#তোমাতেই_ইতি
#আয়েশা
পর্ব-১২
ইচ্ছের আর কোনওদিকে নজর দেয়ার সময় নেই।সব গেস্ট সব আয়োজন উপেক্ষা করে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্যাকেট টা খুলল খুব অস্থিরতার সাথে। বুকের বা পাশে খুব জোরে আওয়াজে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে।যেন ইচ্ছে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে আওয়াজটা।
কাঁপাকাঁপা হাতে যেই খুলল আর বেরোলো কিনা একটা সিডি!
ইচ্ছের খুব মন খারাপ করল।কি ই বা আছে এমন এই সিডিতে মুহুর্তেই আবার মাথার টনক নড়ে গিয়ে ভাবল হয়তো পূরণ ভাই নিজে কিছু রেকর্ড করেই পাঠিয়েছেন!ওয়াও!এর থেকে বড় গিফট ইচ্ছের জন্য আর কিছু হতেই পারেনা?
আবারও অদ্ভুদ এক ভাললাগা ময় শিহরণ নিয়ে ল্যাপটপে সিডিটা সেট করল।প্লে তে গিয়ে আবার সরে আসছে।কি হতে পারে সেটা ভাবতেই হার্টবিট দ্বিগুন পরিমাণে বাড়তে লাগল।পূরণ ভাইক্ব সামনা সামনি বলতে পারবেনা বলে রেকর্ড দিয়ে প্রপোজ করবে?সে যাই হোক যেভাবেজ করুক তবুও অন্তত করুক না!
প্লে করতেই বাজতে লাগল,
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ।
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ
প্রেমে পড়া বারণ……
যেই গানটা বন্ধ করতে যাবে অমনি পূরণ ভাইয়ের গলার আওয়াজ শুনে কোথাও মনের মধ্যে একটা আশার আলো জ্বলে উঠল যেন খুব জোর পেল।শুকিয়ে যাওয়া গলার তেষ্টা মিটল।কিন্তু মুহুর্তেই সব আবার ঝাপসা হতে লাগল।
-ইচ্ছেমতি!আমাদের সবারই মন গড়া সব ইচ্ছে থাকে।দেখ এমনটা তো সব সময় হয়না যে আমরা যা চাই সব সময় সেটা সঠিক আর সেটা পেতেই হবে।
আমি জানি তুই আমার প্রেমে পড়েছিস!এটা তো হওয়ার ছিল না? আমি তো বারবার তোকে বারণ করে দিতাম দেখ ইচ্ছে সব করলেও তোকে প্রেমে পড়া বারণ বিশেষ করে আমার প্রেমে তো নয়-ই!
ব্যস আর শুনতে পারছে না ইচ্ছে।ল্যাপটপ টা এক আচাড় মেরে নিচে ফেলে দিল।
ইচ্ছের পুরো শরীর রাগে কাঁপতে লাগল।এটা দিবে বলে আগে থেকে জানিয়ে রাখা হয়েছে কিনা গিফট আসবে!এটা গিফট?
এই গানটা শোনার জন্য ইচ্ছে অপেক্ষা করে বসেছিল এত এত আয়োজন উপেক্ষা করে?তার বাবা মা বাকি আত্মীয় স্বজনদের পাত্তা না দিয়ে সে কিনা অধীর আগ্রহে এই লোকটার বাজে গানটা আর বাজে কথাগুলো শোনার অপেক্ষায় ছিল!
নাহ আর পারছে না নিতে, কি চায় লোকটা?ইচ্ছে তো সেটাই বুঝে না!এই মনে হয় ইচ্ছেকে তার মত ভাল বুঝি আর কেউ বাসেনা।আবার মুহুর্তেই ইচ্ছের সব জল্পনা কল্পনায় পানি ঢেলে দিয়ে সব মিথ্যে করে দেয়!কিন্তু কেন?
ইচ্ছে এর সরাসরি উত্তর চায়।আর কোনও লুকোচুরি নয়।অনেক হয়েছে,অনেক সহ্য করেছে।এভাবে দিন দিন নিজেকে কত ছোট করে ফেলছে,নিজের সেল্প রেস্পক্টটুকু অবদি রাখছেনা।সব সময় বেহায়ার মত সে প্রমাণ করে যাচ্ছে যে আমি আপনার প্রেমে কাঙাল ভিখারী হয়ে পড়ে আছি,দেখে যান একবার।কেন?সে কি এতটাই পঁচে গেছে?
