দুই দুইজন পাত্রের সামনে বসে থাকতে খুবই লজ্জা লাগছে নাফিয়ার ।এমন লজ্জাজনক অবস্থায় কোনোদিন পরতে হয়নি নাফিয়াকে ।এই প্রথম এমনটা হল ।নাফিয়া আড়চোখে তাকাল মিসেস আইদাহ তার মা আর ওবায়দুল হামিদ তার বাবার দিকে ।উনাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এরকম লজ্জাজনক অবস্থায় উনারা কোনোদিন পরেনি ।এই অবস্থাতেও খুব হাঁসি পাচ্ছে নাফিয়ার ।অনেক কষ্টে হাঁসিটা চেঁপে রেখে , আড়চোখে তাকাল তার সামনে সোফায় বসে থাকা পাত্রদুটোর দিকে ।একজন দেখতে একটু বয়স্ক টাইপ আর একজন দেখতে বেশ ভালোই । বেচারাদের খুবই বিব্রত দেখাচ্ছে , পারছেনা এই জায়গা থেকে দৌঁড়ে চলে যেতে ।
আজকে দুইজায়গা থেকে নাফিয়াকে পাত্র দেখতে আসার কথা ছিল ।এক পাত্রের আসার কথা ছিল বিকেলের দিকে ,আরেক পাত্রের আসার কথা ছিল মাগরিবের পরে অর্থাৎ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাত্র দুইজন ওদের মা বাবাসহ একই টাইমে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এসে হাজির হয়েছে ।আর এসেই এমন লজ্জাজনক অবস্থায় পরতে হল সবাইকে ।এই অস্বস্তিকর পরিবেশ স্বাভাবিক করতে এক পাত্রের বাবা মেকি হেঁসে বললেন ,
মেয়েরা হল বড়ই গাছের মত ঝাকি দিলেই ঝরঝর করে পরবে ।অর্থাৎ মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছ , তখন পাত্র তো সকাল বিকাল দেখতে আসবেই ।ভদ্রলোকের এই কথাতে সবার চেহারা থেকে অস্বস্তিকর ভাবটা চলে গেল ।মিসেস আইদাহ আর ওবায়দুল হামিদ দুই পরিবারকেই খুব ভদ্রভাবে আপ্যায়ন করলেন ।আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি ছিলনা তাদের ।আপ্যায়ন শেষে উনারা দুই পরিবারকে ভদ্রভাবে বিদায় জানালেন ।
________________________
হা হা হা হা নাফিয়া আর কিছু বলিসনা প্লিজ ।হাঁসতে হাঁসতে আমার পেট ব্যাথা করছে প্লিজ্ বলতে না বলতেই অনু হোঁ হোঁ করে হেঁসে ঢলে পরল রাস্তায় ।
বান্ধবীর অবস্থা দেখে নাফিয়াও ফিঁক করে হেঁসে দিল ।
অনু হাঁসতে হাঁসতে বলল , তা তোর শ্বশুররা কত টাকা বকশিশ দিল কালকে ?
নাফিয়া রাগীচোখে তাকাল অনুর দিকে ।পরোক্ষনে স্বাভাবিক গলায় বলল,
দুই পরিবার থেকে একহাজার করে দিয়েছে ।
অনু অবাক হয়ে বলল , মাত্র এক হাজার টাকা ?
