“তুমি কেন আগে আসোনি?”
২৩.
গতকাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে ভোরের হাওয়াটা একেবারে স্নিগ্ধ লাগছে সিনথিয়ার কাছে। একেবারে রেডি হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলো সিনথিয়া। জাভেদের ডাকে ফিরে তাকায়। আজকে তারা যাবে হ্যালিপ্যাড। সিনথিয়া খুব বেশি এক্সাইটেড হয়ে আছে। কারণ গতকাল বৃষ্টি হওয়ায় আকাশে এত এত মেঘ জমেছে যে মনে হচ্ছে সবমেঘ তাদের বারান্দায় নেমে এসেছে। না জানি সেখানে কেমন অবস্থায় আছে মেঘগুলো। জাভেদের ডাকে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। জাভেদ ভ্রু কুচকে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সিনথিয়া দুইপায়ে লাফিয়ে তাগাদা দিয়ে বললো,
— “উফ আসুন না। দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? দেরি হচ্ছে না আমাদের?”
— “বাহ! আমার বউটার উন্নতি হচ্ছে।”
— “তাড়াতাড়ি আসুন।”
কিছুটা চেচিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো সিনথিয়া। জাভেদের ক্যাবলাকান্ত হাসি দেখে রাগ হলো ওর। মনে হচ্ছে লোকটা ইচ্ছে করেই দেরি করছে। কেমন দেখো এখনো রুমের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে সিনথিয়ার। জাভেদকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুমে এসে হাত ধরে টানতে টানতে বাহিরে আনলো। রুমটা লক করে গাড়ির উদ্দেশ্যে হাটতে শুরু করেছে। সিনথিয়ার উত্তেজনা এবং কৌতুহল দেখে জাভেদ নিজে নিজেই মিটিমিটি হাসছে। এই মুহুর্তে মেয়েটাকে ক্ষ্যাপাতে বেশ লাগছে।
যথাসময়ে তারা পৌছে গেলো হ্যালিপ্যাড। আরেকটু পথ হেটে যেতে হবে। হাটতে হাটতে সামনে আসলো সেই বিখ্যাত আর্মি রিসোর্ট। জাভেদ সিনথিয়াকে রিসোর্ট দেখিয়ে বললো,
— “গুগলে সাজেক লিখে সার্চ দিলে যেই ছবিটা আগে আসে সেটা হচ্ছে এই রিসোর্ট। দেখো কত সুন্দর?”
সিনথিয়া মুগ্ধ হয়ে আশেপাশে দেখছে। জাভেদের হাত চেপে ধরেছে খুশিতে। জাভেদ বললো,
— “যাওয়ার সময় আমরা আর্মি রিসোর্টের পেছনে যাবো। পেছনে ছবি তুলার মতো বেশ সুন্দর জায়গা আছে। পার্কের মতো অনেকটা। দোলনাও আছে।”
— “সত্যি? আমি যাবো।”
— “ঠিকাছে। এখন চলো।”
তারা এসেছে মূলত অফ সিজনে। যার কারণে মানুষ অনেকটাই কম। তবে সিজনাল সময়ে এখানে অনেক মানুষ হয়। হ্যালিপ্যাডের মূল জায়গাটা একটু ঢালু। উপরের দিকে উঠতে একটু পরিশ্রম হয়। নিচে দাঁড়িয়ে সিনথিয়া উপরের দিকে তাকাতেই বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। পাহাড় এবং আকাশ যেনো একে অপরের সাথে মিলে গেছে। এতোদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখতো। আজ এতোটা কাছ থেকে দেখে সিনথিয়া কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেছে। জাভেদ হাটতে গিয়ে দেখলো সিনথিয়া দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। জাভেদ ভ্রু কুচকে তাকালো। সিনথিয়ার অভিব্যক্তি দেখে মুচকি হাসলো। জোর করে টেনে নিয়ে হাটতে শুরু করেছে।
