তোমাতে রহিব বিলীন পর্ব ১+২

এনগেইজমেন্টের পূর্ব মুহূর্তে বড় আপুর ছোট দেবরকে হবু বর ভেসে দেখা মাএই অকস্মাৎ তব্দিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। প্রকান্ড চোখে ঘোর উত্তেজনা নিয়ে আমি “আহনাফের” দিকে তাজ্জব ভঙ্গিতে চেয়ে আছি। ট্যারা চোখে আহনাফ ঠোঁটের আলিজে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আমার গাঁয়ের সাথে একদম চিপকে দাঁড়িয়ে আচমকা আমার কানে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে মিনমিনে কন্ঠে বললেন,,

“হায়এ! লাল শাড়ি! মার ডালা লুক ইয়ার! আমি তো রীতিমতো বেসামাল হয়ে পড়লাম আপনার এই হৃদমোহিনী রূপে, “মিস প্রভা!”

উনার আচমকা এই লাগামহীন কথা বার্তায় চোখের ব্যাসার্ধ অত্যধিক প্রকান্ড হয়ে এলো আমার। প্রকান্ড চোখ জোড়ায় এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে উনি পুনরায় আমার কর্ণকুহরে উষ্ণতার শিহরণ তুলে বললেন,,

“কন্ট্রোল ম্যাম, প্লিজ কন্ট্রোল। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে এতো মায়া ভরা ঢাগড় আঁখি দিয়েছেন। নিশ্চয়ই কোটর থেকে আঁখিদ্বয়কে ভূমিষ্ট করার জন্য নয়! চোখবিহীন আপনাকে দেখতে ক্ষ্যাত লাগবে, ক্ষ্যাত! কোনো মাধূর্যই খুঁজে পাওয়া যাবে না তখন। উডবি হাজবেন্ড হয়ে আপনার এই বিশ্রী রূপ কিভাবে আমি মেনে নিবো বলুন? হৃদয়ে তো ছোট খাটো আঘাত আমার ও লাগবে তাই না?”

উনার তপ্ত শ্বাসের উষ্ণ আঁচে আমার শরীরের প্রতিটা লোমকূপে শীতল শিহরণের তান্ডব বয়ে গেলো। চেয়ে ও এই মন মাতানো শিহরণকে আমি উপেক্ষা করতে পারছিলাম না। নূন্যতম কয়েক মিনিটের জন্য সেই হৃদয় কাঁপানো অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিয়ে আমি পুনরায় নিজের কাঠিন্য রূপে ফিরে এলাম। চোখ জোড়া লাল করে আমি চোয়াল শক্ত করে আহনাফের দিকে তাকাতেই আহনাফ দাঁত কেলিয়ে হেসে উনার বাঁ হাতটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,,

“লেডিস ফার্স্ট ম্যাম। ফার্স্টে আপনি রিংটা পড়ান! ”

শুকনো মুখে আমি উপস্থিত দু পরিবারের সবার দিকে কাঁপা দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। সবার মুখে প্রানোচ্ছ্বল হাসির রেশ লেগে আছে। বুঝাই যাচ্ছে, পরিবারের সবাই খুব খুশি আহনাফ এবং আমার এনগেইজমেন্টে। সবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি রাগান্বিত দৃষ্টিতে ধারালো নখ দিয়ে আহনাফের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম। আহনাফ উনার (-০.৩০) পাওয়ারের চশমাটা একটু নিচু করে আমার হাতের দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“হাতটা ধরতে বলি নি ম্যাম। জাস্ট রিংটা পড়াতে বলেছি! পরিবারের সামনে হবু বরের সাথে রোমান্স করার ভীষণ স্পিড দেখছি আপনার! ভাবতেই পারি নি, এত্তো রোমান্টিক টাইপ একটা মেয়ে, ওয়াইফ হিসেবে আমার ভাগ্যে জুটবে! আমার তো লাক লেগে গেলো “মিস প্রভা? আঁচড়ের দাগ ও পড়ে যাচ্ছে হাতে। তার মানে আমি কি ধরে নিতে পারি? আপনার ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ এটা আমার?”

দাঁতে দাঁত চেঁপে আমি আহনাফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“আপনার সাথে রোমান্স করতে আমার বয়ে গেছে, বুঝেছেন মিঃ চাশমিশ? আপনার ক্যারেক্টার সম্পর্কে হেব্বি নলেজ আছে আমার। ক্যারেক্টারলেস কাহিকা! চরিএে দোষ আছে আপনার। প্রখর রোমান্সে ভরা তো আপনি। ছুকছুকে টাইপ লোকদের আবার রোমান্টিক ওয়াইফ হওয়া চাই নাকি?”

মুহূর্তের মধ্যেই আহনাফ ভাব ভঙ্গি পাল্টে প্রখর রাগে ক্ষীপ্ত হয়ে চোয়াল শক্ত করে বললেন,,

“এক্সকিউজ মি, মিস প্রভা! হোয়াট আর ইউ সে এবাউট মি? আমি ক্যারেক্টালেস? চরিএে দোষ আছে আমার?”

আমি উড়নচণ্ডী ভাব নিয়ে বললাম,,

“আছে বৈ কি? আলবাত আছে। সত্যি কথা বলাতে গাঁয়ে খুব লেগেছে তাই না?”

আহনাফের পা থেকে মাথা অব্দি একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে আমি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে পুনরায় বললাম,,

“দেখি দেখি, কোথায় কোথায় ফোঁসকা পড়েছে? দেখানো যাবে তো ফোঁসকা গুলো?”

