তোকে দিয়েছি মন পর্ব ৪১+৪২

তোকে_দিয়েছি_মন❤
৪১.৪২
পর্ব – ৪১
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমি পেটে হাত রেখে কটমট চোখে জায়মার দিকে তাকিয়ে আছি। মেয়েটা আমার মেজাজ তুঙ্গে তুলে দিচ্ছে। না জানি কখন কি হাতে নিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিবো মেয়েটার। নিজের উপর একদমই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না। তার উপর ফ্যাচ ফ্যাচ শব্দ করে কেদে চলেছে মেয়েটা। চোখমুখ ফুলে ফেপে লাল টুকটুকে হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে থাপ্পর মেরে আরো এক্সট্রা লাল করে দিতে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম আমি। চোখমুখে গাম্ভীর্য এনে বলে উঠলাম—

তুই যদি এই মুহুর্তে কান্না থামিয়ে আসল কথাটা না বলিস তাহলে কিন্তু বাড়ি থেকে এখনি বের করে দিবো তোকে আমি।

জায়মা ওরনা দিয়ে চোখ মুছে ডায়নার দিকে তাকালো। ডায়না দরজার সামনে মাথা নিচু রেখে দাড়িয়ে আছে। আমি ডায়না আড়চোখে দেখে নিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালাম–

মিস ডায়না এখানেই থাকবে। যা বলার ওর সামনেই বল।

জায়মা আরেকবার ভালো করে চোখমুখ মুছে টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিল। গড়গড় করে পুরো গ্লাসের পানিটা শেষ করে আবার টেবিলে রাখল। কান্না জড়ানো কণ্ঠে অনেকটা আটকে আটকে উচ্চারণ করল—

আমি প্র্যাগনেন্ট।

জায়মার কথায় আমার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করল মুহুর্তেই। যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হল। বুকের মধ্যে যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে এবার। বিস্ফোরণ শুরু গেছে ভেতরটায়। বিছানার চাদর মুষ্টিতে নিয়ে ডায়নাকে উদ্দেশ্য করে করে আমি বললাম–

মিস ডায়না আপনি এখন যান।

ডায়না মাথা হেলিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে জায়মার দিকে তাকালাম। রাগে ঠোট কাপছে আমার। চোখ দিয়ে পানির বদলে রক্ত বের হতে চাইছে। এখন যদি মেয়েটাকে আমি ঠাস ঠুস চড় দেই…. কেউ বাচাতে পারবে না তাকে। জায়মা আমার কাছে এসে হঠাৎ আমার দুই হাত জড়িয়ে ধরল–

দোস্ত আমি এখন কি করবো দোস্ত?? আমি যে ফেসে গেছি। থাঞ্চুও লাপাত্তা হয়ে গেছে। এবার কি হবে আমার?

আমি বাকা ঠোটে হাসলাম। ভ্রু কুচকে বললাম—

কেনো? থাঞ্চু থাকলে কি করতি? পুলিশ কেস? ঈশানকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতি? নাকি আমার আর ঈশানের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতি? কোনটা করতি শুনি??

জায়মা মাথা ঝাকিয়ে বলল— কিচ্ছু করতাম না দোস্ত! বিশ্বাস কর আমি কিচ্ছু করতাম না।

তোকে বিশ্বাস করবো?৷ বিশ্বাসের কথাটা বলতে লজ্জা করল না তোর? কোন মুখে বলিস তোকে বিশ্বাস করতে?

জায়মা বড় করে ঢোক গিলল। চুলের ঝুটিটা ঠিক করে সামনের অগোছালো চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল–

দেখ দোস্ত। আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। খুব বড় অন্যায়। ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়। আর সেইজন্য ক্ষমা চাওয়ার মুখও আমার নেই। আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইবো না। কিন্তু শুধু এইটুকু বলবো। আমার বাচ্চার কোনো দোষ নেই। তাহলে আমার ভুলের শাস্তি সে কেনো পাবে? ঈশানকে আমি না পেলাম। কিন্তু বাচ্চাটার তো ওর বাবাকে পাওয়া উচিৎ!

