#তুই_আমার_সুরঞ্জনা
Part–16
#Arishan_Nur
বরকত চারপাশে তাকাতে লাগলো। ইতিমধ্যে আশেপাশে চিৎকার-চেচামেচি শুরু হয়ে গেছে। চারপাশে হাহাকার। ওই বিল্ডিং থেকে চিৎকারের ধ্বনি ভেসে উঠছে। বরকতের বুকটা ধুক করে উঠল। না জানি কার কার গায়ে আগুন ধরে গেছে। কারন এখন রাত। সবাই বাসাতেই আছে। বরকত দোয়া করতে লাগলো। যখন তখন এই বিল্ডিংয়ে আগুন লেগে যেতে পারে। কারন তাদের বিল্ডিংটা থেকে ঐ বিল্ডিংয়ের মধ্যে তফাত মাত্র এক হাত।
বরকত দরদর করে ঘামছে। সে আবারো গেটটা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু কোন লাভ হলো না। বরকত নিজেকে নিয়ে চিন্তা করছে না। সে লিনাকে নিয়ে ভয়ে আছে। লিনা কি আওয়াজ পেয়েছে? তাদের বেড রুম সাউন্ড প্রুফ৷ লিনার মাইগ্রেন সমস্যা জন্য বিয়ের পর পর এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারন এই বিল্ডিংয়ের ডান পাশে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। এখন সে কি করবে?
সে যদি বের না হতে পারে তবে লিনাকে কে জাগাবে?
বরকত বিরবির করে বলে, আল্লাহ একটা রাস্তা দেখাও।
বরকত বাথরুম থেকেই শুনতে পেল তাদের বাসার বেল বাজছে। সে আশার আলো খুজে পেল। এদিকে হৈচৈ মূহুর্তের মধ্যে বেড়ে গেল। কারন এই বিল্ডিংয়েও আগুন লাগতে শুরু করেছে৷
বরকত বারবার গেট খোলার চেষ্টা করছে সেই সাথে গেটে লাথি মারছে। যদি ভেঙে যায় তাহলে বের হতে পারবে।
বেল বাজা থেমে গেল। বরকত মনে মনে বলে, তবে কি লিনা জেগে গেছে?
মিনিট খানেক এমনি চিৎকার-হাহাকারের মাঝে কাটলো বরকতের!
হুট করে লিনার আওয়াজ পেতে লাগল। তার ই নাম ধরে ডাকছে লিনা। বরকত বলে উঠে, লিনা আমি বাথরুমে আটকে গেছি। তুমি প্লিজ নিচে নামো। কথাটা লিনা শুনল কি না জানে না বরকত। তবে কিছুক্ষনের মাঝে সব চুপচাপ হয়ে গেল! আসলে আবারো একটা বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হওয়ায় কানে এতো জোড়ে শব্দটা বেজে উঠল যে কিছু সময়ের জন্য বরকত কানে কিছু শুনতে পেল না। তাদের বিল্ডিংয়ের ট্রান্সমিটার ব্লাস্ট হয়েছে সম্ভবত। এদিকে ও দাউদাউ আগুন জ্বলছে। তাদের বিল্ডিং ও রক্ষা পেল না।
বাহির থেকে লিনার কান্নার আওয়াজ আসছে। বরকত খুব অসহায় বোধ করতে লাগলো। এক সময় বাথরুমের দরজা ধাক্কার আওয়াজ পেয়ে বরকত উত্তেজিত হয়ে গেল এবং বলল, লিনা?
বাহির থেকে লিনার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসল সাথে তিন-চার জন লোকের ও। তারা বরকতের প্রতিবেশী।
একজন বলে উঠে, ভাই বের হন। আগুন লাগছে।
বরকত বলল, জানি আমি। আপনারা লিনাকে নিয়ে যান। আমি আসতে পারব না। গেটের ছিটকিনি ভেঙে গেছে। ফায়ার সার্ভিসকে কল দেন।
–দিয়েছে। রাস্তায়। আসতেছে।
এমন সময় বরকত বুঝতে পারল তাদের বাসার দিকেও আগুন লেগে যাচ্ছে।
বরকত চেচিয়ে বলে, ভাই শুনছেন?
