাক গলাবেন না। আমাদের এবার হাঁটতে দিন। আর ভালো থাকবেন।

বলেই জাহিন সাহেব আমার হাতটা ধরে আয়ানের সামনে দিয়ে নিয়ে আসলো। কিছু দূর হাঁটার পর আয়ান আর আরশিকে যখন দেখা যাচ্ছিল না তখন জাহিন সাহেব আমার হাতটা ছেড়ে দিল। তারপর মোলায়েম কন্ঠে বলল

– আপনার হাতটা ধরার জন্য দুঃখিত। আর উনাকে এভাবে জবাব দিতে চাইনি। তবে আপনার মায়ের মুখে আপনার ব্যপারে সব শোনেছিলাম। তাই রাগ টা চেপে রাখতে পারিনি। আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি ক্ষমা করে দেবেন।

জাহিন সাহেবের কথা শোনে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখের জল ফেলছিলাম। জাহিন সাহেব আমার চোখের জল দেখে হালকা গলায় বলল

– আমি কী আপনাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। দয়াকরে এভাবে আপনি কাঁদবেন না। আপনার কান্না সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি মেয়ে মানুষের চোখের জল সহ্য করতে পারি না। আমার সামনে কোনো মেয়ে মানুষ কাঁদলে অসহ্য লাগে। দয়াকরে কাঁদবেন না।

আমি চোখের জলটা মুছে হালকা হেসে বললাম

– আপনি কোনো দোষ করেন নি যা করেছেন একদম ঠিক করেছেন। আমি আপনার উপর রাগ করে কাঁদছি না। আমি আমার নিজের ভুলের জন্য কাঁদছি। এটা ভেবে কাঁদছি যে আমি মানুষ চিনতে কতটা ভুল করেছিলাম।

– সত্যি বলতে আপনি কোনো ভুল করেননি। অমানুষগুলো মানুষের মুখোশ এমনভাবে পড়ে থাকে তাদের দেখতে মানুষেই লাগে। আপনি নিজেকে শান্ত করুন। মানুষ মাত্রই ভুল। ভুলকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে শিখুন। ভুল করে হতাশ না হয়ে সে ভুল থেকে শিক্ষা নিন। জীবন খুব বড় নয়। তবে এ ছোট্ট জীবনে অনেকগুলো অধ্যায়। একটা অধ্যায়ে আটকে না থেকে বাকি অধ্যায় গুলো নিয়ে ভাবুন। সংক্ষিপ্ত জীবনটাকে একটা ভুলের জন্য বিষাদময় না করে নিজেকে শান্ত করে নিজের সুখটা খুঁজে নিন। আপনার সুখ আপনাকেই খুঁজতে হবে নাহয় কেউ খুঁজে দেবে না। এ স্বার্থপর দুনিয়ায় স্বার্থপর হয়েই বেঁচে থাকতে হয়। আপনার কী মনে হয় আমি আপনার জন্য এতকিছু করছি কোনো স্বার্থ ছাড়া? আমি আপনার জন্য এতকিছু করছি আমার স্বার্থের জন্য।

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম

– এতে আপনার কী স্বার্থ জড়িয়ে আছে?

– ভালো থাকার স্বার্থ বলতে পারেন। আমি আপনার জন্য এতকিছু করছি আমার ভালো থাকার জন্য। কারণ আপনার সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে।৷ আপনাকে দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। আমার ভালো লাগার জন্যই আপনার জন্য এতকিছু করা। তাই বলব নিজের ভালোলাগাটাকে আগে প্রাধান্য দিন। আপনি কিসে ভালো থাকবেন সেটা খুঁজে বের করুন। জীবনকে উপভোগ করুন। যাইহোক অনেক বকবক করে ফেললাম। চলুন বাসায় যাওয়া যাক এবার। কারণ আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।

আমি জাহিন সাহেবের কথাগুলো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শোনছিলাম। নিজের মধ্যে যেন একটা ভালো লাগার সঞ্চার হয়েছে উনার কথা শোনে। আমি মোলায়েম কন্ঠে বললাম

