“তুমি কেন আগে আসোনি?”
২১.
সবে মাত্র আলো ফুটতে শুরু করেছে। এখনো চারিদিকে হালকা অন্ধকার। ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়েছিলো আজ। তাই এখন কিছুটা ঠান্ডা লাগছে। বৃষ্টি থামার পরে প্রকৃতিকে আরো বেশি স্নিগ্ধ লাগছে৷
এমনিতেই বৃষ্টি হলে প্রকৃতি সজীব হয়ে উঠে। স্নিগ্ধ লাগে। ভোরের পরিবেশ তো আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠে। যদি সেটা সাজেকের মতো জায়গায় হয় তাহলে তো প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। সিনথিয়ার কাছে এখন তেমনই লাগছে সবকিছু। এই স্নিগ্ধ পরিবেশের সৌন্দর্য্যকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তাইতো পলকহীন তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে।
দূরে একটা গাছে একজোড়া পাখি বসে আছে একে অপরকে লেপ্টে। ভোরের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় ভিজে গেছে। তাই পুরুষ পাখিটা মেয়ে পাখিকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। একটু পরপর ঠোঁটে এবং মাথায় নিজের ঠোঁট বুলিয়ে দিচ্ছে পুরুষ পাখিটা। মেয়ে পাখিটা আরো গুটিশুটি মেরে মিশে গেছে পুরুষ পাখিটার বুকে। পুরুষ পাখিটা সামনে তাকাতেই দেখলো তাদের মতো অনুরূপ করছে কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা একজোড়া দম্পতি। মেয়ে পাখিটা চোখ রাঙাতেই পুরুষ পাখিটা সেদিক থেকে নজর সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলো।
ফজরের আযানের আগে থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিলো। ফজরের সালাত শেষ করে সিনথিয়া বেশ কয়েকবার ভিজতে চেয়েছে বৃষ্টিতে। কিন্তু জাভেদের জন্য পারেনি। বলতে গেলেই চোখ রাঙিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে সিনথিয়াকে। তাই পরেরবার কিছু না বলেই ফুড়ুৎ করে এসে উপস্থিত হয়েছে বারান্দায়। জাভেদের ধমকানিতেও কাজ হয়নি।
সিনথিয়া খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে উপভোগ করেছে বৃষ্টিতে ভেজা। সিনথিয়ার খুশি দেখে জাভেদ আর কিছু বলেনি। নিজেও ভিজেছে সিনথিয়ার সাথে। বৃষ্টির বেগ কমতেই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো সিনথিয়া। আকাশ দেখে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি সব মেঘেরা তাদের বারান্দায় নেমে আসবে। সিনথিয়া সেদিকে তাকিয়ে বললো,
— “মেঘগুলো এখানে নেমে আসবে মনে হচ্ছে। আমি মেঘ ধরবো।”
জাভেদ হেসে বললো,
— “পাগলি। মেঘ এখানে নামবে না৷”
— “কিন্তু আমি মেঘ ধরতে চাই। চাই মানে চাই।” অবুঝের মতো আবদার করলো।
— “ঠিকাছে। আগামীকাল আমরা হ্যালিপ্যাড যাবো। তখন তোমার ইচ্ছে পূরণ করে নিও। এখন এসো ভেতরে। ভেজা কাপড় বদলে নাও। নয়তো ঠান্ডা লাগবে।”
— “না৷ আমি সূর্যোদয় দেখবো। দেখুন মেঘ সরে গেছে।”
— “আচ্ছা দেখবে। আগে কাপড় বদলে নাও। কথা না শুনলে এবার কিন্তু খুব রেগে যাবো।”
জাভেদ কড়া কণ্ঠে কথাটা বলতেই সিনথিয়া বিড়ালছানার মতো চুপসে গেলো। গাল ফুলিয়ে ভেতরে চলে এসেছে। খুব দ্রুত লাগেজ থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে দৌড় দিয়েছে৷ যাইহোক, সূর্যোদয় সে দেখবেই দেখবে।
হালকা নীল রঙের পাতলা ফিনফিনে একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে সিনথিয়া দৌড়ে এলো বারান্দায়। চুলগুলো-ও ঠিকঠাক মতো মুছে নি। সিনথিয়ার কান্ড দেখে জাভেদ হেসে ফেললো। বউটার গাল টেনে দিয়ে ওয়াশরুমে এলো। জাভেদ কাপড় বদলে তাওয়াল নিয়ে বারান্দায় এসে সিনথিয়ার পিছনে দাড়ালো। সিনথিয়ার চুল ভালো করে মুছে দিয়ে ভেতরে গেলো। ক্যামেরাটা তাদের পেছন বরাবর সেট করে আবার এসে দাঁড়িয়েছে সিনথিয়ার পাশে।
দৃষ্টির শেষ সীমানায় তাকিয়ে সিনথিয়ার মনে হলো সূর্যটা পাহাড়ের পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে। নিজের আগমন সবাইকে জানানোর জন্য সূর্য তার সোনালি আভা চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। সোনালি রৌদ্দুর আকাশে ঘুড়ে বেড়ানো মেঘের ভেলাদের-ও নিজের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতি যেনো নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে উঠেছে। মনে হচ্ছে অলংকার পরেছে প্রকৃতি।
ধীরে ধীরে সূর্যটা পাহাড়ের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে গোল থালার মতো আকার ধারণ করেছে। প্রকৃতি ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে পরেছে। সূর্যের সোনালী কিরণে ঝলমলিয়ে গেলো চারিপাশ। সেই সাথে সিনথিয়ার মুখশ্রীতে আলো পরতেই জাভেদের দিকে ফিরে হাত চেপে ধরে বললো,
— “ইশ! এতো সুন্দর কেনো? আমার এখান থেকে যেতেই ইচ্ছে করছে না। সারাজীবন এখানে থেকে যেতে পারবো আমি।”
সিনথিয়া দুই হাত দুইদিকে মেলে এদিক থেকে সেদিকে ছুটাছুটি করছে আর বলছে,
— “সূর্যোদয় এতো সুন্দর। এই মেঘ, মেঘমালা, পাহাড়পর্বত এতো সুন্দর। না জানি জান্নাত কত সুন্দর হবে। জান্নাতের নিচে প্রবাহিত নহরসমূহ কত সুন্দর হবে।”
জাভেদ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে সিনথিয়ার কান্ড দেখে। সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে রেখেছে। কিছু একটা মনে হতেই দৌড়ে জাভেদের কাছে এসে হাত ধরে বললো,
— “শুনুন আমি আপনার আদর্শ স্ত্রী হতে চাই। জাতে আমি জান্নাতে যেতে পারি। জান্নাতের মতো চিরস্থায়ী জায়গায় ভ্রমণ করতে চাই। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন প্লিজ? প্লিজ..!”