উপরের এসে দাড়াতেই বাতাসের ঢেউয়ে শরীর, মন-প্রাণ যেনো জুড়িয়ে গেলো। পুরো জায়গাটা একবার চক্কর দিয়ে তারা সবাই পূর্বদিকে এসে দাঁড়িয়েছে। এদিকের ভিউটা অসাধারণ। জাভেদ-সিনথিয়া দুজনে সবার থেকে দূরে দাঁড়িয়েছে৷ সিনথিয়া নিকাব তুলে দাড়ালো। জাভেদ সামনে তাকিয়ে সিনথিয়ার থেকে কিছুটা সরে পাশে এসে দাড়ালো।
সাদা তুলার মতো একখণ্ড মেঘ যখন সিনথিয়াকে ছুয়ে দিয়ে গেলো সেই মুহুর্তে সিনথিয়া একেবারেই স্থির হয়ে গেলো। নড়চড় করতে না পারা একটা পুতুলের মতো। অনেকক্ষণ যাবৎ কিছুই বলতে পারলো না। না পারলো নড়তে। বিষ্ময়ে এবং অত্যাধিক খুশির কারণে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো।
জাভেদ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ঠোঁটে ছিলো অপূর্ব এক হাসি। সিনথিয়ার মুখের এই অভিব্যক্তি দেখার জন্যই এতো আয়োজন। যা আজ পূরণ হলো। অনেকক্ষণ পর সিনথিয়া স্বাভাবিক হলো। নড়েচড়ে তাকালো জাভেদের দিকে। জাভেদ ওর দিকেই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো। সিনথিয়া লজ্জা পেলো৷
অদ্ভুত না? সায়ান যেদিন ওকে বাবা-মায়ের পায়ের কাছে ফেলে চলে গেছিলো সেদিন কি মারটাই না খেয়েছিলো। এরপরেই একদিন আনমনে বসে ভেবেছিলো নিজের স্বপ্নের কথা। তার প্রিয় মানুষটা এভাবেই তার মুখের অভিব্যাক্তি দেখবে মুগ্ধ নয়নে। তখন সেসব অকল্পনীয় লাগতো। অথচ আজ! আজ সব ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেছে। সিনথিয়া লাজুক নয়নে আবার তাকালো জাভেদের দিকে। এখনো তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে সিনথিয়ার দিকে।
সিনথিয়া হেটে এসে জাভেদের পাশে দাড়ালো। লাজুকতা নিয়ে বললো,
— “এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন?”
— “তোমার ঘন পল্লব বিশিষ্ট আঁখি প্রেমে পরার মতো। কতশত বার যে প্রেমে পরেছি জানা নেই।”
.
আসার সময় সবাই মিলে আবার আর্মি রিসোর্টের পেছনে গেলো। সিনথিয়া তাড়াতাড়ি গিয়েই একটা দোলনা দখল করে নিলো। কারণ দোলনার ওপাশ থেকে আরেকজোড়া দম্পতি হেটে আসছিলো দোলনায় বসার জন্য। জাভেদ সিনথিয়ার সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
— “এতো দুষ্ট হয়েছো কবে থেকে?”
— “কিসের দুষ্ট হু? যদি আমি এভাবে না বসতাম তো আজকে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও একটুও সুযোগ পেতাম না দোলনায় বসার। এতো ভদ্রতা দেখিয়ে লাভ নেই বুঝেছেন? এবার আপনিও বসুন।”
জাভেদকে বসতে না দেখে সিনথিয়া হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো নিজের পাশে। কাধে মাথা রেখে ক্লান্তির একটা নিশ্বাস ফেললো। কিছু একটা মনে পরতেই সিনথিয়া জাভেদের বাহু দুইহাতে চেপে ধরে বললো,
— “এই আমার একটা দোলনার ভিডিও করে দিন।”
— “মানে? কিরকম করে?”
— “স্লো-মোশনে একটা ভিডিও করুন আমার পেছন থেকে প্লিজ। দেখুন এখানে বাতাসও আছে। অনেক জোস হবে ভিডিও-টা। প্লিজ যান না।”
— “তোমার হঠাৎ এভাবে ভিডিও বানানোর ইচ্ছা কবে থেকে জাগলো?”
