“তুমি কেন আগে আসোনি?”
৪.
যোহরের সুন্নাহ সালাতের দ্বিতীয় রাকাআতের সিজদায় থাকা অবস্থায় নিচ থেকে সিনথিয়াকে ডাক দিলো ওর শ্বাশুড়ি। বেশ কয়েকবার ডেকে হিসহিসিয়ে আরশি তার ফুফু শ্বাশুড়িকে বললো,
— “কি এমন রাজ কর্ম করতেছে কে জানে? এতো ডাকি তারপরেও জবাব দিচ্ছে না। আমাকে ওর চোখে মানুষ মনে হয়না? সেই আধা ঘন্টা আগে উপরে উঠেছে এখনো নামছে না।” একটু চিল্লিয়ে বললো, “আজকে কি গরম পানি পাবো না? গসলের সময় পার হচ্ছে আমার।”
আরশির ফুফুশ্বাশুড়ি সালেহা বানু বললো,
— “আমাকে বলে গেলো নামাজ পড়তে যাচ্ছে।”
— “নামাজ পড়তে এতক্ষণ লাগে?”
— “কিজানি? নতুন নতুন হুজুরেরা আরো কতকিছু যে দেখাইবো।”
— “হু.. আল্লাহরে ডেকে নিচে নামিয়ে আনবে যেনো।”
সিনথিয়া দ্রুত সালাত শেষ করলো। ওদের সবকথাই শুনেছে ও। যখন সিজদা দিয়েছে চোখ থেকে অনবরত নোনাজল গড়িয়ে পরেছে। জায়নামাজ রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দরজার কাছে এসে থেমে গেলো। মুখ চেপে ঢুকরে কেঁদে উঠে। এখানে এসে এই দুইমাসে ঠিকমতো সালাত আদায় করতে পারেনি সিনথিয়া। সালাতের সময়ই যেনো কাজের চাপ বেড়ে যায়। সত্যিই কি বেড়ে যায় নাকি ইচ্ছে করেই ওর উপর কাজ চাপিয়ে দেয় সিনথিয়া কিছুতেই এইটা মিলাতে পারেনা। নিজেকে ঠিক করে দ্রুত নিচে নেমে এলো। আরশি ওকে দেখে বললো,
— “তুমি জানো না আমার গোসলের সময় গরম পানি লাগে? গরম পানি না দিয়ে উপরে গেছো কেনো?”
— “আম্মা গরম পানির তো আলাদা একটা লাইন আছে। তাই আমি ভেবেছি আপনি সেটা দিয়েই…।”
— “নিজে নিজে এতো বেশি ভাববা না। ফুফুরে ভাত দেও।”
— “জ্বী।”
সিনথিয়া রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। বিয়ের তৃতীয় দিন থেকেই এতোবড় বাড়িটা সিনথিয়াকেই সামলাতে হচ্ছে। মাঝেমাঝে হিমশিম খেয়ে যায় কিন্তু কিছু করার নেই। সাহায্যের কেউ নেই। টেবিলে খাবার পরিবেশন করে সিনথিয়া একপাশে দাড়ালো। সালেহা বানু টেবিলে বসে বললেন,
— “তুমি খাইবা না?”
— “না দাদি। আমি রোযা রেখেছি।”
— “কিয়ের রোযা?”
— “আইয়্যামে বীজের রোযা। আজ তো চাঁদের তেরো তারিখ।”
আরশি বাঁকা চোখে তাকালো। সিনথিয়া সালেহা বানুকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। সালেহা বানু খাবার চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
— “তুমি তো আধাঘন্টা আগেই উপরে গেছিলা এতো দেরি করলা কেন?”
— “আপনার নাতির শার্ট ধুতে গিয়ে দেড়ি হয়েছে। তারপর গোসল করে সালাত পড়েছি এইজন্য আরো সময় লেগেছে।”
— “হুনো বউ আমরাও আমাগো সময় কাম করছি। জামাইরেও সামলাইছি। নামাজ কালামও পড়ছি। কিন্তু এতো সময় লইয়া রুমে বইসা থাকি নাই। শার্ট একটা আর তোমার গোসল কইরা নামাজ পড়তে এতো সময় লাগলো?”
