#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_৩২
#সুমাইয়া_মনি
পুরোবাড়ি নিরব ফাঁকা লাগছে রাদ চলে যাওয়ার পর। ইসানা বিষয়টি অনুভব করে অস্বস্তি বোধ করে। যাওয়ার সময়েও মুখে কোনো বাক্য বলেনি। আগের ন্যায় টেক্সটের মাধ্যমে বার্তা প্রদান করেছেন। রাদ মনঃক্ষুণ্ন করে বেড়িয়ে গিয়েছে। তবে সে আশাবাদী ফিরে আসার পর ঠিকিই কথা বলবে।
ইসানা রুমে ফিরে দেয়ালে টাঙানো ছবিটির ওপর লক্ষ্য করে।
যাওয়ার সময় এই ছবিটি দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। এবং বলে গেছে, ‘তার কথা মনে পড়লে ছবির পানে চেয়ে বাক্যবিনিময় করতে।’
বিনাবাক্যে শুনেছে রাদের কথা। আগ্রহ দেখিয়ে কিছু বলেনি।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটি দেখে। রাজকীয় নরম আসনে বসে ঘাড় মৃদু কাত করে চিত্রটি তোলা হয়েছে। চেহারায় শোভনীয় সুদর্শন ভাব স্পষ্ট!
হাস্যমুখ বিহীন গম্ভীর ভাব তার আদলে। বেশ চমৎকার মনোমুগ্ধকর হয়েছে চিত্রটি। কিছু একটা ভেবে ইসানা নজর সরিয়ে ফেলে। টেক্সট করে জিজ্ঞেস করে আমেরিকায় পৌঁছেছে কি-না। উত্তর আসে ওপর প্রান্ত থেকে।
‘হ্যাঁ!’
ইসানা জবাবে কিছু লিখে না। ফোন রেখে দিবে এমতাবস্থায় ফোনের টোন শুনে দ্রুত নজর ফেলে।
‘টেক কেয়ার সানা।’
ইসানার বুকে অদ্ভুত অনুভূতির উগ্রতা আবিষ্কার করে। বদনখানায় মলিন ভাবে কিছু একটা স্পর্শ করল। দ্রুত ফোন রেখে বিছানার চট করে বসে যায়। এদিক-ওদিক আঁখিযুগল ছোটাছুটি করে নিজেকে ধাতস্থ করার প্রচেষ্টা চালায়।
_
পিকাপ দ্বারা কাপড় ডেলিভারি করতে বেরিয়েছে ইভান। ফ্যাক্টরির সঙ্গে ডেলিভারির দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। মেইন রাস্তা থেকে সরু গলিতে ঢুকতেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়।
তৎক্ষনাৎ একটি মেয়ে সামনে চলে আসায় জোরে ব্রেক কষে। মেয়েটি নিজের রক্ষার্থে ভীতু হয়ে দু হাত সামনে তুলে আদল ঢেকে ফেলে। ইভান ড্রাইভারকে দু চারটে কঁড়া কথা শুনিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে। মেয়েটি নিজেকে সুস্থ সবলা দেখে পুরুষালী কণ্ঠ শুনে তার পানে তাকায়। ইভান এগিয়ে এসে ভদ্রতাসূচক ভাবে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি ঠিক আছেন?’
মেয়েটি মৃদুস্বরে বলল,
‘হ্যাঁ!’