চোখ দিয়ে ব্যাথার অশ্রুরাতো ঝরেই যাচ্ছে।বাইরে থেকে আবারও ইচ্ছের মায়ের ডাক।অসহ্য সব! ইচ্ছে করছে এক্ষুনি কিছু একটা করে ফেলুক।
দরজা খুলতেই ইচ্ছের মা একপ্রকার ধমক দিয়ে বলে উঠেন,
-ইচ্ছে কেমন বিহেভিয়ার এসব!তুমি কি চার পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে?তোমার জন্য সবাই এসেছে আজ আর তুমিই বারবার উদাও হয়ে যাচ্ছো?
ইচ্ছের চোখের পানি মুছে নিল,এখনও চোখে লেগেই আছে তবুও তবে কি মা দেখতে পায়নি?দেখতে তো পাওয়ার কথা।দ্রুত ইচ্ছের ভাবনাকে বদলে দিয়ে টিস্যু পেপার নিয়ে ইচ্ছের চোখ মুখ মুছে দিতে লাগলেন।
-এসব আবেগ বাদ দাও ইচ্ছে।আমি সব খেয়াল করছি,চুপ করে আছি বলে এটা ভেবোনা আমি কিছুই জানতে বা বুঝতে পারিনি।
আমরাও এই বয়সটা পার করে এসেছি ইচ্ছে!তাই মা হয়ে সন্তানের হাবভাব বুঝবোনা এতটাও বোকা নই আমি।সব ঠিক হয়ে যাবে এবার,অনেক হয়েছে পাগলামো।এবার সারা জীবনের জন্য শাড়ি পড়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।বলেই হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন।
ইচ্ছে অবাক আর ভাবলেশহীন হয়ে হেটে যাচ্ছে।মা সব জানে?কি হতে যাচ্ছে সব তো অন্ধকার দেখছে সে!
পুরো ঘর ভর্তি মানুষের সামনে মা কি সুন্দর ভাবে বলে দিল ইচ্ছের সাথে খুব শীগ্রই সজলের বিয়ে আর আজই কিনা আংটি পরিয়ে দেবে?
কেন জানিনা ইচ্ছের কান্না পাচ্ছে না!সত্যি কান্না পাচ্ছে না?
ইচ্ছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু বুঝতে পারছে না এই মুহুর্তে ইচ্ছের সাথে কি হচ্ছে!ইচ্ছের কি কষ্ট হচ্ছে না সুখ পাচ্ছে সেটাও ইচ্ছে বুঝতে পারছে না।তবে বারবার মনে হচ্ছে যা হচ্ছে হোক।এরকমটা হওয়ার খুব দরকার ছিল।এমনিতেই এই সম্পর্কটা এক প্রকার ঝুলে পড়ে আছে,না এগোচ্ছে আর নাইবা পিছুচ্ছে!
কেউ যদি স্বেচ্ছায় তাকে গ্রহণ না করে সে কি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে দেবে নাকি?
তার প্রতি যদি একটু ভালবাসা ও থেকে থাকে তবে আংটি কেন দুনিয়ার কোনও কিছুই তাদের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাড়াতে পারবেনা।অথচ সেই মানুষটাই তো ইচ্ছেকে চায়না!
রাত গভীর হতেই সবাই যেতে লাগল।বাবা এসে ইচ্ছেকে খুব করে জড়িয়ে ধরল।ইচ্ছে না হাসতে পারছে না কাঁদতে।এক দম বন্ধ হওয়া অনুভূতির আভাস পাচ্ছে শুধু।মা ও এসে করত বার জড়ালো হিসেব নেই। অথচ ইচ্ছের ফিল ই হচ্ছে না।ফুফু এসে কেন জানিনা কাঁদলো খুব।আশ্চর্য সবাই হাসছে একমাত্র ফুফুই কাঁদলো শুধু।ইচ্ছের আফসোস হল তোমার মত যদি আমিও এমন কাঁদতে পারতাম ফুফু!
