তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব -২৫+২৬

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৫.
~
রাত অনেক। আকাশে মিটি মিটি তারা। চাঁদের ম্লান আলো। দূরের রাস্তাটা থেকে কিছু কুকুরের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। গুমোট পরিবেশ। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। পুরো শহর এখন ঘুমে ব্যস্ত। কিন্তু ঠিক এই সময়ই কেউ একজন মনের কষ্ট মেটাতে সিগারেটে সুখ খুঁজছে। মানুষটা কঠিন। সিগারেটের প্রতিটা টান তাকে আরও কঠিনতর করে তুলছে। ঈগল চক্ষুগুলো দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে খুব মনোযোগ দিয়ে সে কাউকে দেখছে। অনেকক্ষণ যাবত দেখে গেল। বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। মানুষটি ক্ষীণ সুরে বললো,

‘আই মিস ইউ, মিঠু। আই মিস ইউ সো মাচ।’
.
.
আজ সকালটা সুন্দর। খুব সুন্দর। শুভ্রতায় ছেয়ে আছে আকাশ। তার সাথে একরাশ কোমল শুভ্রতায় ভরপুর মিথির মন। খুশিতে তার প্রাণ পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। সকাল হতে না হতেই নৈরিথের ম্যাসেজ। লেখা ছিল, ‘শুভ সকাল’। মিথি ম্যাসেজটা সিন করেছিল অনেক সময় পর। কিন্তু যখনই সে ম্যাসেজটা দেখে তখনই সে লাফিয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দেয়, ‘শুভ সকাল।’

নৈরিথ মিথির ম্যাসেজ সিন করলেও পরে আর কোনো উত্তর দেয় না। মিথি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নৈরিথের ম্যাসেজের কিন্তু সে আর কোনো ম্যাসেজ পায় না। তাই সে দুঃখি দুঃখি মন নিয়ে উঠে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে।

ফ্রেশ হয়ে এসে সোজা যায় ডাইনিং রুমে। দেখে তার মা মাহিকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। মিথি একটা চেয়ার টেনে বসলো। তারপর জগ থেকে পানি ঢেলে পানি পান করলো। আমিরা বেগম ততক্ষণে আরেকটা বাটিতে মিথিকে স্যুপ বেড়ে দিলেন। মিথি এক চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে বললো,

‘উমম মা, খুব টেস্টি হয়েছে।’

সে আস্তে আস্তে স্যুপটা খেতে লাগল। মাহির খাবার ততক্ষণে শেষ। মাহি খাবার শেষ করেও সেখানে বসে রইল। তাকিয়ে রইল মিথির দিকে। মিথি খাওয়ার মাঝখানেই খেয়াল করলো ব্যাপারটা যে মাহি তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,

‘কি রে কি দেখছিস?’

মাহি টেবলের উপর দুহাত রেখে মাথাটা কিছুটা এগিয়ে এনে বললো,

‘এই স্যুপটা তুমি কেন খাচ্ছো বুবু? এটাতো মা আমার জন্য বানিয়েছে।’

মিথির হঠাৎ সব মনে পড়ল। তার ভাই তো কিছু জানে না। এখনই সে যদি মাহিকে কিছু একটা বলে বুঝাতে না পারে তবে নির্ঘাত সে ধরা পড়ে যাবে। তাই সে আমতা আমতা করে বললো,

‘ত তো কি হয়েছে? আমি কি খেতে পারি না? ভেজিটেবল স্যুপ শরীরের জন্য অনেক উপকারী, তাই খাচ্ছি। আর একটু পর তো পা রুটি আর জ্যাম খাবো। এখন এটা খেতে ইচ্ছে করেছে তাই খাচ্ছি।

মাহির সন্দেহ মিটল না। সে সরু চোখে কিছুক্ষণ মিথির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে নেমে লিভিং রুমে চলে গেল। মাহি চলে যেতেই মিথি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘উফফ মা, তোমার ছেলেটা যা শুরু করেছে আমি মনে হয় বেশিদিন আর এই সত্যিটা লুকিয়ে রাখতে পারবো না।’

