#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_নয়
-“আমি বিবাহিত নীলাভ্র ভাই। জানেন তো?”
ভাঙা কন্ঠে বললো বেলী। তীব্র যন্ত্রনা লুঁকিয়ে আছে কথাটার মাঝে। বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। নেত্রযুগলে অশ্রুকনা টলমল করছে। তৃষ্ণায় কন্ঠস্বর শুকিয়ে যাচ্ছে। অঙ্গে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। বেলীর প্রশ্নে নীলাভ্র হাসলো। স্নিগ্ধ সেই হাসি। ছেলেটা’কে হাসলে দারুন লাগে। সব সময় এত হাসে কেনো ছেলেটা? না হাসলে কি খুব ক্ষতি হয়? এই হাসি যে অনেকের হৃদ পিন্ড ছিদ্র করে দিবে সে খেয়াল কি তার আছে? নেই হয়তো? নীলাভ্র হেসে প্রশান্তির চোখে তাঁকালো বেলীর দিকে। বেলীর নেত্রযুগলে জমে থাকা অশ্রুকনা সযত্নে মুছে দিলো। আলতো টানে খোঁপা করা লম্বা কেশ ছেড়ে দিলো। ধমকা হাওয়ায় বেলীর লম্বা কেশ এলোমেলো ভাবে উড়তে লাগলো। এত লম্বা কেশ সামলায় কি করে মেয়েটা? ভাবতে পারলো না। ভাবনার মাঝেই বেলী অধৈর্য গলায় পুনরায় বললো,
“আমি বিবাহিত জানা স্বত্তেও আমাকে ভালোবাসেন কেনো?”
এইবার নীলাভ্র নড়ে চড়ে বসলো। মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো,
“বার বার বিবাহিত বিবাহিত করছিস কেনো? তুই বিবাহিত ছিলি এখন নেই।”
নীলাভ্র’র গম্ভীর কন্ঠস্বরে বেলী ভয় পেলো। হৃদপিন্ডে ধুপপুক শব্দ করছে। নয়ন জোড়া ভীতু দেখালো। কাঁতর স্বরে শুধালো,
” এখন বিবাহিত না তা ঠিক। কিন্তু আমি ডির্ভোসী।”
কথা’টার মাঝে আর্তনাদ ভেসে আসলো নীলাভ্র’র কানে। নীলাভ্র শান্ত দৃষ্টিতে নদীর উথাল-পাতাল ঢেউগুলোর দিকে চেয়ে আছে। বাতাসের ঝাপটায় চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বেলী পলকহীন ভাবে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে৷ বললো,
“আপনার সাথে আমার যায়না নীলাভ্র ভাই।”
এবার নীলাভ্র কপাল কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। অবাক স্বরে বললো,
“আমার সাথে তোর যায় আমি কখন বললাম?”
বেলী ঢোক গিললো। বললো,
“তাহলে ভালোবাসেন কেনো? ”
নীলাভ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। এই হাসির মাঝে চাপা কষ্ট আছে। স্পষ্ট ভাষায় বললো,
“ভালোবাসা খারাপ, বাজে, বিদঘুটে অনুভূতি দ্বারা গঠিত। এই অনুভূতি ভেঙে চূড়ে ফেলে দেওয়া যায় না, আবার মুছে ফেলাও যায়না।”
এইটুকু বলে খানিক থামলো। বললো,
“ভালোবাসার মতো ভয়ংকর অসুখ আর হয় না রে বেলীপ্রিয়া। আর আমি সেই ভয়ংকর অসুখে আক্রান্ত। আর আমার ঔষুধ হলো ‘তুই’। ”
বলে দুই হাতে উড়ন্ত চুল গুলো ঠিক করতে লাগলো। বেলী নিশ্চুপ, বাকরুদ্ধ। উত্তর দেওয়ার ভাষা পেলো না। দুজনের মাঝেই পিনপতন নিরবতা চললো কিছুক্ষণ। বাতাসে শনশন শব্দ হচ্ছে। নদীর বুকে কয়েকটা নৌকা ভাসছে। আকাশের বুকে নীল, সাদা মেঘের আনাগোনা। যতদূর চোখ যায়, ততদূর অব্দি খালি নদীর বিশালতা। এপার-ওপার কূল-কিনারা নেই। বেলীর চোখের থেকে পানি টুপটাপ করে পড়ছে। আর বেলী অনবরত মুছে যাচ্ছে। অবাধ্য চোখের জল কিছুতেই থামছে না। সেদিকে লক্ষ্য করে নিরবতা ভেঙে নীলাভ্র বলে উঠলো,
“ছোট্ট একটা কথা বলি?”