— “এখনই জেগেছে। যান তো। শুধু দেরি করেন আপনি।”
জাভেদ উঠে গিয়ে সিনথিয়ার পেছনে দাড়ালো। মোবাইলটা ধরে দোলনা ধাক্কা দিয়ে ভিডিও অন করে তিন সেকেন্ডের মতো ভিডিও করে আবার পাশে এসে বসলো সিনথিয়ার। তারপর আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে এলো নিজেদের রিসোর্টে। বিকেলে তারা আবার আসবে হ্যালিপ্যাডে। কারণ বিকেলের দিকেও এই জায়গার ভিউ অসাধার হয়।
.
সব ঘুরাফিরা শেষে অবশেষে আবারও নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যাবে সবাই। আজ রাতেই তাদের শেষ রাত সাজেকে। সিনথিয়া নিজের অনেকগুলো ইচ্ছের কথা বলেছে জাভেদকে। জাভেদ মুচকি হেসে সেসবের ব্যবস্থা করেছে। আজকের রাতটা নিজেদের মতো করে স্পেশাল করে কাটাতে চায় সিনথিয়া। জাভেদেরও সেরকম কিছু ইচ্ছে ছিলো।
বিকেলেই সাজেকের একটা মার্কেটে গিয়ে সিনথিয়ার জন্য একটা স্পেশাল ড্রেস নিয়েছে জাভেদ। কিনার সময় বারবার মুচকি হাসছিলো। এই ড্রেস হাতে নিয়ে সিনথিয়া কেমন রিয়েক্ট দিবে সেটা ভাবতেই ঠোঁটের হাসি বারবার চওড়া হয়ে আসছিলো জাভেদের। ড্রেসটা পরার পর সিনথিয়াকে কেমন লাগবে সেটা কল্পনাই করতে পারছে না সে।
এখানকার এলাকার একটা ছেলেকে দিয়ে কিছু কৃষ্ণচূড়া ফুল আনিয়েছে জাভেদ। অনেক কষ্টে খুজে পেয়েছে। সাথে রজনীগন্ধা ফুল। কিছু ফেরি লাইট কিনে নিয়েছে যা ব্যাটারির সাহায্য জ্বলবে৷ কারণ রাতে কটেজে কারেন্ট থাকে না।
কটেজে ফিরে এসে আগে দুজনে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। আজকের আকাশটা একেবারে পরিষ্কার। পরিষ্কার ফকফকা চাঁদের আলো বিদ্যমান চারিদিকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে কামরার ভেতরে। জাভেদ সেই স্পেশাল ড্রেসটা সিনথিয়াকে দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো। এরপর বিছানার আশেপাশে ফেরি লাইট লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিলো। কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলো। রজনীগন্ধা ফুলগুলো কাটেজের বাশের ফাঁকে ফাঁকে গুজে দিলো। ব্যাস, সবকিছু সিনথিয়ার স্বপ্নের মতো করে সাজানো শেষ।
সিনথিয়া বেশ গুটিশুটি মেরে ধীরপায়ে বেরিয়ে এসেছে ওয়াশরুম থেকে। লজ্জায় থরথর করে কাপছে। এরকম ড্রেস সে আগে কখনো পরেছি। পুরো মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। ফুলের মিহি ঘ্রাণ নাকে লাগতেই আশেপাশে তাকালো। তারপর জাভেদের দিকে তাকালো। খুশিতে দুচোখে অশ্রুকণা চিকচিক করে উঠে। সবকিছু ঠিক সেভাবেই করা আছে যেভাবে সে সবসময় চেয়ে এসেছিলো। নিজের স্বপ্নপটে সবসময় প্রিয়মানুষটাকে যেভাবে আশা করেছিলো জাভেদ আজ সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে।
_________________________
সায়ান উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-সেদিক হাটতে লাগলো। কোনোকিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না সে। বাসায় একদন্ড শান্তি পায়না সে। তাই সেই সকাল বেরিয়ে গেছে। উদ্দেশ্যহীন হাটতে হাটতে কোথায় এসেছে সে নিজেই জানে না।
