#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা – জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৬.
~
‘ নৈরিথকে কি তুই পছন্দ করিস মা?’
মিথি হকচকিয়ে উঠলো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেলেছে সে। বাবার মুখে এমন কোনো কথা কখনো আশা করেনি। ভাবলেশহীন ভাবে মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন আতাউর সাহেব। তিনি বড্ড স্বাভাবিক। মিথি ভেবে পাচ্ছে না তার বাবাকে কি উত্তর দিবে। ভীষণ রকম অসহ্য বিরক্তকর মুহূর্ত বোধ হয় এটাকেই বলে। বাবা কেন তাকে এয় প্রশ্ন করলো? উনি কি তবে কিছু সন্দেহ করেছেন? মিথির ভাবনার সুতো কাটলো বাবার কণ্ঠস্বরে। তিনি গম্ভীর সুরে বললেন,
‘ আমাকে ভুল বুঝিস না মা। আমি তোকে যথেষ্ঠ বিশ্বাস করি। আমি শুধু আমার মনের সন্দেহটা দূর করতে চেয়েছিলাম এর থেকে বেশী আর কিছু না। আমার কথায় তোর খারাপ লেগে থাকলে তাহলে এই বাবাটাকে তুই ক্ষমা করে দিস।’
মিথি জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল। বাবার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ আমাকে তুমি ক্ষমা করো বাবা। আমি হয়তো তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিনি।’
কথাটা বলেই মিথি বাবার রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
দরজা আটকিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো সে। বুকের মধ্যে ভীষণ চাপ অনুভব করছে সে। সে কি সত্যিই তার বাবার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে? নৈরিথের সাথে তো তার কোনো সম্পর্ক নেই, হ্যাঁ পছন্দ করে সে হয়তো ভালোও বসে। এটাতেও কি বিশ্বাস ভেঙে যায়? নিজের প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পেলো না মিথি। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখের পাতা এক করলেও ঘুমের কোনো দেখা পেলো না সে। আবার উঠে বসলো। আলমারি খুলে একটা ডাইরি বের করলো। বেশ পুরনো একটা ডাইরি। সামনের কাভারটা খানিকটা ছেঁড়া। ডাইরিটা বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো সে। মস্তিষ্কে তখন হানা দিল কিছু পুরনো স্মৃতি।
_____________
তখন বাইরে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুর। লাইব্রেরী রুমে বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে কেউ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পাতা উলটাচ্ছে। হুট করেই সেই মানুষটির পাশে এসে বসলো আরেকটি মানুষ। চোখে তার মোটা ফ্রেমের এক চশমা। মাথায় এক ঝাঁক কোকড়ানো চুল। মুখে চমৎকার হাসি। সে এসেই বললো,
‘ এই মিঠু, পড়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকা।’
উপন্যাস পড়ার মাঝখানে কেউ এসে বিরক্ত করাটা মিথির মোটেও পছন্দ না। এই ছেলেটাও জানে সেটা, তাও সে ইচ্ছে করে এমন করে। যেনো এই পৃথিবীতে তার জন্মই হয়েছে কেবল মিথিকে জ্বালানোর জন্য। মিথি দাঁতে দাঁত চেপে সিফাতের দিকে তাকালো। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
‘ কি সমস্যা তোর?’
সিফাত দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘ কোনো সমস্যা না তো। শুধু তোকে বিরক্ত করতে ভালো লাগে।’
মিথির রাগে যেনো ঘি পড়লো। লাইব্রেরী বলে চেঁচাতে পারছে না, নয়তো এতক্ষণে চেঁচিয়ে সব মাথায় তুলতো। মিথি জোরে একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে বললো,
‘ এখান থেকে যা সিফাতের বাচ্চা। নয়তো আমি তোকে মেরে ভর্তা বানাবো।’
সিফাত বরাবরের মতই হাসলো। বললো,
‘ কি ভর্তা বানাবি? আলু না শুঁটকি? কোনটা?’
