#তুই_আমার_সুরঞ্জনা
Part–9
#Arishan_Nur
প্রমিতি বিকেলের হালকা মিস্টি রোদের নিচে মাঝ রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে কানে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠল। সে পেছনে তাকিয়ে দেখে, একটা প্রাইভেট কার তার সামনে দাড়িয়ে আছে।
প্রমিতি হতাশার একটা শ্বাস ফেলল। সে ভেবেছিল কালো শার্ট পড়া ছেলেটাই তাকে নিতে এসেছে। কিন্তু তার ধারনা ভুল ছিল।
প্রমিতি টলমলে চোখে রাস্তার এক সাইডে গিয়ে দাড়ালো। সে আশেপাশে তাকালো। যে যার মতো ব্যস্ত। কারো দিকে কারো তাকানোর সময় পর্যন্ত নেই।
প্রমিতি বুক ফেটে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে কি করবে? এই রাস্তায়ই বসে থাকবে? নাকি হাটা ধরবে? আর হাটা ধরেই বা লাভ কি? কোথায় যাবে সে?
মাথায় কিছুই ঢুকছে না তার। প্রমিতি ফুটপাতে বসে পড়ে। বসতে গিয়ে হাতে একটু লাগল তার। সে খেয়াল করলো, তার হাতে ব্যান্ডেজ। প্রমিতি ব্যান্ডেজের জায়গায় হাত বুলালো। তার খুব করে কাদতে মন চাইছে৷
★★★
নিরব ইউটার্ণ নিল এবং প্রমিতিকে যেইখানে রেখে এসেছে তার সামনের গলিতে গাড়ি ঢুকালো। এবং প্রমিতিকে যেই স্পটে রেখে এসেছে ঠিক সেই জায়গায় আসল। গাড়ি থামাতেই তার চোখ কপালে। কারন রাস্তায় একটা ছোট-খাটো জটলা পেকে গেছে।দুই ঘন্টা আগেই তো সব ঠিক ছিল। যদিও বা এটা ঢাকা শহর। সেকেন্ডর মধ্যে রাস্তায় ঝামেলা লেগে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে গাড়ি থেকে নেমে ভীড় ঠেলে সামনে আগাতেই এক দফা শক খেল।
কারন জটলা পাকার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে প্রমিতি। তাকে ঘিরেই সবাই দাঁড়িয়ে আছে। তা
আর প্রমিতি একাধারে কেদেই যাচ্ছে।
ভীড়ের মধ্যে একজন বলে উঠে, এই আপা, আপনে রাস্তা-ঘাট কিছু চেনেন না?
প্রমিতি কাদতে কাদতে উত্তর দেয়, নাহ!
লোকটা বলল, আপনার স্বামীকে এখন কেমনে খুজে বের করবেন?
প্রমিতি কাদতে কাদতেই বলে, জানি না।
ভীড় থাকায় প্রমিতি নিরবকে দেখতে পেল না।
নিরব এই কান্ড দেখে ঘামতে লাগল। মেয়েটা এই বার ও পাশ করে গেল। তাহলে বুঝি আসলেই মেয়েটার মেমোরি লস হয়েছে। যদি মেয়েটা তাকে ফাসানোর ধান্দায় থাকত তবে দুই দুইটা ঘন্টা রাস্তায় বসে কান্না করত না।
নিরব ভীড় ঠেলে প্রমিতির সামনে গেল।
প্রমিতি তাকে দেখে কান্না থামিয়ে দিল এবং তার দিকে অবাক নয়নে চেয়ে থাকে তারপর আবার কান্না করতে লাগলো এবং বলল, আমাকে রেখে কেন চলে গিয়েছিলেন?
নিরব কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। সে তো মেয়েটার পরীক্ষা নিচ্ছিল।
লোকজন বলে উঠে, কে আপনাকে রেখে গেছে?