কথাটা শুনে আর থাকতে পারলাম না। শক্ত হাতে চড় বসালাম জায়মার ফ্যাকাশে গালের মাঝ বরাবর। আর জায়মা? গালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে চড়টা হজম করার চেষ্টা চালালো। অবশ্য এ ছাড়া আর কিই বা করার আছে তার? সহ্য করা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই। ঠিক এই মুহুর্তে এসে আমার মনে হচ্ছে শুধু আমি একলা বোকা নই। জায়মা আমার থেকেও দিগুন বোকা। নাহলে থাঞ্চু ওকে এতো সুন্দরভাবে ব্যবহার করল আমার আর ঈশানের সম্পর্ক ভাঙার অস্ত্র হিসেবে….আর ও কিচ্ছু বুঝতে পারলো না। অন্ধের মতো বিশ্বাস করল বেইমানটা কে। অবশ্য এই পরিণতি জায়মার হওয়ারই ছিল। কারণ বেইমানি সেও করেছে। আমার সাথে। প্রতারণা করেছে।এমনকি ঈশানের সাথেও। যাকে সে ভালোবাসে তার সাথে পর্যন্ত প্রতারণা করেছে। আর এই প্রতারককে আমি ছাড় দিলেও প্রকৃতি এতো সহজে ছাড় দিবে না। রিভেঞ্জ অফ নেচার খুব ভয়ানক জিনিস। আর সেইটাই এখন ভুগতে হবে জায়মাকে। আমিও চাই জায়মা এর পরিণাম ভোগ করুক। যেই নোংরা খেলা সে নিজে শুরু করেছিল সেইটা এবার নোংরা ভাবেই তাকে শেষ করতে হবে। দরকার হলে বাচ্চাটাকে শেষ করে দিবে সে। জায়মা আচমকা বিছানা থেকে নেমে ফ্লোরে বসে পরল। আমার পা জড়িয়ে কাদতে শুরু করল। ওর এমন আচরণে আমি হতবাক। জায়মা কাদতে কাদতে উচ্চারণ করল—

দোস্ত ঈশানকে বল আমায় বিয়ে করে নিতে। একটা ছেলের তো দুটো বিয়ে হতেই পারে। পারেনা বল?? আমি নিজেই তো কত দেখেছি। একজন মানুষ দুটো বিয়ে করে তিনটা বিয়ে করে এমনকি চারটা পর্যন্ত করে। তাহলে সমস্যা কই?? তুই বিশ্বাস কর আমি জীবনে কোনোদিন তোদর মাঝে আসবো না। শুধু বাচ্চাটার পরিচয় চাই আমার। নিজের বাসায় জবাবদিহি করার উপায় চাই। এটকু হলেই চলবে। আর কিচ্ছু লাগবে না বিশ্বাস কর! আমার চাহিদা শুধু এটুকুই তারু! দোহাই লাগে আমাকে ফিরিয়ে দিস না। তুই চাইলে ঈশান ঠিক মেনে নিবে। দুইটা জীবন এখন তোর ওপর নির্ভর করছে। আমাদের বাচাবি না তারু? প্লিজ!!

শোন জায়মা। তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সবার আগে দরকার তোর মানসিক চিকিৎসা। তারপর শারীরিক। বাচ্চাটা কে ফেলে দিবি তুই। অ্যাবর্শন করবি। এটাই এখন একমাত্র অপশন। আর যদি না পারিস….. তাহলে মরে যা। আমার কিচ্ছু যায় আসেনা।

বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিলাম আমি। জায়মা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। আমার এই রুপটা ওর অচেনা ছিল। আমি যে এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারি সেটা ও ভাবেনি। এমনকি আমি নিজেও ভাবিনি। জায়মার চোখের দিকে আর তাকানো যাবে না। তাহলেই মানবতাবোধ জেগে উঠবে আমার। এই মানবতা আমি চাইনা। মাঝে মাঝে মানবতাকে তুচ্ছ করে পশুত্ব বরণ করে নিতে হয়। সবসময় মহান হওয়া চলে না। তাহলে যে জীবনটা নদীর মতো হয়ে যাবে। নদীর মতো আত্মবিসর্জন দিতে হবে নিজের সব সুখ। কিন্তু জীবনটা তো নদী নয়! জীবন টা যে বৃক্ষের মতো। বৃক্ষের মতোই বেড়ে উঠতে হবে। বেচে থাকতে হবে। লড়াই করতে হবে। প্রয়োজনে স্বার্থপরও হতে হবে। শক্ত মুখে চোখের অনবরত ধেয়ে চলা স্রোত মুছে নিয়ে জায়মাকে উদ্দেশ্য করে আমি বললাম–