‘স্যরি! আসলে তাড়াহুড়োয় ছিলাম তো। তাই দ্রুত গাড়ি ছুড়াচ্ছিল। আপনি কোথায় যাবেন বলুন। আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি আসুন।’
‘লাগবে না। আমি যেতে পারব।’
‘না, আপনি আসুন। না হলে বুঝবো আপনি স্যরি এক্সেপ্ট করেননি।’
‘করেছি। আপনারা যেতে পারেন।’
‘আপনি আসুন প্লিজ।’
ইভানের ভদ্রতাসূচক আবদারে মেয়েটি পিকাপে চড়তে রাজি হয়। সামনের সিটে ড্রাইভার সহ তারা তিনজন উঠে বসে। তিনজনই হ্যাংলা-পাতলা হওয়ায় বসতে অসুবিধা হয় না।
গাড়ি চলাকালীন পরিচয় হয় তাদের। মেয়েটির নাম মিতু।
পরিবারের বড়ো মেয়ে। তিনবোন। ভাই নেই। বাবার অকালে মৃ’ত্যু’তে সংসারের হাল নিজেকে ধরতো হয়। অনার্স প্রথম অব্ধি পড়া হয়। তারপরই সমাপ্ত। এখন দু বোনের পড়াশোনা ও সংসারের জন্য টিউশনি করিয়ে উপার্জন করতে হয় তাকে। সেখান থেকেই ফিরছিল। পথিমধ্যে অঘটনের হাত থেকে রক্ষে হলো। পরিচয় পর্বের মাধ্যমে বাড়ির কাছে চলে আসে। গাড়ি থেকে নেমে ইভানকে বিদায় জানায়। তারা এগোয় তাদের গন্তব্যে। দু পাশে দেয়াল ও উপরে চাল দিয়ে নির্মিত দু’টি রুমে ভাড়া থাকে তারা। এই এড়িয়ায় প্রাই চালাঘর দেখা যায়। বিল্ডিং রয়েছে পাশের গলিতে।
‘এ রাস্তায় পিকাপ আসলো কোথায় থেকে মিতু?’
‘আজ একটুর জন্য রক্ষে হলো মা।’
‘কী হয়েছে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।
মাকে ঘটনাটি বললেন। তিনি বিচলিত হয়ে বললেন,
‘কোথাও লেগেছে তোর?’
‘নাহ! তবে ইভান লোকটা ভালো ছিল। আচার-আচরণ যথেষ্ট মার্জিত।’
‘কোথায় থাকে? কি করে?’
ইভাবের আলাপের খই ফুটে মিতুর মুখে। বোনরাও পাশ থেকে শুনছে।
__
‘কি করছো সোনা।’ বাক্যটি সম্পূর্ণ করে বালিশে ঠেস দিয়ে বসল মুরাদ।
‘খেয়ে বসলাম। তুমি খেয়েছো?’
‘নাহ! খেতে যাব।’
‘এখনো যাও নি। দ্রুত যাও। রাদ ভাইয়া কোথায়?’
‘কাছেই রয়েছে।’ রাদের পানে এক পলক চেয়ে বলল।
‘তাকে নিয়ে খেতে যাও। পরে কথা বলি।’
‘ওঁকে বেবি।’ বলতে বলতে ফোন রেখে দিলো।
মুরাদ সোজা হয়ে বসে রাদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘যাবি নাকি আরো কাজ করবি?’
‘যাব।’ ল্যাপটপের পানে চেয়ে জবাব দিলো রাদ।
‘চল। খিদে পেয়েছে।’
‘সোহানা আপু তোকে তুমি করে বলে?’
‘হ্যাঁ!’
রাদ ল্যাপটপ বন্ধ করে মুরাদের নিকট নজর তাক করে বলল,
‘আমি যে তুমি বলা অধিকার কবে পাব।’ বলার শেষে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷
‘পাবি একদিন। আর শোন, সোহানা আপু বলবি না। ভাবি বল।’
‘তাহলে তো আমি তার দ্বিতীয় বর হয়ে যাই।’
‘কীভাবে?’ ভ্রু কুঞ্চন করে জানতে চাইলো৷
‘শব্দটা এমন হয় দে-বর। মানে দ্বিতীয় বর। বুঝাছে পেরছি?’
‘আপু বলেই ডাকিস।’ ভ্রুক্ষেপহীন নজরে বলল।
‘জ্বালা হচ্ছে শুনে।’
সরু চোখে দেখে রাদকে মুরাদ। সে হাসে। বলে,
‘বোন নেই আমার। তোর তো একটি বোন আছে। সোহানা আপুকে আমি বড়ো বোন বানিয়েছি অনেক আগেই।’
‘তাহলে তুই আমার শা’লা।’ হেসে বলল।
‘বলতে পারিস।’
‘ওয়েট সোনাকে বলি।’
‘খেতে যাব এখন। পরে বলে নিস।’
‘তবে চল।’
__
মিটিং শেষে রাদ ও মুরাদ রোহান ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়। গাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে যায় কোম্পানির মালিক রোহান।
গাড়ি ছুটে হোটেলের উদ্দেশ্যে। তখন ঘড়িতে নয়টার কাছাকাছি। তারা এখন লস এঞ্জেলেস অবস্থান করছে।
বাংলাদেশে তখন সাতটা বেজে দশ মিনিট।
দু-তিন ঘন্টা সময় পার্থক্য কেবল। হোটেলে ফিরে রাদ ইসানাকে কল দেয়। ইসানা ফোন রেখে টেক্সট করে।
‘বলুন?’
