#তুমি_অতঃপর_তুমিই (পর্ব ০৭)
#Taniya_Sheikh
·
·
·
প্রেম সুখময়। তবে মাঝে মাঝে মিষ্টতা কমে তা হয় অম্লিত। হয় বিচ্ছেদ নয়ত বিবাহ। প্রেমকে কিসের সাথে তুলনা করবে? জুয়া! নাকি লটারী? ভাগ্য না জেনে ভাগ্য গড়তে, ধরতে ক’জন পারে? সে আমার হবে কিনা? আমি তার হতে পারব কিনা প্রেমের শুরুতে এসব কথা অর্থহীন, অনাদৃত। ক্রমশ প্রেমটা যখন পুরোনো হয়ে পড়ে। দুজন থেকে যখন পরিজনে ব্যাপ্তি ঘটে। তখনই টনক নড়ে প্রেমে মোহিত কপোত কপোতীর। শুদ্ধ প্রেমের শুদ্ধতায় জিতে যায় কেউ কেউ তবে সবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় না। সেদিক থেকে নুসরাত, বাশারের প্রেমটাকে শুদ্ধ ধরা চলে। ভাগ্যও বেশ সুপ্রসন্ন। তাইতো বাড়ি ছাড়ার পরই তারা শান নিহান খানের সামনে পড়ল। ভবিষ্যত ভাবনায় ছিল চিন্তিত তারা। চার হাত এক হলেই তো জীবন চলে না। আরও যে প্রয়োজন থাকে। একমুঠো অন্ন, একসাথে থাকার জন্য একটুকরো ছাদ ইত্যাদি। ভীতু মন নিয়ে শানের সামনে বসেছিল নুসরাত,বাশার। দুজনেই শঙ্কিত সেসময়৷ এই মানুষটাকে তারা চেনে,জানে না। অথচ অস্ত্রের মুখে লোকমারফত তাদের রাস্তা থেকে তুলে এনে এই নির্জন হোটেল কক্ষে বসিয়ে রেখেছে। শান ওয়াইনের গ্লাসে বরফ ছেড়ে মৃদু ঝাকাতে ঝাকাতে বেশ গাম্ভীর্য্যের সাথে বসল সামনে। তাদের জীবনের এ টু জেড বলতে বাধ্য করা হলো। তারা ভীতমনে অনায়াসেই বলে দিল শানকে। শান গম্ভীরমুখে নুসরাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। খুব ভয় করছিল সে দৃষ্টি দেখে নুসরাতের। একটা সাদা কাগজ আর কলম এগিয়ে দিল নাম ধাম লিখতে। নুসরাত লিখল। কাগজটা দু’আঙুলের ডগায় ধরে ভাবছিল শান। ভাবনার রেশ কাটতেই কাজী ডেকে ওদের বিয়ে পড়িয়ে দিল। নুসরাতের সেকি কান্না। কৃতজ্ঞতায় পায়ে পড়ল শানের। শান বিব্রত, নুসরাত কৃতজ্ঞ হয়ে শানকে ধর্ম ভাই বলে সম্বোধন করে। শানের মুখটা তখন দেখার মতো ছিল। একটুও আগেও যাকে স্ত্রী ভেবেছিল। সে এখন বোন!