–আমরা চেষ্টা করতেছি গেট ভাঙ্গার। আপনি ভয় পেয়েন না। (প্রতিবেশী বলে উঠে)
বরকত তড়িঘড়ি করে বলে, আমাকে বাচাতে হবে না৷ আপনারা নেমে যান। সিড়ি তে আগুন লাগলে আপনারাও আটকা পড়বেন৷ একজন কে বাচাতে গিয়ে আপনারা চারজন নিজের জীবনের রিস্ক নিয়েন না। প্লিজ চলে যান।
লিনা কেদে দিল এবং বলল, আমি যাব না বরকত।তোমাকে রেখে।
–দেখো আবেগী হয়ে লাভ নেই। প্লিজ চলে যাও। ভাই ওকে জোড় করে এখান থেকে নিয়ে যান।
লিনা চিৎকার করে বলে, নাহ। আমি যাব না।
বরকত বলল, প্লিজ লিনা! বোঝার চেষ্টা করো!
–কি বুঝব আমি?এখানে বোঝাবুঝির কি আছে? তোমাকে আমি বিপদে ফেলে চলে যাব না।
বরকত অন্যদের উদ্দেশ্য করে করে বলে, আপনারা প্লিজ যান। সাথে লিনাকে জোড় করে নিয়ে যান।
একজন বলে উঠে, ঠিক বলছে বরকত ভাই৷ এখানে থেকে আমরা কিছুই করতে পারব না। তার চেয়ে বরং নিচে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিই। চলেন নামি।
লিনা কান্না মাখা গলায় বলে উঠে, না। আমি যাব না। আপনারা যান।
বরকত আবারো হন্তদন্ত হয়ে বলে, ওর কথায় কান দিয়েন না। প্লিজ ওকে জোড় করে নিয়ে যান।
লিনাকে জোড় করে নিয়ে যাওয়া হলো। লিনার কান্নার শব্দ বরকত শুনতে পেল। তার জন্য কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে। একটা সময় লিনার কান্নার ধ্বনি আর শোনা গেল না।
বরকত বলে উঠে, আল্লাহ লিনাকে রক্ষা করো। আর কিছু চাই না আমি।
বরকত ভাবতে লাগলো, লিনা কান্না করছে কেন? লিনা না তাকে ভালোবাসে না? যদিও বা কোন সংবিধানে লেখা নেই ভালো না বাসলে কারো জন্য কাদা যাবে না। তবুও তার জন্য মরন হতে পারে জেনেও কেন থাকতে চাইল?
এতো এতো ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ও বরকতের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। এখন মরে গেলেও শান্তি পাবে।
বরকত বাথরুমের মেঝেতে বসে পড়ল। খুব গরম লাগছে। আগুনের উত্তাপ পাচ্ছে। তবে কি তার খুব কাছাকাছি আগুন? একটু পর কি তাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই বানাবে? যদিও বা আগুনে পুড়ে মরা শহীদী মৃত্যু তাও বরকতের বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। চিৎকার দিয়ে কান্না করে খুব করে বলতে ইচ্ছা করছে, আমাকে প্লিজ বাচাও। কিন্তু পারল না চিৎকারটা দিতে। চিৎকারটাকে এক রাশ দীর্ঘশ্বাসে পরিনত করে আল্লাহ তায়ালা কে স্মরণ করতে লাগলো হায়াত, জন্ম-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ। আল্লাহ যা লিখে রেখেছে তাই হবে৷
বরকত চোখ বুজে ফেলে। বেচে থাকা কিংবা মরে যাওয়াটা সে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছে। তার চোখের সামনে মা আর ফ্যামিলির সবার চেহারা ভেসে উঠে। লিনার হাসিমাখা ফেসটা ভেসে উঠে। আচ্ছা সে যদি মারা যায় তবে কি লিনা আরেকটা বিয়ে করবে? করতে পারে। আরেকটা বিয়ে করলে বরকত খুশিই হবে। শুধু খুশি না, খুব খুশি হবে।
মৃত্যুর আগে মানুষ অবান্তর চিন্তা করে যেগুলো না করলেও চলে!