মিথি দাঁত কিড়মিড় করে সিফাতের দিকে তাকালো। সিফাত ঠোঁট চেপে হাসলো। মিথিকে রাগানোর মত আনন্দ বোধ হয় আর কিছুই হতে পারে না। সিফাত হঠাৎ হাসি থামিয়ে মিথির দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
‘ তোর জন্য একটা গিফট এনেছি মিঠু।’
মিথি হঠাৎ চমকে গেল। সিফাত সচারাচর তাকে কোনো গিফট টিফট দেয় না। আজ হঠাৎ কি ভেবে? মিথির রাগ নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো। সে সিফাতের হাত থেকে গিফটটা নিল। আন্তাজ করে মিথির মনে হলো এটা কোনো বই অথবা ডাইরি। মিথি উৎফুল্ল মন নিয়ে রেপিং করা গিফট টা খুললো। একটা হালকা বাদামি রঙের ডাইরি। মিথি ডাইরিটা উল্টে পাল্টে দেখে বেশ কৌতূহল নিয়ে বললো,
‘ হঠাৎ ডাইরি কেন?’
সিফাত তখন চমৎকার হেসে বললো,
‘ লেখার জন্য?’
‘ কি লিখবো?’
‘ তোর প্রিয় সুখগুলো।’
মিথি কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
‘ প্রিয় সুখ?’
সিফাত মাথা হেলিয়ে বললো,
‘ হুম।’
মিথি তখন মুচকি হেসে ডাইরিটা খুলে। ডাইরির প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো করে লিখে,
‘ সিফাত ‘
সিফাত চোখ মুখ কুঁচকে অবাক কণ্ঠে বললো,
‘ তুই আমার নাম লিখলি কেন?’
মিথি তখন মুচকি হেসে জবাব দিল,
‘ কারণ তুই আমার সবথেকে বড়ো সুখ।’
মিথির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কিছু স্বচ্ছ জল। সিফাতকে এই মুহূর্তে ভীষণ মিস করছে সে। যদি পারতো একবার… শুধু একবার তাকে ফিরিয়ে আনতে। যদি পারতো…
,
,
চোখ খুলতেই দেখলো বাইরে ফকফকা রোদ। মিথি ঘুম থেকে উঠে বসলো। ঘড়ির দিকে তাকাতেই হকচকিয়ে উঠলো সে। এগারোটা বাজতে চললো অথচ এখনও কেউ ওকে ঘুম থেকে জাগায়নি। আজব, মানুষগুলো গেলো কই? মিথি রুমের দরজা খুলে ‘ মা ‘ বলে জোরে ডেকে উঠলো। মাহি মিথির রুমে ছুটে এসে বললো,
‘ কি হয়েছে বুবু?’
মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,
‘ কি হয়েছে মানে? এগারোটা বাজে, তোরা আমাকে ডাকিসনি কেন? এখন যে আমার কলেজের লেইট হয়ে গেলো সেটার কি হবে?’
মাহি বললো,
‘ বাবা ডাকতে বারণ করেছে। বলেছে আজ তোমার কলেজ যেতে হবে না?’
মিথি অবাক হলো। বুঝতে পারলো না বাবার এই কথার মানে। সে বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ কেন?’
মাহি ঠোঁট উল্টে বললো,
‘ কি জানি।’
মিথি চিন্তায় পড়ে গেল। মাহিকে যেতে বলে সে উঠে ফ্রেশ হলো।
তারপর সে গেলো রান্নাঘরে। আমিরা বেগম তখন সবজি কাটছিলেন। মিথি গিয়ে তার পাশে বসলো। অনুনয়ের সুরে বললো,
‘ মা, বাবা আমাকে কলেজ যেতে বারণ করেছে কেন?’