নুসরাত সামান্য একজন মুদির দোকানীর মেয়ে। তার ভয় বাশারের বাড়ির লোকজন তাকে মানবে না৷ বাশারেরও একই ভয়৷ শেষে শানকে নিরুপায় হয়ে এই অসহায় মেয়েটার রোদনে উদারমনা হতে হলো। নুসরাতকে কথা দিল সে সব ঠিক করে দেবে। শান এমনটা এর পূর্বে কোনোদিন করে নি৷ কাওকে এভাবে সাহায্য করার ইতিহাস তার জীবনে ছিল না৷ এবার যেন হুট করেই মনটা নরম হলো মেয়েটার অসহায়ত্বে। আর তাছাড়া তার অর্থহীন জীবনের কিছুটা কারো দুঃখ দূরের কারণ হলে ক্ষতি কী? বরং মনে শান্তি পাচ্ছে সে। দানে পুন্য,দানে প্রাপ্তি। আগের চেয়েও অনেক বেশি। গাড়ির ব্যাক সিটে বসে আছে শান,ইমা এবং নুসরাত। গাড়ি ওদের এলাকায় ঢোকার মুখে শানের কথায় ইমার হাত,মুখের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো। ব্যথা, মনের বিফল হওয়া জেদ বেচারী করে ছেড়েছে ইমাকে। রক্তাভ মুখখানি তার নুয়ে আছে। নুসরাত হাত বাড়িয়ে বান্ধবীর হাতটা ধরতেও সাহস পাচ্ছে না এখন। কে জানে হিতে বিপরীত না হয় ফের তাতে! সরু গলি দিয়ে বাশারদের বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থামল।
সাজ্জাদ মা’কে না বলে লুকিয়ে লুকিয়ে এসেছিল দোকানে। সামনের হোটেল থেকে একপ্লেট তেহারি খেয়ে আয়েশে বের হয়ে দাঁড়াল গলির একপাশে। ঠিক তখনই সে ফুপির বাসার সামনে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে বাশার ভাইকে নামতে দেখে চিৎকার জুড়ে দিল। আশেপাশের মানুষ জড়ো হওয়ার পূর্বেই ওরা গাড়ি ছেড়ে নেমে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করে। বাশার মা,বাবার পায়ের কাছে বসে ক্ষমা চাইল। বাশারের বাবা শান্ত প্রকৃতির বলে সহজেই মেনে নিলেন। কিন্তু বীণা মানতে নারাজ। একজন সামান্য মুদি দোকানীর মেয়েকে সে বউ মানবে না বলে ঠান নিয়েছে। তার এই জেদ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। শান নিজের ক্ষমতা বলে তাকেও মানতে বাধ্য করল। শানের পরিচয় পেয়ে বাড়িসুদ্ধ লোকের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছে। এমন মাফিয়া টাইপ লোকের সামনে মুখ খোলাটা প্রাণনাশের সমতুল্য বলেই চুপ রইল বাড়ির পুরুষেরা। শান সবার সামনেই বললো নুসরাতের অভিভাবক সে। বিন্দুমাত্র কষ্ট যদি কেউ নুসরাতকে দিয়েছে তবে তার কপাল আর শানের গুলি এক হবে। এরপরে সেখানে কারোরই কথা রইল না। অনিচ্ছা মনে তারা নুসরাতকে বরণ করে ঘরে তোলে। নুসরাতের বাবা-মা মেয়ের এহেন কাজের মাশুল স্বরুপ বাশারের পরিবারের কাছে যথেষ্ট অপমানিত হয়েছিলেন। মেয়ে এসেছে জেনেও সাহস করে এবাড়ি তারা আর এলেন না। শান এ বাড়ির মানুষের চেহারা পড়ে নিয়েছে। বিশেষ করে ইমার আচরণে সে বুঝেই নিয়েছিল নুসরাত এ বাড়িতে নিরাপদ নয়। সুতরাং মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে দু’রাত এবাড়ি থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। বাড়ির গেষ্ট রুমটা শানের জন্যে খুলে দিলেন বাশারের বাবা। খুব খাতির যত্ন করা হলো সেই রাতে শান, মোবারক এবং নুসরাতকে। শান মোবারকের সাথে রুমে এলো। মোবারক নিচে ঘুমানোর জন্য বিছানা তৈরিতে ব্যস্ত। বিছানায় পা মেলে সিগারেট টানছিল শান। মাথায় হাজারটা চিন্তা তন্মধ্যে নব্বই শতাংশ ছিল পলাতক স্ত্রীকে নিয়ে। শান খেয়াল করছে আজকাল ভাবনারা যা নিয়েই শুরু হোক তাকেই নিয়েই বিস্তৃতি পাচ্ছে।
মোবারক বিছানা তৈরি করে শানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। শানের কান পর্যন্ত এসে ভাবনা ছেদ করল সে শব্দ। সিগারেট হাতে নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল সে,
” দীর্ঘশ্বাসের কারণ?”