আহনাফ অগ্নিঝড়া চোখে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,,

“ইউ ইস্টুপিট গার্ল। ফোঁসকা আমার গাঁয়ে নয়, তোমার গাঁয়ে পড়বে। দেখানোর জায়গা ও খুঁজে পাবে না তখন! কেঁদে বুক ভাসিয়ে ও তখন কষ্ট নিবারণ করতে পারবে না। ইউ নো হোয়াট মিস প্রভা? তোমাকে টাইট করার জন্যই এই আহনাফ ফিরে এসেছে! তুমি না জাস্ট দেখতে থাকো, সামনে কি কি হয়!”

আমি উগ্র কন্ঠে বললাম,,

“জানি, জানি। আপনাদের মতোন অত্যাচারী পুরুষদের দৌঁড় আমার বেশ ভালো করেই জানা আছে! বধূ নির্যাতন করবেন তাই তো? আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন মিঃ আহনাফ, দেশে নারী নির্যাতনের অনেক কঠোর আইনবিধি আছে। একবার যদি কেইস ঠুকে দেই না? পারবেন তো ১০ বছরের পূর্বে গারোদের অন্ধকার জগত থেকে বেরিয়ে আসতে?”

আহনাফ আমার মাথায় আঙ্গুল ঠুকে তটস্থ কন্ঠে বললেন,,

“কেইস ঠুকার আগে আমিই তোমাকে ঠুকে দেবো। মার্ডার করে ফেলব একদম, মার্ডার। আহনাফকে চিনতে তুমি ভুল করছ, মস্ত বড় ভুল করছ! রিপেন্ড করবে একদিন বুঝেছ?”

ভ্রু যুগল কুঁচকে আমি কিঞ্চিৎ রাগী কন্ঠে বললাম,,

“আপনি যে ক্যারেক্টারলেস ওটা আমি আগে থেকেই জানতাম। তবে আজ নতুন করে জানলাম আপনি একজন খুনি ও বটে। যখন তখন লোকজনকে মার্ডার করার হুমকি দিন। বলি, কয়টা মার্ডার করেছেন এই পর্যন্ত হুম?”

আহনাফ উনার প্রখর রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে কপালে লেপ্টে থাকা বেসামাল চুল গুলো হালকা হাতে টেনে বললেন,,

“এনগেজমেন্টটা জাস্ট হয়ে নিক, এরপর বুঝাচ্ছি আহনাফের শেখের সাথে মুখে মুখে তর্ক করার ফল। তাকে ক্যারেক্টারলেস বলার ফল! হারে হারে টের পাবে তখন আহনাফ কি জিনিস। তোমাকে মার্ডার করেই তবে আমি খুনির তকমা গাঁয়ে মাখবো। এটাই হবে আমার ফার্স্ট মার্ডার! তোমাকে দিয়েই স্টার্ট করব বুঝতে পেরেছ?”

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,,

“ফান অফ দ্যা ইয়ার। আপনাকে বিয়ে করতে, আপনার সাথে এনগেজমেন্ট করতে বয়ে গেছে আমার। পৃথিবীতে নিশ্চয়ই ছেলের অভাব পড়ে নি? আমার মতো কিউট, সুইট প্রভা যদি ছোট্ট একটা তুড়ি মারে না? লাইনে হাজার হাজার ছেলে ভীড় জমাবে!”

আহনাফ ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে অকস্মাৎ বাঁকা হেসে আমার দিকে চেয়ে বললেন,,

“তার মানে তুমি স্বীকার করছ, হাজারটা ছেলের জীবন অলরেডি নষ্ট করে দিয়েছ? প্রেমের জালে তাদের খুব বাজেভাবে ফাঁসিয়েছিলে তাই না?”

থতমত খেয়ে আমি শুকনো কন্ঠে আহনাফকে বললাম,,

“মামামানে? কাকাকাদের আমি প্রেপ্রেপ্রেমের জালে ফাঁসিয়েছি?”

আহনাফ এক রহস্যময়ী হাসি দিলেন। উনার এই রসাত্মক হাসির পেছনে জানা, অজানা অনেক কথা লুকিয়ে আছে। আকস্মিক ভয়টা যেনো আমার প্রখরভাবে বেড়ে গেলো। যেই বিশেষ ভয়টার আঁচ করছিলাম আমি সেই ভয়টাই যেনো সত্যি হতে তৎপর হয়ে উঠেছে। ভয়াল দৃষ্টিতে আমি পাশে অস্থিরতা নিয়ে নখ কাঁমড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তিস্তার (আমার বেস্ট ফ্রেন্ড) দিকে তাকালাম। তিস্তা শুকনো ঢোক গিলে আমায় ইশারা করে বলল,,

“দোস্ত। তু তো গায়া কাম চে!”

কম্পিত কন্ঠে আমি তিস্তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে নিজেই নিজেকে বকে বললাম,,

“ইসসসসস প্রভা। কি করলি এটা? ফটো না দেখে বিয়েতে রাজি হওয়ার ফল এবার ভোগ কর! এই বজ্জাত ছেলে নিশ্চয়ই এখন তোর বারোটা বাজিয়ে তেরোটায় লাগিয়ে ছাড়বে। সব গুপ্ত রহস্য এক এক করে টেনে হেঁছড়ে বের করে আনবে। জিনা হারাম করে দিবে আমার, জিনা!”

আমার মৌণতা দেখে আহনাফ হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে আমার দিকে খানিক ঝুঁকে পৈশাচিক হাসি দিয়ে জিগ্যাসু কন্ঠে বললেন,,

“কি মিস প্রভা? কিছু ভাবছেন?”

রাগান্বিত ভঙ্গিতে ও আমি জোর পূর্বক হাসি টেনে বললাম,,

“বেশি কিছু না মিঃ চাশমিশ। আপনাকে মার্ডার করার উপায় খুঁজছিলাম মাএ। ভাবছি, আপনার পূর্বেই আপনাকে মার্ডার করে একটু স্বস্তির শ্বাস নিবো আমি! মুক্ত, উচ্ছ্বল, উদাসী হাওয়া ফুসফুসে সঞ্চার করব। আসলে, দেশে ক্যারেক্টারলেস ছেলেদের সংখ্যা বেড়ে গেছে তো তাই!”