স্বর্নাপুরা আর একবারের জন্যও ইচ্ছের কাছে ঘেষেনি।বাহ আগে থেকে বিদাইয়ের প্রস্তুতি করছে বুঝি!তবে ইচ্ছের ও তো কিছু প্রস্তুতি দরকার!
স্বর্নাপুদের ছুটি আরও ক’দিন বাড়লো।ইচ্ছের বিয়েতো!হুট করে ডেইট পড়ে যাবে কাল কিংবা পরশু?
কি ভাগ্যক্রমে এসেছিলে তোমরা আপু। একজনের অসুস্থতার সুস্থতা কামনার আমন্ত্রণ পেয়ে আরেকজন সুস্থ সবল মানুষের জ্যান্ত মরে যাওয়ার নিমন্ত্রণ খেয়ে যাবে এবার।
রাত আরও বাড়ছে বারান্দায় দাঁড়াতেই সব গুমোট অনুভূতিরা এবার হামলা করলো ইচ্ছের মন মস্তিষ্ক সবটা জুড়ে।কই এতক্ষণ তো কিছুই হলো না।তবে এখন কেন এমন লাগছে।
“রাত বাড়লেই বুঝি ব্যাথারা বাড়ে?
তবে এ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে যার অভিমানে সে কি তা জানে!”
মনে হচ্ছে বারবার গানটা ইচ্ছের কানে বেজে যাচ্ছে ইচ্ছে কান চেপে ধরে রইলো কিন্তু না তবুও সেটা তার কানের পর্দা ভেদ করে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তে নিজের হেরে যাওয়ার জানান দিচ্ছে।আর পারছে না চুপ থাকতে চিৎকার করে একবার কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু এখানে যে সবাই আছে জেনে যাবে যে!
“কান্নাদের যে শব্দ করতে নেই!
শব্দরাই তো কান্না হয়ে ঝরে”
এক দৌড়ে ইচ্ছে ছুটে ছাদে চলে গেল।রাত এখন প্রায় দুটোর কাছাকাছি হবে।সেদিনকার মত আজও ইচ্ছের একবিন্দুও ভয় করছে না।সেদিন তো পূরণ ভাই ছিল বলে তবে আজ কে আছে?
এ ভয় যে হারানোর ভয়ের চেয়ে কিচ্ছুনা তাই বুঝি ইচ্ছে এত নির্ভয়?
সেই জায়গাটায় গিয়ে বসল।আলতো হাতে চারিপাশটা বুলিয়ে দিল,এই যে এখানে বসে পূরণ ভাই সেদিন তার কোলে ঘুমিয়ে ছিল ছোট বাচ্চার মত ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদেছিল।এই হাতে সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল।আজীবন এভাবেই ঘুম পাড়াবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল।খুব জোরে আওয়াজে এক চিৎকার এসে মুহুর্তেই চারিপাশ কাঁপিয়ে তুলল।যেমনটা বৃষ্টি হওয়ার আগে খুব জোরে আওয়াজে বজ্রপাত হয় ঠিক তেমন গগন বিধারী কারও হৃদয় ভাঙার আওয়াজ।
কতক্ষন এভাবে ছিল ইচ্ছের মনে নেই শুধু চারিপাশ আলোকিত আর ফজরের আজান টা কানে কানে ভাসতেই বুঝল সকাল হয়েছে।রাতের সব কটা কালো আধার মুছিয়ে দিয়ে।জীবনের সবকটা কালো অধ্যায় যদি এভাবে কাটিয়ে দিয়ে নতুন এক সকালের আহবান জানাতো কতই না সুখী হত মানুষ!
খুব দুর্বল লাগছে যেন পুরো শরীর ভেঙে আসছে।উঠে দাড়াতেও পারছে না।কিন্তু না তাকে যে উঠতে হবে যার কথা ভেবে সে নিজেকে গুড়িয়ে ফেলতে চাইছে সে তো দিব্যি আছে।তার তো কষ্ট হচ্ছে না?