মোবারক এগিয়ে এসে শানের পায়ের কাছে বসল। বিষন্ন মুখে বললো,
” আমার জন্যেই ঝামেলায় পড়লেন আপনি?”
” সেটা ঠিক। আমাকে ইদানিং ঝামেলায় ফেলতে তুই দারুন ভূমিকা পালন করছিস।” সিগারেটে ফের এক টান দিল শান। মোবারক মুখ নিচু করে বললো,
” আপনি বললেন নুসরাত ভাবি,,”
” আপা বলবি ওকে। নুসরাত আপা।” মোবারকের কথা থামিয়ে বললো শান।
” জি আচ্ছা! আমাকে যখন তার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে বললেন, আমি সেটাই করতে চাইলাম। হঠাৎ দেখলাম একটা ছেলের হাত ধরে নিশীথে রাস্তায় নামল আপা। পিছু নিলাম। তাদের অস্পষ্ট আলাপের কিছু অংশ কানে আসতেই বুঝলাম তারা পালিয়েছে। বাধ্য হয়ে আমাকে দলের লোক ডেকে তাদের আপনার কাছে নিতে হলো।”
” বাহ! চমৎকার বর্ণনা। তারপর আমি যদি তোরই মতো অল্প বুঝে বিশাল কিছু করতাম তখন কী হতো?” মোবারকের মুখের দিকে তাকায় শান। মোবারক নিচু গলায় বলে,
” আমার ভুল হয়েছে স্যার।”
” হুমম! তারপর?”
” সত্যি বলছি ভুল হয়েছে আমার।”
” বুঝলাম। যা ঘুমিয়ে পড় গিয়ে।”
মোবারক চোখ তুলে শানের মুখের দিকে তাকায়। ভাবলেশহীন, স্থির মুখ চোখ। মোবারকের মাঝে মাঝে মনে হয় শান মানুষ নয় কোনো পাথুরে মূর্তি। এই যেমন এখন মনে হচ্ছে। মোবারক তাকে বিপদে ফেললেও তেমন কিছু বলে শান। বাহ্যিক ভাবে তাকে কঠিন দেখালেও আসলে মনটা ভারী নরম তার স্যারের। মোবারকের ক্ষেত্রে তো শতভাগ সেটা। গরিব বলে আজ পর্যন্ত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নি। কতোবার একসাথে, একবিছানায় শুয়েছে তারা। মোবারকেরই কেমন অস্বস্তি হয় স্যারের সাথে ঘুমাতে। গরিব বলে নিজেকে যেন নিজেই ছোট করে সে। তবে স্যারকে খুব বেশি ভালোবাসে মোবারক। ওতো বড়লোক অথচ নিরহংকার মানুষটা। যতোই ধমক ধামকি দিক মোবারক তো জানে এসবের আড়ালে কতোটা মায়া আছে তার জন্য। মাঝে মাঝে কষ্ট হয় স্যারের কষ্টগুলো অনুভব করে। মোবারকের সাধ্যে থাকলে জীবন দিয়ে হাসি ফোটাত স্যারের মুখে।
মোবারক রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। আঁধারের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে বসে আছে শান। আচমকা কেউ দেখলে ভূতুরে মনে হতে পারে। শানের আঁধারে ঢাকা মানব মূর্তির দিকে চেয়েই একসময় ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল মোবারক।
শানের ঘুম ভাঙল মোবারকের পীড়িত গলার শব্দে। মুখ ঘুরিয়ে ঘুম জড়ানো চোখে মোবারকের দিকে ফিরে দেখল শরীর রক্তাক্ত অবস্থা। সমস্ত শরীর চুলাচ্ছে চাপা গোঙানিতে। ভ্রুকুটি করে বিছানার উপর উঠে বসল শান। বললো,
” কী হয়েছে তোর? এভাবে চুলকাচ্ছিস কেন?”