প্রমিতি হিচকি তুলতে তুলতে বলে, আমার স্বামী।
স্বামী শব্দটা শুনতেই নিরবের বুক কেপে উঠে। সে আবারো ঘামতে লাগল। যদিও বা এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। সূর্যের উত্তাপ নেই বলতেই চলে তবুও প্রচন্ড গরম লাগতে শুরু করে নিরবের।
নিরব প্রমিতির কাছে গিয়ে দাড়িয়ে আশেপাশের লোকজনের উদ্দেশ্য বলে, আপনারা এখন যেতে পারেন।
ভীড়ের মধ্যে একজন বলে উঠে, আপনি কে?
নিরব আমতাআমতা করতে থাকে। কি বলবে সে? জামাই লাগি –বলবে? নিজের মনেই ভাবতে লাগলো এসব নিরব।
প্রমিতি এবার বলে উঠে, আমার উনি!
নিরব প্রমিতির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকালো। তার এতো সুন্দর একটা পরিচয় আছে তাহলো নিরব চৌধুরি। সেই পরিচয় বাদ দিয়ে সে এখন সামনে দাড়িয়ে থাকা লাল শাড়ি পড়া মেয়েটার আমার উনি হয়ে গেল?
লোকজন বলতে লাগলো, কেমন মানুষ আপনি? বউকে রেখে পালাইছেন?
নিরব বলল, পালায় নি৷ একটা কাজে গিয়েছিলাম।
বলে প্রমিতির হাত ধরে টানতে টানতে গাড়ির কাছে গেল। এবং পকেট থেকে চাবি বের করে লক খুলল আর সামনের সিটে প্রমিতিকে বসালো। প্রমিতিও চুপচাপ বসে পড়ে।
নিরব নিজের চুল ঠিক করে ড্রাইভিং সিটে বসল।
এবং গাড়ি চালাতে শুরু করল। একটানে ভীড় থেকে দূরে সরে এলো।
এরপর বলল, তুমি এই দুই ঘন্টা রাস্তাই দাঁড়িয়ে ছিলে?
–হু।
–কেন?
–আমি কোথায় যাব? কিছু ই তো চিনি না। শুধু আপনাকে ই চিনি।
নিরব কিছু টা বিরক্ত হয়ে বলে, আচ্ছা। ঠিক আছে।
সে গুলশানের একটা আবাসিক হোটেলের দিকে গাড়ি চালাতে লাগে। গাড়ি তে তাদের মাঝে আর কোন কথা হয় না।
হোটেলে পৌছে নিরব প্রমিতিকে নিয়ে হোটেল রুমে গেল।
রুমে ঢুকে সে কর্কষ গলায় বলে উঠে, যাও ফ্রেস হয়ে নাও। আমি খাবার ওর্ডার দিচ্ছি।
প্রমিতি আচ্ছা বলে বাথরুমে ঢুকল।
নিরব হোটেলের টেলিফোন দিয়ে দুইজনের খাবার ওর্ডার দিল।
তারপর বেডে গিয়ে বসল। তার গা ছেড়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনি ঘুমিয়ে পড়বে। কালকে রাতে ঘুম হয় নি। আজকে সারা দিনে একবারো চোখের পাতা এক করার সময় পায় নি সে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।
নিরব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। বেডে গা এলিয়ে দিল। এবং ঘুমিয়ে গেল।
প্রমিতি গোসল করে বের হলো। গোসল করে আবার সেই লাল শাড়িটাই পড়েছে। চুল থেকে টিপটিপ করে পানি পড়ছে৷ সে বেডের সামনে এসে দাড়ালো। এবং দেখতে পেল, নিরব ঘুমাচ্ছে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
প্রমিতি নিরবের দিকে চেয়ে রইল। ছেলেটাকে চাপ দাড়িতে খুবই সুন্দর লাগছে। লম্বা হলেও দেখে মনে হয় না জিম-টিম করে।ওয়েট ভালোই হবে। প্রমিতি ঘুটিয়ে ঘুটিয়ে বড়ই আগ্রহের সাথে নিরবকে এমনভাবে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো যেমনটা একজন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রথম দিন ল্যাবে গিয়ে সব কিছু দেখে !