‘কি করছেন?’
‘কিছু না।’
‘টাইসন কোথায়?’
‘ট্যাবে কার্টুন দেখছে।’
বার্তাটি দেখে ইসানা সৌজন্যতা বজায় রেখে লিখে,
‘খেয়েছেন?’
‘এগারোটায় খাব।’
ইসানা চুপ হয়ে যায়। রাদ লিখে,
‘কতদিন চলবে এই শাস্তির মেয়াদ বললেন না যে?’
রিপ্লাই আসে না ইসানার। রাদ পুনরায় লিখে,
‘জানতে চাই?’
এবারও চুপ থাকে ইসানা। রাদ মেকি রাগ নিয়ে লিখল,
‘উত্তর দিচ্ছেন না যে? জোরপূর্বক অধিকার দেখালে তখন কিন্তু সহ্য করতে পারবেন না।’
এবার ইসানা লিখে,
‘জোরপূর্বক বিয়েটি যখন মেনে নিয়েছি এ আর নতুন কি! আপনি আপনার অধিকার নিতে পারবেন। কিন্তু জোর করে মন পাবেন না।’
রাদ বার্তাটি পড়ে পরবর্তীতে কিছু লিখে না। চুপ করে রয়।
ইসানার মনে সেই ঘটনার প্রভাব এখনো রয়েছে সেটা আজ পুরোপুরি নিশ্চিত হয় রাদ। বিষয়টি তার কাছে দুঃখজনক লাগে। ফোনটি পাশে রেখে বেলকনির দিকে এগোয়।
মুরাদ রাদের মনঃক্ষুণ্নতা দেখে ফোন তুলে টেক্সট চেক করে। তাদের চ্যাটিং দেখে নিজের কাছেও খারাপ লাগে। বন্ধুর নিকটে যেয়ে তাকে বোঝায়৷ সম্পর্ক সুন্দর ভাবে তৈরী করার জন্য আরো সময় দিতে বলে। ধৈর্যহারা যেন না হয়।
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_৩৩
#সুমাইয়া_মনি
সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই বললে হয়৷ বেলা সাতটা গড়িয়ে এগারোটার কাছাকাছি। এখনো আকাশ মেঘলাময়।
অনেকটা স্থান জুড়ে কুয়াশাচ্ছন্ন দেখা যাচ্ছে। মিতু গায়ের সুয়েটারটি ভালোভাবে টেনে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। আবহাওয়া মেঘাচ্ছন্ন থাকায় শীতের রেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সবে একটা টিউশনি করিয়ে দ্বিতীয়টির গন্তব্যে হাঁটছে। আরেকটু পথ পেরোলেই পৌঁছে যাবে। রাস্তায় বেশ কয়েকটি পিকাপ যেতে দেখে আনমনে চোখ গাড়ির ওপর চলে যাচ্ছে। হয়তো কালকের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখার সুপ্ত আশা জাগছে হৃদয়ে। তবে বারংবার চোখ দু’টি হতাশ হয়েছে। এ গলি থেকে বেরিয়ে ওপর গলিতে এসে পৌঁছায় তার গন্তব্যে।
.