” স্যার খুব চুলকাচ্ছে। বুঝতাছি কেন এমন হলো?”
” এলার্জির সমস্যা আছে ?”
” না স্যার।”
” তাহলে?”
” ভোর বেলা একটা বাচ্চা এসে চাদর দিয়ে গেল। বললো আপনার জন্য নুসরাত আপা পাঠিয়েছে। আমি আপনার গায়ে দিতে যাব দেখলাম আপনি ঘামছেন। আপনি তো জানেন স্যার, রাতে চাদর মুড়ি না দিলে ভালো ঘুম হয় না আমার। তাই আমিই গায়ে দিয়েছিলাম। তারপর থেকেই এমন চুলকাচ্ছে শরীর।”
শান ভেবে চোয়াল ফুলিয়ে বললো,
” বুঝেছি বিষয়টা। তুই গিয়ে ভালো করে গোসল সেড়ে নে। এক্ষুনি ডাক্তার দেখাতে হবে। যা!”
মোবারক গোসল খানায় ঢুকেই চিৎকার করল। নখের আচরের স্থানে পানি পড়তেই জ্বলছে শরীর তার। শান অন্য একটা কাপড়ে চাদরটা মুড়ে ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। বিরবির করে বললো,
” ডোজ বাড়াতে হবে দেখছি বেয়াইনের। বড়ো বেশিই ঘাড় ত্যাড়া আপনি বেয়াইন। নো প্রবলেম! শান ত্যাড়া কে সোজা করতে সিদ্ধহস্ত। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ। ”
মোবারককে হসপিটাইজড করে ফিরে আসে শান। খাবার টেবিলে দেখা মেলে ইমার। শানকে দেখে চমকে ওঠে। খাবার শেষ করতেই সবাই দেখল বাড়ির সামনে গৃহস্থালি তৈজসপত্র,আসবাবপত্রে ভর্তি একটি ট্রাক এসে থেমেছে। এসব নুসরাতকে উপহারস্বরুপ দিচ্ছে শান। বীণাকে বুঝিয়ে দিল সে যা আশা করেছে তার দ্বিগুণ তাকে দেওয়া হল। বাশারের জন্য ভালো চাকরির ব্যবস্থা করবে বলেও আশস্ত করা হলো তাদের। বাসার সবাই অবাক। নুসরাতকে এবার মন থেকেই মানল বাড়ির লোক। তবে বীণার মনের খেদটা গেল না। উপরন্তু শানের ব্যবহারে সে বেজায় রুষ্ট ভেতরে ভেতরে। মন ভার করেই নুসরাতকে পুত্রবধূ স্বীকার করল সে। এতোকিছুর মধ্যে শানের নজর ঠিকই ইমার দিকে গিয়ে পড়ল। পড়ল বললে ভুল হবে। সেই ইমাকেই খুঁজছিল এতোক্ষণ। বাড়ির ভেতর লোকসমাগম এখন তেমন নেই। শান ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে।
” তোকে বলেছিলাম ঐ খবিশটাকে চাদর দিতে। কাকে দিয়েছিলি তুই?”
” দরজা তো সে খোলে নাই। খুললো তার ড্রাইভার। আমি কী করতাম তাইলে?”