আহনাফ ভাব শূণ্য কন্ঠে বললেন,,

“ওহ্হ্হ্ আই সি। আমি তো ভাবছিলাম তুমি হয়তো এই ক্যারেক্টারলেস ছেলেটার সাথেই রোমান্স করার স্কোপ খুঁজছ। ওয়ার্ণ করার পরে ও হাতটা যেভাবে ধরে আছো! রোমান্সের শিহরণ তো আমারো হচ্ছে তাই না?”

শেষের কথাটা আহনাফ কেমন যেনো ঘোর লাগানো স্বরে বললেন। উনার মুখ থেকে নিঃসৃত তপ্ত শ্বাস আমার সারা মুখে প্রখর রোমাঞ্চের ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। সমস্ত রোমাঞ্চরকর অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করে আমি জিভ কেটে আহনাফের হাতের দিকটায় হীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। নখের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে উনার ফর্সা হাতটায়। ফোঁটা ফোঁটা রক্তের উদ্ভব ঘটেছে ঐ ক্ষত স্থান গুলো থেকে। ভীষণ হীনমন্যতা বোধ করে আমি ঝট করে আহনাফের হাতটা ছাড়তেই পল্লবী আপু (আমার বড় বোন) ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। এনগেজমেন্ট রিংটা আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“নে। রিংটা পড়িয়ে দে। এমনিতেই অনেকটা লেইট হয়ে গেলো রিংটা খুঁজতে।”

প্রখর রাগে ফুসফুস করে আমি আপুর কানে ফিসফিসিয়ে বললাম,,

“তোমরা আর পাএ খুঁজে পেলে না আপু? এই বিদেশ ফেরত লম্পট ছেলেটাকেই আমার গলায় ঝুলানোর সুন্দর একটা বন্দোবস্ত করে নিলে?”

আচমকা আপু ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললেন,,

“মারব এক চড়। ভুলে যাস না, আহনাফ আমার দেবর।”

“সো? তোমার দেবর হয়েছে তো কি? আমার মাথা কেটে নিয়েছে? দেশের মন্ত্রীত্ব ছিনিয়ে নিয়েছে? আমার স্বাধীনতাবোধে হস্তক্ষেপ করার অধিকার অর্জন করে নিয়েছে?”

“আমরা মোটেও কিন্তু তোকে এক্ষনি বিয়ে করার জন্য জোর জবরদস্তি করি নি প্রভা। তুই নিজে থেকেই বলেছিলি তোর জন্য পাএ খুঁজতে! পাএ হিসেবে আহনাফকে আমাদের বেস্ট মনে হয়েছে। তাই আমরা এনগেজমেন্টের এই ব্যবস্থাটা করেছি। যখন আমরা বিয়েতে তোর মতামত জানতে চেয়েছিলাম, আহনাফের ছবি দেখাতে চেয়েছিলাম, তখন কিন্তু তুই আমাদের সিদ্ধান্তের উপর মতামত ছেড়ে দিয়েছিলি। এখন আর কোনো বার্কেটিং করা যাবে না ওকে? আমাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তোকে আহনাফকে এনগেজমেন্ট এবং বিয়েটা ও করতে হবে!”

আমি অধৈর্য্য কন্ঠে বললাম,,

“পাএ খোঁজার কথা আমি বলেছিলাম মানছি। তবে তোমার এই লম্পট দেবরের কথা তো বলি নি ঘুনাক্ষরে ও বলি নি আমি! বিশ্বাস করো আপু, হাজবেন্ড হিসেবে উনাকে আমি কস্মিনকালেও চাই নি! উনার সাথে কখনোই আমার বনাবনি হয় নি। না আগামীতে কখনো হবে!”

আপু রগচটা ভাব নিয়ে বললেন,,

“প্রভা। এবার কিন্তু আমি বাধ্য হবো তোর গাঁয়ে হাত তুলতে। অযথা ড্রামা ক্রিয়েট না করে, চুপচাপ আংটি টা পড়িয়ে দে আহনাফকে!”

দৃষ্টি সংকুচিত করে আমি মুখে তিক্ততার ছাপ ফুটিয়ে বললাম,,

“না আপু। আমি কিছুতেই উনাকে আংটি পড়াতে পারব না। উনাকে বিয়ে করার মোটে ও ইচ্ছে নেই আমার। প্লিজ তোমরা আমাকে ফোর্স করো না! বিয়েটা এক্ষনি ভেঙ্গে দাও।”

আপু দাঁতে দাঁত চেঁপে আমার ডান হাতটা চেঁপে ধরে বললেন,,

“নাটক করছিস তুই? নাটক? আমার শ্বশুড় বাড়ির সবার সামনে আমাদের পরিবারের মান সম্মান নিলামে তুলতে তুই উঠে পড়ে লেগেছিস তাই না? জানিস, তোর এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দুই পরিবারের সবাই কতোটা কষ্ট পাবে? আমাদের মধ্যকার সুন্দর সম্পর্কটা কতোটা নষ্ট হবে? ভালোয় ভালোয় বলছি, আংটিটা পড়িয়ে দে আহনাফকে। আহনাফের চে ভালো পাএ তুই দু কূলে ও খুঁজে পাবি না!”