কালকের পর এখন অব্ধি ইসানার সঙ্গে রাদের কথপোকথন হয়নি। দুইটা বাজে। বাংলাদেশে বারোটা হবে। রাত বাসার ট্যাবে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দেয়। টাইসন তখন বিছানার ওপর বসে কার্টুন দেখছিল। ইসানা টাইসনকে বিছানার ওপর কার্টুন দেখতে দিয়ে শাওয়ারে গিয়েছে। ভিডিও কলে রাদকে দেখে টাইসন তার বন্ধুকে চিনতে পারে। তাই রাদের কল সে পীক করে। আগে থেকে তাকে কল রিসিভ করার ট্রেনিং দিয়েছিল রাদ। তাই টাইসনের অসুবিধা হয়না কল রিসিভ করতে। কিছুক্ষণ টাইসনের সঙ্গে কথা বলে। কয়েকটি কথার উত্তরও দেয় টাইসন মাথা নাড়িয়ে। হঠাৎ ইসানা শাওয়ার শেষে বের হয়। রাদের নজর পড়ে ইসানার ওপর। বোকার মতো উৎসুক হয়ে ফোনের অপর প্রান্ত থেকেই উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। পরক্ষণে টাইসনকে ইশারায় পাশে সরতে বলে। টাইসন রাদের ইশারা অনুসরণ করে পাশে সরে বসে। এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তাকে। ইসানা ভেজা চুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুছে টাওয়াল দিয়ে ঝাড়ছে। গায়ের ওড়না বিছানার ওপর রাখা। ইসানা উল্টোদিকে ফিরে ছিল তাই পিঠ দেখা যাচ্ছিল। রাদ আয়নার মাধ্যমে ইসানার মুখশ্রী সহ বদনখানি দেখছে। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে। ইসানাকে ভেজা চুলে এভাবে কাছ থেকে দেখা হয়নি। বেশিরভাগ সময়ই মাথায় ওড়না দিয়ে রাখতো। তাই মাথার ঘন-কালো কেশ গুলো কখনো নজরে পড়েনি। ঝাড়া শেষে চুল আঁচড়িয়ে ওড়না নেওয়ার সময় ট্যাবে নজর পড়ে তার। সঙ্গে সঙ্গে ইসানার চোখাচোখি হয় রাদের সঙ্গে। তার চোখ চড়কগাছ! দ্রুত উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই নজর পড়ে আয়নায়। লজ্জায় তৎক্ষনাৎ বুকে দু হাত রেখে টাওয়াল জড়িয়ে নেয়। ছুটে গিয়ে ভিডিও কল কেঁটে টাইসনের পানে রাগান্বিত নজরে তাকায়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে টাইসন। বোবা পশু আদৌও বুঝতে পারবে কি-না, সে কি কাণ্ডই না ঘটিয়েছে। ট্যাব বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে আঙুল তাক করে ওঁকে বলল,
‘গ’র্দ’ভ কোথাকার। তুই তার ভিডিও কল রিসিভ করেছিস কীভাবে? কে শিখিয়েছে তোকে?’
টাইসন বোবা হয়ে দেয়ালে টাঙানো রাদের ছবির উপর নজর ফেলে। ইসানা টাইসনের নজর অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখে রাদের ছবি দেখছে। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। চেঁচিয়ে বলে,
‘রাদ শিখিয়েছে? শীট! সম্মান আর রইলো না। আজকের পর থেকে তুই কার্টুন দেখতে পারবি না।’
টাইসন বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ইসানা কপাল কুঁচকে ফেলে। টাইসন যে অভিমান করেছে এটা সে নিশ্চিত! লজ্জায় চোখমুখ ঘুচে আসে তার। তবে সে বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নেয়। তার ওপর পুরো অধিকার রয়েছে। আজ নয়তো কাল তাকে ঠিকিই তাকে তার অধিকার বুঝিয়ে দিতে হবে। এটাই যে নিয়ম! নিজেকে ধাতস্থ করে ইসানা। ফোনের টোন পেয়ে হাতে ফোন তুলে নেয়।
রাদ টেক্সট দিয়েছে। লিখেছে,
‘টাইসনকে কিছু বলবেন না। আমিই ওঁকে সরে বসতে বলেছিলাম আপনাকে দেখার জন্য। যেহেতু আপনাকে দেখার পুরোপুরি অধিকার আমার আছে আশা করি আপনি বিষয়টি অস্বাভাবিক ভাবে নিবেন না। স্যরি!’