এলোমেলো পা ফেলে নিচে নামতেই সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।সকালে নামাজ পড়তে এসে একবার ইচ্ছের রুমে গেল মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি বাড়ি খালি করে দেবে ভাবতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।একবার মন ভরে দেখতে ইচ্ছে করছিল শত হোক মেয়ে বড় হয়েছে জাগ্রত থাকা অবস্থায় তো আর মন ভরে দেখা যায় না?
কিন্তু গিয়ে তিনি নিজেই অবাক হলেন ইচ্ছে নেই!সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছের বাবাকেও ডেকে তুললেন।আর তার মধ্যেই ইচ্ছে অগোচালো আর কান্নারত অবস্থায় তাদের সামনে পড়লো।
এভাবে মেয়েটাকে দেখে ইচ্ছের বাবা অস্থির হয়ে পড়লেন জড়িয়ে ধরে ভেতরে বসাতেই ইচ্ছে বলল,
-বিয়ে দিতে হলে কাল হলুদ আর পরশু বিয়ের আয়োজন কর।এরপরে আর চাইলেও আমায় রাজি করাতে পারবে না।পারলে আজীবন সন্ন্যাসী হয়ে থেকে যাব তবুও না!
আর হ্যা আমার বিয়ের শুরু থেকে শেষ অবদি সব দায়িত্ব নেবে পূরণ ভাই!
কোনও প্রশ নয়!আমি আমার মতামত জানালাম।বাকি সিদ্ধান্ত তোমাদের হাতে বলে ইচ্ছে রুমে ঢুকে গেল।
#তোমাতেই_ইতি
#আয়েশা
পর্ব-১৩
উষ্কখুষ্ক চুল,চেহারায় ক্লান্তির ছাপ নিয়ে পরদিন খুব ভোরে এসে পূরণ ইচ্ছেদের বাসায় উপস্থিত হলো।ইচ্ছের চোখের পাতায় তখনও ঘুম নেই।অথচ এই মেয়েটা এক সময় সকাল ৯টা দশটার আগে ঘুম থেকেই উঠতোনা।আর আজকাল সারারাত জাগার পর সকালেও ঘুমহীন ভাবলেশহীন ভাবে পড়ে থাকে।অপেক্ষায় আছে শুধু সেই মানুষটাকে দেখে তার ভাবভঙ্গি বুঝার।
কলিং বেলের আওয়াজে ইচ্ছে সচকিত হয়ে উঠে বসল।একটু পরেই কানে বাজলো সেই ফ্যাশ ফ্যাশানো গলার আওয়াজ।এত কিছুর পরেও বেহায়ামন বারবার বলে যাচ্ছে সব ভুল হয়ে গিয়ে শুধু পূরণ ভাই শুধু ইচ্ছের, সেটা ঠিক হয়ে যাক।বাকি সব মিথ্যে হয়ে যাক।এখনও যদি পূরণ ভাই একবার বলে সে ইচ্ছেকে চায়,ইচ্ছে সব ভুল ক্ষমা করে দেবে।একবার,শুধু একবার এই কথাটা শুনার জন্য ভিতরে ভিতরে গুমড়ে যাচ্ছে ইচ্ছে।হাতজোড়া এক করে প্রে করার ভঙ্গিতে কপালে ঠেকিয়ে ধরে রেখেছে।
কিন্তু না এভাবে বসে থেকে সে কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না।দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে গেল।সামনে চায়ের কাপ নিয়ে বাবা আর পূরণ ভাই বসে আছে।বাবা চা খেতে খেতে কি যেন বলে যাচ্ছে।পূরণ ভাই এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেও এবার চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল।
বাহ্!কি সুন্দর বসে বসে চা খাওয়া হচ্ছে?আর ইচ্ছে কিনা এক ফোঁটা জল ও গলা দিয়ে ঢালতে পারেনি শুধুমাত্র এই লোকটার জন্য!ইচ্ছে এখনও টলমল চোখে দাঁড়িয়ে অথচ পূরণ ভাই একবার ফিরেও তাকাচ্ছেনা?