আপু অবশ্য ভুল কিছু বলে নি। আমার এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দুই পরিবারের সবাই ভীষণ কষ্ট পাবেন। এতো সুন্দর সম্পর্কটা ও নষ্ট হয়ে যাবে। জীবনে অনেক পাপ করেছি আমি। সেই পাপের মোচন আমাকে ঐ চাশমিশ, ক্যারেক্টারলেস, উগ্র আহনাফকে বিয়ে করেই সাফ করতে হবে। মাথা নিচু করে আমি অপারগ হয়ে আহনাফের বাঁ হাতের অনামিকা আঙ্গুলটা চেঁপে ধরে রিংটা পড়িয়ে দিয়ে তেজর্শিনী দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,,

“কি ভেবেছেন আপনি? আমি আপনাকে ভয় পাই? ভয়ে খুব সিঁধিয়ে যাবো? আপনার মতো লম্পটকে বিয়ের করার সাহস পর্যন্ত পোষণ করাতে পারব না? আমার বুঝি থরথরিয়ে হাত, পা কাঁপবে?”

আহনাফ দুষ্টু ভঙ্গিতে হেসে সাদা পায়জামার পকেট থেকে ডায়মন্ডের এনগেজমেন্ট রিংটা আমার বাঁ হাতের আঙ্গুলে পড়িয়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,,

“লম্পট না? সাহসের ভালোই পরিচয় দিচ্ছ! আমি যদি লম্পট হই না? তুমি ও কিন্তু লম্পটের স্ত্রী বাচক লিঙ্গ হবে। এজ লাইক “লম্পটিনী।” এই বিষয়ে তুমি আমার থেকে এক ধাপ এগিয়ে বুঝলে?”

কথার ফুল ঝুড়ি যেনো মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেলো আমার। শুকনো মুখে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে আছি। আহনাফ চোয়াল শক্ত করে পুনরায় বললেন,,

“হাসি খুশি মুখের আড়ালে যে একটা তেজীয়ান রূপ লুকিয়ে আছে তা হয়তো এখনো তুমি টের পাও নি। আর সেজন্যই ভীষণ পটর পটর করছ! তোমার ফিউজ কিভাবে উড়াতে হয় আমার ভীষণ ভালোভাবে জানা আছে মিস প্রভা! পুরোপুরি হাতের মুঠোয় তোমাকে বন্দি করে নেই, এরপর দেখো, তুড়ি মেরে তোমাকে উড়িয়ে দিতে ঠিক কতো সময় লাগে আমার।”

ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে আমি আহনাফের দিকে তাকাতেই আহনাফ ঝাঁঝালো কন্ঠে আমার একদম সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললেন,,

“আগে আগে দেখো, হোতা হে কেয়া!”

অসহায় ভাবভঙ্গি পাল্টে আমি চোয়াল শক্ত করে জিগ্যাসু কন্ঠে বললাম,,

“এই? আপনি কি কোনোভাবে আমাকে থ্রেড দিচ্ছেন?”

আহনাফ ভাবশূণ্য হয়ে পায়জামার পকেটে দু হাত গুজে বললেন,,

“যা খুশি ভাবতে পারো! আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার!”

পরমুহূর্তে উনি খানিক ঝুঁকে আমার মুখের কাছে এসে বাঁকা হেসে বললেন,,

“বাই দ্যা ওয়ে, কংগ্রাচুলেশান “মিসেস প্রভা।” আজ থেকে আপনি এই “আহনাফ শেখের” উডবি ওয়াইফ। জারা সামহালকে রেহে না ওকে?”

ঠোঁটের কোণে একই হাসি বজায় রেখে আহনাফ তড়িঘড়ি করে আমার সম্মুখ থেকে সরে এসে ইয়ানাত আঙ্কেলের (আহনাফের বাবা) মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললেন,,

“আই থিংক বাবা, এনগেজমেন্ট আপাতত ডান। আমি নিশ্চয়ই এবার আসতে পারি?”

আঙ্কেল বেশ গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন,

“নো আহনাফ। আজ তোমার অফিসে যাওয়া হবে না। এই শুভ দিনে বাড়ির বাইরে একদম পা রাখা চলবে না! জাস্ট একদিন অফিস মিস করলে মহা ভারত কিছু অশুদ্ধ হয়ে যাবে না!”

আহনাফ বিরক্তি ভরা চোখে আঙ্কেলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আপু মৃদ্যু হেসে পেছন থেকে আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বললেন,,

“আজ থাক না আহনাফ। মাএ তো এনগেজমেন্টটা হলো। আই থিংক প্রভার ও তোমার সাথে কিছু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা দরকার!”

আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,,

“ইউ নো হোয়াট ভাবি? ঠিক ৮ টায় আমার ইম্পর্টেন্ট একটা মিটিং আছে। কিভাবে স্কিপ করি মিটিংটা বলো?”

“তোমার বড় ভাই তো আছেই আহনাফ। আজ ছেড়ে দাও না। প্রভার ও হয়তো মন খারাপ হতে পারে তাই না? এই বিশেষ দিনটায় তুমি ওর পাশে থাকবে না!”

মুখ বাঁকা করে আমি চোখে প্রখর রাগ সমেত আপুর দিকে চেয়ে আছি। ঐ লম্পট আহনাফের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে আমার বয়ে গেছে। পারলে তো একে আমি গলা টিপে মেরে দেই। একদম এটেম টু মার্ডার করে দেই। এই লম্পট ছেলের গার্লফ্রেন্ডের আবার অভাব আছে নাকি? মুহূর্তে মুহূর্তে তার এই ফোন থেকে সেই ফোন থেকে হাজার হাজার মেয়েদের কল আসে। সেই লম্পট ছেলে নাকি আবার এই প্রভার হাজবেন্ড হবে। হা, হাসালে আমায়! বিয়ের আগের রাতেই কিভাবে পালাই দেখো না। পুরো শহর সার্চ করে ও খুঁজে পাবে না আমায়।

আচমকা আহনাফ পিছু ঘুড়ে আমার দিকে ট্যারা চোখে তাকিয়ে বাঁকা হেসে আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“আমার এবসেন্সে তোমার বোনের মোটে ও বোরিং ফিল হবে না ভাবী। রেদার সে সময়টাকে ভীষণভাবে এন্জ্ঞয় করবে। কতো কি লুকিয়ে আছে ফোনে। সিম সহ একটা ফোন পেলেই হলো তার! আশেপাশে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির প্রয়োজন নেই!”

