#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৫.
.
“আ..আপনি…. এখানে কেক্..কেন?”
আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে ঠাস করে দরজাটা আঁটকে দিলেন তাসফি ভাইয়া। দরজা লক করে দিয়ে পিছন ফিরে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে। শুঁকনো একটা ঢোক গিললাম, হঠাৎই যেন গলাটা শুকিয়ে গেছে ওনাকে দেখার পর, প্রচন্ড ভীতি এসে জমা হয়েছে মনে। অদ্ভুত এক মুখভঙ্গিতে এগিয়ে এসে আমার কিছুটা সামনে দাঁড়ালেন। কিছুটা সাহস জোগাড় করে মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই উনি চট করে আমার হাতটা টেনে নিলেন। হঠাৎ করে হাতটা টেনে ধরায় হালকা ব্যাথায় মুখ চে*পে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। ওনার শক্ত হাতের মুঠোয় আমার হাতটা নিয়ে আস্তে আস্তে উপরে তুললেন। কিঞ্চিৎ ব্যাথা পেলেও মুখ ফুটে কোন শব্দ করলাম না। চোখ খিঁচে বন্ধ করে সহ্য করতে লাগলাম। হালকা চে*পে ধরলেন আমার হাতটা, ব্যাথা পেয়ে ছুটিয়ে আনার চেষ্টা করতেই হঠাৎ ওনার শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম হাতে। চমকে উঠলাম আমি, কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। চট করে চোখ খুলে তাকালাম ওনার দিকে। পুরো হাতটা ওনার হাতে নিয়ে ঠোঁটে ঠেকিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। গাড়ো কালো চোখের মনি স্থির হয়ে আছে আমার দৃষ্টিতে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে টু*করো টু*করো ভাবে চুমু দিতে লাগলেন পুরো হাতে। নিশ্বাসের আনাগোনা যেন হঠাৎই বেড়ে গেল আমার। আধা মিনিটের মতো সময় নিয়ে ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম ওনার থেকে, অপর হাতে ওনাকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম। তবে সামান্য পরিমাণও হয়তো নড়াতে পারলাম না। আমিই দুই ধাপ পিছিয়ে এলাম। বললাম,
“অ*সভ্যের মতো রুমে ঢুকে এসব কি শুধু করেছেন আপনি? কেন এসেছেন আমার রুমে? বেরিয়ে যান বলছি।”
আমার কথা যেন ওনার কানেই গেল না, এমন একটা ভান করে সরে গেলেন সামনে থেকে। সোজা ওয়ারড্রব খুলে খুঁজতে লাগলেন কিছু একটা। কাপড়গুলো টেনে টেনে বের করে ভেতরে দেখতে লাগলেন। ওনার এহেন কাজে বিরক্তির সাথে প্রচন্ড রাগও হলো।
“এগুলো কি করছেন তাসফি ভাইয়া? পা*গল হয়ে গেছেন আপনি? গোছানো কাপড়গুলো এভাবে এলোমেলো করছেন কেন? কি….. ”
কথাটা শেষ না করেই চুপ হয়ে গেলাম আমি। তাসফি ভাইয়ের হাতের জিনিসটা দেখে লজ্জায় মাথা কাঁ*টা যাচ্ছে আমার। উনিও গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। হয়তো বুঝতে পারেন নি এমন অপ্রত্যাশিত কিছু ওনার হাতে চলে আসবে। ওনাকে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে দেখেই ওনার হাতের জিনিস গুলো দ্রুত নিয়ে নিলাম। ড্রয়ারে রেখে আটকে দিতেই কিঞ্চিৎ ব্যাথা লাগলো হাতে। হঠাৎ ব্যাথায় অজান্তেই আহ্ করে উঠলাম। ধমকে উঠলেন তাসফি ভাই।
“পেঙ্গুইনের মতো এতো লাফালাফি করছিস কেন? বেয়াদব! চুপচাপ বসে থাকতে পারছিস না?”