সিনথিয়া মিনমিনে স্বরে বললো,
— “এতো সময় কই দাদি? মাত্র আধাঘন্টাই তো।”
আরশি খানিকটা ক্ষেপে বললো,
— “আধাঘন্টা তোমার কাছে মাত্র অল্প সময় লাগে?”
— “সালাত একটু ধীরে পড়েছি তাই সময় লেগেছে।”
— “ক্যান ধীরে পড়ছো ক্যান? কাম করন লাগবো দেইক্ষা ধীরে ধীরে করছো তাইনা? নাকি শ্বাশুড়ির সেবা করন লাগবো দেইখা দেরি করছো?” সালেহা বানু খোঁচা মেরে বললো।
সিনথিয়ার চোখে পানি চিকচিক করে উঠলো। একটু থেকে একটু দেরি হলেই প্রতিদিন এরকম জেরা করা হয় ওকে। তারপর কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা। যা মনটা একদম বিষিয়ে দেয় সিনথিয়ার। কোনোরকমে দাদিকে বললো,
— “দাদি সালাতের সময় ধীরে ধীরে সালাত পড়তে বলা হয়েছে। যখন কেউ রুকুতে যায় তখন তার গুনাহ গুলো কাধ থেকে ঝুলে পরে আর যখন সিজদা করা হয় তখন গুনাহ গুলো মুছে যায়। তাই রুকু সিজদায় দেরি করতে বলা হয়েছে।”
— “এরলাইগা তুমি আধাঘন্টা লাগাইবা?”
— “দশমিনিটে সালাত শেষ করেছি। বাকি কাজ তো…।”
— “হইছে আর কৈফিয়ত দেওন লাগবো না। কৈফিয়ত দেওন শিখছো দেহি এহন।”
সিনথিয়া চুপ করে রইলো। উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না। গরম পানি নিয়ে আরশির রুমের ওয়াশরুমে রেখে আসলো। ডাইনিং-এর সব কাজ শেষ করে বিকেলের নাস্তার জন্য আয়োজন শুরু করেছে। আজকে দুপুরে একটু ঘুমাতে চেয়েছিলো কিন্তু তা আর হলো না। একটু আগে সায়ান ফোন করে ওর মাকে জানিয়েছে বাসায় মেহমান আসবে। সিনথিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজ শুরু করেছে। আজ না জানি আবার কোন তামাশা হবে ওকে নিয়ে। সায়ানের কথা ভেবে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো সিনথিয়া। সায়ানকে কেমন যেনো ও বুঝে উঠতে পারেনা। খুব রহস্যময় লাগে ওর প্রতিটা কাজ, কথাবার্তা।
___________________________
সব কাজ শেষ করে মাগরিবের সালাতের পর ফ্যানের নিচে বসলো সিনথিয়া। শরীরটা খুব ক্লান্ত হয়ে আছে। সকাল পাঁচটা থেকে শুরু হয় সারাদিনে একটু বিশ্রামের সুযোগ পায়না। একেবারে রাতের দিকে। তাও সায়ানের অত্যাচারের শেষ নেই। এদের সবার জন্য প্রতিদিন আলাদা আলাদা আইটেম রাঁধতে হয়। নাহলে নাকি চলে না। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললো সিনথিয়া।
চুল খোপা করে হিজাবটা মাথায় চড়াতেই সায়ান এসে রুমে ঢুকলো। সিনথিয়া এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। ওর খুব ইচ্ছে ছিলো স্বামীকে ভালোবাসবে। কিন্তু সায়ানের আচরণের কারণে ওকে ভালোবাসা তো দূর ভালালাগার জায়গাতেও বসাতে পারেনা। সায়ানের তাওয়াল এগিয়ে দিতেই তাওয়াল সহ সিনথিয়ার হাত ধরে টান দিলো। সিনথিয়া এসেই সায়ানের বুকে পরেছে। কিছুই বললো না সিনথিয়া। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সায়ান একটু হেসে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
ব্লাক জিন্স এর সাথে ব্লাক টিশার্ট উপরে ব্লাক জ্যাকেট পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পারফিউম মারছে সায়ান। আড়চোখে সিনথিয়াকে দেখছে। একমনে কাপড় ভাজ করে চলেছে। সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো সায়ান। মোবাইল উঠিয়ে কাউকে মেসেজ করে আবার সিনথিয়ার দিকে তাকালো। সিনথিয়াকে হঠাৎ আক্রমণ করলে তখন ও যেই রিয়েকশন দেয় সেটা সায়ানের ভিষণ ভালো লাগে।
একটু পরেই একটা মেয়ে এসে ঢুকলো রুমে। সিনথিয়া মেয়েটাকে দেখে খুব অবাক হলো। এরকম না বলেই কারো বেডরুমে ঢুকে পরাটা ব্যাড ম্যানার্স। সিনথিয়া এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বললো,
— “আপনি কে আপু? কাউকে খুজচ্ছেন?”