হুট করে গেটে নক করল কেউ। প্রমিতি গিয়ে গেট খুলতেই দেখল, ওয়েটার খাবার নিয়ে এসেছে। সে খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে বলে, আমার কাছে এখন টাকা নেই৷
ওয়েটারটা বলল, নো প্রবলেম ম্যাম। চেক আউটের সময় দিলেই হবে।
–আচ্ছা। বলে প্রমিতি খাবারের প্যাকেটটা টেবিলে রাখল।
চুল থেকে পানি এখনো চুইয়ে পড়ছে ফলে ব্লাউসটা ভিজে উঠেছে৷
প্রমিতি আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো এবং চুল গুলো হাত দিয়েই ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে পানি ঝাড়তে শুরু করে।
এ্যাট দ্যাট মুমেন্ট নিরবের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাংতেই চোখ চলে যায় প্রমিতির দিকে। সে পলকহীন ভাবে প্রমিতির দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রমিতিকে দেখে সে কোন ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে। প্রমিতি তার চুল ছাড়ছে।আর ফ্যানের হাওয়ায় চুল শুকাচ্ছে।
আর নিরব মুগ্ধ হয়ে দেখছে প্রমিতিকে। এখন যদি তার কেউ কোন ইন্টারভিউ নেয় আর সেই ইন্টারভিউয়ে প্রশ্ন করে, একটা মেয়েকে কোন সময় সবচেয়ে বেশি রুপবতী লাগে?
সে নিদ্বিধায় উত্তর দিতে পারবে। উত্তর টা হলো সদ্য স্নান করে যখন একটা মেয়ে চুল শুকায়।
তার কেমন যেন লাগতে শুরু করল। এর আগেও তো কতো মেয়ে দেখেছে কিন্তু এমন তো কোন দিন ফিল হয় নি। এই অদ্ভুত অনুভূতি টা কেবল প্রমিতিকে দেখা মাত্র শুরু হচ্ছে। নিরবের মধ্যে একটা খারাপ চিন্তা আসল। সে দ্রুত প্রমিতির থেকে চোখ সরিয়ে নিজেই নিজেকে গালি দিয়ে বলে, এই পুরুষজাতীর মনটা একদম আর্বজনার মতো!
পরে নিজেই নিজের বলা কথাটা সুধরে নিল। আসলে পুরুষের মন ময়লায় ঘেরা না বরং কাপুরুষের মন ময়লার স্তুপ!
নিরব দ্রুত তিন বার তওবা পড়ে নিল আর মনে মনে বলে, ইবলিস শয়তানে ধরছে, ভাগ্যিস তওয়া পড়ে নিলাম। নিরব চোখ খুলেই রেখেছিল। তাই তো প্রমিতি তার কাছে এসে বলে, আপনার ঘুম ভাংলো?
নিরব কিছুটা চমকে উঠে বলে, হু।
প্রমিতি আরো একবার তার চুল ঝাড়া দিল। নিরব হা করে তার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে থাকল। সরাসরি তাকাতে লজ্জা লাগছে নিরবের।
প্রমিতি বলে উঠে, খাবার দিয়ে গেছে।
–ও৷
–আপনি কি এখানেই থাকেন? এটা কি কোন বাসা? মানে,,, আগেও কি আমরা এখানে থাকতাম? (একসাথে এতো গুলো প্রশ্ন করে থামল প্রমিতি)
নিরব হালকা গলায় বলে, নাহ। এটা বাসা না। একটা হোটেল।
–আমরা হোটেলে কেন আছি? আমাদের কোন বাসা নাই?
নিরব এ প্রশ্ন শুনে মনে মনে বলে উঠে, আমরা না। তুমি থাকবা। আমি তো বিরিয়ানি খেয়েই চলে যাব আমার বাসায়। কিন্তু মুখে বলে, আছে তো বাসা। কিন্তু একটা সমস্যার কারনে এখন আমরা বাসায় থাকতে পারব না। চল, ডিনার করে নিই।
প্রমিতি চুল গুলো কাধের এক সাইডে ছেড়ে দিয়ে বলে, হু।
তারপর নিরব আর প্রমিতি খেতে বসল।
প্রমিতি মাথা নিচু করে গুটিসুটি মেরে বসে খেতে লাগলো।
নিরব তা দেখে কিছুটা অবাক হলো। মানুষ খাওয়ার সময় কিভাবে মাথা নিচু রেখে খায়?