বেরিয়ে যা। এখনই বেরিয়ে যা তুই। আর কখনো এ বাসার ত্রিসীমানায় আসবি না। ফারদার যদি কখনো তোকে আমার বা ঈশানের আশেপাশেও দেখি….. সত্যি বলছি জানে মেরে ফেলব।

জায়মা আমার কথা উত্তর দিল না। শান্ত নজর ফিরিয়ে নিয়ে উঠে দাড়ালো। বিছানা থেকে বাদামী রঙের কাপড়ের ব্যাগটা তুলে নিয়ে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পুরোটা সময় আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিবেক নামক জিনিসটা বারবার নাড়া দিচ্ছিল জায়মাকে ফেরানোর জন্য। কিন্তু এবার আমি বিবেকের কথাও শুনলাম না আর আবেগের কথাও না। জায়মার ছায়া আমার দৃষ্টির অগোচরে মিলিয়ে যেতেই হাফ ছাড়লাম আমি। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঠিক তখনি মাথায় জেগে বসল এক অজানা ভয়। কিছু অজানা আতঙ্ক। জায়মা সবকিছু এতো সহজে মেনে নিবে তো? পরিস্থিতির কাছে হার মেনে যদি আরেকবার হিংস্র হয়ে উঠে সে? যদি ঈশানের কোনো ক্ষতি করে? পরিস্থিতি মানুষকে দিয়ে যেকোনো কিছু করাতে পারে। আর তার সাথে যদি থাকে ক্ষোভ নামক মারাত্মক ব্যাধি। তাহলে তো কথাই নেই। না জায়মাকে যেতে দেওয়া যাবে না। ওকে আটকাতে হবে। যে করেই হোক আটকাতেই হবে। আমি ডায়নার নাম ধরে চিৎকার করলাম। নিমেষেই দ্রুতপায়ে ছুটে এলো ডায়না। অস্থির গলায় বলল–

ইয়েস ম্যাম?

এই মাত্র যে মেয়েটা আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তাকে আটকাও। গার্ডদের বলো এখনি মেইন গেইট অফ করতে।

ওকে ম্যাম।

ডায়না তৎক্ষণাৎ টেলিফোন টা হাতে নিয়ে নিচে ইনফর্ম করে দিল। আমি উঠে গিয়ে জানালায় উকি দিলাম। ওরা জায়মাকে আটকে নিয়েছে। আমি ডায়নাকে উদ্দেশ্য করে বললাম–

মিস ডায়না! এই মেয়েটাকে হাত পা বেধে স্টোর রুমে ফেলে রাখো। তিনবেলা খাবার দেবে। যখন যেটা দরকার সবকিছু দেবে। আর ঈশান বাসায় ফিরে আসলে মেয়েটাকে গ্যারাজে ট্রান্সফার করবে। সেখানে বন্দী করে রাখবে। যতদিন আমি না বলবো ততদিন। আর ঈশান যেন কোনোভাবেই কিছু টের না পায়। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।

ডায়না চোখ বড় করে বলল— কিন্তু ম্যাম এটা কি করে সম্ভব?

সব সম্ভব। ঈশান যদি কিছু জানতে পারে তাহলে কিন্তু তোমার চাকতি যাবে এটা নিশ্চিত। সো বি কেয়ারফুল।

ডায়না দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবশেষে হতাশ গলায় বলল– ওকে ম্যাম।
🍂

তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ৪২
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমি মায়ের কাছে বসে মায়ের পা টিপে দিচ্ছি। জার্নি করে এসেই মায়ের পায়ে চিনচিনে ব্যাথা শুরু। সারারাস্তা বসে থাকতে থাকতে পা দুটো অনেকটা ফুলে গেছে। আমাদের বুড়িটা আবার বাবর্চি আঙ্কেলের সাথে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখতে ব্যস্ত। আর ভাইয়া যখন থেকে এসেছে খালি ঘুম আর ঘুম। আস্তো একটা রুম দখল করে ঘুমের অতল সাগরে খুব নিশ্চিন্তে সাতার কেটে বেড়াচ্ছে। আমার অবশ্য বেশ মজাই লাগছে আজ। সবার উপস্থিতিতে পুরো বাড়িটা কেমন গমগম করছে। ঈশান এখনো শপিং শেষ করে ফিরেনি। কিসের এতো কেনাকাটা করছে কে জানে?? মা হঠাৎ বলে উঠলেন —