সূর্যের কিরণ সিনথিয়ার চোখে-মুখে পরায় দারুণ লাগছে এই মুহুর্তে। চোখ দুটো চকচক করছে। হাস্যার কারণে দাঁত দুটোও ঝিকঝিক করে উঠছে। জাভেদের হাত ধরে সে কি অস্থিরতা প্রকাশ করছে সিনথিয়া। এখনই উত্তর চাই তার। জাভেদ হেসে বললো,
— “হু। সবসময় সাহায্য করবো। প্রমিস।”
সিনথিয়া খুশিতে আপ্লুত হয়ে আবারও এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। হালকা রঙের পাতলা ফিনফিনে শাড়ির আঁচল বাতাসের সমান তালে তাল মিলিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই মুহুর্তে সিনথিয়াকে একটা প্রজাপতির মতো লাগছে। যে খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।
_____________________________
দুপুরের খাবার সেড়ে সবাই মিলে বেড়িয়ে পরলো আজ আবার। সিনথিয়া জাভেদের মুখের সামনে মুখ এনে বললো,
— “আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
অনেকক্ষণ হাটার ফলে পুরো মুখ ঘেমে গেছে সিনথিয়ার। গালদুটো লাল হয়ে গেছে। নাকটা ঘেমে গেছে। এই মুহুর্তে আরো মায়াবী লাগে সিনথিয়াকে জাভেদের কাছে। নাকটা টেনে দিয়ে বললো,
— “কংলাক ঝর্ণা দেখতে যাবো।”
— “ঝর্ণা? মানে ওই যে, পাহাড়ের উপর থেকে নিচে পানি নেমে আসে সেটা না?”
— “হ্যাঁ।”
— “সত্যি? আমি ঝর্ণা দেখবো? ইয়েস!”
সিনথয়ার ইয়েস বলা দেখে জাভেদ হো হো করে হেসে উঠলো। জাভেদের হাসি দেখে সিনথিয়া হঠাৎ করেই লজ্জা পেয়ে গেলো যেনো। তাড়াতাড়ি নিকাব নামিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।
কংলাক ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে হলে একজন দক্ষ গাইডের দরকার তাদের। কারণ বন-জঙ্গল পেরিয়ে তারপর ঝর্ণায় যেতে হয়। সবাই হাতে মাঝারি সাইজের বাঁশ নিয়ে রওনা দিয়েছে তাদের কাংখিত গন্তব্যের উদ্দেশে। জাভেদ, সিনথিয়া সবার পেছনে হাটছে। সিনথিয়া কয়েকবার সবার আগে যেতে চেয়েছিলো জাভেদই হাত ধরে থামিয়ে দিয়েছে।
জঙ্গলের ভেতরে সরু রাস্তা দিয়ে সকলে সিরিয়ালি হাটছে। যারা সামনে আছে তারা গাইডের সাথে হালকা পাতলা কথা বলছে এলাকাটা নিয়ে। সিনথিয়া নাক-মুখ কুচকে জাভেদকে বললো,
— “আমরা সবার আগে হাটলে সবার আগে ঝর্ণার কাছে যেতে পারতাম। আপনি আমাকে থামিয়ে দিলেন কেনো? আমরা কেনো সবার পেছনে? বলুন।”
সিনথিয়া অসাবধানতা বশত পা ফেলতেই বনলতার সাথে পা পেচিয়ে পরে যেতে নিচ্ছিলো। জাভেদ কোমড় জড়িয়ে ধরে সোজা করে দাড় করিয়ে দিলো। হালকা চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সিনথিয়া আরো গাল ফুলিয়ে চুপ করে গেছে। কিছুটা সময় পর জাভেদ সিনথিয়াকে বললো,
— “তুমি হাটার সময় এদিক সেদিকে হেলে পরছো। তোমার হেলে পরার কারণে কোমড়ে ভাজ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে সিয়া। যা দেখে আমার মনেই উত্তেজনা জেগে উঠছে। সেই আমিই কি করে অন্য পুরুষদের মনে উত্তেজনা জাগতে দেই নিজের স্ত্রীর কোমড়ের ভাজ দেখতে দিয়ে? তুমি জানো না সিয়া, একজন পুরুষ কোন নজরে একজন নারীর দিকে তাকায়। যদি নারীরা বুঝতো তবে কখনোই নিজেকে খোলামেলা ভাবে সবার সামনে প্রকাশ করতো না। আমি বরাবরই খুব বেশি ঈর্সাবোধ করি তোমাকে নিয়ে। কেউ তোমাকে দেখুক, তোমার কোমড়ের ভাজে নজর পড়ুক, তোমার ঘনপল্লব বিশিষ্ট আঁখির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকুক এটা আমি কখনোই সহ্য করবো না। নেভার এভার। বুঝেছো?”