— “হেই ডোন্ট কল মি আপু ওকে? কল মি লিজা। আমি সায়ানের কাছে এসেছি। কোথায় ও?”
সায়ান বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিনথিয়াকে দেখছে। সিনথিয়া খুব অবাক হলো। সিনথিয়া কিছু বলবে তার আগেই লিজা বললো,
— “বাই দা ওয়ে, তুমি কে? আগে তো দেখিনি এখানে। সায়ানের মেইড নাকি?”
— “আমি…আ..।”
সিনথিয়া কি বলবে ভেবে পেলো না। সায়ান সিনথিয়াকে বিভ্রান্ত দেখে মজা পেলো। কিছুক্ষণ নিজে নিজে হেসে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো। সায়ানকে দেখে লিজা দৌড়ে গিয়ে একহাত জড়িয়ে ধরে বললো,
— “বেবি কোথায় ছিলে তুমি? আমি তোমাকেই খুজচ্ছিলাম।”
— “এইতো আশেপাশেই ছিলাম।”
সিনথিয়া এবার খুব বেশিই অবাক হলো। সায়ান কিভাবে পারলো একটা মেয়েকে এভাবে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে। একটুও খারাপ লাগছে না? স্ত্রীর সামনে এভাবে অন্য মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে একটুও কি বাঁধছে না? সিনথিয়ার চোখের কোণে পানি জমলো। সায়ান সেটা দেখে একটু মুচকি হাসলো। সায়ান লিজাকে বললো,
— “আচ্ছা বাকিরা এসেছে?”
— “হ্যাঁ সবাই এসেছে। চলো আমরা যাই।”
— “আচ্ছা তুমি যাও। আমি একটু পর আসছি।”
— “না তুমি আমার সাথেই যাবে।”
— “আচ্ছা পাঁচ মিনিট দাও আমাকে। পাঁচ মিনিটে না এলে তুমি আবার এসো।”
— “ওকে বাই।”
লিজা চলে যেতেই সিনথিয়া সায়ানের দিকে তাকালো। সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
— “কিছু বলবে?”
— “মেয়েটা কে?”
— “আমার কাজিন। এতোদিন লন্ডন ছিলো। কালই এসেছে দেশে। তাইতো আজ পার্টি দিয়েছি।”
— “সেসব নাহয় বুঝলাম। কিন্তু ও আপনার হাত এভাবে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো কেনো? আপনিও কিছু বললেন না।”
— “লন্ডনের কালচার এমন তাই।”
— “তাই বলে আপনিও ধরবেন? আপনি জানেন না এসব হারাম। এগুলো জিনা। কাজিনদের সাথেও পর্দা করতে বলা হয়েছে আর আপ….।”
— “আমি কি?” সিনথিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো সায়ান।”
— “কি..কিছুনা।”
— “রেডি হয়ে নাও। আমরা আজ একসাথ পার্টি ইনজয় করবো।”
সিনথিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। এতোক্ষণ কাকে কি বলছিলো আর এখন সে কি বলছে। সিনথিয়া আবার বললো,
— “দেখুন এসব ফ্রিমিক্সিং পার্টি এগুলো হারাম। এগুলো বিজাতীয়দের কালচার। আপনি তো মুসলিম ফ্যামিলির ছেলে। তাহলে কেনো বিজাতীয়দের কালচার পালন করবেন। তারা তো আমাদের দুই ঈদে কোনো ধরনের আয়োজন করে না।”
— “উফ! সিনথু সিনথু রিল্যাক্স। তুমি সবসময় একটু বেশি সিরিয়াস হয়ে যাও। সবকিছুতে ধর্ম চলে না বেবি। একটু তো ফ্রি হও। প্লিজ চলো আমার সাথে। তুমি গেলেই বুঝবে সেখানে কত মজা হয়। প্লিজ আজ আমার জন্য চলো।”
সিনথিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। গত দুইমাস ধরেই সিনথিয়া, আরশি সবাইকে বুঝিয়ে আসছে কিন্তু ওরা বুঝতেই চায়না। কিছু বললেই সব এড়িয়ে যায় নয়তো উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলবে। সিনথিয়াকে চুপ থেকে সায়ান বললো,
— “যাবে আমার সাথে? না করো না প্লিজ। তোমার জন্য একটা ব্লাক গাউন এনেছি।”
— “আমি চাইনা আপনি দাইয়ুস হন। তাই আমি বেপর্দা হয়ে কোথাও যাবো না। প্লিজ আপনিও যাবেন না।”
— “আবার শুরু করে দিলে তুমি। এখন বলো যাবে কিনা?”
সিনথিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— “না। আমি এসব জায়গায় কিছুতেই যাবো না।”
— “ওকে দ্যান থাকো তুমি।”
এরমধ্যেই লিজা এসে আবার উপস্থিত হলো। লিজাকে দেখে সায়ান একটু সরে দাড়ালো। সিনথিয়াও অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। লিজা সায়ানের কাধে হাত রেখে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
— “সায়ান বেবি এই মেয়েটা কে?”
সায়ান লিজাকে ছেড়ে সিনথিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো,
— “আমার ওয়াইফ।”
লিজা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো,
— “এই তুমি বিয়ে করেছো? কখন? আমাকে জানাও নি কেন?”
— “এইতো দুইমাস আগে। তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য বলিনি।”
— “হাহ! বেশ সারপ্রাইজড হয়েছি।”
সায়ান হাসলো। সিনথিয়ার বিরক্ত লাগছে এসব। সিনথিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো সায়ান থেকে। লিজা বললো,
— “আমি ভেবেছি তোমার বউ আরো সুন্দর এবং স্মার্ট হবে। বাট…।”
— “তোমার চোখে আমার বউয়ের সৌন্দর্য ধরা পরছে না লিজা? সিনথিয়া খুব রূপবতী। তাইতো প্রথম দেখাতেই ঘায়েল হয়েছি।”
— “হয়েছে চাপা বন্ধ করো। পার্টিতে চলো। সবাই অপেক্ষা করছে।”
লিজা সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার সায়ানের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে বললো,
— “তোমার বউ কি এরকম খালাম্মা সেজে যাবে?”
কথাটা বলেই মুখ টিপে হাসলো লিজা। সিনথিয়া মাথা নিচু করে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললো। এমন সময় আরশি আসলো রুমে। লিজাকে দেখে বললো,
— “এমা লিজা তুই? কতদিন পর দেখা। এসেছিস ভালো হয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি।”
— “তবে আমি খুশি না। সায়ান বিয়ে করে নিলো আর আমি জানিই না। দিস ইজ নট ফেয়ার ফুপি।”
— “আরে বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি হয়েছে তাই বেশি কাউকে জানানোর সুযোগ পাইনি। এখন চল দেরি হচ্ছে তো।” সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “কিরে চল।”
সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “তোমাকে কি আলাদা করে বলতে হবে নাকি?”
— “আম..আমি যাবো না আম্মা।”
— “কেন যাবে না?”
