#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ১৫ (শেষ পর্ব)
আমি ভোরের আলো ফোটার আগেই উঠে পড়লাম। উঠে প্রথমেই নিলয়কে দেখলাম, সে আসলে ঘুমিয়ে না জেগে সেটা দেখলাম। হ্যাঁ, সে অঘোরে ঘুমোচ্ছো। ঘুমোচ্ছে ঠিক না, সে অবচেতন হয়ে আছে। আমি এবার ঘরের চাবি খুঁজতে লাগলাম। চাবিটা খুঁজে পেতে আমাকে অবশ্য খুব একটা বেগ পেতে হলো না। ওর বালিশের নিচেই চাবিটা ছিলো। নিলয় মূলত আমাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। ভেবেছিল আমি তেমন কিছুই করতে পারবো না। ওর এই ভাবনাটাই ওকে ডুবিয়েছে।
আমি ওকে ওর ঘুমের মধ্যেই বেঁধে ফেললাম। ওকে খুব কষ্টে বিছানা থেকে নামিয়ে মেঝেতে রাখলাম। খাটের পায়ের সাথে ওর হাত-পা খুব শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে দিলাম। এরপর নিলয়ের ফোন থেকেই সুমনকে মেসেজ করলাম। খুব দ্রুত যেন বাড়িতে চলে আসে। জরুরী দরকার আছে।
এরপর আমি সুমনের আসার অপেক্ষায় বসে রইলাম। সুমন আসতে আসতে কেটে গেল ঘণ্টা দুয়েক।
ও এসেই দরজার কলিং বেল চাপ দিলো। আমি হাসিহাসি মুখ করে দরজা খুলে দিলাম। এর আগেই নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে নিয়েছিলাম, সুমন যেন কোন সন্দেহ না করে এজন্য। সুমন আমাকে দেখে একটু ভরকে গেল। সে আমতা আমতা করে বললো,
“তুমি? আমাকে তো…!”
ওর কথা শেষ হবার আগেই আমি বললাম,
“তোমাকে আমিই মেসেজ করেছিলাম তোমার স্যারের ফোন থেকে।”
আমার কথায় সুমন মনে হয় কিছুটা সন্দেহ করলো। সে কেমন একটা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি আলতো হেসে বললাম,
“আরেহ এত কী ভাবছো? ভেতরে আসো, একটা সুন্দর খবর আছে তোমার জন্য।”
সে দরজা ঠেলে ভেতরে এলো। আমি আর সুমন সোফায় গিয়ে বসলাম। সুমনকে দেখলাম ঘামছে। আমি ওকে আশ্বস্ত করার জন্য ওর হাতে হাত রাখলাম।
আমি মৃদু স্বরে বললাম,
“আমি অনেক ভেবেছি জানো? অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি তোমার সাথেই যাবো। তোমার কথাই মেনে নেবো। কী বিয়ে করবে না আমাকে?”
আমার কথায় সুমনের ঘাম আরো বেশি ঝড়তে লাগলো। সে আমার হাতের মুঠোয় থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। কাঁপা গলায় বললো,
“কিন্তু স্যার কী এটা মেনে নেবেন?”
আমি সোফা থেকে উঠে টেবিলের দিকে গেলাম। রাতে ওষুধ মেশানো পানি জগ থেকে গ্লাসে নিয়ে সুমনের কাছে এলাম। পানিটা সুমনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম,
“এতকিছু ভাবলে কী আমাদের সংসার হবে? আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে? বলো?”
সুমন পানিটা এক ঢোকে শেষ করে বললো,
“তাও ঠিক।”
আমি ওর পাশে বসে বললাম,
“একটা কথা জানো?”
সুমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কী কথা?”
আমি আদ্র গলায় বললাম,
“আমার সাথে কিন্তু আমার বাচ্চার দায়িত্বও তোমাকে নিতে হবে। কি পারবে না?”
এই কথা শোনা মাত্রই সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মুহুর্তের মধ্যেই তার রূপ বদলে গেল। সে কনকনে গলায় বললো,
“আমারে কী পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে? আমি তোমারেই বা কেন বিয়া করবো, আর তোমার বাচ্ছারেই বা কেন মাইনা নিবো! মগের মুল্লুক না-কি!”
আমি ওর এমন কথায় অবাক হলাম না। কোন কষ্টও পেলাম না। বাচ্চার বাবা যেখানে অস্বীকার করছে সেখানে এ তো কিছুই না। আমি কান্নার ভান করলাম। ব্যথিত হবার ভাব নিয়ে বললাম,
“এত দ্রুত তোমার ভালোবাসা শেষ হয়ে গেল সুমন?”
সুমন উত্তেজিত হয়ে বললো,
“ভালোবাসা? কীসের ভালোবাসা? কে ভালোবাসে তোমায়? আমি তোমায় কখনোই ভালোবাসিনি, যা করেছি সব অভিনয়।”
“তবে, সেদিন রাতে যে বললে আমাকে বিয়ে করবে। আমাকে ভালবাসার অভিনয় করতে করতে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছ। সেসব তবে মিথ্যে ছিল?”
