#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৪.
.
অতি কষ্টে এতক্ষণ পুরো মনোযোগ খাওয়ার প্রতি আনলেও আবারও সেটা হারিয়ে গেছে হঠাৎই। চাইলেও আর খাওয়ার প্রতি মন দিতে পারছি না। ভাত একটু মাখাইতে হাতের ব্যাথায় চিনচিন করে উঠছে। তখন তাসফি ভাইয়া এতোটাই জোরে হাতটা চেপে ধরেছিলেন যে, সেই ব্যাথার রেশ এখনো রয়েই গেছে। রয়ে গেছে বললে ভুল হবে, বরং আরও বেশিই বেড়ে গেছে। ভাত একটু মুখে দিতেই প্রচন্ড জ্বালা করছে হাতটা। তবুও কাউকে সেটা বুঝতে না দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত ফোন কল আসার পর হাতের ব্যাথা মনের ব্যাথা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
সামনের প্লেটে হাত দিয়ে সমানে নাড়াচাড়া করছি। দুই একটা ভাত মুখে দিচ্ছি আর একটু পর পর তাকাচ্ছি ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা তাসফি ভাইয়ার দিকে। বিগত পাঁচ মিনিট ধরে কথা বলেই চলেছে মোবাইলের অপর পাশের মানবীর সাথে। বেশ হেঁসে হেঁসেই কথা বলছেন উনি। ওনার এমন হেঁসে হেঁসে কথা বলায় আমার রাগ হচ্ছে না একটুও, এটা তো হওয়ারই ছিলো। ওনার ভালোবাসার মানুষের সাথেই তো কথা বলছেন, এতে তো আমার রাগ হওয়ার কথা নয়। তবে মিশ্র একটা শুন্য অনুভূতিতে ভরে উঠেছে আমার মন। অদ্ভুত একটা ব্যাথা হচ্ছে বুকের বা পাশে। চাইলেও খাওয়ায় মনোযোগী হতে পারছি না।
“কে ফোন করেছিলো তাসফি? খাবার ছেড়ে উঠেছিলি কেন?”
বড়মার কথায় ভাবনা গুলোর ছুটি দিয়ে বেড়িয়ে এলাম। পাশে তাকাতেই দেখলাম তাসফি ভাইয়া চেয়ারে বসছেন। ওনার ফোন বাজতেই সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠে যান ড্রয়িং রুমে।
বড়মার কথায় উনি সময় না নিয়ে সাথে সাথেই বলে উঠলেন,
“কিয়ানার ফোন ছিলো মামী। কালকে আসার পর আর কথা হয় নি, তাই ফোন দিয়েছিলো।”
তাসফি ভাইয়া আমার দিকে তাকাতেই চট করে চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। বড়মা একটু সময় বললেন,
“তোর সাথেই ফিরলো কালকে?”
“হ্যাঁ”
“একদিন আসতে বল মেয়েটাকে, ঘুরে যাক। আগে তো কতো আসতো তোর সাথে।”
“হ্যাঁ… বললো।”
ছোট করে জবাব দিয়েই চুপ হয়ে গেলেন। তাসফি ভাইয়ার দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলাম আমার দিকেই হয়তো তাকিয়ে আছেন উনি। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে টুকরো টুকরো ভাবে খাবারগুলো মুখে দিয়ে গি*লতে লাগলাম। বড়মা হঠাৎ আমাকে বললেন,
“তাড়াতাড়ি খাওয়া বাদ দিয়ে এমন থম মে*রে বসে আছিস কেন? তোর ফুপিরা কখন খাবে? তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ।”
আর এক টুকরো খাবারও মুখে পু*ড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না, আর না এখানে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। বড়মার কথায় তবুও একটা কারণ খুঁজে পেলাম। গ্লাস বাড়িয়ে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে বড়মা দাঁড়িয়ে যেতে দেখে বলে উঠলেন,
“উঠে গেলি কেনো? খাওয়া শেষ কর।”
“আর খাবো না বড়মা, একদম পেট ভরে গেছে।”
“যেমন খাবার তেমনি তো পড়ে আছে প্লেটে, কি এমন খেলি যে পেট ভরে গেছে?”
বড়মার কথায় প্লেটের দিকে তাকালাম একবার। বললাম,
“সকালে তো অনেক দেরিতেই খেয়েছিলাম, এখন আর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। পরে খেয়ে নিবো।”
“ওর আবার খেতে হয় নাকি মামী? তার চেয়ে বরং এদিকে পাস করে দে দে রূপা। আমরা আছি কি করতে?”