মেয়েটার মাথা নত করে রাখাটা বুঝি অভ্যাস!
সে গলা খাকিয়ে বলে, খাবারটা কেমন? ভালো লাগছে?
প্রমিতি খেতে খেতে উত্তর দিল, হু। মজা আছে।
নিরব আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করল তাহলো মেয়েটা বেশ শান্ত, গম্ভীর। একদমই চঞ্চল না। সে প্রমিতিকে দেখে নিল। কতোই আর বয়স হবে, বিশ কিংবা একুশ । এতো কম বয়সেই এতো চুপচাপ। মেয়েরা নাকি এই বয়সটায় চড়ুই পাখির মতো তিড়িং বিড়িং করে ঘুরে বেড়ায়।
প্রমিতি খাওয়া শেষ করে উঠে দাড়ালো এবং বাথরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে নিল।
এরমধ্যে নিরবের ও খাওয়া শেষ হয়ে যায়। সেও হাত ধুয়ে আসে।
এখন প্রমিতিকে এখানে রেখে চলে যেতে হবে।প্রমিতি কে কি জানিয়ে যাবে? নাকি মিথ্যা বলে চলে যাবে?
মিথ্যা যদি বলে তবে কি বলবে? কিছু কিনতে যাচ্ছে এমনটা বলা যায়। কিন্তু প্রমিতি যদি আগের বারের মতো কান্না-কাটি শুরু করে তাইলে ফের ঝামেলা হবে। তার চেয়ে সত্যটা বলে দিই৷
নিরব প্রমিতির কাছে গিয়ে বলে, শোন!
নিরবের কন্ঠ শুনে প্রমিতি খানিকটা কেপে উঠে। সে মাথা নিচু করেই বলে, জি, বলুন।
–আমাকে বাইরে যেতে হবে।
প্রমিতি চোখ তুলে নিরবের দিকে তাকায়।
চোখাচোখি হতেই নিরবের অস্থির লাগতে শুরু করে। সে কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে, কাজ আছে একটা। সকালের মধ্যেই ফিরব। না, সকাল না সর্যি, বিকেলের মধ্যেই চলে আসব।
একথা শোনা মাত্র প্রমিতি ভ্যা করে কেদে দিল। প্রমিতিকে কাদতে দেখে কিছুটা ভড়কে গেল নিরব। সে মোটেও এটার জন্য প্রস্তুত ছিলনা।
প্রমিতি কাদতে কাদতে বলে, আপনি আমাকে রেখে চলে যাবেন তাই না? আর ফিরে আসবেন না আমি জানি৷
প্রমিতির কথাগুলো শুনে কেন যেন নিরবের খুব মায়া হতে লাগলো প্রমিতির প্রতি।
সে প্রমিতির কাছে গিয়ে বলে, না। তুমি ভুল ভাবছো। আমি আসব তো। আবার আসব।
প্রমিতি বলে উঠে, সত্যি?
–হুম। এখন যাই। কেমন?