আমিরা বেগম বললেন,

‘ওর সেই প্রথম থেকেই তোকে সন্দেহ হচ্ছে। আর ও তোর সবকিছু ইদানিং খুব খেয়াল করছে, তুই কি খাচ্ছিস, কি করছিস, সবকিছুই ও নজরে নজরে রাখছে। তাই আমারও মনে হয় তুই খুব তাড়াতাড়িই ধরা পড়ে যাবি।’

মিথিরও তাই মনে হচ্ছে। ভয় হচ্ছে, ছেলেটা সব সত্যি শোনার পর না জানি কিভাবে রিয়েক্ট করে?

খাবার শেষ হলে মিথি রান্নাঘরে গেল। আমিরা বেগম তখন তাক থেকে কি যেন বের করছিলেন। মিথি কাঁচুমাচু করছে কিছু বলার জন্য। কিন্তু পারছে না। মিথি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ায়। আমিরা বেগম ঘুরে তাকিয়ে মিথিকে দেখে বললেন,

‘কিরে কিছু লাগবে?’

মিথি মাথা নাড়িয়ে না বলে। তিনি তখন জিগ্যেস করেন,

‘তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

মিথি হাত কঁচলাতে কঁচলাতে ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘মা, আমাকে একটু রান্না শেখাবে?’

আমিরা বেগম বড়ো বড়ো চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। মিথি তাতে আরো লজ্জা পেয়ে গেল। আমিরা বেগম হেসে বললেন,

‘আরে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? এখন তো আমার মেয়ে একজনের বাড়ির বউ। তাকে তো রান্না শিখতেই হবে। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে রান্না করতে হবে না?’

মিথি মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। আমিরা বেগমও হাসলেন।বললেন,

‘ঠিক আছে, আজ তাহলে তোকে আমি মুরগী রান্না করাটা শেখাবো কেমন?’

মিথি খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে বললো,

‘ঠিক আছে মা।’
.

আজকাল নেহার নাম্বারটা প্রায়ই ওয়েটিং এ থাকে। ব্যাপার কি? মেয়েটা আবার প্রেম ট্রেম করছে না তো। করতেও পারে, সন্দেহ রাখা যাবে না। মিথি লাগাতার নেহাকে কল দিতে থাকে। সে আজ মুরগী রান্না করেছে এই খবরটা নেহাকে দেওয়া না পর্যন্ত তার পেটের ভাত হজম হচ্ছে না। কিন্তু এই পাকিস্তানি বান্দরটা তার কল রিসিভ করছে না। কোন প্রাণীর সাথে যে এতক্ষণ ধরে কথা বলছে তা এক আল্লাহই জানেন। মিথি বিরক্ত হয়ে ফোনটা রেখে দেয়। ধুর, আর কলই দেবে না। মিথি কথাটা ভাবতে ভাবতেই তার ফোনটা তখন বেজে উঠে। নেহা কল দিয়েছে ভেবে হাতে নিতেই দেখে নৈরিথ। বিনা কারণেই মিথির বুকের কম্পন বেড়ে যায়। মনে পড়ে এই মানুষটা তার স্বামী। তার একমাত্র বন্ধু। তার ভালোবাসা। মিথি তৃপ্তি মনে কলটা রিসিভ করে। প্রথমে সালাম দিতেই নৈরিথ তার সালামের জবাব দিয়ে জিগ্যেস করে,

‘খাওয়া দাওয়া হয়েছে?’

মিথি ক্ষীণ সুরে জবাব দেয়,

‘জ্বি, আপনার?’

‘হুম, মাত্রই শেষ হলো। ঔষধ খেয়েছো?’