ইসানা টেক্সট পড়ে সরু নিশ্বাস নিলো। তার ও রাদের ভাবনায় মিল রয়েছে। শেষে স্যরি লিখার ফলে ইসানার কিছুটা ভালোলাগে।
কল কাটার পর রাদ কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে ডুবেছিল। পরপরই ইসানাকে টেক্সট দেয়। কপালে দু আঙুল বুলিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। তার হাসি মুরাদের চোখে এড়ায় না। চটজলদি জিজ্ঞেস করে,
‘হাসার কারণ কি জানতে পারবো?’
‘না। অতন্ত্য গোপনীয়!’
‘প্রচুর?’
‘ভীষণ!’
‘শুনলাম না।’ ভ্রূক্ষেপহীন নজরে বলল।
রাদ মুরাদকে এক নজর দেখে মৃদু হাসে। মুরাদ টেরা চোখে তাকায়। তবে কিছু জিজ্ঞেস করে না।
_
ইভানের মা ও বোন শালিনী মেয়ে দেখতে এসেছে। মেয়েদের অর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। পরিবারের বড়ো মেয়েকে দেখে তাদের ভীষণ পছন্দ হয়। ইভানের মা আগের বিয়ের বিষয়টি তাদের কাছে লুকায় না। সরাসরি জানায়। মেয়ের বাবা নেই৷ মা পুরো বিষয়টি শুনে বিয়ের জন্য সম্মতি দেয়। পরের সপ্তাহে ঘরোয়া ভাবে বিয়ের তারিখ পাকাপোক্ত করা হয়। বাড়ি ফিরে ইভানকে বিষয়টি বললে তেমন আগ্রহ দেখায় না। মায়ের জোরাজোরিতে বিয়ে করা হচ্ছে। নয়তো বিয়ের ধারেকাছেও যেতে চাইছিল না।
‘মেয়ের নাম মিতু। বড়ো মেয়ে।’
নাম শুনে ইভানের দেখার আগ্রহ হয়। কারণ ক’দিন আগেই এ নামের একটি মেয়ের সঙ্গে তার অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হয়েছিল। শালিনী ছবি তুলে এনেছিল ইভানকে দেখানোর জন্য। বোনের ফোন থেকে ছবি দেখে ইভান শিওর হয় এটিই সেই মিতু নামের মেয়েটি। ছোট্ট ঘটনাটি মা ও বোনের সামনে তুলে ধরে।
‘তাহলে তোরা পূর্ব পরিচিত।’
‘হ্যাঁ! সে কি আমাকে দেখেছে? বা আমার নাম বলেছো?’
‘নাম বলেছি। ছবি শুধু মিতুর মা দেখেছে। মিতু দেখেনি।’
‘ওহ! আমার তাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। শোনো আপু, তুমি আমাদের বাড়িতে বিয়ের পর থাকবে না। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে থাকবে। কারণ মায়ের জন্যই বিয়ে করছি। মিতুই মায়ের সেবাযত্ন করবে। তোমাকে আমাদের বাড়িতে আর থাকবে হবে না। মাঝেমধ্যে দুলাভাইকে নিয়ে বেড়াতে আসবে। ব্যস!’
‘বুঝেছি। তুই কি বলতে চাইছিস?’ অভিমানী স্বরে বলল শালিনী।
‘অভিমান কোরো না। আমার, তোমার ভালোর জন্যই বলছি। মায়ের সেবাযত্ন অনেক করেছো। এভার শ্বশুর-শ্বাশড়ির সেবাযত্ন করো।’
শালিনী কিছু বলল না। ইভান দৃষ্টি নত রেখে বলল,
‘আমি বিয়েতে ইসানাকে নিমন্ত্রণ করতে চাই মা।’
‘করিস। অনেকদিন হলো মেয়েটাকে দেখি না।’ খুশি মুখে বললেন তিনি।
ইভান মেকি হেসে গামছা নিয়ে গোসলে যায়। শালিনী মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোমার না করা উচিত ছিল। যদি ইসানা এসে আমাদের নামে দুর্নাম ছড়ায় মিতুর কাছে তখন ব্যাপারটা কোথায় যাবে একবার ভাবো তো।’
‘তুই এতদিনেও ইসানাকে চিনতে পারিসনি। আমাদের চেয়ে তো ইভান এ ক’দিনে ওঁকে চিনে ফেলেছে। তাই তো এখন আফসোস করছে। শোন, মন পরিষ্কার কর। দেখবি সব কিছু এমনিতেই পরিষ্কার মনে হবে।’ শালিনী মায়ের কথায় কর্ণপাত করল না। বিরক্ত হয়ে উঠে ভেতরে চলে এলো।