–হু বলে প্রমিতি আবার মাথাটা নিচু করল।
নিরব যেই না পাশ ঘুরে দরজার কাছে যেতে ধরল , ওমনি প্রমিতির আচলের সাথে পা লেগে ধুম করে প্রমিতিকে নিয়েই সে বিছানায় পড়ে যায়।
নিরব সোজা গিয়ে প্রমিতির উপর পড়ে। এরই মধ্যে আরো একটা কান্ড ঘটে গেল তাহলো ফ্যানের বাতাসে হুট করে প্রমিতির শাড়ির আচল খানা সরে গেল। নিরব হতভম্ব হয়ে প্রমিতির উপর ই শুয়ে রইল । সে এক ধ্যানে প্রমিতি কে দেখেই যাচ্ছে। আর প্রমিতি ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। নিরব খেয়াল করল, প্রমিতির ঠোঁটের কাপছে। সে এক ধরনের মোহ নিয়েই প্রমিতিকে অবলোকন করতে থাকে। কাহিনি যদি এই পর্যন্ত ই ঘটত তাহলে তা আর বলা লাগত না।
কিন্তু ঠিক সেই সময় তাদের রুমের গেট খুলে পাচ-ছয় জন পুলিশ ভেতরে ঢুকে। এবং সেই পুলিশের মধ্যে থেকে একজন সিনিয়র লেডি পুলিশ তাদের কে এমন অবস্থায় দেখে জোড়ে চিল্লিয়ে বলে উঠে, আস্তাগফিরুল্লাহ! এইসব কি হচ্ছে? ছি ছি!
নিরবের হুশ আসল। কিন্তু তবুও সে প্রমিতির উপর শুয়ে থেকেই পেছন ঘুরল এবং যা দেখল তা দেখার পর তার চোখ প্রায় বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে ঘামছে আর বিরবির করে বলে উঠে, খালা এখানে কি করে? আজকে আমি শেষ! আম্মু জানলে হয় আমাকে ত্যাজো করবে নাহলে নিজেই হার্ট এটাক করবে।
#তুই_আমার_সুরঞ্জনা
Part–10(বোনাস)
#Arishan_Nur
নিরব মাথা ঘুরিয়ে এবার প্রমিতির দিকে তাকালো। মেয়েটা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। নিরব মনে মনে বলে, মেয়েটা ঘুমায়-টুমায় গেল নাকি আবার!
পেছন থেকে পুলিশ গুলো বলে উঠে, এই যে! এইসব অনৈতিক কাজ বন্ধ করেন।
এবার প্রমিতি চোখ খুলল। নিরবকে তার এতো কাছে দেখে সে একটা ঢোক গিলে ফেলে। এবং অপলক নয়নে নিরবকে দেখতে লাগে। এতো কাছে নিরবকে দেখে তার বেশ অস্বস্তি লাগছে। তার উপর তাদের রুমে মানুষ ঢুকে পড়েছে। ইশ!কি লজ্জা।
প্রমিতি নিরবকে নিজের থেকে সরানোর জন্য নিরবকে ধাক্কাতে লাগে।
নিরব বেশ ঘাবড়ে গেছে। সুমি খালাকে সে খুব ভালো করেই চেনে। বাড়াবাড়ি করা খালার রক্তে মিশে আছে। তার এই খালা আবার এসপি। বাশ যে খাবে এটা নিরব দিব্যি বুঝতে পারছে।
সে প্রমিতির উপর থেকে উঠে আসল এবং দাড়িয়ে পড়ল। কিন্তু পেছন ঘুরল না। খালা বুঝি তাকে এখনো দেখে নি। কারন দেখলে এতোক্ষনে উনি চুপ থাকার মানুষ না।
প্রমিতি ও নিরবের দেখাদেখি উঠে দাড়ালো এবং দ্রুত তার শাড়ির আচল ঠিক করে নেয়।
নিরবের খালা প্রমিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। নিরব যেহেতু প্রমিতির দিকে মুখ করে ছিল তাই খালা নিরবের চেহারা দেখতে পায় নি। কেবল পেছনটা দেখতে পাচ্ছেন।
খালা কিছুটা ধমক দিয়ে প্রমিতিকে বলে, এই মেয়ে? তোমার লজ্জা শরম নাই? এভাবে একটা ছেলের সাথে একা একটা রুমে আছো? সমাজ আজকে কোথায় চলে গেল! এই দিন ও দেখা লাগল।
নিরব আর প্রমিতি দুইজন ই চুপ মেরে গেল। নিরব মনে মনে বলে, হোটেলে কি রেট পড়ছে নাকি? কিন্তু রেট তো কমদামি, সস্তা হোটেলে পড়ে। গুলশানের হোটেলে তো পড়ার কথা না।
খালা সাহেবা আবারো বলল, দোষ তো কেবল মেয়ের না। ছেলেটার ও আছে। বেহায়া ছেলে কোথাকার!