জাভেদের কথা শুনে সিনথিয়া দাঁড়িয়ে পরেছিলো। কথা শেষ হতেই হালকা করে মাথা নাড়লো সিনথিয়া। জাভেদ মুচকি হেসে বললো,
— “এমনো কিছু হাদিস আছে যেটা শুনলে খুব আশ্চর্য হবে। মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশের নারীরা যখন কোনো প্রয়োজন রাস্তায় বের হতো, যদি দেখতো কোনো পুরুষ সামনে দিয়ে আসছে তারা তৎক্ষনাৎ বসে যেতো। যাতে করে সেই পুরুষ তাদের হাটার স্টাইল কেমন সেটা বুঝতে না পারে।”
সিনথিয়া ধীরে ধীরে নজর নামিয়ে ফেললো। এতোক্ষণ জাভেদের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দাঁড়িয়ে আছে একেবারে জড়সড় হয়ে। জাভেদ সিনথিয়ার ভ্রুযুগল নিকাব দিয়ে ঢেকে দিয়ে বললো,
— “মনে আছে মুসা আলাইহিস সালামের সাথে যেই নারীর বিয়ে হয়েছিলো সেই নারীর হাটার স্টাইল পর্যন্ত আল্লাহ কুরআনুল কারীমে তুলে ধরেছেন। বুঝতে পারছো কতটা লাজুক ছিলেন তিনি। কতটা সম্ভ্রান্ত ছিলেন। যার কারণে স্বয়ং আল্লাহ সেই মহিয়সী নারীর চলার ধরণ পর্যন্ত কুরআনে বর্ণনা করেছেন। ‘তাদের দুজন নারীর মধ্যে একজন নারী লজ্জা-জড়িত পদক্ষেপে তার(মূসার) নিকট এলো।’ [সূরা কাসাস: ২৫] অন্য আয়াতে আল্লাহ সমস্ত নারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘তারা যেন এমন সজোরে পদক্ষেপ না করে যাতে তাদের গোপন আভরণ প্রকাশ পেয়ে যায়।’ [সূরা নূর: ৩১] এবার বুঝেছো আমাদের পেছনে হাটার কারণ?”
.
অবশেষে সবাই মিলে কাঙ্ক্ষিত স্থানে এসে পৌছালো। জাভেদ শক্ত করে সিনথিয়ার হাত ধরে পানিতে নামল। হাটু সমান পানি। দুজনে ঝর্ণার কাছাকাছি গিয়ে দাড়ালো। সিনথিয়া জাভেদের পেছনে নিজের অর্ধেক দেহ আড়াল করে দাঁড়িয়ে ঝর্ণা দেখছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির স্রোত দেখে সিনথিয়া আপ্লুত হয়ে বললো,
— “আমি ভিজবো।”
— “এখন না। এখানে অনেক মানুষ।”
পানির ছলাৎছলাৎ শব্দে নিজেকে দমিয়ে রাখা কঠিন। জাভেদ নিজেও বুঝলো। সে নিজেও চাইছে ঝর্নার পানিতে ভিজতে। সেখানে সিনথিয়াকেই বা কি মানা করবে। কিন্তু ঝর্ণার কাছাকাছি যাচ্ছে না তারা কারণ সবাই মিলে হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে রেখেছে ঝর্ণার কাছে। নারী-পুরুষ সবাই সমানে ভিজে যাচ্ছে। যেসব নারী থ্রিপিস বা টপস বা জিন্স এবং গেঞ্জি পরে এসেছে তাদের অবস্থা একেবারেই করুন। যদিও সেটা তারা আমলে নিচ্ছে না। সিনথিয়া তাদের দিক থেকে নজর সরিয়ে জাভেদের পেছনে আরেকটু আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। এই মুহুর্তে গিয়েই সিনথিয়া উপলব্ধি করলো জাভেদের বলা প্রতিটা কথা। ইশ! কি বিচ্ছিরি লাগছে মহিলাগুলোকে। অথচ তাদের সেদিকে হুশ নেই। একজন আরেকজনের গায়ে যেনো হুমরি খেয়ে পরছে।
— “কি ভাই ভাবিকে কি এখানে দাড় করিয়ে রাখবেন নাকি?”
