#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_৩
#সুমাইয়া মনি
বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে রুমে ফিরলো ইসানা। দরজার নিকটে দাঁড়িয়ে ক্লান্তিতে পা যেন আগে বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। হাত বাড়িয়ে কলিং বেল বাজানো কষ্টকর। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাত বাড়িয়ে কোনমতে কলিং বেল বাজাতে সক্ষম হয়। দরজা খোলার সময়টাতে পিঠের সঙ্গে মাথাও ঠেকিয়ে রাখে দেয়ালে। এক মিনিট অতিবাহিত হতেই সোহানা দরজা খুলে। ইসানাকে ক্লান্তিকর চোখেমুখে দেখে বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
‘তোর এই অবস্থা কেন? তাড়াতাড়ি ভেতরে আয়।’ মুখ থেকে কোনো বার্তা না চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ইসানা। কয়েক পা এগিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সোফায় আধশোয়া হয়ে ঢলে পড়ে। সোহানা বিনাবাক্যে রান্না ঘরে গিয়ে গ্লুকোজ গুলে দ্রুত ফিরে আসে। ইসানাকে খেতে দিয়ে পাশে এসে বসে। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘আজ বেশি পরিশ্রম হয়েছে ইসা?’
ইসানা অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলো,
‘এটা তো হবারই ছিল।’
‘হঠাৎ করে কল কেটে দিলি কেন?’
‘স্যার ডেকেছিল।’
‘স্যার বলিস না। রাদ বল। ও তোর ছোট ইয়ার।’
‘ব্যাপার না। আজ প্রচুর ঘাটিয়েছে।’
‘তোকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তোর কপালে কি সুখপাখিটা কখনো ধরা দিবে না রে?’
‘বহু আগে মা*রা গিয়েছে। গোসল করে আসি। তারপর বাকি জিনিস গুলো গুছাতে হবে।’
‘আমি গুছিয়ে রেখেছি। তুই কি সত্যি চলে যাবি?’ মুখ মলিন করে বলল সোহানা।
‘হ্যাঁ! তোকে এ ক’দিন জ্বা*লি*য়ে*ছি। আর জ্বা*লা*তে চাই না রে। তোর ও তো একটা ভবিষ্যত আছে।’
‘চুপ থাক! মাঝেমধ্যে আসবি না?’
‘তা আসবো।’ বলতে বলতে ওয়াশরুমের দিকে এগোয় ইসানা। দু বান্ধবী গল্প করতে করতে প্রায় দশটা বাজিয়ে দেয়। ইসানা তখনই বাড়ি থেকে বের হয়। রাদ যে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছিল সেই বিষয়টি একদমই মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে তার। বাড়ি থেকে বের হবার পর রিকশার দেখা মিলছে না। যাও পাচ্ছে ভাড়া দ্বিগুণ চাইছে। ইসানা ব্যাগ হাতে হাঁটতে শুরু করে। মেইন রাস্তায় এসে রিকশা নিবে বলে ভাবে। হাতে কেবল পাঁচশো টাকা আছে। সেটাও সোহানা দিয়েছে। এ টাকা দিয়ে বেতন পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই মাসটা কোনমতে চলতে হবে। তাই এরা-দেড়া ভাড়া দিয়ে রিকশায় যাবে না।
পাঁচ মিনিট হাঁটার পর রিকশা আর পাচ্ছে না। যা দেখা যাচ্ছে সব টেক্সি । তাতে ইসানা যাবে না। দোকানপাট অনেকেই বন্ধ করে বাড়ি চলে গেছে। শুধু এক-দুটি দোকান খোলা রয়েছে কেবল। আরেকটু পথ এগোয় ইসানা। হঠাৎ একটি হলুদ রঙের টেক্সি ইসানার সামনে এসে থামে। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে একটি লোক ইসানার উদ্দেশ্য করে বল,
‘মেডাম কোথায় যাইবেন। আহেন নামায় দিয়া আহি।’
ইসানা লোকটিকে এক পলকে দেখে নিলো। হ্যাংলা-পাতলা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি রয়েছে। ইসানা জবাব দিলো,
‘বনানী যাব, যাবেন?’