পুনরায় আহনাফ চশমার নিচ থেকে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমায় প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কি? ঠিক বলছি তো মিস প্রভা? উফফস স্যরি, মিসেস প্রভা!”

উনার গাঁ জ্বলা মুখভঙ্গি এবং বেহুদা প্রশ্নের কোনো রূপ প্রতিত্তুর না করে আমি রাগে গজগজ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিস্তার হাত ধরে দ্রুত পায়ে দু তলার ছাঁদের দিকে অগ্রসর হলাম।
#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_২
#নিশাত_জাহান_নিশি

উনার গাঁ জ্বলা মুখভঙ্গি এবং বেহুদা প্রশ্নের কোনো রূপ প্রতিত্তুর না করে আমি রাগে গজগজ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিস্তার হাত ধরে দ্রুত পায়ে দু তলার ছাঁদের দিকে অগ্রসর হলাম।

ছাদের দরজাটা খুলেই আমি তিস্তার হাতটা ছেড়ে ধপাধপ পায়ে হেঁটে প্রখর রাগে রাগান্বিত হয়ে ছাদের ঠিক পশ্চিম প্রান্তের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালাম। রাগে, দুঃখে, অপার জেদে আমার গাঁ টা যেমন তুষের আগুনের মতোন জ্বলছে তেমনি মাথাটা নিদারুন যন্ত্রণায় কিলবিল করছে। হাত, পা কঁচলে আমি দাঁতে দাঁত চেঁপে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলে ও রাগটা যেনো কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছি না। হা, এই জন্মে আমার নিজস্ব রাগটাকে আমি কন্ট্রোল করতে পারলাম না। যতক্ষণ না রাগের কারণটা আমার মন মতোন হচ্ছে কিছুতেই যেনো আমার রাগ কমবে না। রাগ নিবারণের জন্য আমি শক্ত রেলিংয়ের পিঠে আমার নরম হাত জোড়ায় অনবরত আঘাত করে চলছি। আঘাতের কোনো ব্যাথাই যেনো আমার হাতে লাগছে না। আমার এহেন অসহ্যকর অবস্থা দেখে তিস্তা আমার পাশে দাঁড়িয়ে নখ কাঁমড়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল,,

“আমার কি মনে হয় জানিস প্রভা? “আহনাফ শেখ” সমস্ত গুপ্ত রহস্য জেনে গেছেন!”

আমি দাঁত চেঁপে হেয়ালী কন্ঠে বললাম,,

“সো হোয়াট? জেনেছে তো কি হয়েছে? ভয় পাই নাকি আমি ঐ চাশমিশটাকে? বেটা কানার হদ্দ! চার চোখ ছাড়া তো উনি চোখেখেখেই দেখেন না। সেই কানার হদ্দ নাকি এসেছে এই প্রভাকে বিয়ে করতে! প্রভা অর্থ জানে সে?”

তিস্তা অকস্মাৎ দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,,

“তোর ই তো উডবি হাজবেন্ড প্রভা! বিশ্বাস কর, আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না, এই চাশমিশ আহনাফ শেখ নাকি তোর উডবি হাজবেন্ড! যাকে তুই কানার হদ্দ বলে ডাকছিস সেই ব্যক্তিটাই হলো তোর উডবি! হাউ ফানি ইয়ার। আমি না, জাস্ট আর হাসতে পারছি না!”

রাগে গজগজ করে আমি তিস্তার দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“এই তুই যা, এক্ষনি আমার সামনে থেকে যা। তুই আমার ফ্রেন্ড নাকি শত্রু রে? কোথায় আমায় এসে একটু শান্তনা দিবি, তা না উল্টে আমাকে উসকাতে এসেছিস। তোর মতোন “দু মুখো” বান্ধুবীর কোনো প্রয়োজন নেই আমার। এর’চে ভালো আমি আজীবন “বান্ধুবীহীনা” থাকব! যেকোনো ডিসিশান নিতে নিজেই নিজেকে হেল্প করব, নিজেই নিজের সাথে কথা বলব, নিজেই নিজেকে বুদ্ধি দিবো। তোর হেল্প আমার চাই না। তুই হলি ছলনাময়ী!”

তিস্তা হাসির মাএা অধিক বাড়িয়ে বলল,,

“হয় হয়, এমন হয়। সত্যি কথা বললে এমনই হয়। আমি ছলনাময়ী, সেল্ফিস আরো কতো কি! অথচ দু মিনিট পরে সেই আমাকেই তোর প্রয়োজন পড়বে। তখন উঁচু গলায় বলতে পারবি তো আমি ছলনা ময়ী?”

রাগটা কিঞ্চিৎ হ্রাস করে আমি তিস্তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাতের আংটির টার দিকে নজর দিলাম। ফট করে রাগটা যেনো হ্রাসের বদলে বৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করল। আংটিটায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে আমি মাথায় জবরদস্ত একটা প্ল্যান এঁটে দাঁত কেলিয়ে হেসে তিস্তার দিকে চেয়ে বললাম,,

“আংটি টা যদি আমি হাত থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেই তাহলে নিশ্চয়ই পরিবারের সবাই খুব রেগে বিয়েটা ভেস্তে দিবেন বল তিস্তা? সবাই তখন বলবেন এত্তো এক্সপেন্সিভ একটা আংটি যে মেয়ে কেরি করতে পারে না, হাত থেকে পড়ে যায়, চূড়ান্ত কেয়ারফুল তার সাথে ভালো পরিবারের কোনো ছেলের বিয়ে হওয়া যায় না! ব্যাস, তাহলেই তো বিয়েটা ভেস্তে গেলো বল?”