অনেক হয়েছে তারু ছাড় তো। আর পায়ে ব্যথা করছে না। তুই এবার একটু আমার কাছে এসে বোস। তোকে একটু দেখি।

আমি হাসি হাসি মুখ করে মায়ের সামনে এসে বসলাম। মা মলিন মুখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আমার দুই গালে স্পর্শ করে কপালে চিন্তার ভাজ আটকে মা বললেন–

কিরে মা! তুই তো দেখছি শুকিয়ে গেছিস অনেক। মুখটা এমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে কেনো?? খাওয়া দাওয়া করিস না ঠিক মতো? মনে হচ্ছে যেন শরীরে কোনো বল নেই। হাটতে নিলেই পড়ে যাবি।

তুমি যে কি বলো না মা! আমি তো একদম ঠিকাছি এই! নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর খাওয়া দাওয়ার কথা বলছো?? এখানে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হয়না। অনেকটা রেস্টুরেন্টের মতো। যখন যেটা অর্ডার করবে সেটাই হাজির। দারুণ না??

বলতে বলতে হেসে উঠলাম আমি। কিন্তু মা আমার হাসিতে সায় দিলেন না। উনার চেখেমুখে এখনো দুশ্চিন্তার ছাপ। আমার এই সময়টা আসলেই মায়ের এমন দুশ্চিন্তা শুরু হয়। অবশ্য আমি এখনো মাকে জানাই নি বিষয়টা। জানালে যে কি করবেন আল্লাহ মালুম। এমনি আমাকে নিয়ে উনার চিন্তার অন্ত নেই। তার উপর এই বিষয়টা বলে মাকে এক্সট্রা টেনশন দেওয়ার মানে হয়না। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে কারো চিৎকারের আর্তনাদ শোনা গেল। আমি আর মা আতকে উঠলাম তীক্ষ্ণ শব্দের অত্যাচারে। দুজনেই ছুটে গেলাম তখনি। আর গিয়ে যেটা দেখলাম….. বিশ্বাস করেন রাসেল ভাই এমন কিছু দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। পুরো ঘর লন্ড ভন্ড হয়ে আছে। বিছানার চাদর অর্ধেক মাটিতে পড়ে আছে। ফিশ পন্ড ভেঙে মাছগুলো ফ্লোরে এক্কাদোক্কা খেলছে। পানিতে ভেসে যাচ্ছে সাদা টাইলসের ফ্লোর। আর রকিং চেয়ারটা প্রায় অর্ধেক ভাঙা। সব থেকে বেশি করুন অবস্থা হল বাবর্চি আঙ্কেলের। বেচারার মাথার বিশাল ক্যাপটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর উনি মাথায় হাত রেখে ভেজা ফ্লোর থেকে উঠে বসার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কপালের অনেকটা অংশই কেটে গেছে উনার। আমি বাবর্চি আঙ্কেলের এক হাত ধরে বসা থেকে দাড়াতে সাহায্য করলাম। পায়েও হয়তো ব্যাথা পেয়েছে বেশ। তাইতো সোজা হয়ে দাড়াতে পারছেন না। আমি আর মা অবস্থা পর্যবেক্ষন করে একবার চোখাচোখি করলাম। আমি বাবর্চি আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করলাম–

কি হয়েছে বাবর্চি আঙ্কেল?? পুরো ঘরের এমন করুন অবস্থা হল কি করে? ভুমিকম্প হয়েছিল নাকি?

উনি কপালের কাটা অংশে রুমাল ঠেকিয়ে বড় করে হাফ ছাড়তে ছাড়তে বললেন—

ভুমিকম্পও ঢের ভালো। বাবা রে বাবা! আমি আর জীবনে কাউকে ঘরবাড়ি ঘুরিয়ে দেখাতে যাবো না। আমার কাজ রান্না করা। আমি ওইটাই করবো। এসবে আমি আর নেই।

আমি বিস্ময় নিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মাও মুখে হা নিয়ে আমাকে দেখছেন। এসব কিছুর পেছনে যে বুড়ির কারসাজি আছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই আমার। মাও নিশ্চয়ই এতো ক্ষনে বুঝে গেছেন। আমি কোমরে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম–

বুড়িটা কোথায়?