বড়মার কথা শেষ হতেই রাহাত বলে উঠলো। কপাল কুঁচকে তাকালাম আমি ওর দিকে, রা*ক্ষ*সের মতো করে খাচ্ছে, তাতেও যেন হচ্ছে না তার। রাহাতের কথা শেষ হতেই সাগর ভাইয়া বলে উঠলো,
“বড় মামীর হাতের রান্না কি মিস করা যায় নাকি? রাহাত ঠিক বলছিস তুই, এই রূপা তোর প্লেটটা এদিকে দিয়ে দে, খেতে হবে না তোর।”
“চুপচাপ খা তো তোরা। ওর সাথে লাগলি কেন? তুই বস এখানে, খাওয়া শেষ করে উঠবি।”
শেষ কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বললেন বড়মা। আমি আবারও বারণ করলাম খাবো না বলে। বড়মা আবারও ধমকে উঠে বসতে বললেন আমাকে, তার বকতে বকতে রান্না ঘরে চলে গেলেন। বড়মা যেতেই সাগর ভাইয়া বললেন,
“ফু*ট এখান থেকে, খেতে হবে না তোর। তাসফি ভাই, ওর প্লেটটা এদিকে দিয়ে দাও। আমি আর রাহাত রেডি, অবশ্য তুমি চাইলে আমার আর না করবো না।”
তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকালাম একবার। এতক্ষণে কোন কথা বলেন নি উনি, চুপচাপ বসে দুই একবার মুখে খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। তাসফি ভাইয়ার কথা বলায় একটু রাগ হলো আমার। ফুঁ*সে উঠে বললাম,
“আমিই দিচ্ছি, অন্যকে কেন বলছেন ছাগল ভাইয়া।”
“এই তুই আবারও আমায় ছাগল বললি? তোর জন্য আমার বন্ধু বান্ধব এমনকি গার্লফ্রেন্ড পর্যন্ত ছাগল ছাগল বলে ডাকা শুরু করছে।”
সাগর ভাইয়ার ধমকে থতমত খেয়ে গেলাম। সাথে সাথে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলাম। বারবার বলার পরেও ভাইয়াকে ঠিকঠাক ভাবে ডাকতে পারি না। ছোট বেলা থেকেই ছাগল ভাইয়া বলে বলে এমন অভ্যসে পরিণত হয়েছে যে, এখন আর সাগর নামটা মুখেই আসে না। সাগর ভাইয়ার রাগী ফেস্ দেখে সবাই হেঁসে উঠলো, শুধু চুপ করে থাকলেন তাসফি ভাইয়া। বমি আস্তে করে বললাম,
“হয়ছে হয়ছে, নেন আর বলবো না।”
বলেই চলে আসতে নিলাম ওখান থেকে। এক পা বাড়াতেই খপ করে আমার ডান হাতটা ধরে ফেললেন তাসফি ভাইয়া।
“কোথায় যাচ্ছিস? খাবারটা শেষ করে তারপর যাবি।”
এমনিতেই হাতটা প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছিলো, তার মাঝে শক্ত করে চেপে ধরায় আরও ব্যাথা পেয়ে কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে আহ্ করে আর্তনাদ করে উঠলাম। চোখের কোণে এক দল অশ্রুকণা এসে ভীর জমালো।
“আহ্ লাগছে আমার তাসফি ভাইয়া।”
আমার কথায় কিছুটা আলগা হয়ে এলো ওনার হাত। তবে ছেড়ে দিলেন না, আমার দিকে তাকিয়ে হয়তো বোঝার চেষ্টা করলেন, সামান্য হাত ধরতেই এমন কুঁকড়ে উঠলাম কেন? হাতটা নিজের দিকে একটু টেনে নিয়ে দেখতে লাগলেন। সাথে সাথে বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে তোর হাতে হাতে, এমন লাল হয়ে আছে কেন?”