‘আহেন।’
‘ভাড়া কিন্তু পঞ্চাশ টাকা দিবো।’
‘আইচ্ছা।’
এত দ্রুত রাজি হওয়াতে ইসানা দেরি করে না। দ্রুত গাড়িতে ওঠে বসল। গাড়ি ছুঁটতে লাগলো। বিশ মিনিট চলার পর বনানীর কিছুটা কাছে আসার পূর্বে আরেকজন লোক এসে গাড়িতে ঠিক ইসানার সঙ্গে পিছনের সিটে বসল। ইসানা এ পাশে চেপে বসল। লোকটি সিগারেট ফুঁকছিল। ইসানার সমস্যা হচ্ছে এতে। তবুও কিছু বলল না। ইসানার কাছে এই ব্যক্তিকে দেখে সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। সে চালাকি করে ব্যাগের চেইন খুলে ভেতরে এক হাত ঢুকিয়ে রাখে। হঠাৎ পিছনের লোকটি সিগারেট ফেলেই সামনের ব্যক্তির উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বলল,
‘রুস্তম বাঁ-য়ে মোচড় মা*র।’ কথাটা শেষ করতেই ইসানাকে ধরতে আসতে যাবে এমতাবস্থায় ইসানা ব্যাগের ভেতর থেকে পেপার স্প্রে বের করে লোকটির চোখে নিক্ষেপ করল। লোকটি চেঁচিয়ে উঠে দু হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল। সামনের লোকটি গাড়ি জোরে ব্রেক কষিয়ে ইসানাকে পিছনে ঝুঁকে ধরতে চাইলে তার চোখেও নিক্ষেপ করে স্প্রে। দু’জনে চিৎকার করে ছ*ট*ফ*ট করতে থাকে। ইসানা চটজলদি গাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্যাগ রাস্তায় রেখে দু পায়ের জুতো খু*লে হাতে নেয়। তারপর গাড়ির দরজা খু*লে দু’জনকে কলার ধরে টেনে বের করে হাতের জুতো দিয়ে ইচ্ছেমতো পিটাতে থাকে। একে তো তারা চোখের য*ন্ত্র*ণা*য় কাবু। তার ওপর ইসানার জুতোর পি*টা*নি খে*য়ে নাস্তানাবুদ!
ইশানা ক্ষি*প্ত কণ্ঠে তাদের উদ্দেশ্যে বলছে,
‘ভেবেছিলি কি আমি অবলা নারী? সুযোগ নিতে চেয়েছিলি। আয় নে, নে না! নারীদের এতটাও অবলা-অসহায় মনে করিস না৷ তারা ক্ষেপে গেলে আ*গু*নে*র গোলাতে পরিনত হয়।’ আচ্ছামতো আরো কয়েক গা দিয়ে ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট টি ড্রাইভারের মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে বলল,
‘নে তোর টাকা। ফ্রী-তে চলার অভ্যেস আমার নেই।’ বলেই দ্রুত বেগে এগিয়ে যাচ্ছে ইসানা। বাকিটুকু পথ সে হেঁটেই যেতে পারবে। ইসানা চলে যাওয়ার পরপরই রাস্তার অপর পাশে মুরাদের গাড়ি দেখা যায়। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ছিল মুরাদ, পাশে ছিল রাদ। ফাইল গুলো চেক করার দরুণ তার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে লেট হয়। মুরাদও শেষ অব্দি তাকে সাহায্য করতে বাধ্য হয়। ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়ে মুরাদের গাড়িতে চড়ে তার বাড়িতে যাবার জন্য রওনা হয়। তাদের বাড়ি একদম পাশাপাশি। মাঝ রাস্তায় এসে প্রথম লোকটির চিৎকার শুনে মুরাদ গাড়ি ব্রেক কষে। তড়িঘড়ি করে ইসানাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে চুপ করে তারা পর্যবেক্ষণ করে পুরো বিষয়টি। ইসানার সাহসীকতা দেখে বিস্ময়ে বিহ্বল তারা। বিষেশ করে রাদ! তাকে রাদ সহজ-সরলা স্বভাবের অবলা বাঙালী নারী মনে করেছিল। কিন্তু তার ধারণায় পরিবর্তন ঘটেছে এমন চমৎকৃত ঘটনা দেখে। ইসানার সাহসীকতার সদৃশ রাদ কিছুটা বিমুগ্ধ।
মুরাদ স্মিত হেসে বলল,
‘কী বুঝছি?’
‘ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টর!’
‘নিঃসন্দেহে সে একজন বাঘিনীর পরিচয় দিয়েছে।’
রাদ সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে মুরাদকে বলল,
‘পুলিশকে ইনফর্ম কর। এই কালপিট দু’টোকে গ্রেফতার করা উচিত।’
‘রাইট!’ বলেই মুরাদ পুলিশকে কল দিয়ে ঘটনাস্থলের এড্রেস জানায়। দু বন্ধু চলে আসে বাড়িতে। সকালে রেহানা আনসারী যাওয়ার পূর্বে ইসানাকে বাড়ির অপর চাবিটি দিয়ে যায়। তাই বাড়িতে প্রবেশ করতে তার অসুবিধা হয় না। রাদ এসেছে বুঝতে পেরে দরজা খুলে দেয় ইসানা। রাদ রাস্তার ঘটনাটি লুকায়িত রেখে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনাকে দ্রুত আসতে বলা হয়েছে। এখন ক’টা বাজে দেখেছেন?’