“রুমে ঢুকে তা*ন্ডব শুরু করছেন, আর আমাকে বলছেন চুপ করে থাকতে? অ*সভ্য বখাটের মতো এগুলো কি শুরু করেছেন তাসফি ভাইয়া?”
আমার কথাটা আবারও উপেক্ষা করে পাশ কে*টে চলে গেলেন উনি। টেবিলের কাছে গিয়ে আবারও একই ভাবে খুঁজতে শুরু করলেন কিছু একটা। বই গুলো এলোমেলো করে ড্রয়ার খুললেন। এবার প্রচন্ড রাগে এক প্রকার চিৎকার করে উঠলাম।
“ভর দুপুরে কি নাটক শুরু করলেন আপনি? এক্ষুনি বেরিয়ে যান বলছি, নয়লে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম। আম্মু…. ফুপি বড়মা…. দেখো তোমাদের ছেলে…..”
“চুপ…. কানের কাছে এমন চেঁচাচ্ছিস কেন? বেয়াদব! তোকে কি আমি রে*প করছি, নাকি জামা কাপড় টেনে*টুনে খুলছি?”
ওনার এক ধমকে চুপ হয়ে গেলাম। মানুষটার চেহারায় পরিবর্তন হলেও ওনার সেই বিশাল বিশাল ধমকগুলো এখনো আগের মতোই রয়েছে যেন। আর ওনার এই বিখ্যাত ধমকে যে আমি ভয় পাবো না, এমনটা কখনোই হবে না, কদাপি নেহি! মনে মনে সাহস জাগিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই উনি শব্দ করে ড্রয়ারটা লাগিয়ে দিলেন। দূরত্ব ঘুচিয়ে একদম আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি সরে আসতে চাইলেই খপ করে হাতটা ধরে ফেললেন উনি। চাইলেও আর নিজেকে ছুটিতে আনতে পারলাম না। উনি সময় না নিয়ে হাতে থাকা মুভটা খুলে আমার হাতে লাগিয়ে দিতে শুরু করলেন। আমি বিরক্ত হলে বলে উঠলাম,
“এত আদিখ্যেতা দেখাতে কে বলেছে আপনাকে। ছাড়েন বলছি, বলছি না আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না। এখনি আ…..”
“একদম চুপ করে থাকবি। আমি যে, নয়লে আমি যে ঠিক কি করতে পারি, সেটার এক্সপেরিয়েন্স কিন্তু তোর খুব ভালো ভাবেই আছে।”
তাসফি ভাইয়ার কথায় চুপ হয়ে গেলাম আবারও। উনি যে ঠিক কি উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন, বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার। আমি শান্ত হাতে উনি আলতে করে মুভটা লাগিয়ে দিচ্ছেন হাতে। চিনচিন করে উঠলো ঠান্ডা ছোঁয়ায়, হাতের কব্জি থেকে আঙুল পর্যন্ত লাল হয়ে হয়ে জায়গায় জায়গায়।
তাসফি বেশ মনোযোগ নিজের কাজ করে চলেছেন, হাত একটু কেঁপে উঠতেই মাঝে মাঝে ফুঁ দিচ্ছেন। এতদিন পর চিরচেনা এই চেহারাটা দেখে মনের মাঝে নানার কিছু উঁকি দিচ্ছে বারংবার। ওনাকে যে এভাবে আবারও এতটা কাছে থেকে দেখবো, সেটা কালকেও ভাবতে পারি নি। ওনার প্রতি তো আমার রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু তার এক বিন্দুও রাগ নেই ওনার প্রতি। কিন্তু বিশাল পরিমাণের পাহাড় সমান অভিমান জমা হয়ে আছে।
তাসফি ভাই হঠাৎ আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। চোখে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম আমি, হাতের দিকে তাকিয়ে টেনে নিলাম ওনার থেকে। ওনার থেকে একটু দূরে গিয়ে বলে উঠলাম,
“অনেক হয়েছে আপনার নাটক, এবার বেড়িয়ে যান। অনেক করেছেন আপনি।”
“দেখ, বেশি লাফালাফি করিস না। আবার কিন্তু হাতে ব্যাথা পাবি।”
“আপনার দেওয়া ব্যাথা থেকে সেগুলো অনেক সহ্যশীল আমার জন্য। এতো দরদ দেখাতে হবে না আমাকে। এখন যান এখান থেকে, অ*সহ্য লাগছে আপনাকে আমার। আমাকে একটু আমার মতো করে থাকতে দিন। বেরিয়ে যান বলছি আমার রুম থেকে।”
শেষের কথাগুলো বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠলাম। আমার কথায় চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তাসফি ভাইয়া। কয়েক সেকেন্ডের মতো দাঁড়িয়ে থেকে কয়েক ধাপে দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিলেন আমাদের মাঝের। হুট করে পিছন থেকে আমার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন। ধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“তোর এই অ*সহ্য কে সহ্য বানিয়ে দিতে, আমার কিন্তু খুব একটা সময় লাগবে না।”
ছটফট করতে লাগলাম আমি, ওনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য। কিন্তু একটুকুুও সরাতে পারলাম না ওনাকে। তবুও থেমে না থেকে হাত পা ছোটাছুটি করতেই লাগলাম। উনি গভীর ভাবে আমাকে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে, গালে হাত দিয়ে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“রুপু…..”