— “আস..লে..।”
সিনথিয়া এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সায়ানটাও কিছু বলছে না। সবসময় ওকে এরকম পরিস্থিতিতে একা ছেড়ে মজা নেয়। সিনথিয়ার খুব খারাপ লাগে কিন্তু মুখে কাউকে কিছু বলতে পারেনা। আরশি কটমট করে তাকিয়ে বললো,
— “আবার শুরু হয়েছে তোমার মোল্লাগিরি তাইনা? এই তুমি এসব করে কি পাও বলো তো? শুধু তুমিই ধর্ম মানো আমরা মানিনা বুঝাতে চাও? তুমি একাই সব মেনে উলটে ফেলছো তাইনা? গোয়ার কোথাকার। এরকম ক্ষেত হয়ে চলতে কি এমন ভালো লাগে বুঝি না বাপু। লিজাকে একটু দেখো। নিজেকে একটু আপডেট করতে পারো না? কতদিন বলেছি তোমার এসব মোল্লাগিরি এখনের যুগে চলে না। আগে এসব চলতো এখন এগুলো জাস্ট মুখে মুখেই মানায়। তোমার জন্য আর কতযে আমাকে অসম্মানিত হতে হবে বলা যায়না। যত্তসব ঢং!”
— “ফুপি কোনো সমস্যা নাকি?”
— “আরে আয়। যেতে যেতে বলছি।”
— “হুম চলো। সায়ান বেবি তুমিও চলো।”
ওরা বেরিয়ে যেতেই সায়ান সিনথিয়ার মুখটা উঁচু করে ধরে বললো,
— “এভাবে ইগনোর করো না আমাকে। তোমার এই ইগনোর বেশ লাগে আমার।”
সিনথিয়া মুখ ঘুড়িয়ে নিলো। সায়ান জোর করেই সিনথিয়ার অধর আকড়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বেরিয়ে গেলো। সিনথিয়া এভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। কিন্তু কিছু তো করার নেই। তবে সায়ানের হাসিটা বেশ রহস্যময় মনে হলো।
_____________________________
খাবার টেবিলে সবাই বসেছে ডিনারের জন্য। সেইদিনের ঘটনার তিন মাস পার হয়েছে। আজও সায়ান এখনো আসেনি। ইদানীং বেশ দেরি করেই বাসায় ফিরে। আর কেমন যেনো একটা অদ্ভুত আচরণ করে। সিনথিয়া বুঝতে পারেনা কিছুই কেনো সায়ান এমন করে। একটু পরেই বেল বাজলো। সিনথিয়া তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই দেখলো সায়ান দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে হাসলো। সিনথিয়া ভয়ে কেঁপে উঠে। আজ না জানি কি হবে ওর সাথে। না জানি আজ সায়ান কতটা হিংস্র হবে। একটা ঢোক গিললো গোপনে। এই হাসিটাকে বেশ ভয় পায় সিনথিয়া।
সায়ান বসার পর সবাই খাওয়া শুরু করলো। সিনথিয়া একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে। সবাই বলতে সায়ান, আরশি, সালেহা বানু আর সিনথিয়া। খাবার খাওয়ার মাঝেই সায়ান ওর মাকে জিজ্ঞেস করলো,
— “কাল রাতে কিচেনের দরজা লক ছিলো নাকি মম?”
— “হ্যাঁ। আমিই লক করে রেখেছি।”
— “বাট হোয়াই?”
— “এই বাড়িতে একটা রুলস আছে। সবসময় সবাই সময় মতো খাবে। এটা কোনো হোটেল নয় যে যার যখন ইচ্ছে তখন এসেই ভিখারির মতো খাওয়া শুরু করবে। আজ থেকে দশটার দিকেই কিচেনের দরজা লক করে দেয়া হবে।”
সায়ান আড়চোখে সিনথিয়ার দিকে তাকালো। ওর মুখটা মলিন হয়ে গেছে। আরশি কথাটা যে সিনথিয়াকে বুঝিয়ে বলেছে সেটা সিনথিয়া বেশ বুঝলো। প্রতিদিন উঠে না সিনথিয়া। যেদিন রোযা রাখে সেদিনই সাহরি করতে উঠে। তাই আরশি আজ ওকে ভিখারি বললো। আরশি বললো,
— “কিন্তু তুই রাতে কেনো উঠেছিলি?”
— “পানি খেতে। রুমে পানি ছিলো না তাই কিচেনে এসেছিলাম। বাট দেখলাম কিচেন লক।”
আরশি সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “তোমার মনোযোগ কোথায় থাকে বলো তো? সারাদিনে তো এক হাড়ি গিলো। তারপরেও কিভাবে ভুলে গেলে রুমে পানি ছিলো না। কেনো খেয়াল রাখলে না? তোমার বেখেয়ালির জন্য আমার ছেলের রাতের বেলা নিচে নামতে হয়েছে। সারাদিন তো তেমন একটা কাজই করো না। গর্তের ভেতরে ঢুকলে আর বের হতে ইচ্ছে করে না তাইনা? যত্তসব গেঁয়ো ভূত। খাওয়া শেষে রুমে পানি আছে নাকি চেক করে নিবে। বুঝেছো?”