– চলুন যাওয়া যাক।

তারপর দুজন মিলে বাসায় আসলাম।উনি উনার কাজে চলে গেল। আমি আমার বাসায়।

সারাদিন শুধু নিজের ভালো থাকা নিয়ে ভাবতে লাগলাম।ভাবতে লাগলাম আমার জীবনটা আর কয়দিনের। এ জীবনটাকে এত বিষাদময় করে লাভ নেই। যা ভালো লাগে সেটাই করব। অনেক ভেবে একটু পড়তে বসলাম। পড়া শেষে চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচরাতেই লক্ষ্য করলাম চুলগুলো উঠে আসছে৷ বুঝতে পারলাম মাথায় আর চুলগুলো বেশিদিন থাকবে না। তবুও চুলগুলো দেখে বেশ মায়া হচ্ছিল। অনেকগুলো চুল উঠে এসেছে৷ তবুও হতাশ হলাম না। বাকি চুল গুলো বেঁধে নিলাম।তারপর খাওয়াদাওয়া করে একটু পড়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। বিকেল হতেই ছাদে চলে গেলাম। লক্ষ্য করলাম জাহিন সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জাহিন সাহেবকে দেখে একটু হেসে বললাম

– আজকে মনে হয় একটু আগেই ছাদে চলে আসছেন।

– ঠিক তানা হাসপাতালে কাজ শেষ তাড়াতাড়ি তাই ছাদেও এসেছি তাড়াতাড়ি। আপনার শরীর কেমন?

– আগের চেয়ে ভালো।

– দুপুরে কী খেয়েছেন?

– ভাত,ডিম, মাছ সবজি। আপনি?

– আপনার মতোই।

– ওহ আচ্ছা।

– হুম। আচ্ছা অবসরে আপনার বই পড়তে ভালো লাগে না?

– হ্যাঁ লাগে তো।

– আমারও বেশ ভালো লাগে বই পড়তে। জানেন গতকালকে একটা বই পড়েছিলাম। সে বইটাই একটা কাহিনি পড়ে মনটা অনেক শীতল হয়েছিল।

– কী কাহিনি?

– কাহিনি টা হলো।

বিশ বছর পরিশ্রম করে বিজ্ঞানী নিউটন একটি বই লিখেছিলেন। তার প্রিয় কুকুর জ্বলন্ত বাতি ফেলে এই বইখানি মুহূর্তের মধ্যে ছাই করে দিয়েছিল।বিশ বছর পরিশ্রমজাত চিন্তা হঠাৎ সর্বনাশ হয়ে গেল।নিউটনের খুব দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য সহিষ্ণুতা তিনি দমলেন না আবার সেই বই লেখা শুরু করলেন এবং শেষ ও করলেন।

তাহলে চিন্তা করুন বিশ বছর কষ্ট করে একটা বই লেখার পর সেটা পুড়ে গেল। তখন কিন্তু নিউটন হতাশ হয়ে পড়েনি। বরং তিনি আবার বইটা লেখা শুরু করেছেন। আমাদের জীবনও তো তার ব্যতিক্রম না। আমাদের জীবনে তো এমন বাঁধা বিপত্তি আসবেই। আমরা যদি হতাশ হই তাহলেই হেরে যাব। বরং আমাদের হতাশ না হয়ে সবর করতে হবে। আবার সবকিছু সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। পিছুটান তো আসবেই। পিছুটান নিয়েই তো জীবন। পিছুটান পার হয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

জাহিন সাহেবের প্রতিটা কথায় যেন একেকটা শক্তি লুকায়িত থাকে। যা আমাকে অনেক সাহসী করে তুলতে সাহায্য করছে। আমি চুপ থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম

– আকাশ দেখতে আপনার ভালো লাগে কেন?

– আকাশের মতো বিশালতায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা তাই। আপনার আকাশ দেখতে ভালো লাগে না?

– লাগে মাঝে মাঝে যখন বিমর্ষ একা থাকি ঠিক তখন আকাশটাকে বেশ আপন লাগে।আকাশের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে সব বলতে পারি। কারণ আকাশটা কিন্তু বেইমানী করে না। আমি যতকিছু বলিই সে গোপন রাখে। তবে আকাশের দিকে তাকিয়েই হাজার সম্পর্কগুলো মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বেইমানী করে। যাইহোক বাসায় যাব।

– আমি কী এগিয়ে দেবো?

– আজকে আর এগিয়ে দিতে হবে না। একাই যেতে পারব।

– সাবধানে যাবেন আর সন্ধ্যায় ঔষধ টা মনে করে খাবেন।

আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বাসায় চলে আসলাম।।বাসায় এসে মায়ের সাথে বসে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। মাকে জিজ্ঞেস করলাম

– মা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া কী ছিল?