ট্রিপে তাদের সাথে আসা একজোড়া দম্পতির মধ্যে একজন প্রশ্ন করলো। সিনথিয়া এবার পুরোপুরি জাভেদের পেছনে লুকিয়ে শার্ট খামছে ধরে রেখেছে। জাভেদ লোকটার দিকে তাকিয়ে হেসে জবাব দিলো,
— “সবাই নিজেদের ইচ্ছা পূরণ করে নিক। তারপর আমরা যাবো।”
— “তাহলে এক কাজ করতে পারেন আপনি। যেই গাইড আমরা এনেছি তার সাথে আরো একজন আছে। আপনি তাকে হায়ার করুন। সবাই চলে গেলে নিজেদের মতো সময় কাটিয়ে তারপর ফিরতে পারবেন। আর এদিকে ঘন্টা পর পর পর্যটক আসে। ততক্ষণে আপনাদের অসুবিধে হবে না। তবে একটু এক্সট্রা টাকা দিতে হবে আরকি।”
জাভেদের কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগলো। সে কিছুক্ষণ চিন্তা করেই লোকটার বলা অনুযায়ী কাজ করলো। সবাই নিজেদের মতো সময় কাটিয়ে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনই একদল মেয়েরা এসে উপস্থিত হয়েছে এই স্থানে। এদের সবার গায়ে একই গেঞ্জি। হয়ত কোনো কোম্পানি বা কোনো সংস্থা থেকে একসাথে ট্রিপে এসেছে। জাভেদ স্বস্তি পেলো। কারণ সবাই চলে গেলে তারা শুধু দুজন মানুষ থাকে। আর বলা যায়না কখন কি বিপদ ঘটে। জাভেদদের ট্রিপে আসা সবাই চলে যেতেই জাভেদ কাধের ব্যাগ একপাশে রাখলো। সিনথিয়ার হাত ধরে এগিয়ে গেলো ঝর্ণার কাছাকাছি।
সিনথিয়া তো আর নিজের মধ্যে নেই। ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়েই লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। জাভেদ বেশ কয়েকবার থামতে বলেও থামাতে পারেনি। এতো বেশি উল্লাসিত হয়ে পরেছে মেয়েটা। শেষে উপায় না পেয়ে সিনথিয়া কোমড় চেপে ধরে থামিয়ে দিলো। ঠান্ডা পানি মাথার উপর পরতেই যেনো শরীরে হিম ধরে যাবে অবস্থা। সিনথিয়া ঢলে পরলো জাভেদের বুকে। মিনমিন করে বললো,
— “আমি এরকম আরো অনেক অনেক ট্রিপে যেতে চাই আপনার সাথে।”
দুজনে বেশ কিছু ছবি তুলে, ভিডিও করে, নিজেদের মতো সময় কাটিয়ে তারপর এখন পাথরের উপর বসে আছে। সিনথিয়ার বিশ্বাস হচ্ছে না সে ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজেছে। এখনো স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। ব্যাগ থেকে শুকনো একটা বোরকা বের করে সিনথিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো জাভেদ। সিনথিয়া সেটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললো,
— “এসব কবে এনেছেন?”
— “যখন আপনি প্রজাপতির মতো উড়াউড়িতে ব্যস্ত ছিলেন কটেজের বারান্দায়। এখন এটা পরে নাও ভিজাটা খুলে। জলদি করো।”
সিনথিয়া দ্রুত হাতে জিলবাব চেঞ্জ করে নিলো। ভিজা জিলবাবটা জাভেদ পলিথিনে ভরে ব্যাগে ভরে ফেললো। নিজেও শুকনো একটা গেঞ্জি পরে নিলো। আরো কিচ্ছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে রওনা দিলো কটেজের উদ্দেশ্যে।
আসার পথে বাঁশটা কোনো কাজে না লাগলেও ফেরার পথে বেশ কাজে দিয়েছে। এটা না থাকলে ঢালু পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা বেশ মুসকিল হতো। ফেরার পথে দুজনে চান্দের গাড়িতে করে কটেজে ফিরেছে। বোরকার ভেতরের ভেজা কাপড়-চোপড় বদলে সিনথিয়া শুয়ে পরেছে। শীতল ঠান্ডা পানিতে ভিজায় দেহ-মন শীতল হয়ে আছে এখনো। গাড়িতে বসতেই চোখ ভেঙে ঘুম আসছিলো যেনো। কোনোরকমে খোলা রেখেছিলো চোখ দুটো।
কটেজে ফিরার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না দুজনের একজনও। দুজনেই ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে।
“তুমি কেন আগে আসোনি?”
২২.
সময়টা বহমান। কারো জন্যে থেমে থাকে না। ঠিক সেভাবেই থেমে নেই সায়ানের জন্যেও। তবে পূর্ববর্তী সময়টা অনেক কিছু শিখিয়ে গেছে তাকে। সাথে নিয়ে গেছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু বা ব্যাক্তিটাকেও। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিঙের উপর দুইহাত রেখে সেখানে ভর দিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টির সীমানা যতদূর যায় সেখানেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। সব আছে তার। বাড়ি, গাড়ি, টাকা, পয়সা, সুন্দরী একটা স্ত্রী। তবুও যেনো কি একটা নেই। মনের চোরাগলিতে মাঝেমধ্যেই উঁকিঝুঁকি দিয়ে যায় একটা পরিচিত চেহারা। যার জন্যে আজও মনের কোণে একটা ছোট্ট জায়গা বরাদ্দ আছে। কিন্তু আগে সেটা বুঝতে পারেনি। আজ বুঝতে পারে। আজ সায়ান অনেক কিছুই বুঝে। কিন্তু এখন আর সেসবে কিছু যায় আসেনা। বা কোনোকিছুই ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
সায়ানের চোখে ভীষণ আকুতি। কার কাছে প্রকাশ করবে সে জানে না। প্রকাশ করেও লাভ আছে বলে মনে হয়না। আজকের উপলব্ধিটা যদি আরো তিন বছর আগে হতো। তাহলে আজ জীবনটা অন্যরকম হতো। সে-ও সুখী হতো। হৃদয়ের তীব্র দহনে চোখ বন্ধ করে নেয় সায়ান। হৃদয়টা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এই দহন আর কখনো, আর কেউ নিভিয়ে দিতে পারবে কিনা জানা নেই তার। চোখের কোন বেয়ে একফোটা অশ্রুকণা নেমে আসে। এই জায়গাটাতেই, এই বারান্দার রেলিঙের উপর হাত রেখেই তার হৃদহরিণী অশ্রুবিসর্জন দিতো। এখানে দাঁড়িয়েই আকাশপানে তাকিয়ে থাকতো। সেসব চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মনের গহীন থেকে বেরিয়ে আসে, ‘ভালোবাসি সিনথিয়া। কেনো আগে এই অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়নি? কেনো?’