নাফিয়া মুচকি হেঁসে বলে , এক হাজার টাকা করে দিয়েছে এইতো ঢের । বেচারাদের অবস্থা যা হয়েছিল না পারেনা আমাদের বাড়ি থেকে দৌঁড়ে চলে যায় ।
অনু রহস্যজনক হাঁসি দিয়ে বলল , তাহলে আজকে্ অনুকে থামিয়ে দিয়ে নাফিয়া মুচকি হেঁসে বলল ,
টাকা আমার কাছেই আছে ।আজকে কলেজ ছুটির পর দুজনে রেস্টুরেন্টে গিয়ে জম্পেশ খাওয়াদাওয়া করব ।
অনু হেঁসে টান দিয়ে বলল , খাবোরে খাবোওওও ।
নাফিয়া আর অনু কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্য বাসে উঠে বসল ।সিটে বসে দুজন আবারো গল্পে মেতে উঠল ।
নাফিয়া এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী ।পড়ালেখায় খুব মেধাবী না হলেও মোটামুটি ভালো ।নাফিয়ার বাবা ওবায়দুল হামিদ হাইস্কুলের শিক্ষক আর মা গৃহিনী ।নাফিয়ার দাদার রেখে যাওয়া পাঁচতলা বাড়িটা পুরোটাই নাফিয়ার বাবার নামে ।নাফিয়ারা শুধু এক ফ্ল্যাটে থাকে আর সবগুলো ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া ।এতেই নাফিয়াদের সংসার খুব ভালোভাবে চলে যায় । নাফিয়ার একটা বড় ভাইও আছে ,নাম ইহান ।সে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে নতুন জয়েন করেছে । নাফিয়ার গাঁ-এর রং শ্যামলা তা নিয়ে নানির বাড়ি , দাদির বাড়ির আত্মীয়দের চিন্তার শেষ নেই ।নাফিয়ার এস এস সি এক্সাম শেষ হতে না হতেই দুইদিন পর পরই তারা সম্বন্ধ নিয়ে হাজির হয় নাফিয়ার বাড়ি ।এতে অবশ্য নাফিয়া খুব বিরক্ত হয় কিন্তু মা বাবার জন্য কিছু বলতে পারেনা ।
বাস থামতেই নাফিয়া আর অনু বাস থেকে নেমে কলেজের ভেতরে ঢুকল ।আজকে অলরেডি পাঁচ মিনিট লেট হয়ে গেছে দুজনে ।ক্লাস শুরু হয়ে গেছে ।লেট করাতে দুজনকে কিছুসময় ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হল ।তারপর ক্লাসে ঢুকার অনুমতি দিল ক্লাস টিচার ।
সব ক্লাস শেষে নাফিয়া আর অনু কলেজ থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠে বসল রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্য ।কিছু সময় পর তারা রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছালো ।নাফিয়া আর অনু রিক্সা থেকে নেমে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকল ।এখন সময়টা দুপুর হওয়াতে রেস্টুরেন্টে তেমন কোনো মানুষ নেই ।তিনটা টেবিল বাদে সব টেবিলই খালি পড়ে আছে ।নাফিয়া আর অনু কোণার টেবিলটায় গিয়ে বসল ।চেয়ার টেনে বসতেই নাফিয়ার ব্যাগে থাকা ফোনটা বেজে উঠল ।নাফিয়া ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখল তার মা ফোন করেছে ।নাফিয়া কল রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে তার মা গম্ভীর গলায় বলে উঠে ,
কই তুই ? কলেজ তো অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে তো বাসায় ফিরছিস না কেন ?
আম্মু রিলেক্স !আমি আর অনু মাত্র রেস্টুরেন্টে এসেছি ।আমি খুব শিগ্রই বাড়ি ফিরে আসব ।তুমি চিন্তা করনা ।
মিসেস আইদাহ গলাটা আরো গম্ভীর করে বললেন , এক্ষুনি ভিডিও কল দে আমায় ,আমি তোকে দেখবো ।
নাফিয়া চমকিত গলায় বলল আম্মু ! তুমি কি আমায় বিশ্বাস করছনা ?
মিসেস আইদাহর থেকে কোনো জবাব পেলনা নাফিয়া ।
নাফিয়া একটা দীর্ঘ দম নিয়ে বলল , বিশ্বাস না হলে অনুর সাথে কথা বল ।নাফিয়া হাতের ফোনটা অনুর কাছে এগিয়ে দিল ।অনু কিছুক্ষণ মিসেস আইদাহর সাথে কথা বলে নাফিয়াকে ফোনটা এগিয়ে দেয় ।
নাফিয়া ফোন কানে নিয়ে ধরা গলায় বলল , এখন বিশ্বাস হল তো ?
মেয়ের অভিমান বুজতে পেরেও মিসেস আইদার মধ্যে কোনো অনুতাপ দেখা দিলনা ।তিনি শান্ত গলায় বললেন ,
আজকালকার যুগ ভালোনা ।কখন কি হয় বলা তো যায়না ? আর তোকে আমি অবিশ্বাস করিনি ।তুই খুব সহজ সরল মেয়ে ।যে কেউ তোকে ভুলিয়েভালিয়ে তোর ক্ষতি করতে পারে ,এসব ভেবেই আমার চিন্তা হয় ।যাইহোক ,ফোন রাখছি এখন । খাওয়া শেষ হলে অনুর সাথে জলদি বাড়ি ফিরে আসিস বলেই খট করে ফোন রেখে দিলেন মিসেস আইদাহ ।
বরাবরের মতোই মায়ের বলা কথাগুলো বুজতে ব্যর্থ হল নাফিয়া ।কিছুক্ষণ আগেও তার মুডটা খুব ভালো ছিল আর এখন মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে তার মায়ের কথা শুনে ।খুব রাগ হচ্ছে নাফিয়ার ।সব সময়-ই মা তার সাথে এমন করে ।নাফিয়া মনে মনে ভাবে এতই যখন সন্দেহ তাহলে বাইরে বের হতে কেন দেয় ? ঘরে বসিয়ে রাখলেই তো পারে !