এতই বাজে দেখতে সে?একবার দেখতেও ইচ্ছে করে না?ইচ্ছের সব প্রার্থনা মুহুর্তেই যেন নিভু নিভু করা প্রদীপের রূপ নিল।
-একটু পরেই ক্যাটারিং এর লোকেরা আসবে।আমি সব ঠিকঠাক করে রেখেছি মামা!
ছেলের সাথেও কথা বলে নিয়েছি,ওরা দুপুরের পর পরই হলুদের কাপড় চোপড় পাঠিয়ে দেবে।আর তাদের বাড়ির জন্য তায়েফ ভাইকে নিয়ে ও শপিং করা হয়ে গেছে।
খাওয়ার দাওয়ার ব্যাপারে কড়া ভাবে বলে দিয়েছি কিছুতেই যেন কমতি না থাকে।
কোনও রকম ভুলের সুযোগ নেই,আপনি চিন্তা করবেন না মামা!
এসব কথা শুনে ইচ্ছে মনে মনে বলছে এক্ষুনি চাটা ২০০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় গরম হয়ে যাক।আর সেটা গিলে নিয়ে লোকটার ভেতরকার সব পুড়ে ছাই হয়ে যাক।সেও বুঝুক না একটু,ইচ্ছের ঠিক কতখানি পুড়ছে!
নাহ আর কান্না না অনেক কেঁদে ফেলেছে সে।বারবার সে কেন এত দুর্বল হয়ে পড়ে,যখনই ভাবে সব ভুলে যাবে?
ভুলেরা সব ভুললেও তাকে কেন ভুলতে দেয় না?
সন্ধ্যা হতে না হতেই সব কৃত্রিম আলোয় চারিপাশ আলোকিত হলেও ইচ্ছের কাছে সব রাতের অন্ধকারের মতই কালো।যত রাত বাড়ছে ঘুটঘুটে আধার আরও বাড়ছে।পার্লার থেকে মেয়ে এসে ইচ্ছেকে সাজিয়ে দিয়ে গেল।সাথে স্বর্নাপুদের ও।এতদিন স্বর্নাপু শান্তনা দিয়ে গেল।
-ইচ্ছে দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।আরে দেখলিনা পূরণ ভাই কিভাবে সেদিন তোকে কোলে করে রুমে রেখে গেল।কোথাও একটা কিন্তু আছে।
অথচ আজ স্বর্নাপু ও চুপ।বলে যা হচ্ছে মনে কর তোর ভালোর জন্যই হচ্ছে।
ভালো না ছাই স্বর্নাপু।বলো সেদিন যেমন ঘুমের ঘোরে আমাকে কোলে নিয়ে স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিল।মনে কর আজ ঠিক সেভাবেই কোলে নিয়ে আমাকে শশ্মান ঘাটে রেখে আসছে।তফাত টা হলো ওদেরকে তো মরার পরে পুড়ে আর আমাকে জ্যান্তই পুড়িয়ে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই যেন সব মেনে নিজেকে স্থির করে নিল ইচ্ছে তো এই আবার ঘূর্ণিঝড়ের মত সব তোলপাড় করে আসছে।হুট করে সাজগোজ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ইচ্ছে।ইচ্ছেদের ডাইনিং রুম টা অনেক বড় হওয়ায় হলুদের আয়োজন সেখানেই করা হয়েছে।ছেলে পক্ষদের সাথে কথা বলে অল্পকিছু লোকজন নিয়ে আপাতত বিয়েটা সেরে ফেলা হবে।কিছুদিন পরে ঘটা করে দুপক্ষ মিলিয়ে আয়োজন করা হবে কোনও কমিউনিটি সেন্টারে।
স্টেজের পাশেই ফোনের দিকে তাকিয়ে পূরণ ভাই।ইচ্ছে গিয়ে সামনে দাড়াতেই তিনিও উঠে দাড়ালেন।তবে ইচ্ছের দিকে তাকাচ্ছে না।ইচ্ছে যেন অনেক খুশি মনে বিয়েটা করছে,সেরকম একটা ভাব নিয়ে হেলেদুলে বলে উঠল,
-আমাকে কেমন দেখাচ্ছে পূরণ ভাই?যেটা সব সময় কোনও ফাংশানে যাওয়ার আগে পূরণ ভাই এসে ইচ্ছেকে জিজ্ঞেস করতো।আজ সেও বুঝুক এত কিছু করে কিভাবে সে বলে বেড়ায় তার প্রেমে পড়া বারণ।যেখানে প্রেমে পড়ার জন্য রীতিমতো তিনি নিজেই ইচ্ছেকে ফুসিয়ে দিত!