এখনো চোখ খুলেনি সায়ান। প্রিয় রমণীর মুখটা চোখের সামনে ভাসে। সেই রাগী চেহারা। রাগে লাল হয়ে যাওয়া চেহারা। হয়ত কোনোদিন বলা হয়নি। তবে আর কোনোদিন বলাও হবে না। এই রাগী মায়াবী চেহারাটাই সায়ানের হৃদয়ে গভীরভাবে ধাক্কা দিয়েছিলো প্রথম আলাপে, প্রথম দেখায়। প্রচন্ড তীব্রভাবে ঘায়েল করেছিলো সিনথিয়া রাগি চোখজোড়া, রাগে লাল হওয়া নাক। সেদিন, এরপর প্রতিবারই সায়ান থমকেছে সিনথিয়ার রাগি চেহারাটা দেখে। কতকবার বলেওছিলো, ‘তোমার এই রাগি চেহারা একেবারে হৃদয়ে এসে লাগে।’ হয়ত সিনথিয়া কোনোদিন সিরিয়াসলি নেয়নি। এমনকি সায়ান নিজেও বুঝতে পারেনি কেনো এই রাগি মুখশ্রীর দিকে তাকালে হার্টবিট মিস হতো। সবকিছু মনে হতেই হৃদয়টা হাহাকার করে উঠে। তীব্র দহনে চোখ জোড়া ঝট করে খুলে নেয়।
নিচ থেকে জেনিফার চেচামেচির আওয়াজ আসছে। সায়ান স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এসব আর ভালোলাগে না তার। ইচ্ছে করে কোথাও চলে যেতে। এই বাড়ি, গাড়ি, স্ট্যাটাস এসব এখন আর ভালোলাগে না। নারীর সঙ্গও ভালোলাগে না। বিতৃষ্ণা চলে এসেছে এসবে৷ সায়ান এখন বুঝে সিনথিয়া চলে যাওয়ার পরপরই কেনো সে আরো অমানুষ হয়ে গেছিলো। ইশ্ যদি সাথে সাথে বুঝতে পারতো। অথবা, একমাস পর, অথবা একবছর পরেও যদি বুঝতে পারতো কেনো এমন হয়েছে তাহলে আবার ফিরিয়ে আনতো তার হৃদহরিণীকে। যেদিন প্রথম জাভেদের সাথে সিনথিয়াকে দেখেছিলো হৃদয়টা জ্বলে পুড়ে গেছিলো। তাইতো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কিসব কান্ড রটিয়ে বসেছিলো। তবুও বুঝতে পারেনি, পরিচিত হতে পারেনি এই অনুভূতির সাথে। যেনো একটা ঘোরের মধ্যেই চলে গেছিলো। অপ্সরা চলে যাওয়ার পরই যেনো ঘোর থেকে ঝট করে বেরিয়ে এলো। তারপরই জীবনটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো।
কাধে কারো হাতের ছোয়া পেতেই তাড়াতাড়ি চোখ মুছে পিছন ফিরে তাকায় সায়ান। নিজের মায়ের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়। প্রচন্ড আফসোস হয় সায়ানের। কেনো যে এই মহিলার পেটে জন্ম নিয়েছিলো সে। নিজের মতোই চরিত্রহীন আর অমানুষ বানিয়েছে তাকে। উফ! মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়৷ এসব আর নিতে পারছে না। সায়ান মাথাটা চেপে ধরে ধপ করেই ফ্লোরে বসে পরে। আরশি জলদি সায়ানের পাশে বসে বিচলিত কণ্ঠে বললো,
— “কি হয়েছে বাবা। মাথা যন্ত্রণা করছে? বল মাকে।”
সায়ান মাথা তুলে নিজের মায়ের দিকে তাকায়। খুব ঘৃণা হয় নিজের প্রতি। সাথে এই মহিলার প্রতি। কিন্তু সায়ান ঘৃণা করতে চায়না তাকে। হাজার হক তার মা। কোলেপিঠে নিয়ে মানুষ করেছে। না না অমানুষ বানিয়েছে। সায়ান মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
— “তুমি সবই জানতে তাইনা?”
— “কি জানতাম?” আরশি অবাক হয়ে বললো।
— “আমি আমার অনুভূতির সাথে অপরিচিত ছিলাম। কিন্তু তুমি ঠিক বুঝে গেছিলে আমি ধীরে ধীরে মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম সিনথিয়ার। তাই ছলে,বলে, কৌশলে আমার কান ভারি করেছো। আর সিনথিয়াকে আমার সামনে নিঁচু করেছো। এম আই রাইট?”
আরশি নজর নামিয়ে ফেললো। কোনো কিছু বলার মতো মুখ তার নেই। সায়ান আর্তনাদ করে বললো,
— “কেনো মা কেনো? কেনো আমাকে এরকম অমানুষ বানালে? কেনো আমাকে একটুও শাসন করলে না? কেনো আমাকে নৈতিকতা শিখালে না? কেনো তোমার মতো চরিত্রহীন বানালে?”
— “সায়ান!!”