এবার প্রমিতি মুখ খুলল। সে বলল, আপনি ভুল ভাবছেন।
খালা আবারো বলল, মানে? তোমরা খারাপ কাজ করতে আসো নি?
–না৷
–ছেলেটা কে হয় তোমার? বয়ফ্রেন্ড?
–না। না। উনি,,,,, আম,,
খালা আবার বলল, হ্যা বল কে হয় ছেলেটা তোমার?
নিরব প্রমিতির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, বলো, বলো, বেশি করে বলো, আমার উনি হয়। বাল। আমি আসলেই একটা অভাগা। তারপর আবার নিজেই নিজেকে বলে, না। না। অভাগা না। অভাগা হলে কি আর গুলশানে আমার ছয়তলা বাড়ি থাকে? মিরপুরেও আছে। আবার বনানীতে একটা ফ্লাট ও আছে। আই আম নট এ অভাগা। আজকের দিনটা খারাপ। এই যা।
প্রমিতি সুন্দর করে বলে, উনি আমার হ্যাসবেন্ড হন।
নিরব চোখ বন্ধ করে ফেলে একটা নিশ্বাস নেয়।
খালা আবারো বলে, হ্যসবেন্ড হলে হোটেলে আসার কি দরকার ছিল? আর এই যে মিস্টার চেহারা দেখান। লুকায় আছেন কেন?
বলে খালা নিরবের সামনে দাড়ালো।
খালাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে নিরব মুচকি হেসে বলে, আসসালামু আলাইকুম খালা। ভালো আছেন? খালুর শরীর কেমন? অনেকদিন ধরে বাসায় আসেন না। কোন খোজ-খবর নাই আপনার। শুধু ফেসবুকে স্টোরি দিলে একটা করে লাভ রিয়্যাক্টশন দেন।
খালা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, নিরব তুই?
–জি খালা।
–তুই বিয়ে করে ফেলেছিস? আর আমরা কেউ কিছু জানিই না!
নিরব গেল ফেসে। তাও যে-সে রকম ভাবে ফাসে নি সে। বেশ বড় ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে গেল।
নিরব আমতা আমতা করে বলে, আসলে,,,,খালা,,, হইসে কি! আমি বিয়ে করি,,
–বিয়ে করে বউ লুকায় রাখছোস। ছিঃ নিরব। লজ্জা করে না তোর। আবার বলিস কেমন আছি। তোকে ধরে থাপড়ানো দরকার।
–খালা। আমার কথা তো শুনেন।
খালা নিরবের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে প্রমিতিকে বলে, নিরব তোমার স্বামী হয়?
এতোক্ষন যাবত প্রমিতি জানত না কালো শার্ট পড়া, তার হ্যাসবেন্ডের নাম নিরব। মাত্র জানল। সে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে।
খালা প্রমিতিকে দেখে নেয়। আর বলে,সেকি রে! নিরব তুই বাসর রাত করতে আসছিস নাকি?
নিরব হন্তদন্ত হয়ে বলে, না। না।তুমি ভুল ভাবছো খালা। এমন কিছু না।
খালা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে, মেয়েটা লাল শাড়ি পড়ে আছে। শাড়ির কোন ভাজ ঠিক নাই।কোচড়া মোচড়া হয়ে আছে। আর হবেই বা না কেন? তোর মতো দামড়া ছেলে যদি শাড়ির উপর শুয়ে থাকে তাইলে শাড়ির ভাজ তো নস্ট হবেই।
নিরব কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে চুপচাপ খালার কথা শুনে যাচ্ছেব।এই মূহুর্তে খালাকে রাগানো যাবে না।
খালা প্রমিতিকে জিজ্ঞেস করল, আজকে তোমাদের বাসর রাত?