‘না খাবো এখন।’

‘আচ্ছা খেয়ে নাও।’

ব্যাস চুপ। মিথিও চুপ। কি বলবে? কি বলা যায়? উফফ তারা না স্বামী স্ত্রী তবে তারা চুপ করে বসে আছে কেন? আরেহ, কোনো কথাই তো কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। মিথি অনেকক্ষণ ভেবে ভেবে হঠাৎ বলে উঠল,

‘আপনার অফিসের সবাই বিয়ের কথা জানে?’

‘না, আমি বলেনি। এখন বললেই ট্রিট ট্রিট বলে মাথা খাবে।’

‘তো কি হয়েছে, না হয় দিবেন ট্রিট। তাই বলে কাউকে বলবেন না আপনি যে বিবাহিত?’

নৈরিথ ব্রু উঁচিয়ে বললো,

‘এটা বলাটা কি খুব জরুরি?’

মিথি নাক মুখ কুঁচকে বললো,

‘অবশ্যই জরুরি। আচ্ছা বাই দ্যা ওয়ে, আপনার নিশ্চয়ই অনেক মেয়ে কলিগ আছে?’

‘হ্যাঁ আছে, তো?’

মিথি গলা ঝেড়ে বললো,

‘শুনোন কাল ওদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবেন। তারপর ওদের মিষ্টি খাইয়ে বলবেন, এটা আপনার বিয়ের মিষ্টি। ছেলেদের খাওয়ানোটা বাধ্যতামূলক নয় তবে মেয়েদের অবশ্যই খাওয়াতে হবে। প্রত্যেকটা মেয়ে কলিগকে খাওয়াবেন বুঝেছেন?’

নৈরিথ ঠোঁট কামড়ে হাসল। বললো,

‘কি যে বলো, তোমার কথা শুনলে তো আমি আমার ঐ সুন্দরী কলিগদের হারাবো। তারা যখন জানবে আমি বিবাহিত তখন কি তারা আমার ধারে কাছে ঘেঁষবে বলো? ঘেঁষবে না। তাই এই কথাটা ভুলেও ওদের কানে দেওয়া যাবে না, বুঝেছো?’

মিথি জ্বলে উঠল। চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘অফিসে যান কি সুন্দরী কলিগদের সাথে ঘেঁষা ঘেঁষি করার জন্য? বের করছি আপনার এই ঘেঁষা ঘেঁষি। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’

কথাটা বলেই মিথি কল কেটে দিল। রাগে কান দিয়ে তার গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। যদিও সে জানে নৈরিথ তাকে রাগানোর জন্য এসব বলেছে। কিন্তু তাও সে বলবে কেন? কেন বলবে? আর তার উপর ছেলেদের মন। বিশ্বাস নেই। আগে থেকেই তাকে সাবধান থাকতে হবে। মিথি নেহাকে কল লাগায়। এবার কলটা রিসিভ হয়। কিন্তু নেহা কিছু বলার আগেই মিথি বলে উঠে,

‘নেহু, তুই তোর ভাইয়ের অফিসের লোকেশন জানিস?’

নেহা খানিক অবাক হয়ে বললো,

‘হ্যাঁ জানি। কিন্তু, কেন বলতো?’

‘আমাকে এখনই তোর ভাইয়ের অফিসে নিয়ে যাবি। আমি তৈরি হচ্ছি। তুইও তৈরি হয়ে আমাদের বাসায় চলে আয়।’

নেহা কিছু বুঝে উঠার আগেই মিথি কলটা কেটে দেয়। তারপর সে আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করে। শাড়িটা গায়ে দিয়ে আয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলে,

‘আপনার আর কষ্ট করে কাউকে কিছু বলতে হবে না নৈরিথ। আমি নিজেই সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে আসছি।’
#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৬.
~
আমিরা বেগমকে কোনো রকমে বুঝিয়ে মিথি আর নেহা বেরিয়ে পড়ল। প্রথমে তারা গেল একটা মিষ্টির দোকানে। সেখান থেকে মিথি কিছু মিষ্টি কিনল। তারপর একটা সি এন জি নিয়ে তারা রওনা হলো নৈরিথের অফিসের উদ্দেশ্যে। নেহার যেন সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে ব্রু কুঁচকে মিথির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তোর হঠাৎ কি হয়েছে বলতো? এই মিষ্টি টিষ্টি নিয়ে তুই ভাইয়ের অফিসে কেন যাচ্ছিস? আর ভাই জানে এসব?’