— “এইজন্যই তুমি বাবাকে ছেড়েছিলে তাইনা? তোমার… ছিহ! আমার নিজের প্রতি খুব ঘৃণা হয়। ইচ্ছে করে নিজেকে শেষ করে দেই। ইশ যদি বাবা আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতো। যদি আমাকে তার সাথে রাখতো। হয়ত সৎমায়ের অত্যচার সহ্য করতে হতো। কিন্তু অন্তত তোমার মতো হতাম না আমি।”
সায়ান মেঝেতে লুটিয়ে পরে। আরশি সায়ানের মাথার কাছেই বসা। সে-ও অনুতপ্ত। অথবা নিজের কাজে লজ্জিত। জানা নেই। সেটা আরশি নিজেই ভালো জানে। সায়ান হঠাৎ মনে পরার ভঙ্গিতে বললো,
— “আচ্ছা মা আমার না এখনো একটা বিষয় বুঝে আসেনি। নাঈমকে শুধু বলেছিলাম পার্টিতে যেনো সিনথিয়াকে একটু ভয় দেখায়। ব্যস এতটুকুই। কিন্তু আমি কখনোই চাইনি নাঈম সিনথিয়ার কাছাকাছি আসুক। প্রথমদিন পার্টিতে নাঈম যখন সিনথিয়ার কোমড় চেপে ধরেছিলো আমি দেখেছিলাম। তাইতো তাড়াতাড়ি করে ডান্সফ্লোরে উঠে সিনথুকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়েছিলাম। তারপর তো সিনথিয়া-ই আর যায়নি পার্টিতে। তাহলে এরপরেই নাঈম কি করে আমাদের বাসার ছাদে এলো? সিনথিয়ার কাছাকাছি এলো? আর ছবিগুলো? নাঈম তো বাসা চিনতো না। আর কেউ যদি গলায় ছুরি ধরে বলে যে সিনথিয়া ঠিকানা দিয়েছে আমি কোনোদিন বিশ্বাস করবো না। আমি জানি সিনথিয়া কেমন। তাহলে সেদিন এতোবড় ঘটনা রটলো কিভাবে?”
সায়ান অবুঝের মতো নিজের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আরশি হাসফাস করছে। কি বলবে বা জবাব দিবে সে জানে না। কোন মুখে নিজে কৃতকর্মের কথা বলবে? সায়ান যেনো হঠাৎ করেই সব বুঝে গেলো। আঙুল তুলে সন্দেহের চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বললো,
— “ডোন্ট টেল মি, যে এসব তুমি করিয়েছো।”
— “(—)”
— “এসব তুমি করিয়েছিলে মা?”
— “(—)”
— “মা!!” সায়ান আর্তনাদ করে উঠে। “তুমি জানো তুমি কি করেছো? এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুমি আর মিম মিলে…। ওয়েট মিমও জড়িত ছিলো এসবে? রাইট? এইজন্য আমার সাথে ভাব জমিয়েছিলো। আর তুমিও আমাকে তাল দিয়েছিলে? ছিহ! আমি এতো নিচ? আমি কিছুই বুঝিনি। আমি তোমাদের এতবড় চাল ধরতে পারিনি। ছেড়ে দিয়েছিলাম মেয়েটাকে একা।”
সায়ান বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে আবার শুয়ে পরলো। নিজের হাত কামড়ে ধরে। পাগল পাগল লাগে নিজেকে। যতটা না কষ্ট হচ্ছে সিনথিয়াকে হারিয়ে। তারচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে নিজের মায়ের প্রতারণা বুঝতে পেরে। এই একজন মানুষকে সে নিজের বেস্টফ্রেন্ড ভাবতো। অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো। আর সে-ই কিনা এভাবে তাকে গর্তে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। সায়ান আবার উঠে বসে। আরশির দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো,
— “তারমানে বাবুটা আমার ছিলো? সিনথিয়ার গর্ভের বাচ্চাটা আমার ছিলো? মা কথা বলো প্লিজ।”
— “হ..হ্যাঁ।”
— “তাহলে কেনো বলেছিলে এটা আমার বাচ্চা ছিলো না? কেনো তোমরা দুইজন নারী মিলে আমাকে মিথ্যে প্রুফ দেখিয়েছিলে?” চিৎকার করে বললো সায়ান। “তুমি জানো এরপর আমি কি করেছি? এসব শোকে আমি অপ্সরাকে ধোঁকা দিয়েছি। ভুলভাল বুঝিয়ে ওকে বিয়ে করেছি। আর.. আর ওর বাবুটাকেও কষ্ট দিয়েছি।”
সায়ান হঠাৎ করেই হেসে উঠলো। আরশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে ভয় পেলো। কেমন করে যেনো হাসছে। পাগলের মতো করছে। সায়ান নিজের হাতে কামড়ে ধরে। এতোটাই জোরে ধরেছে যে রক্ত পরতে শুরু করে। আরশি ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। সায়ান ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “দুই-দুইজন নারীর সাথে অন্যায় করেছি। শুধু অন্যায় নয়। মহা অন্যায় করেছি। তাই আল্লাহ আমার থেকে বাবা হওয়ার তাওফিক ছিনিয়ে নিয়েছেন। আমি আর কোনোদিন বাবা হতে পারবো না। খুশি তুমি? জেনিফার এখন অন্য জায়গায় রিলেশন চলছে। খুব শীঘ্রই সে ওই লোকের কাছে চলে যাবে। সাথে এই পাপের সাম্রাজ্য নিয়ে যাবে। সব ওর নামে করিয়ে নিয়েছে। তুমি আমি এরপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো। ভিক্ষা করবো। হেহে ভিক্ষা করবো। মজা হবে তাইনা? কেমন লাগবে আমাকে দেখতে বলো তো? ছিঁড়া, ময়লা কাপড় গায়ে থাকবে। হাতে একটা থালা থাকবে তাইনা? আর..আর কি থাকবে…?”