এই কথায় সুমন একটু শান্ত হলো। ধরাম করে সোফায় বসে পড়লো।
সে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“না, মিথ্যে ছিল না। কিন্তু এখন আর আমি তোমাকে বিয়ে করবো না। তোমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে কাছে পাওয়া। একবারের জন্য হলেও তোমাকে বিছানায় নিয়ে যাওয়া। সেটাই যখন হবে না, তবে বিয়ে কেন করবো? তাও আবার একটা বাচ্চার দায়িত্ব কাধে নিয়ে!”
কথাগুলো বলার সময় ওর জিহ্বা জড়িয়ে আসছিল। আমি বুঝলাম কাজ শুরু হয়েছে। কথা শেষ হতেই সে সোফায় এলিয়ে পড়লো। আমি তৎক্ষণাৎ কিছু করলাম না। ওর কাছে থেকে উঠে নিলয়ের কাছে গেলাম। দেখলাম নিলয়ের হালকা জ্ঞান ফিরছে। আমি আর দেরি করলাম না ছুটে গেলাম সুমনের কাছে। সুমনকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে এলাম নিলয়ের কাছে। সুমনকে ও ঘর থেকে এ ঘরে আনতে আমার অনেকটা সময় লেগে গেছে। আমার অনেক কষ্টও হয়েছে। তলপেটে ব্যথাও পেয়েছি। তবুও আমি হাল ছাড়লাম না।
ওকে নিলয়ের সামনে আনলাম। তারপর সুমনের শরীরের উপরে বসে সুমনের গলায় প্রথম পোজ টা দিলাম। আমার সবজি কাটা ছুরি দিয়েই পোজ টা দিলাম। সুমনের এমন অবস্থা দেখে নিলয়ের চোখ বড়বড় হয়ে গেল। হালকা গোঙানির আওয়াজও পেলাম। নিলয় খুব একটা কথা বলতে পারছে না। হালকা গোঙাচ্ছে শুধু। আমি পরপর আরো দুটো পোজ দিলাম সুমনের গলায়। এরপর পেটের মধ্যে দুবার চাকু বসিয়ে দিলাম।
ওর গলা আর পেট থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে লাগলো। আমার চোখে মুখে এসে সেসব রক্ত আছড়ে পড়ছিল। তবুও আমার ভেতরে কোন বিকার এলো না। আমি সুমনকে ছেড়ে নিলয়ের দিকে অগ্রসর হলাম। তখন আমার মাথায় খুনের নেশা চেপে বসেছিল। আমি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিলাম। একইভাবে নিলয়কেও মারলাম। নিলয়কে মারতে গিয়ে আমি কয়েকবার নিশানা ভুল করেছিলাম। আমার হাত কাঁপছিল ক্রমাগত। তবুও আমি দমে গেলাম না। নিলয়কে একেবারেই শেষ করে ফেললাম।
এতক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে ছিল অফিসার শীলা। সামিয়ার সমস্ত কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার পর সে সামিয়ার কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় সামিয়াকে কোন কথা বলে গেল না। সামিয়াকে কী বলবে সেটাই আসলে সে ভেবে পাচ্ছিল না। সামিয়া যা করেছে আপাত দৃষ্টিতে তা অপরাধ মনে না হলেও; সে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী। যত যাই হোক, খুন কোন কিছুর সমাধান হতে পারে না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারোরই নেই।
দুদিন বাদে সামিয়াকে কোর্টে হাজির করা হলো। সামিয়ার সমস্ত কথা অফিসার শীলা কোর্টে জজ সাহেবের সামনে উপস্থাপন করলো। জজ সাহেব অফিসার শীলার কথা শোনার পর সামিয়া কে জিজ্ঞেস করলো, তার মতামত কী। সামিয়া একবাক্যে স্বীকার করলো সে এই খুন দুটো স্বেচ্ছায় করেছে। আর এই খুনের দায়ও সে স্বীকার করে নিচ্ছে। জজ সাহেব সমস্ত শুনানি শেষ করে সামিয়াকে যাবতজীবন কারাদণ্ড প্রদান করলেন। এবং যেহেতু সে নিজেকে বাঁচাতে, সমাজের আর দশটা মেয়েকে বাঁচাতে এই কাজ করেছে; সেহেতু তাকে কিছুটা শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। শেষে তাকে দশ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হলো।
আদালতের সমস্ত কার্যক্রম শেষে সামিয়াকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। আবারও সেই অন্ধকার কক্ষে তাকে বন্দী করা হলো। সে বারবার আদালতে আর্জি করেছে তাকে যেন ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়, কিন্তু আইন অনুযায়ী তাকে সেটা দেওয়া হয়নি। সে এই ঘুনে খাওয়া জীবন নিয়ে আরো কিছু বছর বেচেঁ থাকবে। হয়তো সমস্ত সাজা শেষে আবারও এই সমাজে ফেরত আসবে। সমাজের চোখে একজন খুনীর পরিচয়ে থেকে যাবে। কিংবা, এর আগেই তার জীবনের ভবলীলা সাঙ্গ হবে। উপর ওয়ালা ওর উপর দয়া করবেন। ওকে এই নরক জীবন থেকে উদ্ধার করবেন। তখনও কী জীবনের স্বার্থকতা চরিতার্থ হবে? এই পৃথিবীর শাস্তির থেকেও যে, ওই জীবনে আরো বেশি শাস্তি অপেক্ষা করছে!
সমাপ্ত