…
টাইসন টাইসন ডেকে গলা বসিয়ে ফেলার উপক্রম ইসানার। তবুও সাড়া নেই টাইসনের। ড্রইংরুম অতিক্রম করে বারান্দায় এসে মহাশয়কে পেয়ে যায়। ইসানা সরু চোখে ওঁকে দেখে নেয়। টাইসনের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে ভারী অভিমান হয়েছে তার। চোখ-মুখ ভারী ভারী দেখাচ্ছে। এতক্ষণ ডাকাডাকি তার কর্ণকুহরে পৌঁছেছে কি-না সন্দেহ। ইসানা এগিয়ে এসে দু গালে হাত রেখে নিজের দিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘অভিমান হয়েছে। স্যরি! ট্যাবে কার্টুন দেখতে দিবো। এবার খেতে আয়।’
টাইসন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ইসানার সঙ্গে হাঁটা ধরে। ইসানার কথাতে অভিমান ভেঙেছে মহাশয়ের। একত্তে দুপুরের আহার খেতে বসে।
রাদের চক্ষুদয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ভাসছে বারংবার। বহুবার কল দিতে গিয়েও ফোন রেখে দিয়েছে। সে জানে ইসানা কথা বলবে না। তবুও তার অবাধ্য মনকে সে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই দ্বিধাবোধ নিয়ে কল দেয় রাদ। ফোনের টোন শুনে ইসানা রুমে আসলো। রাদের কল দেখে কেটে মেসেজ দিলো। উত্তর আসার পূর্বেই ফের কল আসলো। এবারও কেটে দিলো। রাদ আগের ন্যায় কল দিলো। ইসানা তখনকার ঘটনার জন্য কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ নিয়ে ফোন পীক করল। স্পিকার অন করে পাশে রেখে বিনাবাক্যে খাচ্ছে। রাদ সেকেন্ড কয়েক চুপ থাকে। ফের কোমল স্বরে বলে,
‘জানি আপনি আমার কল রিসিভ করলেও কথা বলবেন না। তবে আমার কথা বলায় তো কোনো বাঁধা নেই। আপনার সে-ই ওড়নার টুকরোটি এখন আমার হাতের মুঠোবন্দি!’
ইসানার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বুকের মাঝে কেমন যেন করে উঠলো। সে মনোযোগ দিলো।
‘সানা! তোমার ওড়নার টুকরোর মতো যদি তোমায় ছুঁতে পারতাম। তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে আমায় তীব্রভাবে য’ন্ত্র’ণা দেয়। এ য’ন্ত্র’ণা যে ভীষণ পীড়াদায়ক! সহ্যশক্তির বাহিরে। বহিঃপ্রকাশ করা অসম্ভব কষ্টদায়ক।’ এতটুকু বলার পর রাদ চুপ হয়ে যায়। ইসানা মূর্তির ন্যায় বাক্যগুলো শুনেছে। বক্ষে মোচড় দিয়ে উঠে। রাদের করা বহিঃপ্রকাশ একেকটি তীরের মতো বক্ষে এসে লাগে। কিছুক্ষণের জন্য ইসানা রাদের একেকটা কথা অমৃতর সমতুল্য মেনে নেয়। চোখ জোড়া আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসে তার। শরীরের পশম শিউরে ওঠে। অপরপ্রান্তে রাদ নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে বসে। কিছুক্ষণের জন্য ইসানাকে পাওয়ার কল্পনার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবে মৃদুস্বরে আওড়ায়,
‘স্যরি!’ খট করে লাইট কেটে দেয়। ইসানা নিজেকে ধাতস্থ করতে পারছে না। তার গলা শুঁকিয়ে গেছে। দ্রুত পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়। প্লেটের পানে এক পলক ফেলে উঠে পড়ে। খাওয়া আর হবে না। হাত ধুয়ে রুমের দিকে এগোয়। বক্ষে এখনো মৃদু ধুকধুক আওয়াজ হচ্ছে।
.
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।