আমিরা বেগম সবজি কাটাতেই মনোযোগ রেখে বললেন,
‘ আমাকেও এই ব্যাপারে তোর বাবা কিছু বলেনি ।’
মিথির চিন্তাটা এবার আরো বেড়ে গেলো। নিজের মনকে প্রশ্ন করে জানতে চাইলো। কিন্তু মন তার সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারলো না। বাবাকে একবার ফোন দিবে ভেবেও দিল না, অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকবে এই ভেবে।
মিথি সবেই নাস্তা সেরেছে। চায়ের কাপটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো। আবারও তার চোখ গেল ঐ পাশের ফ্ল্যাটের দিকে। বারান্দার দোলনাটার উপর আজও সেই গিটারটা রাখা। সিফাত এর ও এমন একটা গিটার ছিল। গিটার বাজিয়ে মিথিকে যে সে কত গান শুনিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই তার মনে পড়লো আবারও সেই কথা, কেন বাবা তাকে কলেজ যেতে বারণ করেছে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতেই মিথির মনে হলো দরজার বেলটা যেনো বেজে উঠল। সে উঠে তাদের লিভিং রুমে গেল। মাহি দরজা খুলে দিলে আতাউর সাহেব বাসার ভেতর আসেন। বাবাকে দেখে মিথি ভাবলো, এখনি সুযোগ বাবাকে জিগ্যেস করতে হবে কেন তিনি তাকে কলেজ যেতে বারণ করেছেন। তবে মিথি কিছু বলার সুযোগ পেলো না। তার আগেই আতাউর সাহেব গম্ভীর সুরে বললেন,
‘ মিথি, আমার সাথে আমার রুমে এসো। কথা আছে।’
মিথির দুশ্চিন্তা ক্রমে ক্রমে বেড়ে চলছে। মাথায় তার হাজারো চিন্তা ভাবনা এসে হানা দিচ্ছে। হাত কচলাতে কচলাতে মিথি তার বাবার পেছন পেছন তার রুমে গেল। মিথির চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। আতাউর সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ নৈরিথের সাথে আমার কথা হয়েছে মিথি।’
মিথি চমকে উঠে। বড়ো বড়ো চোখ করে বাবার দিকে তাকায়। এক রাশ প্রশ্নের দানা এসে বিঁধল মিথির মস্তিষ্কে। সে জোরে একটা শ্বাস টেনে নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করে বললো,
‘ কি কথা বাবা?’
#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৭.
~
‘নৈরিথ তোকে ভালোবাসে না। ও তোকে নিয়ে নাকি কোনো দিন এসব ভাবেও নি। নৈরিথের কাছে তুই নাকি শুধু ওর ছাত্রী, এর থেকে বেশি কিছু না।’
বাবার কথা শুনে মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে আগে থেকেই জানে এসব। নৈরিথ তাকে ভালোবাসে না জানা সত্ত্বেও সে এতদিন তার পিছেই পড়ে ছিল। তার ভালোবাসা বোঝাতে চেয়েছিল, কিন্তু নৈরিথ সেটাও বুঝতে চায় নি। মিথি মেনে নিয়েছে, বলা যায় মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। মিথি নম্র গলায় বললো,
‘বাবা, আমি জানি। আমি সরি বাবা। আমি তোমার বিশ্বাস ভেঙেছি। আমি আমার আবেগের কাছে হেরে গিয়েছিলাম। কিছু না ভেবেই নৈরিথ স্যারের উপর বার বার নিজের ভালোবাসা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমি যা করেছি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করো বাবা।’
আতাউর সাহেব অনুভূতিহীন চোখে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। তিনি জানেন উনার মেয়ে যতই মুখে বলুক না কেন ভেতরে ভেতরে ঠিক সে কতটা কষ্ট পাচ্ছে। উনিও যে এই সময়টা একসময় পাড় করে এসেছেন। উনি বোঝেন, মনের অসুখটা টের পান। এই অসুখে তিনিও এককালে অসুস্থ ছিল। তিনি তার মেয়ের কাছে গেলেন। তার মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বললেন,
‘ভালোবাসিস মা, ভুলবি কি করে বলতো? ভালোবাসা কি ভুলা যায়? ভালোবাসা যদি ভুলা যেত তাহলে আমিও এতদিনে নিশিকে ভুলে যেতাম। ভালোবাসা ভুলা যায়না রে মা। ভুলা যায় না।’
মিথি টলমল চোখে বাবার দিকে তাকাল। বাবা তার মেয়ের সামনে তার এক্সের কথা বলছে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত মনে হলেও মিথির কাছে ভীষণ আশ্চর্যজনক। কয়জনে পারে এমন ভালোবাসতে? তার বাবা পেরেছে। মৃত একটা মানুষকে এখনও ভালোবেসে তার মনের এক কোণে এখনও তার ভালোবাসা জমিয়ে রাখতে পেরেছে। মিথি জড়িয়ে ধরল তার বাবাকে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
‘তুমি তোমার নিশিকে কি খুব মিস করছো বাবা?’