বেশ উত্তে*জিত হয়ে কথাটা বললেন উনি। সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে তাকিয়ে আছে হাতের দিকে। আমি চট করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
“কিছু হয় নি। খাবো না আমি।”
“কিছু হয় নি তাহলে খাবার ছেড়ে উঠছিস কেন? খাবারগুলো শেষ করে তবেই এখান থেকে উঠবি।”
বলেই আমাকে হাত ধরে বসিয়ে দিলেন তাসফি ভাইয়া। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার হাতের দিকে। হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হলো আমার, হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হালকা চেঁচিয়ে ই বলে উঠলাম,
“বললাম তো খাবো না আমি, এতো জোর করার মানেটা কি তাসফি ভাই? নিজে খাচ্ছেন খান না, আমার হাত ধরে টানাটানি করছেন কেন? বলছি না, আমার হাত ধরে এমন টানাটানি করবেন না, আবারও এমন করলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম।”
কথাগুলো বলেই আর দাঁড়ালাম না, বেসিনে এসে হাত ধুতে নিলাম। হাতে ঠান্ডা পানির ছোঁয়া পেতেই জ্বলে উঠলো আবারও। ভেতরের কান্নাগুলো যেন দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। হাতের ব্যাথায় নাকি মনের ব্যাথায় সেইটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সামলে নিলাম নিজেকে। অনেক কষ্টে হাতটা ধুয়ে নিলাম। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি আম্মু বড়মা ফুপিরা দাঁড়িয়ে আছেন। তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন উনি। হয়তো আমার ওমন রিয়াক্ট করাটা মেনে নিতে পারছেন না। যে মেয়েটা কি না আগে ওনার ভয়ে কুঁকড়ে থাকতো, সেইই এমন জোরে জোরে কথা বলছে ওনার সাথে, এটা মেনে নিতেই হয়তো কষ্ট হচ্ছে ওনার।
তাসফি ভাইয়ার দিকে পাত্তা দিলাম না আমি। রুমে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই ফুপি বলে উঠলো,
“কি হয়েছে রূপা, ওখন চিৎকার করলি কেন?”
জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। জানি, বড়মা বা আম্মু কিছু বলবে না এখন, তাই হয়তো ফুপিকে বলতে বলছেন। আর যাই হোক, সবাই জানে ফুপির কথা ফেলতে পারবো না আমি।
“তোমার ছেলেকে বলে দিও ফুপি, আমার হাত ধরে যেন টানাটানি না করে, আর না কাছে আসার চেষ্টা করে। মামাতো বোনের হাত ধরে টানাটানি করা, কাছে আসা, এগুলো ভালো দেখায় না। আমি কিন্তু আর ছোট নেই, বারণ করে দিও ওনাকে।
ফুপির দিকে তাকিয়ে একটু জোরেই বললাম কথাটা, যেন ওনার কান পর্যন্ত পৌঁছায়। আমার কথায় একেবারে চুপ হয়ে গেল সবাই। আমি কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে আসলাম। ড্রয়িং রুমের দরজা পেরিয়ে আসতেই বড়মার কথা ভেসে আসতেই পা দু’টো এমনিতেই থেমে গেল।
“তুই আবার উঠলি কেন বাবা? খাবারটা শেষ কর।”
“খাবো না মামী।”
তাসফি ভাইয়ার কথা শেষ হতেই ফুপি বলে উঠলো,
“ও ছোট মানুষ, কি বলতে কি বলে ফেলেছে। তুই ওর কথায় কিছু মনে করিস না। খাবারটা শেষ কর আব্বু।”
“শুনলে না তুমি, কি বলে গেল? ও কিন্তু আর সত্যিই ছোট নেই, অনেক বড় হয়ে গেছে। শুধু তোমরাই বুঝতে চাইলে না।”
“খাবারটা শেষ করে যা বাবা, সকালেও কিছু মুখে দিলি না।”
“বললাম তো খাবো আমি।”
সব স্থির হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম তাসফি ভাইয়ার কথার উপর আর কেউ কিছু বলতে পারবে না। আমি আর দাঁড়ালাম না। সোজা রুমে চলে এলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, যতদিন উনি এই বাসায় আছেন ততদিন রুম ছেড়ে বের হবো না। আর কলেজে গেলে তো আর কথায় নেই, একটু হলেও শান্তি তে থাকতে পারবো।
হাতের ব্যাথাটা মাথা চারা দিয়ে উঠতেই হাতটা সামনে আনলাম। একদম লাল হয়ে গেছে পুরো হাত সহ আঙুল গুলো। চোখটা আবারও ভিজে উঠলো। এবার আর কোন বাধ মানলো না, টপটপ করে বেরিয়ে আসলো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু কণা। তবে কান্নাটা হয়তো হাতের ব্যাথার চেয়ে মনের ব্যাথা র কারণ হয়েই দাঁড়ালো। অপর হাতে চোখ দুটো মুছতেই আবারও গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই যেন পারছি না। হঠাৎ জোরে দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম কিছুটা। চোখটা ভালোভাবে মোছার চেষ্টা করে পিছন ফিরে তাকাতেই আরেক দফা চমকে উঠলাম।
.
.
চলবে……