সায়ানের এলোমেলো আর অদ্ভুত ব্যবহার দেখে আরশি অবাক না হয়ে পারলো না। দু-চোখ ভরে এলো তার। শেষ পর্যন্ত ছেলেটা মানসিক ভাবে অসুস্থ হতে শুরু করলো। কেমন করে প্রলাপ বকছে, হাসছে। আজ মনে হচ্ছে সেই প্রবাদটা ঠিকই আছে তার জন্য। ‘বাবা-মায়ের পাপের শাস্তি মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েকে-ও বইতে হয়।’ আজ তার পাপের শাস্তি পাচ্ছে সায়ান। সব হারিয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পরেছে। সায়ান হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে মেঝেতে শুয়ে বললো,
— “তুমি জানো না আমার কত ক্ষতি করেছো। তুমি জানো না সেদিন আমার কেমন লেগেছিলো। তুমি কিচ্ছু জানো না। তুমি আমার হৃদয়ের আকুতি কখনো বুঝোনি। তুমি কিচ্ছু…..।”
সায়ান হু হু করে কেঁদে উঠে। দুইহাতে মুখ ঢেকে ফেলে। আরশি বুঝতে পারেনা এসব কথা সায়ান কাকে বলছে। কোনদিনের কথা বলছে? কিসের কথা বলছে? আরশি বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পায়না। সায়ান হয়ত ঘুমিয়ে গেছে। নাকি অচেতন হয়ে গেছে বুঝা যাচ্ছে না। নিচ থেকে জেনিফার চেচিয়ে ডাকলো আরশিকে। আঁতকে উঠে আরশি। কফি চেয়েছিলো জেনিফার। সে সায়ানকে দেখতে এসে এখানেই বসে আছে জানলে আজ আর রক্ষে হবে না তার। আরশি তাড়াতাড়ি উঠে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। দ্রুত নিচে নামে। জেনিফার যা তা ব্যবহার করে চলে গেলো। আরশি ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে জেনিফার চলে যাওয়ার দিকে।
প্রকৃতি কখনো কাউকে ছাড় দেয়না। প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ে। এই যেনো পুরাবৃত্তি হচ্ছে একই ঘটনা বারবার। আগে ছিলো দুই অবলা নারী। যারা কখনো প্রতিবাদ করতে পারেনি আরশির। আর আজ সেই জায়গায় নিজে এসে দাঁড়িয়েছে আরশি। এ যেনো কঠিন প্রতিশোধ নিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। ‘নিশ্চয়ই তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী।’
________________________________
আনন্দের জোয়ার বইছে হাদিম এবং রিহার জীবনে। সেই সাথে পুরো বাড়িতে। মিম একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের আনন্দ উৎসব দেখছে। আর নিজের কৃতকর্মের জন্য আফসোস হচ্ছে। রিহা আজই জানতে পেরেছে সে দুই মাসের গর্ভবতী। হামিদকে জানাতেই কোলে নিয়ে নাঁচতে শুরু করেছে। মিষ্টি এনে ভরিয়ে দিয়েছে। রিহা হামিদের বুকে মুখ লুকিয়েছে লজ্জায়।
মিম পিলারের আড়াল থেকেই সেসব দেখে চলেছে। অজান্তেই হাতটা নিজের পেটে চলে গেছে। একবার নয় দুইবার নয়, চার চারবার বাচ্চা নষ্ট করেছে সে। কারণ তার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে বাচ্চা হলে তাই। অথচ আজ মনে হচ্ছে এই বাচ্চাগুলো দুনিয়ায় আসলে তার আর হামিদের জীবনে আনন্দের জোয়ার বইতো। মিম মুখ চেপে কেঁদে উঠে। এখন তো সে চাইলেই পারবে না মা ডাক শুনতে। আজ বুকটা হাহাকার করছে একবার মা ডাক শুনতে। সাথে মানুষটার ভালোবাসা পেতে। রিহার মতোই লজ্জায় মুখ লুকাতে ইচ্ছা করছে প্রিয়তমের বুকে। হায় আফসোস! আজ সবকিছু নিজের কৃতকর্মের কারণেই শেষ হয়ে গেছে। নিজের হাতেই নিজের সংসার ভেঙেছে। সুখ ছিনিয়েছে।
— “মিম এদিকে আসো।”
হামিদের ডাকে মিম নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। একটু খুশি হয়েছে কারণ এতোদিন পর আজ হামিদ ভালোভাবে তাকে ডেকেছে। মিম সেদিকে যেতেই দেখলো রিহা হামিদের কোলে শুয়ে আছে। বুকটা আবার ভার হয়ে আসে। কিন্তু আজতো কিছুই তার হাতে নেই। হামিদ রিহার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,
— “ব্যাগপত্র গোছাও। তোমাকে তোমার বাবার বাড়ি দিয়ে আসবো।”
মিম ভীষণ অবাক হলো। সেই সাথে ভয় হচ্ছে। হামিদ কি তাকে ছেড়ে দিবে? তাছাড়া বাবার বাড়ি গেলে একদন্ড-ও শান্তি পাবে না সে। ভাইয়ের বউরা যা-তা বলে অপমান করবে। তারচেয়ে এখানেই থাকা ভালো। কিন্তু আজ কেনো চলে যেতে বলছে? মিম অস্পষ্ট ভাবে বললো,
— “কে..কেনো?”