বেশ ক্লান্ত হয়ে পরায় রাস্তার একপাশে বসে পরেছে। অনেক তৃষ্ণা পেয়েছে। পকেটে হাত দিয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট পেলো। সেটা দিয়েই একটা ছোট্ট পানির বোতল কিনলো। বাকি টাকা পকেটে রেখে পানির বোতল নিয়ে আবার বসলো ফুটপাতে। অল্প পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে বসে রইলো নির্বিকার। একটা অল্প বয়সী বাচ্চা মেয়ে ফুল হাতে নিয়ে দৌড়ে এলো সায়ানের কাছে। বারবার বলছে ‘স্যার ফুল নিবেন? একদম তাজা ফুল। একটা নেন। মাত্র দশ টাকা।’ সায়ান মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। যদি আজকে সিনথিয়ার সাথে সব ঠিক থাকতো তাহলে এতোদিন ওদের বাবুটাও বড় হয়ে যেতো। বুকটা হাহাকার করে উঠে।
একটা বেলীফুলের মালা মেয়েটার হাত থেকে নিয়ে পকেটের সব টাকা দিয়ে দিলো মেয়েটাকে। মেয়েটা খুশিতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অবাক হয় সায়ান। বাচ্চা মেয়েটা টাকাও গুনতে জানে না। অথচ বেরিয়ে পরেছে জীবনের তাগিদে। এতসব ভাবনার মাঝেই আসরের আযান শুরু হয়েছে। সায়ান হঠাৎই থমকে গেলো। আযানের আওয়াজে চোখ থেকে অটোমেটিক পানি গড়িয়ে পরতে শুরু করেছে তার। হঠাৎই সিনথিয়ার বলা একটা কথা মনে পরে গেলো। মেয়েটা প্রায়ই বলতো ‘আপনার কি একটুও ভয় লাগে না আল্লাহর পাকড়াও-র?’ আজ হঠাৎ করেই ভয় লাগছে সায়ানের৷ এতো এতো পাপ করেছে সে এর ক্ষমা কি সে পাবে? যদি এভাবেই মরে যায়? তাহলে তো অন্ততকালের জন্য জাহান্নামের বাসিন্দা হয়ে যাবে সে। যেখানে শুধু যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই নেই। দুনিয়ার এই সামান্য যন্ত্রণায় নিজেকে এতোটা অসহায় লাগছে। জাহান্নামের যন্ত্রণায় কি করবে সে?
এসব কথা নিজের মনে আওড়াতে লাগলো সায়ান। ভয়ে একেবারে কাবু হয়ে গেছে সে। ঘাম ছুটেছে শরীর থেকে। আর কোনোকিছু চিন্তা না করেই মসজিদের দিকে ছুটে গেলো। প্রথম কদম রাখতেই পুরো শরীর কেঁপে উঠে। শিরশির করে উঠে পায়ের তলা। সায়ান ভীত হয়ে ভেতরে যায়। সবাই যেদিকে ওযু করতে সেদিকে যায়। বসে পরে ওযু করার জন্য। কিন্তু হায় সে-তো ওযুর নিয়মই জানেনা। মুহুর্তেই বুক ফেটে কান্না আসে সায়ানের। এই চৌত্রিশ বছরের জীবনটা একেবারেই বৃথা তার। সায়ান নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলে।
আট বছর বয়সী একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসে। সায়ান পাশে বসে বললো,
— “তুমি কাঁদছো কেনো? তোমার বুঝি খুব দুঃখ? নামাজ পড়তে আসো। একবার সিজদা দাও দেখবে সব দুঃখ একছুটে পালিয়েছে।”
বাচ্চাটা হেসে ফেলে। সায়ান অবাক চোখে তাকায় বাচ্চাটার দিকে। আজ যদি তার বাবুটা বেঁচে থাকতো তাহলে এরকম পাকা কথা বলতো তাইনা? সিনথিয়ার আর্দশে বেড়ে উঠলে তার বাবুটাও এভাবেই স্মরণ করিয়ে দিতো রবের কথা। সেসব ভেবে আরো একধাপ কষ্ট বাড়ে সায়ানের৷ বাচ্চা ছেলেটা ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বললো,
— “উফফো! চলো তো। আমার সাথে আসো।”
— “আম..আমি তো ওযু করতে জানি না। কিভাবে নামাজ পড়বো?” ভাঙা কণ্ঠে সায়ান বললো।
— “ওহ এই ব্যাপার? এইজন্য বুঝি কাঁদতে হয়? আসো আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি কিভাবে ওযু করতে হয়। ঠিকাছে? আমার থেকে দেখে দেখে ওযু করে নাও।”
বাচ্চাটার থেকে দেখে দেখে সায়ান ওযু করে নিলো। ওযু শেষে বাচ্চাটাকে বিড়বিড় করতে দেখে সায়ান কৌতুহলি হয়ে বললো,
— “কি বলছো তুমি?”