বাবর্চি আঙ্কেল জড়েসড়ো হয়ে বললেন– জানিনা কোথায় গেছে। উনাকে কন্ট্রোল করা আমার সাধ্যি না ম্যাম।

আমি বাবর্চি আঙ্কেলের কাধে হাত রেখে মাথা নাড়িয়ে বললাম— আহা বলবেন তো কি হয়েছে। দাদী কি করেছেন শুনি।

বাবর্চি অসহায় মুখ করে বললেন– গোটা দশেক হাস এনেছিলেন একসাথে বেধে। আমি বললাম হাসগুলো কিচেনে রাখি…. লাঞ্চে রোস্ট হবে। উনি তো দিলেনই না বরং আমায় এক ঝারি মেরে সবগুলো হাসের পায়ের বাধন খুলে দিলেন।

কথা শুনে মাথায় হাত রাখলাম আমি। মা জিভ কাটলেন।

তারপর তারপর??

বাবর্চি আঙ্কেল বললেন— আমি তো ছুটোছুটি করছি হাস ধরার জন্য। আর এই ফাকে উনি কখন যে এই রুমে ঢুকে পড়লেন খেয়ালও করিনি। ক্লান্ত হয়ে রকিং চেয়ারে বসেছিলেন হয়তো। পেছন ছিল ফিশ পিন্ড। রকিং চেয়ারের অটো ম্যাসাজ সিস্টেম অন হয়ে গিয়েছিল। আর উনি ভাবছেন বাড়িতে ভুত আছে। ভুত উনার সাথে মশকরা করছে। তাই ভুত ভুত বলে চেচাতে চেচাতে স্টিক দিয়ে পিটিয়ে চেয়ার ভেঙে ফেলেছেন। ফিশ পন্ডেও আঘাত করে ভেঙে দিয়েছেন। এর মধ্যে আবার দু একটা হাস দৌড়াতে দৌড়াতে এখানে চলে এসেছিল। আমি হাস ধরতে এসে ভেজা টাইলসে আছাড় খেয়েছি। কাচ ঢুকে মাথা কেটে গেছে আমার। এখন হাস কোথায় আমি জানিনা। আর আপনার দাদীমার খবরও জানিনা। আমাকে ক্ষমা করবেন ম্যাম। আমার কোনো কথা শুনেন না উনি। কথায় কথায় খালি ঝারি দেয়। নবাবের পুত বলে গালি দেয়। আমার পক্ষে উনাকে সামলানো সম্ভব না। উনাকে বলবেন আমার থেকে দুরে থাকতে। ধন্যবাদ। আমি যাই ম্যাম। ( মায়ের দিকে ঘুরে) আসছি ম্যাম!

মা কপালে চিন্তার ভাজ নিয়েই মাথা দুলালেন। বাবর্চি আঙ্কেল খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। আর আমি কপাল চাপড়াতে লাগলাম৷ বুড়িটার জন্য মান সম্মান খোয়াতে হবে যা দেখছি। প্রথমদিনই এই ঘটনা। ভাগ্যিস বাড়িতে তেমন কেউ ছিল না। ঈশানের মা–বাবা ফিরে আসলে কি হবে সেটাই এখন ভাবছি। তাদের সামনেও বুড়িটা এমন হট্টগোল বাধিয়ে বসবে না তো ? তার উপর কাল আবার বাড়িতে এতোবড় অনুষ্ঠান। উফফ! কি একটা মুশকিল!

.

.