মা হাসতে হাসতে বলল

– যখন তুই আর তোর ভাই বোনরা আমার কোল আলো করে এসেছিলি।

আমি মায়ের বুকে মাথাটা রেখে চুপ হয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে ভুলেই যাই আমাদের মা আমাদের কত কষ্টের বিনিময়ে এ পৃথিবীতে এনেছে। আমাদের কিছু হলে আমাদের মায়ের কষ্টটা বেশি হবে। আর সেই আমরা সামান্য মিথ্যা ভালেবাসার জন্য নিজেদের শেষ করে দিয়ে মাকে কষ্ট দিতে চাই। মায়ের বুকে মাথা রাখা যে কত শান্তি সেটা না রাখলে কেউ বুঝবে না। মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। ছোট বোনটার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। মনটা বেশ প্রশান্ত লাগছে। তারপর বই নিয়ে পড়তে বসলাম।একটু পড়ে নামাজ শষ করে খাওয়া দাওয়া করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম। এর মধ্যেই অচেনা একটা নম্বর থেকে কল আসলো। আমি ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠ বলে উঠল

– আপু আমি আনিসা। জাহিন ভাই কেমন জানি করছে একটু বাসায় আসবে দয়াকরে।

আমি তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠলাম। আস্তে করে দরজা খুলে জাহিন সাহেবের বাসায় গিয়ে জাহিন সাহেবকে দেখে চমকে গেলাম।
#তবুও ভালোবাসি তোমায়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৪

আস্তে করে দরজা খুলে জাহিন সাহেবের বাসায় গিয়ে জাহিন সাহেবকে দেখে চমকে গেলাম। জাহিন সাহেব মাটিতে পড়ে আছে। গা টা যেন হিম হয়ে গেল আমার। মূহুর্তের মধ্যে মনে হলো আমি জিবীতও না মৃতও না। অনিশ্চয়তা নিয়ে জাহিন সাহেবের দিকে এগুতে লাগলাম। জাহিন সাহেবকে যখনই ধরতে যাব ঠিক তখনই মনে হলো আমি আটলান্টিক সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। চারদিকে পার্টি স্প্রে দিয়ে একদম আটলান্টিক মহাসাহগর পরিণত করে ফেলেছে সবাই। বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে এসব। বুঝে উঠার আগেই জাহিন সাহেব বলে উঠল

– হ্যাপি বার্থ ডে আয়রা।

জাহিন সাহেবের মুখে কথাটা শোনে আমি চমকে গেলাম।সত্যিই কী আজকে আমার জন্মদিন। মোবাইলের কেলেন্ডার দেখে খেয়াল করলাম সত্যিই আজকে আমার জন্মদিন। জাহিন সাহেব জানলো কী করে বুঝতে পারছিলাম না। এত বড় সারপ্রাইজ পাব সেটা আমি আশাও করিনি। ঠিক যেন অনেকখানি কষ্টের মাঝে একটু খানি প্রশান্তি। খুশিতে যেন আমার গলাও কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম

– আমার জন্মদিন আজকে আপনি জানলেন কী করে?

উনি মুচকি হেসে বলল

– আপনার মা বলেছে।

এর মধ্যেই মা আসলো ঘরে। সত্যিই মাকে দেখে খুব আশ্চর্য হলাম আমি। বুঝতে পারছিলাম না জাহিন সাহেব কখন মায়ের সাথে কথা বলে এত বড় সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করেছে। তারপর ভাই বোন পরিবারের সবাই আসলো।সবাই মিলে আমাকে একটা বড় সারপ্রাইজ দিল। আমি এতটাই খুশি হয়েছিলাম কী বলব। মা আর আন্টিকে জড়িয়ে ধরে নিজের খুশিটা প্রকাশ করি। সেখানে অনেকক্ষণ মজা করার পর বাসায় আসি। বাসার আসার পর মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম

– মা তুমি তো জানতে আমি একটা সারপ্রাইজ পাব। তাহলে বললে না কেন?

– সারপ্রাইজ বললে কী আর সারপ্রাইজ থাকে রে মা। জাহিন ছেলেটা সত্যিই অনেক ভালো। আর ওর মা ও অনেক ভালো। জাহিনের মা এসে হুট করে জাহিনের প্ল্যানটা বলল। ভাবলাম তোর মনটা খারাপ থাকে সবসময়। এমন সময় এরকম একটা সারপ্রাইজ দিলে তোর মনটা ভালো হবে। তাই জাহিন সহেবের মায়ের কথায় রাজি হলাম। কেন তুই খুশি না এতে?

মাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে বললাম

– মা আমি অনেক খুশি। এত বড় সারপ্রাইজ এর কথা তো ভাবতেই পারিনি। আমি তো ভেবেছিলাম জাহিন সাহেবের কী না কী হয়ে যায়। বেশ ভয় ও পেয়ে গিয়েছিলাম।তাই তোমাকে না বলেই ওদের বাসায় চলে যাই। মা তুমি কিছু মনে করোনি তো?