আতাউর সাহেব হাসলেন, বললেন,
‘তোর মা শুনলে আমাকে বাড়ি ছাড়া করবে।’
মিথি ক্ষীণ সুরে বললো,
‘মাকে ভালোবাসো বাবা?’
‘নিজের থেকেও বেশি।’
‘তাহলে তোমার নিশিকে?’
আতাউর সাহেব নিজেকে সপ্রতিভ রেখে বললেন,
‘নিশিকে যেমন আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না, তেমনি তোর মাকে ছাড়া আমি কোনোদিন বাঁচতে পারবো না। নিশি আমার অতীত, কিন্তু তোর মা, আমার বর্তমান আমার ভবিষ্যত। তোর মা আমার জীবনে আছে বলেই আমি এখনও বেঁচে আছি। নয়তো কবেই হারিয়ে যেতাম।’
মিথি চোখ বুজে বাবার বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখল। বাবার বুকের ঢিপঢিপ শব্দটা সে শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তার প্রতিটা স্পন্দন কেবল তার মার নামে। যেন তাকেই ক্ষণে ক্ষণে ডেকে চলছে। একেই বুঝি বলে ভালোবাসা? একেই বুঝি বলে প্রণয়? যার দহনে হাজারও হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হয় প্রতিনিয়ত।
.
.
‘কলেজে এলি না কেন?’
‘ইচ্ছে করেনি।’
নেহা কপাল কুঁচকে বললো,
‘ইচ্ছে করেনি, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? বলবি না আমাকে?’
মিথি স্বাভাবিক গলায় বললো,
‘কোনো কারণ নেই। সত্যিই ইচ্ছে করেনি তাই আসিনি।’
‘আচ্ছা বুঝলাম। কি করছিস এখন?’
‘বারান্দায় বসে আছি।’
নেহা তখন হেসে বললো,
‘আচ্ছা, তোর গোলাপ গাছে গোলাপ ফুটেছে। অনেক দিন হলো তো চারাটা আনলি।’
মিথি তাকালো তার গোলাপ ফুলের চারাটার দিকে।
‘কুড়ি বেরিয়েছে সবে, ফুল ফুটতে এখনও অনেক দেরি।’
‘আচ্ছা শোন, তোর এই গোলাপ গাছে গোলাপ ফুটলে প্রথম গোলাপটা কিন্তু আমাকে দিবি, কেমন?’
মিথি স্মিত হেসে বললো,
‘ঠিক আছে।’
তারপর আরও কিছুক্ষণ কথা বললো দুজন। কথা বলার শেষ মুহুর্তে আসতেই হঠাৎ নেহার রুমে নৈরিথ এসে বললো,
‘তুই কি মিথির সাথে কথা বলছিস?’
নেহা মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘হ্যাঁ।’
নৈরিথ তখন বললো,
‘আমাকে একটু দে। কথা আছে ওর সাথে।’
বিস্মিত হয়ে ব্রু কুঁচকালো নেহা। কিছু না বুঝেই নৈরিথের হাতে তার ফোনটা দিল। নৈরিথ ফোনটা কানে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
‘হ্যালো!’