— “জ্বী!”
এতো এতো মধুর কথা শুনে সিনথিয়ার খাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেলো। সব কাজ শেষ করে অল্প করে খেয়ে নিলো। রুমে এসে চেক করলো পানি আছে নাকি। মগে পানি ভরে নিয়ে এলো। ইদানীং সিনথিয়া খেয়াল করেছে দুপুরে সব কাজ শেষ করে খেতে গেলে পাতিলে তেমন একটা ভাত থাকে না। রান্না করার সময় বেশিই করেই রান্না করে কিন্তু খেতে গেলে ভাত থাকেনা কেনো এটা সিনথিয়া বুঝতে পারছে না। বাড়িতে তো আরশি আর সালেহা বানু ছাড়া আর কেউ নেই তাহলে কিভাবে পাতিলের ভাত গায়েব হয় এই বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে সিনথিয়াকে। দুপুরে যে কয়টা ভাত থাকে সেগুলো খেলে পেট ভরে না। ইচ্ছে করে আরো একমুঠ ভাত খেতে। কিন্তু…। অন্যকিছু খেতে গেলে সেটাও আরশিকে বলে খেতে হয়। নাহলে তুমুল ঝড় চলে ঘরে।
সিনথিয়া পানির নিয়ে রুমে এলো। রুমে এসে দেখলো সায়ানের ফোন বাজচ্ছে। পানির মগ রেখে রুমের আশেপাশে চোখ বুলালো। সায়ানকে পেলো না। ওয়াসরুম থেকে পানির শব্দ আসতেই বুঝলো সায়ান ওয়াশরুমে। মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাতেই সিনথিয়ার বুকটা ধক করে উঠে। মোবাইলের স্ক্রিনে ‘Baby’ লিখা। সিনথিয়া মোবাইল হাতে নিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো,
— “উফ জান এতো লেট করো কেন বলোতো? ভালো লাগে না এতো লেইট করে রিসিভ করলে। আচ্ছা কি করছিলে? নিশ্চয়ই তোমার ওই অশিক্ষিত গাইয়া বউ-এর থেকে মজা নিচ্ছিলে তাইনা? সত্যিই মেয়েটা বেশ হট। জান…।”
সিনথিয়া তাড়াতাড়ি ফোন কেটে মোবাইল জায়গা মতো রেখে দিলো। খুব কষ্ট লাগছে। সায়ান পরকিয়ায় জড়িয়েছে ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সায়ানের সামনে। কিন্তু চোখের কোণে পানি জমে উঠছে। সায়ান ওর সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ফু দিলো। সিনথিয়া কেঁপে উঠে। সায়ান বিছানায় গড়িয়ে পরে। সিনথিয়া আজ সায়ানকে কিছুই বললো না। ওর সব অত্যাচার মেনে নিলো।
.