– একদম না। আমার মেয়ে যে প্রাণ খুলে হাসতে পারছে এটাই তো আমার বড় পাওয়া। আমি তো চাই তুই সারাজীবন এভাবে হাসিখুশি থাক। নিজেকে সুন্দর করে গুছিয়ে নে।

– হ্যাঁ মা তোমরা পাশে থাকতে আমার চিন্তা নেই।

মা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল

– এবার একটু ঘুমিয়ে নে।

আমিও চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে উঠে নামাজ শেষ করে বেলকনিতে যেতেই লক্ষ্য করলাম জাহিন সাহেব নীচে দাঁড়ানো। আমাকে দেখেই বলল

– হাঁটবেন না আজকে?

আমি হালকা গলায় বললাম

– আপনি দাঁড়ান আমি আসছি।

বলেই চুলটা আঁচরে প্রস্তুত হতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার চুলগুলো সব খসে পড়ছে। খুবলে খুবলে চুলগুলো হাতের মধ্যে চলে আসছে। চুলগুলো যতই হাতে আসছিল ততই মনে হচ্ছিল আমার হায়াত আর বেশিদিন নেই। মাথার তালু পুরো ফাঁকা হয়ে গেছে। চিরুনী ভর্তি লম্বা লম্বা চুল। কত যত্নই না করতাম এ চুলগুলোকে আজকে সব অবহেলায় ঝরে পড়ছে। চিরুনী থেকে চুলগুলো ছুটিয়ে চুল গুলোকে একসাথে করে ফেলে দিলাম। তারপর হিজাব পড়ে বের হলাম। চুলের জন্য মনটা খুব খারাপ লাগছিল। তাই চেহারাতেও বিমর্ষতার ছাপ পড়ে ছিল। আমার চেহারা দেখে জাহিন সাহেব বলল

– আপনার চেহারা এত মলিন কেন?এনিথিং রং?

– নাথিং।চুলগুলো সব পড়ে যাচ্ছে তো তাই মন খারাপ। যদিও পড়াটা স্বাভাবিক। কারণ কিছুদিন পর তো অপারেশন তখন হয়তো পুরো মাথার চুলেই ফেলে দিতে হবে।

– এজন্য আপনার মন খারাপ?

– হ্যাঁ একটু বলতে পারেন।

– আমার সাথে একটু চলুন।

– কোথায়?

– গেলেই বুঝতে পারবেন।

বলেই আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে হাতে ইশারা করে বলল

– দেখুন এ বাচ্চাটার একটা পা নেই, একটা হাত নেই। ভিক্ষা করে দিনে আনে দিনে খায়। তার চেয়ে কী আপনি বেশি কষ্টে আছেন? আপনার কী মনে হয় আপনার চুল পড়ার কষ্টের চেয়ে তার কষ্ট কম?

আমি হালকা দম নিয়ে বললাম

– আলহামদুলিল্লাহ। সত্যিই তারচেয়ে আমি সুখী।

– শোনোন আমরা নিজেদের সবচেয়ে অসুখী মনে করি কখন জানেন?

– কখন?

– যখন আমরা দুনিয়াবী জিনিসগুলোকে উপরের দিকে দেখি।

– মানে?

– মানেটা হচ্ছে আপনার চেয়ে উপরের দিক না দেখে দুনিয়াবী জিনিসগুলোকে নীচের দিকে দেখুন। আপনার চেয়ে অনেকে ভালো আছে এটা দেখে নিজের কষ্ট না বাড়িয়ে আপনার চেয়ে কষ্টে কে আছে তাদের দেখে নিজেকে সুখী মনে করুন।আপনি একটু সময় করে এসব মানুষগুলোকে দেখুন আর একটু চিন্তা করুন সত্যিই আপনি সবচেয়ে কষ্টে আছেন নাকি আল্লাহ আপনাকে ভালো রেখেছেন।তাহলেই আপনি উত্তর পেয়ে যাবেন।

জাহিন সাহেবের কথাটা যেন মনে বিদে গেল।সত্যিই তো এদের চেয়ে কষ্টে তো আমি নেই।এদের কারও হাত নেই কারও পা নেই,কারও চোখ নেই,থাকার জায়গা নেই,খাওয়ার কিছু পায় না।তাদের চেয়ে সত্যিই আমি অনেক ভালো আছি। আমি দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলললাম

– আলহামদুলিল্লাহ।

জাহিন সাহেবও আমার সাথে বললেন

– আলহামদুলিল্লাহ।

তারপর একটু সামনের দিকে এগুলাম। আমি জাহিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম

– আমার এ অনিশ্চিত জীবনের সাথে আপনি জড়াতে চান কেন?