চমকে উঠল মিথি। নৈরিথের গলা। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছে সে। এটা নৈরিথেরই গলা। হঠাৎ তার অস্থিরতা বেড়ে গেল। বক্ষকম্পনও বেড়ে গেল সমান তালে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
‘সস-স্যার!’
‘হু। কেমন আছো?’
মিথি ঠোঁট দিয়ে জিভ ভিজিয়ে বললো,
‘ভালো। আপনি ভালো আছেন?’
ওপাশ থেকে ফোঁস করে এক নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। সাময়িক নিরবতার পর নৈরিথ বললো,
‘আংকেলকে এসব না বললেই পারতে মিথি। উনি তোমার বাবা, আমার গুরুজন। আমার এখন ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। যদিও আমাদের কথোপকথনটা ফোনে হয়েছিল, তাও আমি লজ্জায় পড়েছিলাম ভীষণ। কোনো দরকার ছিল না মিথি এসব কথা আংকেলকে জানানোর। তোমার আমার মাঝে তো সব কথা হয়েছেই তাই না। তাহলে কেন আংকেলকে এসবের মাঝে টেনে আনলে বলতো?’
মিথি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। গলা ধরে এলো তার। ফোনের অপর পাশের লোকটা যে জীবনেও তার কথা বুঝবে না সেটা সে খুব ভালো করেই জানে। মিথির কোনো জবাব না পেয়ে নৈরিথ বললো,
‘মিথি, আমি জানি তুমি আমার সম্পর্কে সবকিছুই জানো। আমি কেমন ধরনের ছেলে সেটাও তুমি জানো। নেহা নিশ্চয়ই সব বলেছে তোমায়।(খানিক থেমে)..মিথি, আমি ভালোবাসায় বিশ্বাসী না। বিশ্বাস করো, অনেক চেষ্টা করেছি আমি, কষ্ট আমারও হতো। মনে হতো একবার ভালোবাসা উচিত। তোমাকে এত কষ্ট আমি দিতে চায়নি। কিন্তু…কিন্তু আমার মন, আমার মনটাকে আমি কোনোভাবেই রাজি করাতে পারছি না। সে ভয়ে আড়ষ্ট। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমিও কিছু করতে পারি না। আমার ভালোবাসতে ভয় করে। যদি আমাদের দশাও আমার মা বাবার মতো হয়? তারাও ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, কই পারেনি তো একসাথে থাকতে। বিয়ের পর কোথায় গেল এত ভালোবাসা। বাবা আমার অন্য নারীর সাথে অবৈধ কার্যকলাপে ধরা পরে এখন জেলে। আর মা, সে এখন অন্য একজনের সাথে দিব্যি সংসার করছে। কই, মা তো এখন একবারও বাবার কথা বলে না। অথচ শুনেছিলাম তারাই একসময় এই ভালোবাসার জন্য আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে চেয়েছিল।..তাই আমি ভীত, প্রচন্ড ভীত। ভালোবাসার প্রতি আমার এই ভয়টা আদৌ কখনও দূর হবে কিনা আমি জানি না তবে আমি চাই সত্যিই চাই তোমার মতো ভালোবাসতে। তোমার মতো করে তোমাকে ভালোবাসতে। তবে কোনোদিন পারবো কিনা জানিনা। আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই না? পারলে ক্ষমা করো। আর ভালোভাবে পড়াশোনা করো, দোয়া রইল। ভালো থেকো, আল্লাহ হাফেজ।’