মাঝ রাত। সিনথিয়া উঠে বসে। সায়ানের পাশে ফোনটা নিয়ে পাওয়ার বাটন ওন করতেই লক করা দেখালো। আস্তে করে সায়ানের হাত ধরে আঙুলের ছাপ নিয়ে লক খুলে ফেললো। সায়ান এখন গভীর ঘুমে।
সিনথিয়া উঠে বারান্দায় চলে গেলো। প্রথমে গেলো হোয়াটসঅ্যাপে। সেখানে লিজার সাথে অনেক লুতুপুতু টাইপ চ্যাটিং আছে। কিছু মেসেজ পড়তেই সিনথিয়ার খুব কান্না পেলো। একজন নারী হয়ে কিভাবে আরেকজন নারীকে নিয়ে মজা করে? কিভাবে সংসার ভাঙতে পারে? সিনথিয়া হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বেরিয়ে গ্যালারিতে গেলো। সেখানের ছবিগুলো দেখেই সিনথিয়ার মাথায় যেনো বাজ পরলো। সায়ান আর লিজার বেশ ক্লোজ ছবি। লিজার অনেক আপত্তিকর ছবি। সিনথিয়া ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। স্বামী যতই খারাপ হোক তারপরেও বাইরের কোনো মেয়ের পাশে কোনো নারীই মানতে পারেনা।
সকালে সবাইকে নাস্তা দিলো সিনথিয়া। আজ একেবারেই নিরলসভাবে কাজ করছে ও। সায়ান খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছে ওর দিকে। ওকে এরকম দেখে একটু খটকা লাগছে। তাও চুপচাপ খেয়ে নিলো। সিনথিয়া সব গুছিয়ে রুমে এসেছে। সায়ানের অফিসের সব জিনিসপত্র ওকেই এগিয়ে দিতে হয়। নাহলে সায়ান খুব রেগে যায়। সবকিছু এগিয়ে দিয়ে সিনথিয়া বেরিয়ে আসতে চাইলেই সায়ান পথ আটকে দাঁড়ায়। ওকে ধরতে চাইলেই সিনথিয়া সরে যায়। সায়ান ভ্রু কুচকে বললো,
— “কি হয়েছে?”
— “কিছুনা।”
— “তাহলে এমন করছো কেনো?”
সিনথিয়া কিছু না বলে বেরিয়ে আসতে চেয়েও পারেনা। সায়ান ওর দুই বাহু চেপে ধরেছে। সিনথিয়া ছুটাছুটি করতে থাকে। সায়ান আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
— “কি হয়েছে? এমন করছো কেনো? নতুন নাগড় পেয়েছো নাকি?”
— “সবাইকে আপনার মতো ভাববেন না। আমি আপনার মতো না।”
— “আমার মতো না মানে?”
সায়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
— “আপনার মতো চরিত্রহীন নই আমি। ঘরে বউ রেখে অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক রাখতে আপনার লজ্জা করছে না।”
— “ওহ সব দেখে ফেলেছো তাহলে? আমার ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় আমার জাসুসি করছিলে? নট বেড। বাট লিজার সাথে আমার শারীরিক কোনো সম্পর্ক নেই। ওই একটু টাইমপাস আরকি।”
সিনথিয়া ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
— “নির্লজ্জ লোক। লজ্জা নেই আপনার। ছোবেন না আমায়। ঘৃণা হয় আপনার ছোয়ায়।”
— “তাই?”
সায়ানের হঠাৎ আক্রমণে সিনথিয়া আহত নয়নে সায়ানের দিকে তাকালো। সায়ান হাসলো। সিনথিয়া নিরবে চোখের পানি ফেলছে শুধু।
— “কেঁদে লাভ নেই।”
— “কেনো এমন করেন আপনি?” আহত স্বরে বললো সিনথিয়া।
— “কিজানি কেনো করি। মনে আসছে না।”
— “নিজের স্ত্রীর ছবি অন্য মেয়েকে দিয়ে মজা নিতে আপনার একটুও বাঁধলো না? আপনার কি একটুও মায়া হয়না আমার জন্য? কেনো এমন হিংস্র আচরণ করেন আমার সাথে?”
— “কারণ তো অনেক আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলবো?”
সিনথিয়া চুপ হয়ে গেলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। এতোটা চাপ আর নিতে পারছে না। এতোটা অমানবিক এই বাড়ির লোকজন। একটুও দয়ামায়া নেই এদের ভেতরে।
.
দুই সপ্তাহ পেরিয়েছে। এই দুই সপ্তাহে আরো অনেক কিছু ঘটে গেছে সিনথিয়ার জীবনে। রুমে বসে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলো ও। নিচ থেকে ওর বাবা ওকে হুংকার দিয়ে ডাকলো। সিনথিয়া ভয়ে আরো গুটিয়ে গেলো। আজ সায়ানের পরিবার বিচারসভা বসিয়েছে ওর জন্য।
সিনথিয়া উঠে দাড়ালো। চোখ মুখ মুছে হিজাব পরে নিচে নেমে এলো। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। আজ কি পরিমাণ অপদস্ত হতে হবে জানা নেই ওর।
চলনে,,,
® ‘নুরুন নাহার’