তিস্তা বেকুব ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে আচমকা আমার মাথায় গাড্ডা মেরে বলল,,

“বুদ্ধি সুদ্ধি লোপ পেয়েছে নাকি তোর? আংটি একটা গেলে আরেকটা কেনা যাবে। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে তারা বিয়ে ভেস্তে দিবে?”

গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে আমি তিস্তার চোখকে এড়িয়ে সুন্দর করে আঙ্গুল থেকে আংটি টা খুলে টুপ করে নিচে ছুড়ে মারলাম। আনন্দে বশীভূত হয়ে আমি দাঁত কেলিয়ে হেসে আপন মনে আওড়ে বললাম,,

“মিঃ চাশমিশ আহনাফ৷ দেখলেন তো? আপনার দেওয়া বিবাহ বন্ধনীকে কিভাবে আমি নিশ্চিহ্ন করে দিলাম? আস্তে ধীরে আপনাকে ও নিশ্চিহ্ন করে দিবো! আপনি আমার ফিউজ উড়াবেন বলছিলেন তাই না? এবার দেখুন, আমি কিভাবে আপনার ফিউজ উড়াই! আপনার পড়ানো আংটি আমি এই জন্মে হাতে পড়ব না। প্রয়োজনে আমার হাত খালি থাকতে। পরিবারের সবার গাল মন্দ ও আমি ঠিক হজম করে নিবো! তবু ও আপনার পড়ানো কোনো জিনিস আমি শরীরে বহন করব না। এর দ্বারা বিয়ে না ভাঙ্গুক অন্তত আপনার মন তো ভাঙ্গবে!”

ইতোমধ্যেই মনে হলো ছাঁদে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটল। কারো ধপধপ পায়ের শব্দ আমার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পিছু ফিরে তাকাতেই দেখলাম আহনাফ শেখ ফুল মোডে ফোনে স্ক্রলিং করতে করতে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। তিস্তা থরথর করে কেঁপে আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“দোস্ত আমি পালাই। এই বদরাগী জিজুকে আমি ফেইস করতে পারব না দোস্ত। তুই তোর উডবিকে সামলা ভাই, আমি পালাই!”

তিস্তা ভৌঁ দৌঁড়ে প্রস্থান নিলো। কিছু বলার সুযোগ ই দিলো না আমায়। ভয়, ভীতি আমার মধ্যে কাজ করলে ও আমি যথেষ্ট শক্ত থাকার চেষ্টা করছি। দুর্বলতা ঢেকে রাখতে হয়, বুঝতে দিলেই যন্ত্রণা৷ বিশেষ করে এই চাশমিশ আহনাফকে তো ভ্রান্তিতে ও আমার দুর্বলতা বুঝানো যাবে না। নয়তো এই ডেভিল বেছে বেছে আমার দুর্বল জায়গায় গুলোতেই আঘাত করতে তৎপর থাকবেন। বেশি বেশি করে আমাকে ভয় দেখাতে উঠে পড়ে লাগবেন। গলা খাঁকিয়ে আমি বুকের পাজরে দু হাত গুজে ভ্রু উঁচিয়ে আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“এই যে মিঃ চাশমিশ? আপনার এইখানে কি হুম?”

ফোনের স্ক্রীন থেকে মুখ তুলে আহনাফ আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে অকস্মাৎ বাঁকা হেসে ফোনটা পায়জামার পকেটে ঢুকিয়ে হেলে দুলে হেঁটে বেসুরো কন্ঠে গেয়ে উঠলেন,,

“বুকে চিনচিন করছে হায়, মন তোমায় কাছে চায়। আমরা দুজন দুজনারি প্রেমের দুনিয়ায়…..

অল্প সময় থামলেন উনি। তাজ্জব হয়ে আমি প্রকান্ড চোখে উনার দিকে চেয়ে আছি। পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি এই লোক? হঠাৎ গানের সাথে নাচতে আরম্ভ করলেন কেনো? মনে কি সত্যিই রং লেগেছে এই চাশমিশের?

গানটা পুনরায় প্লে করে উনি আচমকা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার বাহুতে খানিক ধাক্কা মেরে বাঁকা হেসে বললেন,,

“তুমি ছুঁয়ে দিলে হায়, আমার কি যে হয়ে যায়! তুমি ছুঁয়ে দিলে হায়, আমার কি যে হয়ে যায়!”

রাগে গাঁ, পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে আমার। এই লোকের বেহায়াপনা দেখে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারছি না। চোয়াল শক্ত করে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে আছি। ইচ্ছে করছে, এই পাঁজি লোকটাকে এক্ষনি গলা টিপে মেরে দেই৷ প্রভার মতোন সুন্দুরী, রূপবতী, গুনবতী একটা মেয়েকে উডবি ওয়াইফ হিসেবে পেয়ে এই লোকের যেনো খুশি আর ধরছে না৷ হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে, চাঁদ। চাঁদের তেজী ছ্যাঁকা তো এখনো খাও নি বাছা। খেলে এরপর বুঝবে, চাঁদ পাওয়াটা আসলে কি জিনিস!”

আকস্মিক দাঁত কেলিয়ে হেসে আহনাফ কপালের লেপ্টে থাকা চুল গুলো পেছনের দিকে ঠেলে চশমাটা উপরের দিকে তুলে আমার দিকে হালকা ঝুঁকে বেশ সিরিয়াস কন্ঠে বললেন,,

“আশা করি, আনসার পেয়ে গেছো? আমি এখানে কেনো এসেছি?”

আমি অট্ট হেসে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললাম,,

“মানে? আমাকে কাছে পাওয়ার জন্য আপনার বুক চিনচিন করছে? তাই আপনি হ্যাংলাদের মতোন চলে এসেছেন আমাকে দেখতে?”