টুট, টুট, টুট কেটে গেল কলটা। কান থেকে ফোনটা সরিয়ে মিথি স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল ফোনটার দিকে। বুকের ভেতরটা ধপধপ করে লাফাচ্ছে তার। নৈরিথ অনেক কিছু বলে ফেলেছে তাকে। এত কিছু সে আশা করেনি। হুট করেই সবকিছু যেন বদলে গিয়েছে। মিথি জানে নৈরিথের মা বাবার কথা, নেহা বলেছিল। কিন্তু নৈরিথ..নৈরিথের ভালোবাসার প্রতি এই ভয়ের কথা সে কোনোদিন জানতো না। আজ জেনেছে। আচ্ছা, ভালোবাসতেও বুঝি কেউ ভয় পায়? কিসের ভয়? ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়? সব ভালোবাসা এক হয় নাকি? ভালোবাসার পরিণয়ে যদি সুখ না পায় সে, প্রয়োজনে বিচ্ছেদে সুখ খুঁজে নিবে, তাও মানুষটা ভালোবাসুক তাকে। একটু ভালোবাসুক। ভীত সন্ত্রস্ত মন নিয়ে পড়ে না থেকে একবার ভালোবাসার কথা বলুক, সবাই তো আর এক হয় না। কেউ কেউ প্রচন্ড ভালোবাসতে জানে। সবাই ছলনা করে না, কে বোঝাবে এই কথাটা ঐ মানুষটাকে? কে বোঝাবে?
.
.
সূর্য ঢলে পড়ল পশ্চিমাকাশে। বাইরে এখন নিভু নিভু বিকেল। বাতাস বইছে হালকা পাতলা। মিথির ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বইটা নিয়ে বসে আছে রাদিতের সামনে। রাদিতের চোখে একটা চিকন ফ্রেমের চশমা। যার ফাঁক দিয়ে সে বারবার মিথির দিকে তাকাচ্ছে। বই বাদে বাকি সবকিছুতেই মিথির চোখ আছে। রাদিত অনেকক্ষণ যাবত মিথির এই উদাসীনতা খেয়াল করছে। যেন আস্ত মানুষটা এখানে থাকলেও তার মন এখন তার ধারে কাছেও নেই। রাদিত অত্যন্ত বিরক্ত হলো। টেবিলে একটা বারি মেরে বলে উঠল,
‘এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার?’
মিথি ব্রু কুঁচকে রাদিতের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কেন স্যার? কি হয়েছে?’
রাদিত নাকের পাল্লা ফুলিয়ে সশব্দে বললো,
‘এদিক ওদিক কি দেখছো তুমি? আমি যে এদিকে একের পর এক অংক করিয়েই যাচ্ছি সেদিকে তোমার কোনো খেয়াল নেই। কি এত ভাবছো তুমি?’
মিথি হঠাৎ দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘না মানে স্যার, আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা ভাবছিলাম।’
রাদিত কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
‘আচ্ছা, তা কি গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনি?’
মিথির ঝলমল করে হেসে বললো,
‘ভাবছিলাম স্যার, আপনার বিয়েতে কি পরে যাওয়া যায়। আসলে আমার সব ড্রেস পরা হয়ে গিয়েছে নতুন কোনো ড্রেস নেই। আপনার তো বিয়ের বয়স যায় যায়। হুটহাট যেকোনো সময় একটা বিয়ে লেগে যেতে পারে। তাই আগে থেকেই ড্রেস কিনে রাখতে হবে। তাই এই নিয়ে একটু চিন্তায় আছি আরকি।’
রাদিত ঠোঁট কামড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিথির দিকে তাকাল। মিথি অস্বস্তি ভরা হাসি দিয়ে বললো,
‘কি হয়েছে স্যার।’
রাদিত বাঁকা হেসে বললো,
‘ভাবছি আমার বিয়েতে তোমাকে বেনারসী পরার সুযোগ করে দিব।’
মিথি বুঝলো না রাদিতের কথার মানে। সে ব্রু কুঁচকে আবার প্রশ্ন করতেই রাদিত সেটা ইগনোর করে বললো,
‘কিছু না। পড়ায় মন দাও।’
চলবে..
চলবে…