চমকে উঠলাম আমি। এতদিন পর ওনার কণ্ঠে ‘রুপু’ ডাকটা শুনে শিরশির করে উঠলো পুরো শরীর, কেঁপে উঠলাম কিছুটা। সহসায় একদম স্থির হয়ে গেলাম। শ্বাস প্রশ্বাসের আনাগোনা বেড়ে গেল মুহুর্তেই। গালে ওনার শক্তপোক্ত হাতটা আলতো করে স্লাইড করতে লাগলেন। মৃদু স্বরে সুর মিলিয়ে বলে উঠলেন।
“আমি ছুঁয়ে দিলে পরে,
অকালেই যাবে ঝড়ে….
গলে যাবে, যে বরফ… গলে না।”
দূরত্বটা আরও কিছুটা ঘুচিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন একেবারে। মাথা নিচু করে আমার দিকে ঝুকে থাকায় ওনার নিশ্বাস আছড়ে পরতে লাগলো আমার চোখে মুখে। ওনার ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না, আর একটু তাকিয়ে থাকলেই যেন এতদিনের সবকিছু ভুলে হারিয়ে যাবো ওনার মাঝে, জড়িয়ে নিবো নিজের সাথে। কিন্তু আমি তো সেটা চাই না, কিছুতেই না….
তাসফি ভাইয়া আর একটু ঝুকে আসতেই শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলাম ওনাকে। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“লজ্জা করে না আপনার, অ*সভ্য লোক কোথাকার। এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন আমার রুম ছেড়ে। মামাতো বোনের রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে এসব কি অ*সভ্যতামী শুরু করছেন? নুন্যতম লজ্জাটুকুও কি নেই আপনার মাঝে, তাসফি ভাইয়া?”
একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন উনি। কথাগুলো বলে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিতে লাগলাম আমি, রাগে পুরো মাথা ফে*টে যাচ্ছে আমার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাসফি ভাইয়াকে এই মুহুর্তে কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না আমার। ওনার দিকে তাকিয়ে আবারও চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“কি হলো, কথা কানে যাচ্ছে না আপনার? বেরিয়ে যান বলছি। এক্ষুনি বেরিয়ে যান আমার রুম থেকে।”
“তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস রুপু।”
এতটুকু বলেই থেমে গেলেন উনি, সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“রেডি থাক, চার বছর অনেক বেশি-ই সময়। অনেকটা সময় দিয়ে ফেলেছি, আর নয়। এরপর যা হবে শুধু নিজ দ্বায়িত্বে সামলে নিস।”
বলেই আর দাঁড়ালেন না তাসফি ভাইয়া। দরজা খুলে সোজা বেরিয়ে গেলেন রুম ছেড়ে। উনি যেতেই ধপ করে নিচে বসে পড়লাম আমি, এতক্ষণের আটকে রাখা কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসলো। হু হু করে কেদে ফেললাম সহসায়। ওনাকে এতটা কাছে যেন সহ্য করতে পারছি না যেন, এতদিন পর এতটা কাছে পেয়েও একটু ছুঁতে পারলাম না ওনাকে।
ওনার বলা শেষ কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগলো শুধু, কি করতে চাইছেন উনি? কিসের জন্যই বা আমাকে রেডি থাকতে বলছেন? আর চার বছর আমাকে কিসের-ই বা সময় দিয়েছিলেন তাসফি ভাইয়া? উনিই তো ছেড়ে গিয়েছিলেন আমাকে, আমাদের সদ্য হওয়া প্রনয়নের সম্পর্কটা ছিন্ন করে কিয়ানার হাত ধরে পারি দিয়েছিলেন বিদেশের মাটিতে। দিনের পর দিন অবহেলা করে গেছেন আমাকে, কি করে ভুলে যাবো সেই দিনগুলোকে? ওনাকে মনে করার প্রতিটা মুহুর্তকে? না…. কিছুতেই ভুলতে পারবো না আমি, আর না ওনারকে জায়গা দিবো আমার জীবনে।
.