— “কালেমা শাহাদাত। তুমিও পড়ো।”
— “এটা পড়লে কি হয়?”
— “ওযুর পর কালেমা শাহাদাত পড়লে জান্নাতের সব দরজা খুলে দেয়া হয়। সে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।[১] আবার অন্য একটা হাদিসে এসেছে। এটা কিন্তু শক্তিশালী হাদিস৷ ‘ওযুর পর যদি কেউ দুই রাকাত সালাত আদায় করে যাতে অন্য কোনো চিন্তা থাকবে না তাহলে তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।'[২] আরো অনেক হাদিস আছে৷ তোমাকে পরে বলবো। আগে তুমি কালেমাটা পড়ো।”
— “আমিতো জানিনা।”
বাচ্চাটা একটু অবাক হলো। পরক্ষণেই মিষ্টি করে হাসলো। তারপর বললো,
— “আচ্ছা আমার সাথে বলো।”
সায়ান তাই উচ্চারণ করলো যা বাচ্চাটা বললো। এরপর সায়ানের হাত ধরে নিয়ে গেলো নামাজের স্থানে। বাচ্চাটা বললো মসজিদে প্রবেশ করলে বসার আগে দুই রাকাত সালাত পড়তে হয়। সায়ান প্রথমে ওযুর সালাত পড়লো। যদিও সে সালাত ঠিকমতো পড়তে পারছে না। যতটুকু ভাঙাচূড়া সূরা পারে সেগুলো দিয়ে কোনোমতে পড়লো। প্রথম সিজদা দিতেই কান্নায় ভেঙে পরলো। এতো শান্তি এই জায়গায়? আর সে কিনা অন্য সব অবৈধ জায়গায় শান্তি খুজে চলেছে?
সালাত শেষে সায়ান সেখানেই বসে রইলো। বাচ্চাটা ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— “আমার নাম অভি। তোমার নাম কি?”
সায়ান হাত মিলিয়ে বললো, “সায়ান আমার নাম। আচ্ছা তুমি এতো কিছু কিভাবে জানলে?”
— “জানতে চাইলে সবই জানা যায়।”
— “আমিও জানতে চাই। আচ্ছা তুমি কোথায় থাকো?”
— “মসজিদ থেকে একটু দূরে একটা অনাথ আশ্রম আছে সেখানে।”
সায়ান বেশ অবাক হলো। অনেকটা সময় কথা বলতে পারলো না। বাচ্চাটা মসজিদ থেকে বেরিয়ে সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “আমাদের আশ্রমে একটা আপু আছে। উনিই আমাদের এসব শিখায়। তবে একটা মজার ব্যাপার কি জানো?”
— “কি?”
— “আমরা এখনো কেউ সেই আপুকে দেখিনি।”
— “কেনো?”
— “কারণ উনি কারো সাথে দেখা দেয়না। এমনকি নিজের চেহারাও কাউকে দেখায় না। তুমি যদি জানতে চাও আপুর সাথে যোগাযোগ করতে পারো।”
সায়ান অভির সাথে ওদের আশ্রমে গেলো। অভিদের উস্তাযার সাথে দেখা করতে চাইলে তিনি দেখা করেননি। তার ভাইকে পাঠিয়েছে দেখা করাতে। অভিই সব বলেছে সায়ানের ব্যাপারে। লোকটা হেসে সায়ানকে ভেতরে নিয়ে গেলো। সায়ান বেশ লজ্জা পাচ্ছিলো। বারবার ভাবছে তারা কি ভাবছে ওকে নিয়ে? এতোবড় লোক অথচ ইসলামের কিছুই জানে না। সায়ানের ইতস্তত দেখে লোকটাই সায়ানকে সহজ হতে বললো। লোকটার ব্যবহার, হাসি দেখে সায়ানের খুব ভালো লাগলো। সাথে আফসোস হলো নিজের জন্য। খুব বেশি আফসোস।
.