নাফিয়া মলিন হয়ে খাবার অর্ডার করল ।নাফিয়ার মন খারাপ হতে দেখে অনু মজার মজার কথা বলে নাফিয়াকে হাঁসানোর চেষ্টা করছে কিন্তু নাফিয়া সেই যে থম ধরে বসে আছে হু হা কিছুই বলছেনা ।অনু শত চেষ্টা করেও নাফিয়ার মনের কালোমেঘ সরাতে পারলনা ।প্রায় পাঁচ -সাত মিনিট পর ওয়েটার তাদের টেবিলে খাবার নিয়ে এল ।
নাফিয়া আর দেরি না করে খাবার খেতে শুরু করে ।তার মাথায় এখন শুধু একটাই চিন্তা তাকে জলদি বাসায় ফিরতে হবে, দেরি করলে দেখা যাবে বাসায় ফিরে আবার মায়ের একদফা জেরার মুখোমুখি হতে হবে ।যেটা নাফিয়ার একটুও পছন্দ না ।যেটা সে করেনি ,সেই ব্যাপারে কেউ যদি তাকে জেরা করে তাহলে খুব রাগ হয় তার ।
নাফিয়া বার্গার মুখে দিতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় নিজের চেহারায় আগুনের তাপ পরতেই নাফিয়া চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ।অনু অস্থির হয়ে বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করে , কি হয়েছে ?
নাফিয়া গালে হাত দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে একটা জ্বলন্ত সিগারেট নিচে পরে আছে ।নাফিয়া সিগারেট টা হাতে নিয়ে রেস্টুরেন্টের চারদিকে চোখ বুলাল ।রেস্টুরেন্টে তেমন কোনো পুরুষ নেই ,থাকলেও তাদের থেকে অনেকটা দূরের টেবিলে দুজন মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছে ।নাফিয়া এবার তাদের বরাবর সামনের টেবিলটার দিকে তাকাল ।তাদের বরাবর টেবিলটায় একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসে আছে ।মেয়েটার চেহারা দেখা যাচ্ছেনা তবে ছেলেটা তার মুখোমুখি হয়ে বসাতে ছেলেটার চেহারা নাফিয়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আর নাফিয়ার সন্দেহের তীর এই ছেলেটার দিকেই ।এই ছেলেটাই একটু আগে তার চেহারায় জ্বলন্ত সিগারেট ছুড়ে মেরেছে ।নাফিয়া রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে সিগারেটটা হাতে নিয়ে ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে বলল ,
এটা কি ধরনের অসভ্যতামি ? বাড়িতে কি মা বোন নেই ?
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির তেজী চেহারার তেজী গলা শুনে স্পর্শ থতমত খেয়ে গেল ।সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
কি যা তা বলছেন আপনি ? আজব তো !
ছেলেটা সরাসরি অস্বীকার করাতে এই পর্যায় নাফিয়া খুব রেগে গেল ।ঠাস করে চড় মেরে দিল স্পর্শের গালে ।নাফিয়া রাগে গজগজ করে হাতের সিগারেট টা দেখিয়ে বলল ,
একটু আগে এই সিগারেটটা আপনি আমার চেহারায় ছুড়ে মেরেছেন আর এখন ভাব এমন করছেন যেন কিছুই জানেন না ? অসভ্য লোক কোথাকার !মেয়েদের দেখলেই খালি হ্যারাস করতে ইচ্ছা করে তাইনা ?ফালতু বলেই নাফিয়া রাগে গটগট করে বের হয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে ।নাফিয়ার পিছু পিছু অনুও বের হয়ে গেল ।
স্পর্শ এখনো গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।খুব ছোটবেলায় পড়া না পারার কারনে স্যারের কাছ থেকে একবার গালে চড় খেতে হয়েছিল ।ঐ টাই ছিল তার জীবনের শেষ মার খাওয়া ।বড় হওয়ার পর কোনোদিন কেউ তাকে মারা তো দূরের কথা ,কেউ ফুলের টুকা পর্যন্ত দেয়নি তার গাঁ-এ।কিন্তু এই মেয়েটা !রাগে ক্ষোভে স্পর্শের গোলা চোখদুটো লাল হয়ে গেছে ।স্পর্শ হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে সামনে থাকা চেয়ারটাকে সজোরে লাথি মেরে হনহন করে বের হয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে ।
চলবে,
@Nusrat Hossain
#তুমিই_আমার_আষাঢ়_শ্রাবণ
#Part_1
#লেখনীতে_Nusrat_Hossain