সন্ধ্যা নামার পর রাতের শহরটা এক ভিন্ন নগরীতে রুপ নেয়। সোডিয়ামের হলদেটে আলোয় রাঙিয়ে উঠে শহরের আনাচে কানাচে। আস্তে আস্তে গভীর রাতের ব্যস্ত শহরটা হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়, শান্ত শহরের ফাঁকা রাস্তায় প্রিয় মানুষটির হাত ধরে হাঁটা, এক অন্য রকম অনুভূতি। কোন এক পাগলাটে হিমুর সাথে শুধু মাত্র তার রূপা হয়ে, নীল শাড়ি এবং তার পড়নে কালো পাঞ্জাবি পড়ে রাতের নিস্তব্ধত শহরে হাঁটতে যাওয়ার অনেক ইচ্ছে। যদিও হিমুর পড়নে হলুদ পাঞ্জাবি ছিলো, কিন্তু আমার ব্যাক্তিগত হিমুর পড়নে শুধু আমার প্রিয় রঙটায় থাকবে।
“এই সময় এখানে বসে কি করছিস বোনু? ছাদে চল….”
হঠাৎ রিফাপুর কথায় নিজের ভাবনাগুলো থেকে বেরিয়ে আসলাম। আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“বললাম তো যাবো না, এতবার করে বলতে হবে কেন?”
“দেখ রূপা, অনেক হয়েছে তোর। এতদিন পর সবাই এক জায়গায় হয়েছে, একটু আড্ডা দিবো, তার তুই কি না ঘরকুনো হয়ে আছিস?”
বেশ ধমকেই উঠলো রিফাপু। আমি গা ছাড়া ভাব নিয়ে তাকালাম রিফাপুর দিকে। কিছু বলতেই আপু আবারও বলে উঠলো,
“দেখ, একদম না করবি না আর, তাড়াতাড়ি চল। রিমি আপু আর ভাইয়া কিন্তু বারবার করে বলে দিয়েছে, যেন তোকে নিয়ে উপরে যাই। তাসফি ভাইয়ের জন্য এভাবে ঘরে বসে থাকবি, এটা কেমন কথা?”
“একদম ওনার নাম নিবা না রিফাপু।”
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, আর বলবো না। এবার তো চল।”
রিফাপুর কথায় আর না করলাম না। ওই একটা মানুষের জন্য সবার মন তো আর খারাপ করে দিতে পারি না। ছাড়াও রিমি আপু আর ভাইয়াও অনেক দিন পর আসছে। রিফাপু কে চলো বলে উঠে দাড়ালাম। অনেকটা খুশি হয়ে গেল আপু, আমিও হালকা হাসলাম। রুম ছেড়ে বেরিয়ে ছাদে যেতে লাগলাম রিফাপুর সাথে।
.
.
চলবে…….
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। একটু পাঠন মূলক মন্তব্য করার চেষ্টা করবেন, যেন পরবর্তী পর্বটা তাড়াতাড়ি দিতে পারি।🙂