প্রমিতি হালকা গলায় বলে, না।
নিরব পকেটে হাত ঢুকিয়ে নেয়।
এদিকে প্রমিতি আগ বাড়িয়ে বলে, উনি তো আমাকে রেখে চলে যেতে ধরেছিলেন,,,,, কিন্তু তার আগেই আপনারা চলে আসলেন।
সুমি খালা নিরবের দিকে তাকালো এবং কড়া গলায় বলে, কতো দিন ধরে এইসব চলছে?
–কি চলছে খালা?
–এই যে আপনার সংসার! বউকে হোটেলে রাখছ,প্রতিদিন বিকেলে দেখা-সাক্ষাৎ, ভালোবাসা বিনিময় করে তুই বাসায় যাস। তাই না? বেগম আপা আমাকে সেদিন ফোনে বলছিল তুই নাকি দেরি করে বাসায় ফিরিস। এখন বুঝলাম কাহিনি কি।
–খালা। আমার কথা তো শুনেন।
–চুপ কর। আহাম্মক৷ (ধমক দিয়ে খালা)
নিরব চুপসে গেল। আর কিছু বলল না। এই মূহুর্তে তার প্রমিতিকে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মারতে মন চাচ্ছে ।
সুমি খালা ফোন হাতে নিয়ে নিরবের মা বেগমকে কল লাগালেন।
নিরবের মা ফোন ধরতেই সুমি খালা বলতে শুরু করলেন, আপা রে সব শেষ হয়ে গেল। তোর ছেলে আমাদের কোন ইজ্জত ই রাখল না। এই যে আমি এতো বড় অফিসার কি ভাব নিয়ে অফিস যেতাম-আসতাম, কালকে থেকে আমাকে বোরখা পড়ে মুখ লুকায় অফিস যেতে হবে। তারপর খানিকক্ষণ চুপ থাকল। অপর পক্ষ থেকে কিছু বলা হচ্ছে,সেটাই শুনছে বুঝি।
তারপর খালা আবারো বলতে লাগলো, কি হইসে মানে? কি হয় নি আপা! তোর ছেলে বিয়ে করে হোটেলে বউয়ে কে লুকায় রাখছে। এখানে সংসার ও শুরু করে দিসে। কবে বিয়ে করছে তা জানি না। কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে। তুমি দ্রুত আমার বাসায় আসো। আজকে এর একটা মীমাংসা করেই আমি ছাড়ব। হ্যা হ্যা৷ আপা, নিরব আমার সাথেই আছে। ওকে আমার বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। তোমরাও চলে আসো। হুম। এখনি আসো। একদম দেরি করিও না। আমার তো মনে হয় নিরবের বাচ্চা-কাচ্চা ও আছে। বাচ্চা লুকায় রাখছে,,,,,,,
নিরব বিরক্ত হলো। খালা এতো বেশি কথা কেন বলে? এখন যে কি করবে? মাকে কি বলবে? সত্যটা বলতে হবে। তা নাহলে আরো ঝামেলায় পড়বে সে।
খালা প্রমিতি আর নিরবকে নিজের বাসায় নিয়ে গেল।
গেট খুলল নিরবের কাজিন আশা। আশা নিরবকে দেখেই বলে, ওহ মাই গড! ব্রো তুমি? হুয়াটস আপ?
নিরব জোড় করে হেসে বলে, মাইকের চিপায় পড়ছি আমি! আর কও কেমন আছি!
কিছু ক্ষনের মধ্যে ই নিরবের মা, দাদি চলে আসল। নিরবের কোন ভাই-বোন নেই।
নিরবের মা বেগম এসেই প্রমিতিকে দেখে বলে, এটাই সেই মেয়ে?
প্রমিতিও কম না, সে মাথা ঝুকিয়ে বলে, জি। আমিই সেই মেয়ে।
বেগম প্রশ্ন করে, মা তুমি আমার ছেলের বউ?