পূরণ ভাই এখনও চোখ লুকিয়ে যাচ্ছে।হাতে থাকা চশমাটা চোখে দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ইচ্ছের দিকে তাকালো।তারপর বলল,
-তোকে ঠিক একটা গায়ের বধূর মত লাগছে ইচ্ছেমতি!আগে স্কুলে থাকতে যেমন খুশি তেমন সাজো একটা খেলা হত।যেটা একদম ফাইনাল খেলার দিন সবাই যার যার বিভিন্ন পছন্দ অনুযায়ী সেজে আসতো।তুই ঠিক হলদে কাপড়ে এক টুকরা কাঁচা হলুদ রঙা গায়ের বধূরে ইচ্ছে!
ইচ্ছের এই কথা গুলো আর এই ডাক শুনে রাগে গা ঘিনঘিন করছে।তার আসল ইচ্ছেটাই তো পূরণ হচ্ছে না।তাহলে কিসের ইচ্ছেমতি সে?
হুট করে পূরণ ভাইয়ের চোখ থেকে চশমাটা টেনে খুলে এক আছাড় মেরে ভেঙে ফেলল!
তারপর রুমে গিয়ে দশ হাজার টাকা এনে পূরণের গায়ে ছুড়ে মারলো।
-এই নাও তোমার প্যান্টের টাকা।অনেক কথা শুনিয়েছো না এই টাকার জন্য!তোমার টাকা উশুল সাথে বাড়তি আরও পাঁচ হাজার কি জন্য দিলাম সেটা জিজ্ঞেস করবেনা?
এটা তোমার এডভান্স ধরে নাও,এই যে কাজ সামলাচ্ছো ডেকোরেট এর বাকিটা কাজ শেষ হলেই পেয়ে যাবে।বলেই ইচ্ছে আর দাড়ালোনা।নিজের ছোট বেলাকার চেইনসহ লকেট টা সে বিক্রি করে ফেলেছে।তবে তার বাবার কাছেই।কথা দিয়েছে যেন যত্ন করেই রাখে যখন সে পড়া শেষ করে চাকরী নেবে তখনই স্যালারি পেলে টাকা দিয়ে আবার কিনে নেবে।ইচ্ছের বাবা বারণ করলেও ইচ্ছের জোরা জুরিতে নিতে হলো।তার সব টাকা তো মেয়েটার জন্যই!অথচ কি পাগলামো করে যাচ্ছে।
কি করবেন,তিনিও তো নিরুপায়।যেন হাত পা চারিপাশ থেকে বাধা।তার যে কতটা কষ্ট হচ্ছে কি করে বুঝাবে সবাইকে!
নিজেকে স্থির করে রেখেছে একটা কথা ভেবেই তিনি একজন বাবা!তাই স্বার্থপরতা করতে আজ ক্ষতি নেই।
অনেক কষ্টে কান্না টা আটকে রেখেছে।রুমে এসে যতটা সম্ভব পারছে বুক আর গলাটা ঘষে যাচ্ছে যেন কান্না টা আটকানো যায়।বাইরের কান্নাটা তো সে আটকে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু ভেতরের টা কিভাবে চুপ করাবে?সে যে থামছেই না!