দুইমাদ পেরিয়েছে। সায়ান এখন নিয়মিত আসা যাওয়া করে এই আশ্রমে। যেই লোকের কাছ থেকে ইলম নেয় তার নাম জুহান। সায়ান ‘জুহান ভাই’ বলে ডাকে। তার সাথে সায়ানও আশ্রমে কাজ করে। নিজের যা ছিলো সব জেনিফার নিজের নামে করিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। এখন নিজেদের তেমন কিছুই নেই। অবশ্য এতে সায়ানের কিছু যায় আসেনা। সে আর এসবের পেছনে ছুটতে চায়না৷ জীবনের চৌত্রিশটা বছর কাটিয়েছে এই দুনিয়াবি সুখের পেছনে। রবের নাফরমানি করেছে। বাকি জীবনটা আর সেভাবে কাটাতে চায়না। রবের খুশির জন্যই কাটিয়ে দিতে চায়।
এই আশ্রমটা শহর থেকে অনেকটা দূরে। সায়ান তার মাকে সিনথিয়াদের বাড়িতে রেখে এসেছে। নিজে এখানে একটা দোকানে কাজ করে। সেই টাকা দিয়েই আশ্রমে সাহায্য করে।
গভীর রাত। জুহান অযু করতে উঠেছিলো। পাশের রুম থেকে কান্নার শব্দ আসতেই সেদিকে গেলো। সায়ান এখন এই আশ্রমেই থাকে। রুমের সামনে আসতেই বুঝলো এটা সায়ানের কান্নার আওয়াজ। জানালার ফাক দিয়ে উঁকি দিলো। দেখলো সিজদায় পড়ে কাদছে। জুহানের ভালো লাগলো। তবে একটা বিষয় খেয়াল করেছে সায়ান প্রায় উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবসময় একটু একা থাকে। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। মেয়েদের দিকে তো একদমই তাকায় না। হয়ত তার দুঃখ বেশি। এটাই ধরে নিলো জুহান।
অন্যদিকে তার বোনটাও সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। উদাস হয়ে আকাশপানে তাকিয়ে থাকে। দুজনের হাবভাব কেমন যেনো মিলে যায়। তার বোন সারার দুইবছর আগেই স্বামী মারা গেছে। তারপর থেকেই এরকম একা একা থাকে।
______________________________
সন্ধ্যা থেকেই অতশি এবং সাবিনা মিলে সিনথিয়ার গল্প শুনছে। এতো এতো গল্পের আসর খুলে বসেছে মেয়েটা। সেখানে কি করেছে, কতটা আনন্দ করছে সেসব বলছে। অতশি মুচকি হাসলো। সিনথিয়ার সুখী ভাবটা ওর চোখেমুখে ঝিলিক দিচ্ছে। আবারো মন দিলো সিনথিয়ার বলা গল্পে।
তারা ফিরে আসার পর খুশিটা আরো দিগুণ হলো যখন জানতে পারলো সিনথিয়া মামী হবে। খুশিতে অতশিকে জড়িয়ে ধরেছে। তারপর তো বাবুর জন্য নিজেই জাভেদের থেকে টাকা নিয়ে কাপড় আনছে। অতশি খুব বকে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। প্রথম বাবু আসবে এই ঘরে তারজন্য তো একটু প্রস্তুতি নিতেই হবে।
রাতে সবাই খাবার শেষ করে যে যার রুমে চলে গেলো। অতশি এখন তার মায়ের সাথেই থাকে। আর দুই সপ্তাহ পর অতশির স্বামী আসবে। তাই বেচারি নিজেও অনেক খুশি।
সিনথিয়া আয়নার সামনে থেকে ফিরতেই জাভেদের মুখোমুখি হলো। জাভেদ হাসছে দেখে সিনথিয়া ভ্রুকুটি করে তাকালো। জাভেদ একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
— “একটু সাজবে প্লিজ? আজকে পূর্ণিমা। দুজন মিলে চন্দ্রবিলাশ করতে চাই।”
সিনথিয়া মুচকি হেসে প্যাকেটটা নিয়ে নিলো। খুলে দেখলো একটা লাল সূতীর শাড়ি। সিনথিয়া হাসলো। জাভেদকে খেতে দিয়ে রুমে এসে সাজুগুজু শুরু করেছে। একটু পর জাভেদ এলো রুমে।
সিনথিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লাজুক হেসে বললো,
— “আমাকে কেমন লাগছে?”