প্রমিতি ডাগর ডাগর চোখে জবাব দেয়, হ্যা।
–আলহামদুরিল্লাহ। কি মিস্টি মেয়ে! হ্যা রে সুমি। একটা ভালো দেখে শাড়ি পড়া বউ মাকে।
সুমি খালা আচ্ছা বলে প্রমিতিকে ভেতরে নিয়ে গেল।
কিছুক্ষনের মধ্যে বাসার পরিবেশ বদলে গেল। বিরিয়ানির,রোস্টের গন্ধ আসতে লাগল। নিরব কিছু ই বুঝে উঠতে পারছে না। সে যে কারো সাথে কথা বলবে তার ও উপায় নেই।
ড্রয়িং রুমে কেউ নেই। কেবল আশা আর সে বসে আছে। আশা গুনগুন করে গান গাচ্ছে, চান্দের বাত্তির কসম দিয়া,,,, ভালোবাসলি, সূর্যের আলোয় ঝলমলাইয়া আমায় পুড়াইলি,,,,
নিরব আর কিছু শুনল না। কারন তার দৃষ্টি প্রমিতির উপর গিয়ে পড়ল।
নিরবের চোখ তো চড়ক গাছে! প্রমিতিকে বউ সাজানো হয়েছে। লাল ঘোমটা, গলায়, হাতে গহনা। হাতে যেই বালা পড়া সেটা তার মায়ের। নিরবের চোখ আটকে গেছে প্রমিতির। চোখ আর নড়াতে পারছে না সে। উফ, আল্লাহ! একটা মেয়ে এতো সুন্দর কি করে হতে পারে। নিরব টেবিলে থাকা পানির জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে পানি খেতে লাগলো।
সে ঢোক গিলল। কি হতে চলেছে তা সে অনুমান করতে পারল খানিকটা হলেও। যদি এমনটা হয় তবে তার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
সে আশেপাশে তাকালো। দেখল বরকত আর লিনা ও আসছে। তাদের আসতে দেখে নিরব শান্তি পেল। এখন মাকে সত্য কথা বলতে পারবে। সাক্ষী আছে। মাকে সব সত্য বলেই প্রমিতি নামক ঝামেলা টাকে সুমি খালার মতো দায়িত্বশীল অফিসারের হাতে তুলে দিবে।
কিন্তু বিধি বাম। বরকত একা আসেনি। সাথে করে নিয়ে এসেছে তাদের পারিবারিক কাজী সাহেব কে।
কাজী সাহেব এসেই বেগম আর সুমিকে সালাম দিয়ে জমজমের পানি বের করব বলে, আপা গন, পশ্চিম দিকে তাকিয়ে আল্লাহ নাম নিয়ে একটু জমজমের পানি খান। মনের আশা পূরণ হবে।
বেগম জমজমের পানি খেয়ে নিল৷
এরপর এক মূহুর্তের মধ্যে কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।
কাজী অনেক কিছু ই বলল কিন্তু লজ্জা আর নার্ভাসের কারনে প্রমিতি ঠিক মতো কিছু ই শুনল না। শুধু শেষের টুকু শুনল সে। জামিল চৌধুরির একমাত্র পুত্র নিরব চৌধুরি ঢাকার বাসিন্দা, উকিল বাবা সালাম সাহেবের কন্যা প্রমিতির নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো। কন্যা যদি এই বিয়েতে রাজী থাকে তাহলে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ কবুল৷
প্রমিতি কিছুক্ষন পর উত্তর দিল, আলহামদুলিল্লাহ কবুল৷
–তিনবার বলেন আম্মাজান।
–কবুল, কবুল, কবুল!
–সবাই শুনেছেন?
বাড়ির সবাই একসাথে বলল, জি শুনেছি।
কাজী সাহেব মুখে মিস্টি পুড়ে নিয়ে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ বিয়ে সম্পন্ন হলো।
নিরব আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল। তার কানে কিছু ই যাচ্ছে। সে কিছু ই শুনতে পাচ্ছে না। কেবল নাকে গরুর মাংস কষানোর গন্ধ আসছে। এই বিরিয়ানি, গরুর মাংস কি তার বিয়ের খাওয়া নাকি?
চলবে।