জাহিন সাহেব হালকা হেসে বলল

– মানুষের জীবন কী আদৌ নিশ্চিত? আপনার ব্রেন টিউমার হয়েছে বলে নিজের জীবনকে অনিশ্চিত ভাবছেন৷ কিন্তু আমি তো সুস্থ আমার জীবন কী নিশ্চিত? আপনার আগে আমার মৃত্যু হবে না এটার গ্যারান্টি কী আপনি দিতে পারবেন? এমনও তো হতে পারে আপনার আগে আমার মৃত্যু হলো আর আপনি দিব্যি আরও ৩০,৪০ বছর বেঁচে থাকলেন। হতে পারে না কী?

– হ্যাঁ হতে পারে।

– গতকালকে হাসপতালে একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা মারা যায়। বাচ্চাটা কিন্তু সুস্থ ছিল।এক্সিডেন্টে হুট করে মারা যায়। আপনার থেকেও তার বয়স কম এবং সুস্থ। তাহলে সে আগে মরল কেন? জন্ম সিরিয়াল হয়ে হলেও মৃত্যু সিরিয়াল করে আসে না।কার মৃত্যু কখন সেটা উপরে যিনি বসে আছেন উনিই বলতে পারেন। আমি বা আপনি কেউ এই বলতে পারব না কার জীবন নিশ্চিত আর কার জীবন অনিশ্চিত।

জাহিন সাহেবের কথা গুলো আমি শ্রবণ করছিলাম।যতই শোনছিলাম ততই কথাগুলোর মনের মধ্যে একটা আশার আলো খুঁজে পাচ্ছিলাম।নিজের মধ্যে কেন জানি না তখন অদ্ভুত শক্তি পাই।জাহিন সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতেই বাসায় আসলাম। বাসায় এসে হিজাবটা খুলে চুল গুলো দেখে হাসলাম। ভাবলাম এ সামন্য চুল গেছে তো কী হয়েছে আমি তো তাদের থেকে ভালো আছি যাদের হাত নেই পা নেই। সত্যিই তো কারও জীবনেই নিশ্চিত না। তাহলে আমি কেন এত ভয় পাচ্ছি। মনে মনে এসব বলে মনকে আরও শক্ত করলাম।

তারপর হালকা খেয়ে পড়তে বসলাম। এর মধ্যেই মাথা ব্যথাটা প্রবল বেগে বাড়তে শুরু করল। ঔষধ খেলাম ব্যথা উঠার সাথে সাথে তবুও ব্যথা কমছে না।ব্যথাটা কেন জানি না তীব্র আকার ধারণ করতে লাগল। মাকে ডাক দিতে দিতেই চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে যেতে লাগল। এরমধ্যেই আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেল। আমি আবারও জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফেরার পর লক্ষ্য করলাম আমি হাসপাতালে আর জাহিন সাহেব আমার পাশেই বসে আছে। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখেই জাহিন সাহেব বলে উঠলেন

– এখন কেমন লাগছে?

– একটু ভালো। আপনি এখানেই ছিলেন?

– নাহ! আমার তো ডিউটি চলে। ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে আপনাকে দেখে যাই। মাত্রই আসলাম আর আপনার জ্ঞান ফিরল। আপনি মনে হয় ঔষধ ঠিক করে খান না।

– তা কেন হবে? আমি তো ঔষধ নিয়মিত সময় করে খাই।

– তাহলে অন্যকিছুতে অনিয়ম করেছেন হয়তো। যাইহোক হতাশ হবেন না। এসময়টা একটু কঠিন। এ সময়ে এমন একটু হবেই। অপারেশনের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। বড় স্যার এসে আপনাকে দেখে যা পরামর্শ দেবে সে অনুযায়ী চললে আল্লাহর রহমতে আপনি ভালো হয়ে যাবেন। তবে নিজেকে আগে প্রস্তুত করতে হবে। মানসিক ভাবে স্টেবল থাকতে হবে। কী পারবেন না?

আমি বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে পুনরায় নিঃশ্বাসটা ছেড়ে বললাম

– অবশ্যই পারব।

আমার আত্নবিশ্বাস দেখে মা ও বেশ খুশি হলো। তারপর বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। উনি আমাকে দেখলেন, রিপোর্ট দেখলেন।যদিও রিপোর্ট ভালো না তবুও আমি হতাশ হলাম না। জীবনে যেটা নির্ধারিত সেটাই হবে সেটা নিয়ে হতাশ হয়ে লাভ নেই। ডাক্তার দেখানো শেষে মাকে নিয়ে যখন হাসপাতাল থেকে বের হলাম তখন চোখ পড়ল…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here