একটু পরেই ইচ্ছেকে চারপাশ ফুলে সাজানো স্টেজে বসানো হলো।সেখানে বসতেই ইচ্ছের দম আরও বন্ধ হয়ে আসছে যেন।এত আলো থাকা স্বত্তেও বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।তবুও নিজেকে শক্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে দুটি চোখ সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিটিকেই খুজছে।বেশিদূর খুজতে হয়নি সামনেই একটা দেয়ালে হেলান দেয়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।সাথে বাবাও আছে।একে একে সবাই এসে ইচ্ছের গায়ে হলুদ ছুইয়ে যাচ্ছে।
ইচ্ছে স্বর্নাপুকে ডেকে বলল পূরণ ভাই যতক্ষন না তার গায়ে হলুদ ছোয়াচ্ছে সে এভাবেই বসে থাকবে।
স্বর্নাপু অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে তারপর নেমে গেল।
সত্যিই!এর কিছুক্ষন পরেই পূরণ ভাই আসলো।ইচ্ছের পাশে বসতেই ইচ্ছের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠলো।একটা বড় করে ঢোক গিলে নিল।
পূরণ ভাই হালকা হলুদ নিয়ে ইচ্ছের হাতে ছোয়ালো,ইচ্ছে এবার গাল বাড়িয়ে দিল পূরণ ভাই হালকা হেসে গালেও ছুইয়ে দিলো।
ইচ্ছের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কিভাবে এত শক্ত হয়ে আছে লোকটা!কোন ধাতু দিয়ে তৈরী? একটুও কি কষ্ট হচ্ছে না তার?একটুও কি মনে পড়ছে না?তবে ইচ্ছের কেন হচ্ছে?
মুহুর্তেই আবার সামলে গিয়ে নিজেই নিজের মনকে শান্তনা দিচ্ছে সে পারবে। সেও দেখিয়ে দেবে তাকে ছাড়া ইচ্ছের দিব্যি চলে যাবে।পূরণের মত কারও প্রয়োজনই পড়বেনা!
পাশ থেকে বাবাকে শুনতে দেখলো।
-তুই সত্যিই অনেক স্ট্রং রে পূরণ!অসুস্থ থাকা স্বত্তেও সব একা হাতে সামলে নিচ্ছিস।আর আমি দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে সব কিনা দেখছি।তোর মত একটা ছেলে আমার হলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
ইচ্ছের রাগ আরও বাড়লো সব সময়ের মত বাবা এই লোকটার সাইড কেন নেয় ইচ্ছে বুঝে না!সত্যিই বুঝে না!ইচ্ছের আজ এই বাড়িতে একেবারে থাকার শেষদিন!যদিও আসবে আবার তবে মাঝে মাঝে।আর আজও বাবা ওই লোকটাকে বাহবা দিয়ে যাচ্ছে?তবে কি ইচ্ছের জন্য বাবার কষ্ট হচ্ছে না!
অনেকক্ষন যাবত এভাবে চলতে লাগল হলুদ প্রক্রিয়া।এবার ইচ্ছের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে আসছে।চারিপাশ নজর বুলিয়ে খুজে দেখলো কোথাও পূরণ ভাইয়ের ছায়াটুকুও নেই!কোথায় গেল লোকটা! ইচ্ছে দেখতে পাচ্ছে না কেন?
স্টেজ থেকে নেমে সব জায়গায় খুজতে লাগলো কিন্তা না উদাও!
আশ্চর্য!এই কিছুক্ষণের জন্য চোখের আড়াল হওয়াটা ইচ্ছের সহ্য হচ্ছেনা!তবে আজীবনের জন্য কিভাবে থাকবে সে?
আবারও কান্নায় চারপাশ ঝাপসা হতে লাগলো।
নাহ একবার এই লোকটার মুখোমুখি ইচ্ছেকে হতেই হবে!নইলে সে শান্তি কিংবা স্বস্তি কোনও টাই পাচ্ছেনা।হতে পারে সামনা সামনি সব জিজ্ঞেস করলে আর কষিয়ে একটা চড় দিয়ে আসতে পারলে কিছুটা শান্তি পাবে সে!নিজেকে বুঝ দিতে পারবে।এই লোকটা সত্যিই তার যোগ্য নয়!
ধীর পায়ে অনেক প্রশ্ন আর রাগ ঘৃনা সঙ্গে নিয়ে সেকেন্ড ফ্লোরের দিকে ছুটলো ইচ্ছে।নিশ্চয়ই ঘরে গিয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে!সব ঘুম আজ উদাও করবে। এত এত কথা আজ ইচ্ছে শুনাবে যে বাকি যে ক’টা দিন বেঁচে থাকবে সেগুলো হজম করতে করতে কেটে যাবে।
চলবে