বরকত বিরবির করে বলে, আল্লাহ খুব একটা কষ্ট দিয়ে মৃত্যু দিও না আমার।আরামে জান টা নিয়ে নিও।
তার চোখ বেয়ে এল ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
★★★
ভোরের মিস্টি আলোয় প্রমিতির ঘুম ভাংলো। সে ঘুমের মধ্যেই ফজরের আযান শুনতে পাচ্ছে। প্রমিতি চোখ পিটপিট করে খুলেই অবাক হয়ে যায়। কারন সে বেডে শুয়ে আছে। সে তো সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবে এখানে আসল কিভাবে? রাতে স্লিপওয়াক করার বদঅভ্যাস হলো নাকি?
সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল নিরব তার পাশে ঘুমিয়ে আছে।
নিরবকে দেখে তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। তবে কি নিরব ই তাকে সোফা হতে বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়েছে? আর যদি দেয় তবে তো নিরব তাকে কোলে উঠিয়েছে সম্ভবত।
এসব কথা ভাবতেই প্রমিতির মুখটা লজ্জায় লাল হতে লাগে।
সে মৃদ্যু হেসে উঠে পড়ে নামাজ পড়তে বসবে। বাথরুম থেকে ওযু করে নামাজ পড়ে নিল।
তারপর নিরবকে ডাকতে লাগে। কিন্তু নিরব তো ঘুমে এতোটাই মগ্ন যে উঠতে পর্যন্ত নারাজ!
ডাকলেই শুধু হু হু করে উঠছে কিন্তু উঠার কোন নাম নাই।
প্রমিতি আবারো ডাকতে লাগলো, নিরব উঠেন। নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে।
নিরব ঘুমের মধ্যে এপাশ থেকে ওপাশ হয়ে বলে। হুম। হু।
প্রমিতি নিরবের এই কান্ড দেখে মৃদ্যু হাসল। তারপর বাথরুমে গিয়ে একটা মগ পানি এনে আস্তে করে নিরবের মুখে ছিটা দিল। দেওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করল যেন নিরবের জামা ভিজে না যায়।
পানির ছিটা পেতেই তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে নিরব।
তাকে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে প্রমিতি।
নিরব প্রমিতির হাসির মায়ায় আটকা পড়ল। সে হা করে প্রমিতির পানে চেয়ে থাকে।
নিরব মনে মনে বলে, এমন সুন্দর ভোর যেন প্রতিদিন আসে আমার জীবনে!
প্রমিতি হাসি থামিয়ে বলে, নামাজে যান।
নিরব হালকা হেসে বলে, হুম। যাচ্ছি।
নিরব নামাজ পড়া শেষ করে এসে দেখে প্রমিতি আবারো সোফায় শুয়েছে।সে ভ্রু কুচকে প্রমিতিকে উদ্দেশ্য করে বলে, এতো বড় বেড থাকতে ওখানে কেন?
প্রমিতি কিছু না বলে চুপ থাকে। তা দেখে নিরব ধীর পায়ে সোফার সামনে গিয়ে হুট করে প্রমিতিকে কোলে তুলে নেয়৷
প্রমিতি মোটেও এটার জন্য প্রস্তুত ছিলনা। সে খানিকটা চমকে উঠে বলে, আরে! আরে! কি করছেন?
–কিছু না। আর কোন দিন সোফায় শোয়ার কথা মাথায় আনবে না।
প্রমিতি অপলক নয়নে নিরবের দিকে তাকালো। আচ্ছা নিরব কি কোন রাজ্যের রাজপুত্র? কারন তার কাছে নিরবকে কোন রুপকথার গল্পের রাজপুত্র ই লাগছে!
★★★
বাসের ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙে যায় রোহানের। রোহান আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বাস থেমে আছে। যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে।সে বুঝতে পারল, গন্তব্যে পৌছে গেছে৷
সে গাড়ি থেকে নামল। বাস শ্যামলী স্ট্যান্ডে থেমেছে। এখান থেকে সে ধানমণ্ডি, তার এক ফ্রেন্ডের বাসায় উঠবে।
রোহান হাটা ধরল। রিকশা নিতে হবে। এতো পথ হাটা যাবে না। তার উপর বাসাটা সে চিনে না। বন্ধুকে কল দিতে হবে।
চলবে।