মিথি বাঁকা হেসে বললো,

‘উঁহু, তোর ভাইকে সারপ্রাইজ দিব।’

নেহা বড়ো বড়ো চোখ করে ভীত কন্ঠে বলে,

‘ভাই কিন্তু খুব রেগে যাবে মিথি।’

মিথি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,

‘রাগলে রাগুক। আমি কাউকে ভয় পায় নাকি?’

নেহা বিরক্তভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না জানি এই মেয়ে কি করতে চাইছে?
.

নৈরিথের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেহা আর মিথি। কিন্তু দারোয়ান তাদের কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। মিথি তো ইতিমধ্যেই রেগে মেগে আগুন। সে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে দারোয়ানকে বললো,

‘আরে চাচা, আমি নৈরিথের বউ। কালই আমাদের বিয়ে হয়েছে। বিশ্বাস করছেন না কেন?’

‘পাগলে পাইছে আমারে যে আপনে যা বুঝাইবেন আমি তাই বুঝম। নৈরিথ স্যার বিয়া করলে বুঝি আমরা জানতাম না? আর কালকে বিয়া কইরা স্যার আজকে আইছে অফিস করতে আর আপনি আমারে হেই কথা বিশ্বাস করতে কইতাছেন? যান তো এইখান থেইকা। অযথা ঝামেলা কইরেন না।’

কথাটা ভজভজ কন্ঠে বলে দারোয়ান চাচা গিয়ে তার চেয়ারটায় বসলেন। মিথি রাগে ফুঁসে উঠে বললো,

‘এই নেহু তুই তোর ভাইকে কল লাগা। বল এক্ষুণি নিচে আসতে। উনি না আসা পর্যন্ত আমরা কোনভাবেই ভেতরে ঢুকতে পারবো না।’

উপায়ান্তর না পেয়ে নেহা নৈরিথকে কল করলো। কলটা কেটে দিয়ে নৈরিথ আবার কল ব্যাক করলো,

‘হ্যালো ভাইয়া, তুই কই রে?’

‘আমি তো অফিসে, কেন?’

‘ওহহ, আচ্ছা একটু নিচে আয় তো!’

নৈরিথ অবাক হয়ে বললো,

‘কেন?’

‘আরে আগে আয় তো। তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। জলদি নিচে আয়।’

নৈরিথ কিছু বুঝতে পারলো না। নেহা কলটা কেটে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। মিথি তখন বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিয়ে বললো,

‘চাচা, আমার জামাই আসছে। এখনই আপনি প্রমাণ পেয়ে যাবেন।’

দারোয়ান তার কথা পাত্তাই দিল না। কিছুক্ষণ পর লিফটের দরজা খুলতেই মিথি নৈরিথকে দেখল। ডার্ক ব্লু ব্লেজার আর ভেতরে হুয়াইট শার্ট। উফফ, মিথি যেন ছোট খাটো হার্ট অ্যাটাক করলো। নৈরিথ ফোন দেখে দেখে এগুচ্ছিল হঠাৎ সামনের দিকে তাকাতেই সে থমকে যায়। ব্রু কুঁচকে ভালোভাবে খেয়াল করতেই সে চমকে উঠে। দ্রুত এগিয়ে আসে। নৈরিথকে দেখা মাত্রই দারোয়ান দাঁড়িয়ে যায়। নৈরিথ বিস্ময় নিয়ে নেহা আর মিথিকে দেখে। অবাক কন্ঠে বলে,

‘তোরা এখানে কেন?’

নেহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

‘এই যে এনার জন্য।’

নৈরিথ চোখ মুখ কুঁচকে রাগি চোখে মিথির দিকে তাকাল। মিথি হালকা ঢোক গিলে ক্ষীণ সুরে বললো,

‘এইভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আমি কি এমনি এমনি এসেছি নাকি? আপনি আমাকে ঐ কথাগুলো বললেন কেন? আপনার কারণেই আমাকে আসতে হয়েছে। এখন একদম আমার দিকে ওভাবে তাকাবেন না।’

নৈরিথ রাগে দুঃখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘তাই বলে তুমি আমার অফিসে চলে আসবে? ইডিয়েট কোথাকার মজাও বুঝো না?’

মিথি কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,

‘এখন আমি আপনার বউ। আপনি আমাকে ইডিয়েট বলতে পারেন না।’

নৈরিথ কোমরে হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে জোরে নিশ্বাস ফেলে। তারপর কিছুটা শান্ত হয়ে বলে,

‘এসেছো ভালো হয়েছে। এবার চলে যাও।’

‘ওমা, চলে যাওয়ার জন্য এসেছি নাকি? এই যে মিষ্টি নিয়ে এসেছি। আপনার সুন্দরী মেয়ে কলিগদের মিষ্টি না খাইয়ে আমি এখান থেকে এক পাও নড়বো না।’

নৈরিথ বিরক্ত হয়ে বলে,

‘মিথি, এটা অফিস। আর আমি এখানকার ম্যানেজার। আর আমার ওয়াইফ হয়ে তোমার এইখানে এসব কাজ মানাচ্ছে না বুঝেছো?’

মিথি যেন লজ্জা পেল। মুচকি হেসে বললো,

‘ইসস, আপনার মুখে ওয়াইফ কথাটা শুনতে কি মিষ্টি লাগে!’

নৈরিথ বিরক্ত হয়ে মিথির দিকে তাকায়। মিথির লজ্জার ফিলিংস যেতেই সে কঠিন গলায় বললো,

‘শুনুন, এই চাচাটা আমায় ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। আমি এতবার করে বলেছি আমি আপনার বউ বউ তাও উনি আমার কথা বিশ্বাস করছে না। আপনি উনাকে বলে দিন তো যে আমি আপনার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র ওয়াইফ!’

নৈরিথ চাচার দিকে ঘুরে তাকাল। চাচা ততক্ষণে সব বুঝে গিয়েছে। তাই নৈরিথের আর কিছু বলতে হয়নি। তিনি নিজ থেকেই বললেন,

‘মা, আমারে ক্ষমা কইরা দিয়েন। আমি বুঝতাম পারি নাই। স্যার আপনেও আমারে ক্ষমা কইরা দিয়েন। আমার ভুল হইয়া গেছে।’

নৈরিথ প্রসন্ন হেসে বললো,

‘আরে না না চাচা, আপনার কোনো ভুল হয়নি। আপনি তো কেবল আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন, ভুল হয়েছে তো এই মেয়ের। সবসময় খালি উল্টা পাল্টা কাজ।’

মিথি সরু চোখে নৈরিথের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আরো উল্টা পাল্টা কাজ করবো। যত খুশি করবো, আপনার কি হ্যাঁ? এখন এত কথা না বলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।’
.
.
একপ্রকার জোর করেই নৈরিথকে নিয়ে মিথি অফিসের ভেতর গেল। নেহাও গেল পেছন পেছন। নৈরিথ চরম বিরক্তিতে আছে। এইভাবে হুট করে কারো বউ অফিসে চলে আসে নাকি? তার বাকি সব কলিগরা কি ভাবে কে জানে? আর তার বস.. নৈরিথ পড়ে যায় দুশ্চিন্তায়। মিথি একগাদা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে খুশি খুশি মনে অফিসের ভেতর প্রবেশ করে। নৈরিথের চুপসানো মুখটা দেখে নেহা ফিসফিসিয়ে তাকে বলে,

‘বিয়ে করেছিস আর বউয়ের প্যারা সহ্য করতে পারবি না, তা কি হয় বল? চিন্তা করিস আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে যাবে।’