— “মায়াবতী।”
জাভেদ সিনথিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে ওর খোঁপায় বেলীফুলের মালা পরিয়ে দিলো। সিনথিয়া চমকালো৷ জাভেদের দিকে ঘুড়ে দাঁড়িয়ে বললো,
— “বেলীফুলের মালা?”
— “হ্যাঁ। তোমার তো এটা খুব পছন্দ তাইনা?”
— “কিভাবে জানলেন?”
— “ম্যাজিক।”
সিনথিয়ার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো পুরো হৃদয়। জাভেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “জানেন আমি সবসময় চেয়েছি আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে এভাবে খোঁপায় মালা পরিয়ে দিবে। কিন্তু সায়ান আম…।”
জাভেদ সিনথিয়ার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরলো। করুন চোখে তাকালো সিনথিয়ার দিকে। করুন স্বরে বললো,
— “প্লিজ সিয়া তোমার এই মুখে অন্য পুরুষের নাম উচ্চারণ করো না। আমার একদম সহ্য হয় না। খুব বেশিই জেলাস ফিল হয়। প্লিজ এরপর থেকে আর কোনো পুরুষের নাম উচ্চারণ করবে না। তোমার মুখে শুধু আমার নাম থাকবে। গট ইট?”
.
আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে। সিনথিয়া-জাভেদ দুজনে দোলনায় বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুদিন আগেই এই দোলনাটা ছাদে লাগিয়েছিলো জাভেদ। কারণ সিনথিয়ার পছন্দ তাই। চারিদিকে মাতাল হাওয়া বইছে। জাভেদ চাঁদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তার চাঁদটার দিকে তাকালো। সিনথিয়াও তাকালো জাভেদের দিকে। দুজনেই মনে মনে বললো,
— “তুমি কেন আগে আসোনি? কেনো আগে ভালোবাসোনি?”
_______________________
একটু আগেই সায়ান এবং সারার বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে। জুহারই নিজ দায়িত্বে দুজনকে বিয়ে দিয়েছে। এই আশ্রমেই তাদের দুজনের থাকার ব্যবস্থা করেছে। আশ্রমের প্রতিটা বাচ্চা ভীষণ খুশি। সায়ান হতভম্ব হয়ে বসে আছে। তবে পূর্বের মতো এবার আর তার মনে লালসা কাজ করছে না। সারা মেয়েটার প্রতি শ্রদ্ধা কাজ করছে। যদিও সিনথিয়াকে এখনো ভুলতে পারেনি সায়ান। কিন্তু হুট করে এভাবে সারার সাথে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে এটা তার মাথাতেই ছিলো না। আজই সব ঘটকালি করেছে জুহায়ের। তারপর তিনঘন্টার ব্যবধানে বিয়ের কাজ সম্পাদন করেছে।
জুহায়ের নিজেই সায়ানকে জোর করে সারার কাছে পাঠালো। আসলে সে বেশ নার্ভাস এবং ভয় পাচ্ছিলো। পূর্বের সবকিছু মনে হতেই একটা অজানা ভয় জেঁকে বসেছে মনে। যদি এই মেয়েটার সাথেও অন্যায় করে বসে? তাহলে কিভাবে দাঁড়াবে রবের সামনে? ভয়ে সায়ানের দুই হাটু কাপছে।