— “কারণ আমি কোনো খুনিকে আমার বাড়িতে রাখতে চাইছি না। আমার নিজের সন্তান আসতে চলেছে দুনিয়ায়। বলা যায়না, কখন তুমি আমার সন্তানকে খুন করে ফেলো। তারচেয়ে ভালো তুমি বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে।”
— “আমি এমন কিছুই করবো না। প্লিজ আমাকে বের করে দিও না।”
— “চারটা সন্তানকে খুন করেছো তুমি। সাথে আমার বোনের সন্তানকেও খুন করেছো। একটুও খারাপ লাগে না তোমার? অনুতপ্ত হও তুমি? ছিহ! কিভাবে পারলে নিজের সন্তানদের খুন করতে? কেমন নারী তুমি?”
হামিদ জানতো না এসব। মিম তার বাচ্চাদের খুন করেছে সেটা রিহার কাছ থেকেই শুনেছে। রিহাই একদিন কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করার সময় মিমের মেডিকেল রিপোর্ট গুলো পেয়েছিলো। তারপর হামিদকে জানিয়েছে৷ মিম মাথা নিচু করেই কেঁদে চলেছে। কিছুই বলার নেই আজ। প্রতিনিয়ত নিজের কৃতকর্মের কারণে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হচ্ছে সে। আর সাহস নেই কারো ক্ষতি করার। হামিদ কিছুটা ধমক দিয়েই বললো,
— “এসব ন্যাকা কান্না বাদ দিয়ে যাও ব্যাগ গোছাও।”
মিম চলে যাচ্ছিলো। হামিদ কি যেনো ভাবলো। তারপর মুখে কুটিল হাসি ফুটিয়ে বললো,
— “ওয়েট কোথাও যাওয়ার দরকার নেই তোমার। এখানেই থাকো। এখানে থেকেই শাস্তি পাও। দগ্ধ হও। নিজের চোখের সামনে নিজের সতীনের ভালোবাসা দেখো। এটারই যোগ্য তুমি।”
— “আচ্ছা শান্ত হও। এভাবে চেচামেচি করো না তো। ভালো লাগছে না।” রিহা বললো।
হামিদ হালকা হেসে রিহাকে জড়িয়ে ধরলো। রিহা আড়চোখে তাকালো মিমের দিকে। এই মুহুর্তে মিমের হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে সেটা বেশ ভালোই বুঝলো রিহা। হামিদ রিহার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে বললো,
— “তোমার এখন নিজেরকেয়ার করা উচিত। আমি আজকে আরো দুইজন মেইড রাখবো।”
— “আরো মেইডের তো দরকার নেই।”
— “দরকার আছে। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না এই নারীকে যে আমার চারটা সন্তানকে খুন করেছে। বলা তো যায়না কখন হিংসার বশবর্তী হয়ে আমাদের সন্তানকে আবার খুন করে দেয়। তাই আরো দুইজন মেইড রাখবো।”
— “ঠিকাছে।”
রিহা হালকা হাসলো। মিম সেখান থেকে চলে গেলো। আর নিতে পারছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হামিদ রিহাকে কোলে তুলে বেডরুমের দিকে হাটা দিলো।
আনন্দের জোয়ার বইছে দুইজনের মাঝে। অথচ তারা জানেই না তাদের সন্তানটা অবৈধ সন্তান। তাদের বিয়েটাই বৈধ হয়নি। শুধু হামিদ এবং রিহা নয়। এই সমাজে আরো বহু হামিদ এবং রিহা আছে যারা এভাবেই নিজের সংসার গড়ে। অথচ তাদের সম্পর্কটাই অবৈধ।
____________________________
জাভেদদের গেইটের সামনে এসে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সিনথিয়ার বাবা আরশ। বুঝতে পারছে না কি করবে৷ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এতদূর এসে এখন ফলাফল শূন্য হবে ভাবতেই পারেনি।
গেইটে বড় একটা তালা ঝুলছে। আরশ এদিক সেদিক তাকালো। তারা কি এখান থেকে চলে গেছে নাকি সেটাই বুঝতে পারছে না৷ অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আর কোনো উপায় না পেয়ে পাশের বাড়িতে গিয়ে খোজ করলো। তারা জানালো বউ এবং ছেলে দুইজনে ঘুড়তে গেছে। আর জাভেদের মা এবং বোন একটু আগেই বেরিয়েছে।
সব শুনে হতাশ হলো আরশ। ভেবেছিলো আজ মেয়েটার সাথে দেখা হলে নিজের সাথে নিয়ে যাবে৷ কত কি ভেবে রেহেছিলো অথচ সব শূন্য। ওদিকে আসমা নিশ্চয়ই আশা নিয়ে বসে আছে। যখন বলবে মেয়েটাকে পায়নি হয়ত আবার কান্না শুরু করবে৷ কেঁদে কেঁদে নিজের অবস্থা আরো খারাপ করে ফেলেছে আসমা। মেয়ের শোকে শরীর দিনদিন আরো খারাপ হয়ে এসেছে। আরশ নিজে যে কষ্ট পাচ্ছে না তা না৷ সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। একমাত্র মেয়েকে বিনা কারণে কত মারধর করেছে। সেসব মনে পরলেই বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়। আজ-ও হতাশ হয়ে ফিরতে হলো বাড়িতে।
চলবে,,
® ‘নুরুন নাহার’
#মেঘমালার_গল্পকথা_নুরুন_নাহার
চলবে,,
® ‘নুরুন নাহার’
#মেঘমালার_গল্পকথা_নুরুন_নাহার