‘স্যরি স্যার। আসলে চলে যাচ্ছি দেখে সোহানা লেট করে যেতে বলেছিল।’
‘এত রাত করে এসেছেন বাইচান্স রাস্তায় যদি কোনো সমস্যা হতো, তার দায়ভার কে নিতো?’
ইসানা দৃষ্টি নত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রাদ সরু চোখে তাকায়। ইসানা এখন নিজেকে যতোটা শান্তশিষ্ট উপস্থাপনা করছে সে মোটেও শান্তিপ্রিয় মেয়ে নয়। তার মধ্যে অ*গ্নি*শ*র্মা বিদ্যমান। রাদ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘খাবার সার্ভ করুন।’ বলেই অগ্রসর হয় রুমের দিকে।
ইসানা খাবার সার্ভ করে। কিছুক্ষণ বাদে রাদ ফিরে। ইসানা দৃষ্টি নত রেখে দাঁড়ায়। রাদ খাবার খাওয়ার পর্যন্ত সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। চলে যাওয়ার পর সব এঁটো থালাবাটি ধুয়ে মুছে গুছিয়ে রুমে ফিরে। কাল শুক্রবার ছিল। হয়তো তার অফিসে না যাওয়া হতে পারে। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আগের কিছু স্মৃতি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায় ইসানা।
____
সুরভী খাতুন পুরনো একটি ছবির এলবামের ওপর হাত ভোলাচ্ছেন। সেখানে রয়েছে ইসানার মা, সে নিজে, আরো একটি অচেনা মেয়ে। এটি তার প্রিয় দু’জন বান্ধবীদের সঙ্গে তোলা বেশ পুরনো ছবি। শেষ স্মৃতি হিসাবে এটিই রয়েছে। সুরভী খাতুন ইসানার মামা’কে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। ইসানার জন্মের আগে বাবা মারা যায় ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে। ইসানাকে জন্ম দেওয়ার পর মৃত্যু হয় তার। রয়ে যায় শুধু ইসানা। একমাত্র মামা ইসানাকে অ*ভি*শ*প্ত বলে মনে করে। ছোট থেকে মামার অনাদরে বড়ো হয়েছে ইসানা। তবে সে ইসানাকে পরিপূর্ণ আদর দিয়েছে ঠিক তার সন্তানের মতো। স্বামীর কাশির শব্দ শুনে তিনি ফ্রেমটি ঢয়ারে রেখে দিলেন। লাইট অফ করে শু*তে এলেন। কিন্তু চোখের পাতায় ঘুমের দেখা নেই। তার ভাবনা জুড়ে রয়েছে ইশানা। অভাগিনী যেখানে আছে ভালো থাকে, তৎক্ষনাৎ দোয়া করেন তিনি।
_
‘বে*র হ বাড়ি থেকে, বে*র হ কু*ত্তা।’ দুরদুর করে বাদামি রঙের কু*কু*রে*র ছানাটিকে বের করে দিলো ইসানা।
দরজা লাগিয়ে পিছনে ফিরতেই রাদের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। সে চোখ নামিয়ে নেয়। রাদ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘টাইসনকে কোথাও দেখেছেন?’
ইসানা একবার তাকিয়ে চোখ পুনরায় সরিয়ে মৃদু স্বরে জবাব দিলো,
‘মানে কু*কু*রে*র বা*চ্চা?’
‘ওর নাম টাইসন। ওই নামেই ওঁকে ডাকবেন।’ বিমর্ষ কণ্ঠে বলল।
‘তবুও তো কু*ত্তা*র বা*চ্চা*ই। নাম রাখলেই তো আর জাত পরিবর্তন হয় না।’ বিড়বিড় করে বলল ইসানা।
‘কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম।’
ইসানা নিরুত্তর থেকে দরজা খুলে। টাইসন বাহির থেকে রাদকে দেখে দৌড়ে ভেতরে আসে। টাইসনকে রাদ কোলে উঠিয়ে এক গাদা আদর-আদিখ্যেতা দেখানো শুরু করে। পাশে দাঁড়িয়ে ইসানা আঁড়চোখে দেখে নেয়। শেষ হলে ইসানার উদ্দেশ্যে করে বলে,
‘আমার সঙ্গে টাইসনের যত্ন নিবেন আপনি।’
‘ঠে*কা!’ মনে মনে বলল। তবে মনের কথা বাহিরে প্রকাশ না করে হ্যাঁ সম্মতি জানায়। রাদ টাইসনকে নিয়ে রুমের দিকে এগোয়। বড়ো লোক দের একটাই স*ম*স্যা। কু*কু*র নয়তো বিড়াল পালতেই হবে। নয়তো জাত-পাত থাকবে না। বিড়বিড় করতে করতে ইসানা রান্না ঘরের দিকে অগ্রসর হয়।
.
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। ধৈর্য সহকারে পড়বেন। অতিদ্রুত গল্পের টুইস্ট খুঁজবেন না। ধীরেধীরে গল্পটি এগোতে চাইছি। ধন্যবাদ!