খাটের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলো মেয়েটা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। সায়ানের তার প্রথম বাসরের কথা মনে পরে গেলো। সিনথিয়াও এভাবেই বসে ছিলো। আর সে কতটা অন্যায় করেছিলো মেয়েটার সাথে। চোখের কোণে একটুখানি পানি জমেছে। বৃদ্ধাঙুলি দিয়ে সেটা মুছে বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো। মেয়েটা সালামের উত্তর নিলো। সায়ান এখনো তাকায়নি সারার দিকে।
সারা নিজেই সায়ানের হাত ধরে টেনে বারান্দায় নিয়ে গেলো। ছোটখাটো বারান্দাটা। এখানে দুটো চেয়ার আছে। সায়ানকে বসিয়ে দিয়ে জানতে চাইলে তার সম্পর্কে। সায়ান চোখ তুলে সারার দিকে তাকালো। তারপরই থমকেছে। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। সারা দেখতে কিছুটা সিনথিয়ার মতো। একই গায়ের রঙ। নাক, ঠোঁট কিছুটা মিলে সিনথিয়ার সাথে। তবে চোখদুটো অন্যরকম। অসংখ্য মায়া চোখদুটোতে। যেই মায়ায় সায়ান ডুব দিলে আর কখনোই এই মায়া কাটবে না।
সায়ান হুট করেই দাঁড়িয়ে সারাকে জড়িয়ে ধরে। সারা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সায়ানের পিঠে হাত রেখে বললো,
— “কি হয়েছে আপনার?”
— “আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না সারা। প্লিজ আমাকে তোমার মতো করে গড়ে তোলো। আমি একেবারে ভেঙে গুড়িয়ে গেছি। আমাকে একটু সাহায্য করো। প্লিজ সারা।”
— “আপনি বসুন প্লিজ।”
— “আমি কখনো তোমাকে মাতৃত্বের স্বাদ দিতে পারবো না সারা। কেনো আমাকে বিয়ে করলে?”
— “আমাদের আশ্রমে ৩০০ বাচ্চা আছে যারা আমাকে মা আর আপনাকে বাবা বলে ডাকে। আর ছেলেমেয়ের দরকার নেই।”
কথাটা শেষে সারা-র হাসি শুনা গেলো। সায়ান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সারা দিকে পূর্ণ নজরে তাকালো। সারা এবং সিনথিয়ার মাঝে একটা পার্থক্য চলে আসছে মনে বারবার। সিনথিয়ার অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে যেটা সায়ান এখন উপলব্ধি করতে পারছে। তবে সে জানে সায়ানের প্রতি সিনথিয়ার অবহেলার কারণ ছিলো পরিস্থিতি।
সিনথিয়ার প্রতি সম্মান জানায় এবং মনের এক কোণে এখনো সিনথিয়ার জন্য একটা জায়গা আছে। তবে সেটা নিয়ে আর ভাবতে চায়না সায়ান। এই মেয়েটাকে নিয়েই বাকিটা পথ কাটাতে চায়। এই মেয়েটাকে তার প্রপার সম্মান দিতে চায়।
নাকের নোলকটা কানের পাশ থেকে এনে সারা নাকে লাগিয়ে দিলো সায়ান। এতে সারা মিষ্টি করে হাসলো। ঘোমটা তুলে এনে মাথায় রাখলো। সায়ান এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সারা দিকে। মনে মনে বললো,
— “তুমি কেন আগে আসোনি? কেনো আগে ভালোবাসোনি?”
® ‘নুরুন নাহার’
________________সমাপ্ত______________
রেফারেন্স, [১] মুসলিম, ২০৯
[২] বুখারী, ১৫৯
[জানি না শেষটা কতটুকু গুছিয়ে লিখতে পেরেছি। তবে চেষ্টা করেছি যাতে আপনাদের ভালো লাগে। এতোদিন এই গল্পের সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের। গল্পটা নিয়ে মন্তব্য করে যান।]
#মেঘমালার_গল্পকথা_নুরুন_নাহার