বিছানার এক প্রান্তে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে আছেন ঈশান। অপর প্রান্তে আমি বসে বসে ক্যাটবেরি চিবুচ্ছি। মাঝে মাঝে আড়চোখে ঈশানকেও দেখছি। খুব মনেযোগের সাথে ল্যাপটপে কি একটা করছেন উনি। সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমার উদ্দেশ্য এখন একটাই। যেভাবেই হোক এই রুম থেকে বের হতে হবে। ডায়না জায়মার ব্যবস্থা ঠিকঠাক করেছে কিনা দেখে আসা দরকার। কাল বাড়িতে রিসিপশন। কত কত মানুষ আসবে। ভীড় জমানো বাড়িতে জায়মাকে লুকিয়ে রাখাটা একটু বেশিই মুশকিল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। কিন্তু এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই। ঈশানের চোখ ফাকি দিয়ে যাস্ট একবার ঘর থেকে বের হতে পারলেই কেল্লাফতে। কিন্তু সেই কাজে সফল হওয়ার কোনো আশংকা আমি খুজে পাচ্ছি না। ঈশান হঠাৎই আমার দিকে দৃষ্টি দিলেন। ভয়ে আমার হাত থেকে ক্যাটবেরি পড়ে গেল। আমি চটজলদি ক্যাটবেরিটা তুলে নিয়ে উনার দিকে তাকালাম। আমার কান্ড দেখে হেসে উঠলেন উনি। আমিও উনার সাথে তাল মিলিয়ে হাসলাম। হাসি একদমই আসছে না তবু জোর করে হাসলাম। উনি এবার আরো জোড়ে হাসছেন। সেই হাসিতে রহস্যের ঘ্রাণ পেয়ে ভ্রু কুচকে তাকালাম আমি। আমি চাহনি দেখে উনি হাসি থামিয়ে দিলেন। খানিকটা কাছে এসে আমার দুই কাধে হাত রেখে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন আমায়। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আমি অবাক। পুরো মুখে চকলেট লেগে আছে। খুবই বাজে অবস্থা। এইজন্যই এভাবে হাসছেন উনি? ধুর! নিজেকে এখন বোকা বোকা লাগছে। ঈশান আরেক দফা হেসে বলে উঠলেন–

যাও তারা মুখ ধুয়ে এসো। তারপর আমরা ঘুমাবো। আই এম ভেরি টায়ার্ড এন্ড স্লিপলি অলসো।( আমার কাধে গলা রেখে)

আমি আমতা আমতা করে বললাম–

আচ্ছা তাহলে আপনি শুয়ে পড়ুন….. আমি একটু মায়ের সাথে দেখা করে আসছি।

এখন আবার মায়ের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কি দরকার? সারাদিন তো মায়ের সাথেই ছিলে। আর তাছাড়া সবাই এখন ঘুমাচ্ছে তো!

ঘুমাবে কেনো? মা এতো জলদি কখনোই ঘুমায় না। মাত্র দশটা বাজে। সবাই কি আপনার মতো ঘুমকাতুরে? সরুন তো….. আমি যাবো আর আসব। একটু যাই হ্যা?

ওকে!

থ্যাঙ্ক ইউ।( খুশি হয়ে)

কিন্তু জলদি আসবে। আর মুখটা ধুয়ে যাও।

আচ্ছা আচ্ছা!!

বলতে বলতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম আমি। মুখ ধোয়ার কাজ শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন কাজ হলো ডায়নাকে খোজা। সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে যাবো তখনি পেছন থেকে ডায়না ডাক দিল আমায়। মনে হচ্ছে আমার রুম থেকে বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিল সে। আমি ডায়নার হাত ধরে টেনে কিছুটা দুরে নিয়ে আসলাম। ডেন্জারজোনের এরিয়া পার হয়ে সেইফ জোনে গিয়ে দাড়ালাম দুজন। আমি ফিসফিস করে বললাম—

তারপর বলো। কি ব্যবস্থা করলে মেয়েটার?

ম্যাম,,, মেয়েটাকে এই বাড়িতে লুকিয়ে রাখা এমনিতেই খুব রিস্কি। যেকোনো সময় স্যারের কাছে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার উপর কাল বাড়িতে অনুষ্ঠান। তাই আমি মেয়েটাকে অন্য একটা জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি।

অন্য জায়গায় মানে? কোথায়?

হসপিটালে।

হোয়াট?

ম্যাম দেখুন….. ওই জায়গাটাই সব থেকে বেশি সেইফ। কেউ সন্দেহও করবে না। সেখানে একটা আলাদা কেবিন বুক করে মেয়েটাকে রাখা হয়েছে।

কিন্তু এতো জায়গা থাকতে হসপিটালে কেনো??