নৈরিথের পাশে দুজন অচেনা মেয়েকে দেখা মাত্রই সকলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাদের উপর গিয়ে পড়ল। সবার মাথায় খালি এক প্রশ্ন, কারা এরা? নৈরিথ প্রথমেই তার এক কলিগকে বলিয়ে তার বসকে ডাকাল। বস আসতেই নৈরিথ জোর পূর্বক হেসে বললো,

‘প্রথমেই আমি সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আমার জন্য হয়তো আপনাদের কাজের ডিস্টার্ব হচ্ছে তার জন্য সত্যিই আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।(একটু থেমে) আসলে..আসলে কাল রাতে আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়ের সূচনা হয়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো সেটা আমি আপনাদের কাউকেই জানাতে পারেনি।’

নৈরিথের এইটুকু কথার ধরনেই অনেকে ধরে ফেলল। তার সবচেয়ে ক্লোসড কলিগটা সবার মাঝখান থেকে বলে উঠল,

‘স্যার, আপনি বিয়ে করেছেন নাকি?’

নৈরিথ তখন মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘হ্যাঁ।’

সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে সোরগোল পড়ে গেল। সকলে হৈ চৈ বাধিয়ে দিয়েছে। বসও খুব অবাক। তিনি বললেন,

‘বিয়ে করলেন আর আমাদের জানালেনও না? আচ্ছা, আমি যদি খুব ভুল করে না থাকি আপনার পাশের উনিই কি আমাদের ভাবি?’

নৈরিথ বিব্রত কন্ঠে বললো,

‘জ্বি স্যার।’

বসে আরো চমকে গেল। খুশি হয়ে বলতে লাগল,

‘আরে কি বলেন? ভাবিকে নিয়ে আসবেন আমাদের জানাবেন না? আমরা তো কোনো আয়োজনই করলাম না। এই তোমরা উনাদের বসার ব্যবস্থা করে দাও। নৈরিথ সাহেব, এইভাবে সারপ্রাইজ না দিলেও পারতেন। আমরা এখন অল্প সময়ের মধ্যে কি করবো বলুন তো?’

নৈরিথ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল। বললো,

‘স্যার, এত ব্যস্ত হবেন না। ও এসেছে আপনাদের মিষ্টি খাওয়াতে। নিজেই মিষ্টি কিনে নিয়ে এসেছে।’

বস হেসে বললেন,

‘শুধু মিষ্টি খাওয়ালে হবে ভাবি? পোলাও কোরমার দাওয়াত দিবেন না?’

মিথি মুচকি হেসে বললো,

‘জ্বি অবশ্যই দিব। আপাতত কাবিনের মিষ্টি খান, আর যখন অনুষ্ঠান হবে তখন না হয় পোলাও কোরমা খাবেন?’

বস বললো,

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। নৈরিথ সাহেব, আপনি ভাবিকে নিয়ে আমার কেবিনে আসুন। আর ঐ মেয়েটা কে? ভাবির বোন?’

নৈরিথ হেসে বললো,

‘না ও আমার একমাত্র বোন, নেহা।’

‘ওহ আচ্ছা আচ্ছা। তা ভালো আছো মা?’

নেহা হেসে জবাব দিল। তারপর তারা তিনজনেই গিয়ে বসের কেবিনে বসলো। মিথি তার মতে মতে মেয়ে কলিগ খুঁজেছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো কোনো মেয়েই দেখল না সে। মিথি ভাবনায় পড়ে গেল। তাহলে কি সবটাই নৈরিথের বানানো কথা ছিল, শুধু মাত্র তাকে রাগানোর জন্য? নাকি পরে গিয়ে আবার তার ধারনাটাই ঠিক হবে? ঠিক হলেই বা কি? সে নৈরিথকে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। আর সে জানে নৈরিথও তাকে তার মতোই ভালোবাসে। কিন্তু তাও ভয় হয়, যদি তাদের এই ভালোবাসায় কারোর নজর লাগে?

চলবে..
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here