আহনাফ বেশ ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন,,

“উহু। ওটা হ্যাংলা হবে না মিসেস প্রভা। ওটা প্রেমিক পুরুষ হবে।”

আমার পাশ থেকে সরে এসে উনি আমার একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এবার অন্তত সুরেলা কন্ঠে গেয়ে উঠলেন,,

“হয়তো তোমারি জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য, জানি তুমি অনন্য, আসার হাত বাড়াই।”

এই লোকের ঠোঁট থেকে যেনো বাঁকা হাসি সরছেই না। উল্টে হাসির মাএা প্রশ্বস্ত হচ্ছে। মস্তিষ্কে ভয়ঙ্কর ভাবে আঘাত হচ্ছে আমার। এই লোকটাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না আমি। চোয়াল শক্ত করে আমি আগপাছ না ভেবে আহনাফের পাঞ্জাবির কলার চেঁপে ধরে ক্ষিপ্র কন্ঠে বললাম,,

“সমস্যাটা কি আপনার হুম? সমস্যাটা কি? এতো বেহায়াপনা করার কারণটাই বা কি?”

উনি নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,,

“আমি তো প্রেমে পড়েছি জানেমান। তাই হয়তো একটু আধটু বেহায়াপনা হয়ে যাচ্ছে। দিল বেসামাল হয়ে পড়েছে আপনার এই চোখ ধাঁধানো রূপে, কি করব আমি বলুন? এর থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় জানা আছে কি আপনার?”

আমি দ্বিগুন রেগে আহনাফের পাঞ্জাবির কলারটা অধিক জোরে আঁকড়ে ধরে বললাম,

“কি ক্ষতি করেছিলাম আমি আপনার হুম? কি ক্ষতি করেছিলাম? কেনো আপনি আমার পিছনে এভাবে আদা জল খেয়ে লেগেছেন বলুন? বুঝতে পারছেন না আপনার এসব উদ্ভব কথা বার্তায়, বেসামাল আচার, আচরণে আমি বিরক্তবোধ হচ্ছি?”

নরম ভাব ভঙ্গি পাল্টে আহনাফ এক ঝটকায় উনার পাঞ্জাবির কলার থেকে আমার হাতটা ছাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে চোখে, মুখে কাঠিন্যতার ছাপ ফুটিয়ে আমার মুখের কাছে এগিয়ে এসে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,,

“অনেক হিসেব নেওয়ার আছে তোমার থেকে আমার! কড়া গন্ডায় সব হিসেব শোধ করব আমি৷ “আহনাফ তোমার হাজবেন্ড নয় তোমার যম রূপে এসেছে।” তোমার মতো “দু মুখো” মেয়েদের সাথে দু মুখো রূপটাই দেখাতে হয় বুঝলে? এইবার থেকে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্তে তুমি এই আহনাফের “দ্বিমুখী” রূপ দেখবে। কিছুক্ষন নরম তো কিছুক্ষণ কঠিন। এসব দেখতে দেখতে হাঁফিয়ে উঠবে তুমি, অতিষ্ট হয়ে উঠবে। অতঃপর “যন্ত্রণা” কি জিনিস তখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবে। আর তখনই হবে তোমার “পাপ মোচন!”

চোখ জোড়ায় আতঙ্ক নিয়ে আমি প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে আহনাফকে বললাম,,

“কি হিসেব হুম? কি হিসেব? কি পাপ করেছি আমি? আমার জানা মতে তো আপনার সাথে কোনো রকম পাপ করি নি আমি। আপনাকে চিনিই বা কতোদিন হলো? আপুর বিয়ের তো সবে মাএ ১ বছর পূর্ণ হলো। বিয়ের পর দিন থেকে আপনাকে প্রায় ১১ মাসের জন্য কোথাও দেখি নি আমি, না আপনার সাথে কোনো রূপ যোগাযোগ ছিলো আমার৷ এইতো ১ মাস হলো আপনি কানাডা থেকে দেশে ফিরেছেন। আপনাকে চেনার মাএ ১ মাস হলো আমার। এর মধ্যেই আমি আপনার কি ক্ষতি করলাম বলুন? আর আপনিই বা কেনো পরিবারের কথায় আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন? কিছুদিন আগে ও তো কথার প্রসঙ্গে আপনি বলেছিলেন, আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে!”

“একটা প্রশ্নের উত্তর ও তুমি পাবে না। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক, আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো, তবে সে আমার সাথে চিট করেছে। আমার ইমোশন, দুর্বলতা, আমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নিয়ে সে মজা করেছে। ভেতর থেকে আমাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এর শাস্তি সে নিশ্চয়ই পাবে। পেতে তাকে হবেই! এই আহনাফ তার জীবদ্দশায় কখনো কাউকে ক্ষমা করতে শিখে নি। সে ও তার অন্যথায় হবে না।”

উনার কঠোর দুচোখে আমি যেমন মেয়েটার জন্য ক্রোধের অগ্নি দেখছিলাম, তেমনি অফুরন্ত ভালোবাসার অনুরক্তি ও সূক্ষ্ম ভাবে আঁচ করছিলাম। পলকহীন চোখে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে জিগ্যাসু কন্ঠে বললাম,,

“এখনো ভালোবাসেন ঐ মেয়েটাকে?”

আহনাফ আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘাঁড়ের রগ গুলো টান টান করে উচ্চ শব্দে বললেন,,

“সে আমার ভালোবাসার যোগ্য না! একদমই না।”

অধৈর্য্য কন্ঠে আমি আহনাফকে বললাম,,

“এর মধ্যে আমার ভুলটা কোথায় আহনাফ? আপনার গার্লফ্রেন্ড আপনার সাথে অন্যায় করেছে, এর মধ্যে আপনি আমাকে দোষারোপ করছেন কেনো? প্লিজ একটু বলবেন? আমার পাপটা কোথায়? আমি আপনার ঠিক, কোন ক্ষতিটা করেছিলাম? কেনো আপনি আমায় বিয়ে করার মতোন এতো বড় সিদ্ধান্তটা নিলেন?