কারণ ওই হসপিটালের নার্স আমার ছোটবোন। ওর দায়িত্বেই সবকিছু দিয়েছি আমি। আপনি টেনশন করবেন না। সব ব্যবস্থা করা আছে। যখন যেটা দরকার হবে পাঠিয়ে দিবো। যতদিন চাইবেন অনায়াসে রাখা যাবে। শুধু এক্সট্রা টাকা খরচ হবে। এই আর কি….

আমি বড় করে উচ্চারণ করলাম— ওওও!! আইডিয়াটা খারাপ না….. বরং বেশ ভালোই হয়েছে এতে। তোমার বোনের নাম কি?

ডানা ডি কস্টা।

আমি উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ডায়নাকে একবার দেখে নিয়ে বললাম– তুমি খ্রিস্টান?

জ্বী ম্যাম।

ও আচ্ছা! যাই হোক যা করেছো ভালোই করেছো। আর খেয়াল রাখবে ঈশান যেন ভুলেও টের না পায়। বাই দ্যা ওয়ে একবার পরীক্ষা করিয়ে নিও তো মেয়েটা সত্যিই প্রেগন্যান্ট কিনা?

ম্যাম সত্যিই প্রেগন্যান্ট। টেস্ট হয়েছে।

ও…… আচ্ছা বাচ্চা টা অ্যাবর্শন করাতে পারবে? মেয়েটা যেন না জানতে পারে। মানে এমন কিছু খাইয়ে দিবে যেন মিস ক্যারেজ হয়ে যায়। পারবে?

হ্যা ম্যাম পারব……এইটা কি কোনো ব্যাপার?

আমি বড় করে হাসলাম— খুব ভালো। তাহলে কাজটা কালকের মধ্যেই সেরে ফেলো। তারপর মেয়েটা যেখানে খুশি চলে যাক। কি আসে যায়!

বলতে বলতে হালকা হাসলাম আমি। ডায়নাও আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল।

আচ্ছা তাহলে ডিসিশন ফাইনাল। কালকের মধ্যেই প্ল্যান সাকসেস হওয়া চাই।

ওকে ম্যাম! ডান।

ডান!

ডায়নাকে বিদায় জানিয়ে রুমে ঢুকতে যাচ্ছিলাম আমি। পেটের ব্যথাটা আবার চড়ে বসেছে। উফফ মাঝে মাঝে এমন মোচড় দেয় না….. মনে হয় যেন সব বমি হয়ে বেরিয়ে আসবে। ঈশানকে দেখলাম এখনো ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন। উনাকে কিছু একটা বলতে যাবো….. তার আগেই চোখে ঝাপসা দেখলাম আমি। চারিদিক ঘুরে এলো মুহুর্তেই। অতঃপর সব অন্ধকার….. এর মাঝে একবার ঈশানের গলার আওয়াজ শুনেছিলাম। এর বেশি কিচ্ছু মনে নেই।

.

.

চোখ মেলে তাকাতেই আবিষ্কার করলাম আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি। আমার ঠিক ডান পাশে খানিকটা দুরে বসে আছেন ঈশান। ঈশানের বরাবর বিপরীত পাশে একজন বয়স্ক চাশমিশ মহিলা বসে আছেন। যা বুঝলাম…. ইনি একজন ডক্টর। আর ঈশান আমাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছেন। ডক্টর মহিলাটা চশমা নাড়াতে নাড়াতে ঈশানকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলছেন। আর ঈশান সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাঝে মাঝে নখ কামড়াচ্ছেন। খুব টেনশনে থাকলে ঈশান নখ কামড়ায়। এখনো কি উনি খুব টেনশনে আছেন?? ডক্টর কি এমন বলছেন উনাকে?? আমি খুব একটা শুনতে পাচ্ছি না…… শুধু যেটুকু শব্দ কানে এলো সেটুকুই ঝংকারের মতো বারবার বাজতে লাগল কানে। শব্দটা হল আমি স্থায়ীভাবে একজন বন্ধ্যা। মানে আমি কখনো সন্তান জন্ম দিতে পারবো না।
কিন্তু কেনো? কি এমন হয়েছে আমার? বিচলিত দৃষ্টি নিয়ে ঈশান আর ডক্টরের দিকে তাকালাম আমি।
🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here