” বলদের বলদ। বজ্জাতের বজ্জাত। ড্রাইভার রে দিছোস কেন তুই? ঐ কাইষ্টারে দিতে কইছিলাম। হালারে এখনও ঠিকঠাক দেইখ্যা কইলজ্জা জ্বলতাছে আমার।”
সাজ্জাদের কান মুচড়ে রাগে ফোঁসফাস করতে লাগল ইমা। ডান হাতটা নাড়াতে পারছে না গতকাল থেকে। ব্যথায় টনটন করে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর হাতটাতে। ডানহাতের উপরিভাগ ব্যান্ডেজ করা লাগছে। হাতটা বাহাতে তুলে কাঁদো কাঁদো সুরে বলে,
” আমার হাত! দেখছোস কী করছে খবিশটাই। ওরে আমি বিলাই চিমটিওয়ালা চাদর দিয়ে শিক্ষা দিতে চাইলাম মাগার সেইটাও হইলো না। একটা কামও ঠিকমতো করতে পারস না তোরা। ভাগ সামনে থেকে নয়ত ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেব। ভাগ কইছি।” সাজ্জাদ ধমক খেয়ে ছুটে নিচে নামতেই শানের মুখোমুখি হয়। ঢোক গিলে ভীরু মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে শানের সামনে। শান কিছু না বলে উপরে উঠে আসে। ছাদের দরজা লাগানোর শব্দে ইমা ঘুরে দাঁড়ায়।
” আপনি?”
” গতকাল কী করেছিলাম এতো সহজে ভুলে গেলেন বেয়াইন।”
” তোর বেয়াইনের খেতাপুরি। তোকে আমি।” ছাদের কোনে লাকড়ির বোঝা থেকে একটা উঠিয়ে ছুঁড়ে মারে শানের দিকে। বা’হাতে ছোঁড়ায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। শান ততোক্ষণে ইমার কাছাকাছি চলে এসেছে। ইমার দিকে এক পা এগোয়, ইমা দু’পা পিছিয়ে যায়। ইমা কাঁপা স্বরে বলে,
” আপনি কিন্তু অতিরিক্ত করছেন মি.।”
” আমিও কিন্তু সেটাই বলছি। অতিরিক্ত হচ্ছে ম্যাডাম। এবার সরি বলে শেষ করেন।”
” সরি আমার জুতা। সরি কেন বলব?”
” কেন বলবে জানো না?”
” রিয়েলি?”
” আবে হালা নাটক করোস ক্যালা? সর সামনে থেইক্যা। ”
শান আচমকা ইমার দু’বাহু ধরে ছাদের রেলিং এ ঠেসে ধরে। গম্ভীরমুখে বলে,
” সরি বলো।”
” জীবনেও না।”
” এক থেকে পাঁচ না তিন পর্যন্ত গুনব। এরমধ্যে সরি বলবে নয়ত ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেব। গতকালের পর থেকে এতোটুকু তো জেনেছ আমি কী করতে পারি আর না পারি। হুমম।” শান ভ্রু নাড়াতেই ইমা শুকনো ঢোক গেলে। ঘাড় বাকিয়ে পাঁচ তলার নিচে তাকাতেই কলিজা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে যায় ওর। শানের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
” ফেলে দে। তুই ফেললেও আমি সরি বলব না। কোনোদিন না।”
” সিরিয়াসলি?”
” হ্যাঁ!” গলা উঁচু করে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দেয় ইমা। ভয়ে তার অন্তরআত্মা কাঁপছে। ভাবছে সত্যি যদি ফেলে দেয়। পরমুহূর্তে আবার মনে হলো ধুর! সামান্য সরির জন্য ফেলবে না। পার্ট নিতাছে। ইমাকে বশ করা এতো সহজ নয়। ইমা কিছুটা সাহস পেল একথা ভেবে। তার সাহস চূর্ণ করে শান ঠিকই দিল ধাক্কা। ইমার অর্ধেক শরীর তাতে হেলে পড়েছে রেলিংএর বাইরে। বাকিটা ছাদে কারন শান ওর হাতটা ধরে আছে। ইমা ভয়ে আর্তচিৎকার করে বললো,
” কতো খারাপ চিন্তা করছ? সত্যি সত্যি ধাক্কা দিল। গুন্ডা একটা! আমাকে কেউ বাঁচাও। ও মা, তোমার মেয়েকে মেরে ফেললো এই গুন্ডা।”
ইমার নাকে কান্না থামে শানের ধমকে।
” মোবারকের কী অবস্থা করেছ জানো? মন তো চাচ্ছে হাতটা ছেড়ে দেই।”
” না! হাত ছাড়বেন না। হাত ছাড়লে কিন্তু ভূত হয়ে আপনার জীবন ত্যাজপাতা করে দিব বললাম। মাআআ!”