উনি স্পষ্ট কন্ঠে বললেন,,

“তোমরা সব মেয়েরাই এক তাই! সবাই দ্বিমুখী। তুমি ও কিন্তু কম যাও না। তোমার হিস্ট্রি ও আমার বেশ ভালো ভাবেই জানা আছে। নিজেকে খুব ভালো একটা মেয়ে ভেবো না তুমি। অন্তত নিজেই নিজেকে বড় ভাবা থেকে দূরে থাকো!”

লোকটা কখন থেকে মেয়েদের সম্পর্কে যা নয় তা বলেই যাচ্ছেন। বিশেষ করে প্রতিটা কথায় আমাকে ইঙ্গিত করছেন। না, এভাবে আর চলতে দেওয়া যাবে না। লোকটাকে এক্ষনি ভালো করে শাসাতে হবে। মুখে রাগী ছাপ ফুটিয়ে আমি জিগ্যাসু কন্ঠে আহনাফকে বললাম,,

“কি কখন থেকে দ্বিমুখী দ্বিমুখী করেই চলছেন? দ্বিমুখীতার কি পরিচয় দিয়েছি আমি হুম?”

আহনাফ ভ্রু যুগল উঁচিয়ে বললেন,,

“ভেবে দেখো কি করেছ!”

থতমত খেয়ে আমি চোখ দুটো নিচে নামিয়ে নিলাম। আহনাফ নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, ফ্রেন্ডদের সাথে বাজি ধরে ছেলেদের সাথে ফোনে দুষ্টুমির স্বভাব আছে আমার। তবে উনি এই বিষয়টা বুঝলেন কিভাবে? লোকটার কি দিব্য দৃষ্টি আছে? জিগ্যেস করব? কিভাবে উনি বিষয়টা বুঝলেন? ইতোমধ্যেই আমার মৌণতা দেখে আহনাফ গলা ঝাঁকিয়ে বললেন,,

“হিসেব মিলাতে পারছ না তাই তো? কোনো ব্যাপার না। তোমাকে একটা কাজ দিচ্ছি এক্ষনি করে দাও! হিসেব মেলানোর কাজটা না হয় আপাতত ছেড়েই দাও।”

কপাল কুঁচকে আমি আহনাফের দিকে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আহনাফ উনার বাম হাতটা আমার মুখের কাছে ধরে বললেন,,

“দেখো, কতোটা ক্ষত হয়ে গেছে নখের। অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দাও। আমার ডেস্কের ড্রয়ার থেকে অয়েন্টমেন্ট টা নিয়ে এসো, গো ফার্স্ট!”

আমি এক রোঁখা ভাব নিয়ে মুখটা বাঁ দিকে হালকা বাঁকিয়ে বললাম,,,

“উহ্। পারব না আমি!”

আহনাফ ভাবশূণ্য কন্ঠে বললেন,,

“ওহ্ সিরিয়াসলি? পারবে না তুমি?”

আমি হেয়ালী চোখে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,

“ইয়েস। পারব না আমি!”

“যদি নাই পারো? তাহলে ব্যাথাটা দিলে কেনো?”

“দিয়েছি, বেশ হয়েছে।”

আমি ক্ষুব্ধ হয়ে পরক্ষণে আবারো বললাম,,

“ইচ্ছে করছে আরো দিতে!”

আচমকা উনি বাঁকা হেসে ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসতে আরম্ভ করলেন। শুকনো ঢোক গিলে আমি একটু একটু করে পিছু হেঁটে একদম ছাঁদের রেলিংয়ের সঙ্গে ঘেঁষে দাঁড়ালাম। উনি আমার ঠোঁটের দিকে বিশ্রী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“আমি আর একটু এগুলেই তোমার ঠোঁটের সঙ্গে আমার ঠোঁটের সংঘর্ষ হবে। আর তুমি একটু পিছুলেই দু তলা ছাঁদ থেকে পিছলে নিচে পড়বে। সামনে, পিছনে দুয়ের মাঝখানে আটকে আছো তুমি। উভয় দিকেই রিস্ক। নাও ডিসিশান ইজ ইউর’স। আমার হাতে অয়ন্টমেন্ট লাগিয়ে দিবে নাকি সামনে, পেছনে যেকোনো একটা পথ বেছে নিবে? বলে রাখি, উভয় দিকেই আমি রাজি!”

উৎসুক দৃষ্টিতে আমি পেছনের দিকে তাকাতেই যেনো মৃত্যুকে দেখতে পেলাম। অবিশ্বাস্য ভয় নিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই চাশমিশ আহনাফের বিশ্রী দৃষ্টি এবং হালকা লাল রঙ্গের ঠোঁট জোড়া দৃষ্টিলোকন হলো আমার। ছাদের চতুর্পাশে ডেকোরেট করা বিভিন্ন ঝাঁড়বাতির আলোতে আমি আহনাফের চশমার দু ফ্রেমে নিজের আতঙ্কগ্রস্থ মুখটা সশীরে দেখতে পাচ্ছি৷ ভয়ে জিভ বেরিয়ে আসছে আমার। চোখ জোড়া ও অস্থিরতায় মিইয়ে আসছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে আমি ফটাফট চোখ জোড়া বুজে অকুল পাথারে ডুব দিলাম। অল্প সময় মৌণ থেকে আমি রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে তেজর্শিনী কন্ঠে বলে উঠলাম,,

“ওকে ওকে, যেতে দিন আমায়। অয়েন্টমেন্ট এনে দিচ্ছি আমি!”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here