নীলাভ্রর কথায় বেলী, শান্ত কন্ঠেই বললো,
“পারমিশন নেওয়া শুরু করেছেন বুঝি আজকাল।”
বলে আড়চোখে তাকালো নীলাভ্রর মুখপানে। নীলাভ্র হাসলো, বললো,
“পরিস্থিতি বা অন্য কারোর জন্য কখনো নিজের স্বভাব চেঞ্জ করতে হয়না। ম্যাচুরিটি ভালো, তবে এতটাও ভালো নয়। যেখানে, মানুষ হাসতে ভুলে যায়, কাঁদতে ভুলে যায়, কথা বলতে ভুলে যায়। কিছু সময় নিজের অজান্তে করা পাগলামি, বকবকানি সুন্দর। ”
নীলাভ্রর কথা শুনে, বেলী আনমনেই জবাব দিল,
“অতীত বড় ভয়ংকর জানেন তো নীলাভ্র ভাই? না দেয় ভালো থাকতে, না দেয় বেঁচে থাকতে। শুধু দেয় তিক্ত যন্ত্রণা।”
বেলীর কথার মানে নীলাভ্র বুঝলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বললো,
” অতীত হলো ব*ন্দুকের গু*লির মতো, গু*লি একবার বের হয়ে গেলে যেমন আর ফেরানো সম্ভব না। তেমনি, অতীতকেও আর ফেরানো বা পরিবর্তন করা সম্ভব না। তাই অতীতের জন্য বর্তমান নষ্ট করা নিছকেই বোকামি। বুঝলি?”
বলে ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাতটা দিয়ে বেলীর চুল গুলো এলোমেলো করে দিলো। এই মুহূর্তে বেলীর একটা আশ্রয় দরকার। একটা বিশ্বস্ত হাত দরকার। কাঁদার জন্য একটা বুক দরকার। দেরি করলো না। হামলে পড়লো নীলাভ্রর বুকে। হুহু করে কান্না করে দিলো। আর নীলাভ্র যেনো ঘোরের মধ্যে আছে। বিশ্বাস করতে পারছে না? কি হতো যদি এইভাবেই মেয়েটা সারাজীবন ওকে আঁকড়ে ধরে রাখতো?
নীলাভ্র বেলীকে আকঁড়ে ধরলো না। কারন, ও বুঝতে পেরেছে বেলী সজ্ঞানে ওকে জড়িয়ে ধরেনি। তাই স্থির, জড় বস্তুর মতো বসে রইলো। প্রায় মিনিট পার হয়ে গেলো। নীলাভ্র আস্তে করে বলে উঠলো,
“বেলী তোর ভার্সিটির দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখন উঠতে হবে।”
নীলাভ্রর কথা শুনে বেলীর হাত দুটো নীলাভ্রর পিঠের থেকে আলগা হয়ে এলো। দূরে সরে গেলো নীলাভ্রর থেকে। নীলাভ্রকে এত শান্ত দেখে বেলীর ভেতরটা আরো পুড়ছে। নীলাভ্র কথা বাড়ালো না। উঠে দাঁড়ালো। ছোট করে বললো,
“চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
বেলী দুইহাতে চুল গুলো খোঁপা করে নিলো। শাড়ির আঁচল দিয়ে পুরো মুখটা মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“চলেন। আমি আর ভার্সিটি যাব না আজ।”
নীলাভ্র উত্তর দিলো না। হাঁটা শুরু করলো। বেলীর ভেতর থেকে চিৎকার করে কান্না আসছে। নীলাভ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,
“আমি আপনাকে ছাড়া ভালো নেই নীলাভ্র ভাই।”
হায়, আফসোস। কিছু কথা মনেই রয়ে যায়। ভাষা আকারে বেরিয়ে আসেনা। গাড়ির সামনে আসতেই বেলী আগের মতো ড্রাইভিং সিটে বসতেই, নীলাভ্র বাঁধা দিয়ে বললো,
“এখানে বসতে হবে না। আমি ড্রাইভিং করব।”
কথার পৃষ্ঠে বেলী বাঁধা দিতে গিয়েও থেমে গেলো। চুপচাপ গিয়ে পেছনের সিটে বসলো। নীলাভ্র কাটা হাত নিয়েই ড্রাইভিং করলো। সারারাস্তা দুজনেই চুপ ছিলো। ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামলো। বেলী শব্দ না করে নেমে গেলো। ভার্সিটির আশেপাশে কেউ নেই বললেই চলে। হয়তো ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। বেলী একবার ঘড়ির দিকে তাঁকালো। নীলাভ্র এখনো গাড়িতে বসে। বেলী গেটের মধ্যে পা দিতেই হঠাৎ করে কোথা থেকে রাফিন এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। রাফিনকে দেখেই বেলী ভয় পেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। রাফিনকে দেখতেই নীলাভ্রর পোড়া ক্ষত গুলো সতেজ হয়ে উঠলো। রাগে গাড়ির স্ট্যায়ারিংটা চেপে ধরে, সেদিকে অগ্নী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। রাফিন কে দেখেই বেলী পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, রাফিন বেলীর হাত টেনে ধরলো। বেলী ভয়ার্ত চোখে একবার গাড়িতে বসে থাকা নীলাভ্রর দিকে তাকালো। দেখলো নীলাভ্র বেশ শান্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে। হেচকা টানে রাফিনের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলো,
“রাস্তার মধ্যে মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি করা কোন ধরনের ভদ্রতা স্যার।”
বেলীর কথা শুনে রাফিনের মুখটা চুপসে গেলো। চেহারা মলিন করে বললো,
“আমার বিশাল বড় অন্যায় হয়ে গেছে বেলী। আমি তো তোমার স্বামী। আমাকে শেষ বারের মতো একটা সুযোগ দাও। আমি নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে সেদিন ভার্সিটির রুমে জঘন্য ব্যবহার করে ফেলেছি। ক্ষমা করে দাও প্লিজ।”
রাফিন কথাগুলো বলেই বেলীর পায়ের কাছে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো। কান্না করে উঠলো। তা দেখে বেলী যেনো আকাশ থেকে পড়লো। গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে ওর রাগে। মাথা চিনচিন করে ব্যাথা করছে। শরীর অনবরত কাঁপছে। এই ছেলেটাকে ও সহ্য করতে পারেনা। তাও কেনো এই ছেলেটা বারবার ফিরে আসে? তীব্র হুংকার ছেড়ে বললো,
“স্বামী! হাসালেন। আপনি আমার স্বামী ছিলেন। এখন নেই। আপনার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। ভুলে গেছেন বুঝি?”
তাচ্ছিল্যের হাসি বেরিয়ে এলো বেলীর মুখ দিয়ে। রাফিন শান্ত স্বরেই শুধালো,
“স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন কি একটা সামান্য সই দিয়ে ভেঙে যায় বেলী? আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমি তোমার পায়ে পড়ছি।”
বলে বেলীর পায়ে হাত দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই, বেলী চিৎকার করে বললো,
“খবরদার। আমার পায়ে হাত দিবেন না। আপনার মতো নোং’রা, জ”ঘন্য ব্যাক্তি শুধু ঘৃণার উপযুক্ত। ”
বলে দাঁড়ালো না আর। হনহন করে চলে গেলো। এই ছেলেকে আর এক মিনিটও সহ্য করবে না। বেলী চলে যেতেই রাফিন উঠে দাড়ালো। চোখের পানি টুকু টিস্যু দিয়ে মুছে নিতে নিতে হাসতে লাগলো। বিশ্রী অঙ্গ-ভঙ্গি করে হাসতে হাসতে বললো,
“আমার কাছেই তোমাকে ফিরতে হবে। দেখে নিও। আমাকে চরিত্রহীন বলেছিলে তাইনা। ন’রক করে দিব তোমার জীবন। প্রমিস”
আড়চোখে একবার নীলাভ্রর দিকে তাকালো। বাঁকা হাসলো। ভেতরে ঢুকে গেলো।
—-
নীলাভ্রর চোখ দুটো ভয়ংকর লাল হয়ে গেলো। ঘাড় ও কপালের কয়েকটা রগ ফুলে উঠলো। ওরা এতক্ষণ কি কথা বলেছে, তা নীলাভ্রর কান অব্দি আসে নি। কিন্তু বুঝতে পেরেছে রাফিন ক্ষমা চাইছিলো বেলীর থেকে। কি যেনো হলো নীলাভ্রর? শব্দ করে পাগলের মতো হাসতে শুরু করলো। বলতে লাগলো,
“আজো তোর মনে রাফিন আছে বেলীপ্রিয়া। আজো তুই রাফিনকে ভালোবাসিস। তোর প্রথম ভালোবাসা হওয়ার মতো সৌভাগ্য আমার কখনোই হলো না।”
#চলবে
[