” চুপ! সরি বলো।”
” সরি!” মিনমিন করে বললো ইমা
” গুনে গুনে পঞ্চাশ বার সরি বলো এবং জোরে।” শান ধমক দিল ফের। ইমা গলা চড়িয়ে বললো,
” এতোবার বলতে পারব না।”
” কেন? পঞ্চাশ পর্যন্ত গুনতে পারো না?”
ইমার রাগ হচ্ছে শানের কথা শুনে আর কষ্টও হচ্ছে এভাবে ঝুলে থাকতে। দাঁত কামড়ে বললো,
” হ্যাঁ পারি না গুনতে।”
” ওকে ফাইন। সত্যিটা বলেছ একারনে ত্রিশবার।”
” এতোও পারব না। আরও কমান।”
” আর কমানো যাবে না। দ্রুত বলো। সময় নেই আমার হাতে।” ইমা চোখ মুখ খিঁচে কোনোমতে পঁচিশবার সরি বলতেই হাত ধরে টেনে তোলে তাকে শান। ইমা পা ছড়িয়ে ছাদের ফ্লোরে বসে জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে আর ছাড়ছে। শান ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
” ফারদার যদি উল্টো পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করেছ এবার আর হাত ধরে আধা ঝুলাব না। পুরোপুরি ফেলে দেব নিচে।”
শান হনহন করে হেঁটে নেমে নিচে চলে যায়। ইমা পাশে পড়ে থাকা চটি ছুঁড়তেও গিয়ে ছোড়ে না। ছাদের ফ্লোরে বা হাত দিয়ে কিল দিতে দিতে বলে,
” তোরে আমি যে কী করুম!” মাথার দু’পাশ ধরে সোজা হয়ে বসে বলে,
“শান্ত হ ইমা। শান্ত হ। এটাকে ঠান্ডা মাথায় শায়েস্তা করতে হবে। ব্যাটা খবিশ,কাইষ্টা, তোরে যদি সাইজ করতে না পারছি তবে নাম বদলে ফেলব আমার। হু।”
বিকেলের দিকে জরুরী প্রয়োজনে ইমা সাজ্জাদকে খুঁজতে গিয়ে শানের রুমে পেল। সাজ্জাদ নত মুখে বাবু মেরে বসেছিল শানের সামনে। ইমা জানালার বাইরে আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল ওদের। কী কথা হচ্ছে বোঝা গেল না। ইমা সাজ্জাদের অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। সাজ্জাদ বের হতেই জিজ্ঞেস করবে বলে ছুটে গেল ইমা৷ সাজ্জাদের মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। বরং খুশিই দেখাল তাকে। ইমাকে দেখতেই হাসল। ইমা ভ্রুকুটি করে গাট্টা মেরে বললো,
” এতোক্ষণ ঐ খবিশের সাথে কী করছিলি? আবার দাঁত কেলিয়ে হাসছে দেখো। বল কী করছিলি ”
” তুমি জেনে কী করবে?” পাশ থেকে শানের গলার শব্দে মুখ পানসে হয়ে যায় ইমার। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শান। চোখে অদ্ভুত চাহনী। ভীরু নয়নে মুখ তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ইমা। শান সাজ্জাদকে যেতে বলতেই সাজ্জাদ চলে যায়। দ্বিরুক্তি না করে হনহন করে সাজ্জাদের পিছু পিছু কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকায় ইমা । শান একদৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ইমা তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ভ্রুকুটি করে শানের ওমন চাহনীর অর্থ ভাবতে ভাবতে হাটছে ইমা। ইচ্ছা করছে আরেকবার পেছন ফিরে তাকাতে। কিন্তু সাহস হলো না আর।
·
·
·
চলবে……………………….